ছবির অন্তরালে

ইরার উড়ান

Reading time 3 minute
Freedom and Subjugation; Image Source – Google Image; @thirdlanespace.com

সময় কত দ্রুত বদলায়! সমাজমাধ্যমে ছবি দুটি অনেকে শেয়ার দিচ্ছেন দেখলাম। দুটিকে যদি পাশাপাশি রাখি তাহলে বাংলাদেশের বদলটা ধরতে সুবিধা হয়। ছবি দুটির মধ্যে সময়ের তফাত সাড়ে তিন বছরের কাছাকাছি হবে। স্থান রাজু ভাস্কর্য। করোনা অতিমারির দাপট ততদিনে অনেকটা ম্রিয়মাণ। প্রতিটি দরজা কাউন্টার কনুইবিহীন আজ দেখার পালা ঘুচতে চলেছে। ঘরবন্দি অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্তির আনন্দ সব ছাপিয়ে যাচ্ছিল তখন!

ভয়মুক্তির উল্লাস উদযাপনে ক্যান্সারজয়ী আলোকচিত্রী জয়িতা আফরিন (তৃষা) রাজু ভাস্কর্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন যে-মেয়েটিকে, তার নাম ছিল ইরা। নওগাঁর মেয়ে। ব্যালে নাচে ততদিনে পারদর্শীতা অর্জন করেছে বেশ। সেই ইরাকে আলোকচিত্রের জন্য বেছে নিলেন জয়িতা। বাকিটা ইতিহাস।

ইরা উড়ান দিলো শূন্যে, আর জয়িতা তার সেই উড়ানকে ধরলেন ক্যামেরায়। সমাজমাধ্যমে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল উড়ানের দৃশ্যাবলী। মনে হচ্ছিল, কেবল ইরা নয়, তার সঙ্গে বুঝি রাজু ভাস্কর্যের উদ্যত মুক্তিসেনার দল, আর সমগ্র বাংলাদেশ আকাশপানে উড্ডীন! মুক্তির স্বাদ নিতে তারা আকুলান!

. . .
সময়ের ব্যবধান মাত্র সাড়ে তিন বছর বা তারো কম! স্থান রাজু ভাস্কর্য। মুক্তিসেনারা এখনো জীবিত। সম্মুখযুদ্ধে গমনে তারা উদ্যত বটে! তবু হায়!—উড়ান দিতে অক্ষম! তাদের প্রস্তরিভূত চোখের সামনে ইরা ঝুলছে! ঝুলছে বাংলাদেশ! ঝুলছে হেরে যাওয়ার, মার খাওয়ার, পরাজিত হওয়ার গল্পগুলো!

রাজু ভাস্কর্যের চত্বর জুড়ে থোকা-থোকা অন্ধকার নেমেছে! ইরাদের ঘরবন্দি হওয়ার সংকেত এই অন্ধকার! ঘরবন্দি ইরা! ঘরবন্দি স্বদেশ! তারো বেশি ঘরবন্দি উদ্যত মুক্তিসেনার দল!

World in Action Home for Revolution (1969); ‍Source – Grove YTC

সময় সত্যি কত দ্রুত রং পালটায়! শামসুর রাহমানকে ফেরত আনছে দুইহাজার পঁচিশ। হরতালের দৃশ্যাবলী কবি কোনো একদিন ধারণ করেছিলেন কবিতায়। কবিবন্ধু শহীদ কাদরীকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন,—উত্তাল ঊনসত্তরের এই দিনে ঢাকা শহরে নেমেছে স্তব্ধতা। ক্রিয়াপদগুলো এমনকি গভীর জলের নিচে কাছিমের মতো দিয়েছে ডুব!

ওটা ছিল ষাটের দশক! ওটা ঊনসত্তর! হাওয়ায় ভেসে আসছিল দ্রোহ ও বারুদের গন্ধ! অনাগত শিশুকে জন্ম দিতে ইরাকে প্রস্তুতি নিতে দেখছিলেন কবি। জানতে চেয়েছিলেন,—কী নাম রাখছো শিশুর? কবিকে একপলক দেখে নিয়ে ইরা উত্তর করেছিল :—আমরা তার নাম রাখব বাংলাদেশ! শহরের প্রতিটি নিওন সাইনে কবি সেদিন বাংলাদেশ নামটি জ্বলজ্বল করতে দেখেছিলেন।

. . .
এখন দুইহাজার পঁচিশ চলে। রাহমান তাঁর কবিতাটি ইরাকে উৎসর্গ করবেন বলে মনস্থির করেছেন। ঘুরছেন ঢাকা শহর। যেমন একদিন বন্ধুরা মিলে ঘুরতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয় চত্বর থেকে ঘুরতে-ঘুরতে টের পেতেন না কবে কখন পৌঁছে গেছেন পুরোনো ঢাকায়! বিউটি বোর্ডিংয়ে হল্লা চলছে বেদম! তার মধ্যে সৈয়দ হক ঢাকাই সিনেমার চিত্রনাট্য লিখছে বসে নির্বিকার!

বন্ধুরা রাহমানকে ছেড়ে গেছেন একে-একে। তিনি একলা ঘুরছেন ঢাকা শহর। সেখানে আবারো স্তব্ধতা নেমেছে। শতবর্ষের নীরবতা নেমেছে যেন শহরের প্রতিটি গলি থেকে তস্য গলিতেও! ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড পালনে কী ভীষণ উন্মুখ এ-শহর!

কবি দেখলেন,—রাজু ভাস্কর্যে ইরা ঝুলছে। ধর্ষিতা ব্যালেরিনা আসাদের রক্তমাখা শার্টের মতো হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে যেন! সব অবিকল ঊনসত্তর! প্রতিটি দরজা কাউন্টার কনুইবিহীন! তবু তা ঊনসত্তর নয়। না তাকে দুইহাজার বাইশ বলা যায়! ইরা সেদিন মুক্তির আনন্দে শরীর ভাসিয়ে দিয়েছিল হাওয়ায়।

Free Flight; Image Source – Google Image

ওটা বাইশ নেই আর! দুইহাজার পঁচিশ চলে এখন! সব আগের মতো আছে অবিকল;—ইরা শুধু নেই! রাজু ভাস্কর্যে এখনো উদ্যত মুক্তিসেনার পাথরজমাট চোখের সমুখে তাকে ঝুলিয়ে দিয়েছে ওরা!

ইরা ঝুলছে… ঝুলছে বাংলাদেশ। কবির মুখ দিয়ে আকস্মিক বেরিয়ে এলো : চকিতে বদলে গেছে আজ,/ আপাদমস্তক/ ভীষণ বদলে গেছে শহর আমার! 
. . .

The Story of Ballerina Ira; Source – Rinsing Bangla YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 29

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *