
. . .

. . .

উপভোগ্য আলোকপাত জাভেদ। হানা আরেন্ট আমাদের এখানে সুপরিচিত হলেও তাঁর দার্শনিক গভীরতা নিয়ে চর্চা ব্যাপক নয়। কিছু বইপত্র অনূদিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু বড়ো স্কেলে তাঁকে নিয়ে আলাপ কানে আসেনি। এখানে যাঁরা হাইডেগার আওরান বেশ, তাঁদের জন্য হানা আরেন্ট যদিও অপরিহার্য হওয়ার কথা ছিল। যাইহোক, আপনার এই পরিচিতিমূলক আরেন্টপাঠ প্রাসঙ্গিক জায়গাগুলো ছুঁয়ে গেছে। বিশেষ করে, আইখম্যানের বিচারের সময় ব্যানালিটি অব ইভিল নিয়ে তাঁর ভাবনা কেবল সাহসী ছিল তা নয়,—সকল প্রত্যাশা ও স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন হানা।
ইহুদিরা তাঁকে ওইসময় হায়ার করেন এই প্রত্যাশায়,—জন্মসূত্রে ঘরের মেয়ে হওয়ার কারণে জল্লাদ আইখম্যানের শাস্তি নিশ্চিত করতে তিনি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবেন। হানা নিজে এই নিয়তে ট্রায়ালে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ওই ব্যানালিটি অব ইভিল এলো, আর তিনি হয়ে উঠলেন ইহুদি সম্প্রদায়ের চক্ষুশূল। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ানো কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছাত্রদের নিয়ে সেমিনার ডেকে নিজের এই মানসিক পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন তখন।
জার্মান চলচ্চিত্রকার মার্গারেট ভন ট্রোটা তাঁর হানা আরেন্ট মুভিতে ঘটনাটি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। ব্যানালিটি অব ইভিল-এর ভাবুকতায় পৌঁছানোর ধাপে হাইডেগারকে ফিরে-ফিরে স্মরণ করছেন হানা, যেন তিনি এই ভাবুকতায় পৌঁছানোর প্যারামিটার। মার্গারেট ছবিতে তা ভালো তুলে ধরেছিলেন। সময় করে দেখতে পারেন ছবিটি। ইউটিউবে খোঁজ করলে পাবেন। শেখ হাসিনার পতন ঘটার গোড়া দিকটায় ফ্যাসিস্ট প্রসঙ্গে গ্রুপে নিত্য হইচই হতো। চ্যাট জিপিটি মামার ফ্যাসিস্ট বন্দনা শিরোনামের এক লেখায় ব্যানালিটি অব ইভিলকে তখন আমরা টাচ করে গেছি কিছুটা। এখন তা ইয়াদ হচ্ছে বটে!
হানা আরেন্টের মতের সপক্ষে আর্গুমেন্ট যেমন সাজানো অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়, টু সাম এক্সটেন্ট, বিপক্ষেও আর্গুমেন্টের জায়গা থেকে যায়। তাঁর ব্যাখ্যা আমলে নিলে আইখম্যানকে নাজিবাদের সাজানো নকশা বা সিস্টেমের অনুগত ক্রীতদাস রূপে আমরা সহজে চিনে নিতে পারছি। লোকটি সেখানে নিজের কাণ্ডজ্ঞান, চিন্তাশক্তি ও বিবেক ব্যবহার না করে উলটো নির্বোধের মতো কিলিং মিশন বাস্তবায়নে খেটে মরেছে। এই জায়গা থেকে হানা সঠিক,—আইখম্যান স্রেফ নাজিদের বানিয়ে তোলা সিস্টেমেটিক অ্যানিহিলেশন বা বিলোপকরণের যন্ত্র রূপে দায়িত্ব পালন করে গেছে। তার অপরাধ এখানে এসে লঘু হয়ে উঠছে। শাস্তি দিতে হলে তাদেরকে দেওয়া উচিত,—যাদের মাথা থেকে এটি তখন বেরিয়ে এসেছিল;—যেখানে অ্যাডলফ হিটলার একমাত্র নয়, আরো অনেক মাথা এই নির্মূলকরণ সফল করতে শ্রম দিয়েছিল। ইহুদিনিধন সফল করতে গণসম্মোহন ও গণমূর্খতায় মানুষকে অভিভূত করার তরিকা আবিষ্কারে নিয়োজিতরা হচ্ছে আসল অপরাধী। হানার ব্যাখ্যা এদিক থেকে বিবেচনা করলে যথার্থ মানতে হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, আমাদের এখানে টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলীকে আপনি কী করবেন তাহলে! একাত্তরে, বিশেষ করে অপারেশন সার্চলাইটে তাদের ভূমিকা হানার ব্যানালিটি অব ইভিল দিয়ে মাপতে পারব আমরা? তারাও তো সিস্টেমের অংশই থেকেছে সেখানে। গণহত্যার একটি মাস্টার প্ল্যান ও তা বাস্তবায়নের নকশা তৈরি করেছিল। আইখম্যান যেমন আমলা, এরা দুজনও তাই ছিল। সামরিক আমলার ভূমিকায় অত্যন্ত সুচারভাবে গণহত্যা চালিয়েছে। সিস্টেমেটিক অ্যানিহিলেশন একাত্তরকে ভালোভাবে নজরে নিলে মিলবে। গোলাম আজম গংকে কি করবেন? ব্যানালিটি অব ইভিল-র ছকে ফেলে ছাড়পত্র দিয়ে দেবেন তাদের? তারা তো জেনেবুঝে স্বেচ্ছায় পাকিস্তানের হয়ে গণহত্যায় শরিক ছিল। ইসলাম ও পাকিস্তানের অখণ্ডতা ভারতের হাতে বিপন্ন হতে যাচ্ছে;—এরকম এক বয়ানকে শিরোধার্য করে আকাম করেছিল সেইসময়।
এরকম আরো ঘটনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটেছে। ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো যেমনপ্যানকাসিলায় নিহিত রাষ্ট্র পরিচালনার মৌল ভিত্তিকে ম্যানিপুলেট করেন। সুকর্ণপন্থী ও মাওপন্থীদের কচুকাটা করতেপ্যানক্যাসিলা নামে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সশস্ত্র বাহিনিকে ব্যবহার করতে কোনো দ্বিধা করেননি সুহার্তে। সেখানে, আনোয়ার কঙ্গোর মতো লোককে আমরা পাচ্ছি। প্রতিপক্ষ নিধনে যার ভূমিকা ছিল নৃশংস! তাকে আপনি কোন ছকে ফেলবেন এখন? সে কি নিছক সিস্টেমেটিক কিলিংয়ের আজ্ঞাবহ ক্রীতদাস রূপে দায়িত্ব পালন করে গেছে? নাকি, তার ভিতরে সক্রিয় থেকেছে অপরাধী এক সত্তা!—যেটি জেনেবুঝে এই বিচার বহির্ভূত নিধনযজ্ঞে কামলা খেটেছিল? নিজের চিন্তাস্তরকে যেখানে সে দুর্বল যুক্তি দিয়ে বৈধ করে গেছে! হানার ব্যানালিটি অব ইভিল ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে স্ট্রং আর্গুমেন্ট, তবে সেখানে বিদ্যমান ছিদ্রগুলো নিয়ে সেইসময় আর তর্ক আগায়নি খুব একটা!
তবে, এটি অবশ্যই গুরুত্ব রাখে,—আইখম্যান বা কথার কথা টিক্কা খানকে শাস্তি দিতে যেয়ে আসল পাণ্ডারা ধরছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় সবসময়। এর ফলে অশুভ ফিরে-ফিরে জন্ম নিতে থাকে। নাজিবাদে নিহিত ভাবাদর্শ এখনো খোদ জার্মানিতে কিছু লোক নীরবে ধারণ করে, সুযোগ পেলে তাদের সংখ্যা বিরাট হতে সময় লাগবে না। আমাদের এখানে যেমন ইসলাম ও ভারতকে ইস্যু করে তৈরি ন্যারেটিভে বিস্তর গোজামিল থাকা সত্ত্বেও এটি কখনো মৃত ছিল না; আর এখন তার পরিণতি সবাই দেখছি বটে!
আপনার লেখার সূত্র ধরে এবার হাইডেগার প্রসঙ্গে আসা যাক। হানা আরেন্টের তখন হাইডেগারের ওপর ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক ছিল। হাইডেগারের মতো বড়ো মাপের চিন্তাবিদ কী-কারণে নাজি ভাবাদর্শে ঝুঁকলেন, তার ইতিহাস কিন্তু লম্বা জাভেদ। সেখানে নিটশে থেকে আরো অনেকের প্রভাব পড়েছে। সেইসঙ্গে আছে ইব্রাহিমের তিন অনুসারী সম্প্রদায়ের মধ্যে চলতে থাকা ঐতিহাসিক সংঘাত ও মানসিক অবরোধের জটিল চাপ। সেক্ষেত্রে, হাইডেগারের ঢাউস বিয়িং অ্যান্ড টাইমের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো দিনলিপির আঙ্গিকে লেখা ব্ল্যাক নোটবুক বইটি। হানা মারা যাওয়ার অনেকদিন গত হওয়ার পর এটি বাজারে আসে। সেখানে, হাইডেগারকে পশ্চিমের গণমাধ্যম যথারীতি নাজিবাদী চিহ্নিত করলেও, ব্ল্যাক নোটবুক পড়তে যেয়ে আমার তা শতভাগ সঠিক মনে হয়নি। হাইডেগার, আমাদের এখানকার বদমাশগুলোর মতো নয়। তাঁকে আপনি কেবল হানা আরেন্টের ছকে ফেলে বিচার করতে পারবেন না। এই ভদ্রলোক জটিল কেস। হিটলারের আগ্রাসনকে যদিও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে সমর্থন করা তাঁর উচিত হয়নি;—পরে অবশ্য ভুল ঠার করতে পেরে সরেও এসেছিলেন।
এই পাপ আরো অনেকেই তখন করেছেন! নাজিবাদের ভাবাদর্শিক শক্তি এতটাই অতিকায় ছিল, তার সঙ্গে যুগবাস্তবতা ও পৌরুষপ্রবণ আধিপত্যের নেশা, ইতালি থেকে জার্মানিতে সংক্রমিত হতে দেরি করেনি। রোমান সম্রাটরা ঐতিহাসিকভাবে ফ্যাসিজমের পৃষ্ঠপোষক থেকেছে চিরকাল,—ভাষা ও ধরন হয়তো ভিন্ন ছিল সেখানে। সুতরাং মুসোলিনি একে পিক করতে দেরি করেনি। তার জিনের মধ্যে প্রবণতাটি বইছে বৈকি। আমার মনে হয়, হানা যে পয়েন্ট অব ভিউ থেকে ব্যানালিটি অব ইভিলকে দেখিয়েছেন, সেটি পৃথিবীতে এমন কোনো রাজনৈতিক ভাবাদর্শ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার মধ্যে নেই। সুতরাং আইখম্যান বা টিক্কাকে যতই গৌণ করুন-না-কেন, জাস্টিস ডিলেইড করার একটি মওকা তাতে তৈরি হয়। এটি তাঁর ভাবনার ছিদ্র হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি।
. . .

মিনহাজ ভাই, আপনি যথার্থই Banality of evil তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা উন্মোচিত করেছেন। সংঘটিত গণহত্যাকে কোনভাবে Banality of evil দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আরেন্টও এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন আশা করি। তিনি এই তত্ত্বকে একটি সাধারণীকরণযোগ্য মডেল হিসেবে দেখতে রাজি ছিলেন না। তিনি বারবার বলেছেন, তার পর্যবেক্ষণ কেবল Eichmann নামক আমলার চরিত্র বোঝাতে প্রযোজ্য। Eichmann in Jerusalem–এর প্রস্তাবনায় পরিষ্কার লিখেছেন :
The report deals with nothing but the extent to which the court in Jerusalem succeeded in fulfilling the demand of justice… This book is a trial report, and no more.
অনেকে আরেন্টকে ভুল বুঝেছেন, ভেবেছেন তিনি বলছেন `সব অশুভই তুচ্ছ।’ কিন্তু বাস্তবে, আরেন্ট বলেছিলে,—অশুভ কখনো দানবীয় রূপে আসে না, বরং প্রায়ই তা আমলাতান্ত্রিক দৈনন্দিনতায় ঢুকে পড়ে। তিনি নিজেই বলেছেন Banality of evil মানে এই নয় যে, অশুভ ছোট বা গৌণ বা এর কোনো গভীরতা নেই;—ভয়াবহ অপরাধও সাধারণ মানুষের চিন্তাহীন অংশগ্রহণে সম্ভব হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে বোঝার জন্য Banality of evil, এই ধারণা যথেষ্ট নয়। এখানে শুধু চিন্তাহীনতা কাজ করেনি, বরং কাজ করেছে সচেতন মতাদর্শ, সংগঠিত সহিংসতা, এবং ভয়ের রাজনীতি। তাই আরেন্টের আরও কিছু ধারণা কাজে লাগাতে হয়। যেমন Ideology and Terror. পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা প্রথমে তৈরি করেছিল এক ধরনের মতাদর্শ;—বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনকে তারা ঘোষণা করেছিল দেশদ্রোহিতা, ভারতের ষড়যন্ত্র, আর ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এই মতাদর্শ মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে। একজন গ্রামের মানুষও যদি স্বাধীনতার কথা বলতেন, তাকে বলা হতো,—‘তুমি ভারতের এজেন্ট।’ এই বয়ান বাস্তব সত্যকে ঢেকে দিয়েছিল, এবং একইসঙ্গে মানুষকে সন্ত্রাসের মুখে ঠেলে দেয়। গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্বিচারে গ্রেপ্তার… সবই ছিল মতাদর্শ টিকিয়ে রাখার সন্ত্রাস। এখানে আরেন্টের কথা মিলে যায়,—টোটালিটারিয়ান শাসন প্রথমে মতাদর্শ দাঁড় করায়, তারপর সেই মতাদর্শকে বাস্তবায়ন করে সন্ত্রাসের মাধ্যমে।
এবার আসি mob আর mass-এর কথায়। ১৯৭১–এ পাকিস্তানি সেনারা নিছক ‘মব’ ছিল না। তারা ছিল এক বিশাল ‘মাস’;—আত্মহীন, শৃঙ্খলিত, অন্ধ আনুগত্যে বাঁধা, যারা কোনো নৈতিক প্রশ্ন না করে আদেশ পালন করেছে। কিন্তু তাদের সহযোগী ছিল স্থানীয় মব,—রাজাকার, আলবদর, আলশামস; যারা প্রতিহিংসা, লুটপাট আর ব্যক্তিগত স্বার্থে অংশ নিয়েছিল সহিংসতায়। ফলে একদিকে আমরা দেখি চিন্তাহীন মাস, অন্যদিকে দেখি হিংস্র মব;—এই দুয়ের মিলিত ভূমিকা গণহত্যাকে সম্ভব করেছিল।
আরেন্ট বলেছিলেন,—ক্ষমতা আর সহিংসতা এক জিনিস নয়। ক্ষমতা আসে জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণ থেকে, আর সহিংসতা আসে অস্ত্র থেকে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা রাষ্ট্রক্ষমতা হারিয়েছিল, কারণ জনগণ তাদের মেনে নেয়নি। তারা টিকে ছিল কেবল বন্দুকের নল আর কামানের গর্জনের ওপর। এটা ছিল নিছক সহিংসতা, কোনো প্রকৃত ক্ষমতা নয়। তাই আরেন্টের ভাষায় বলতে হয়,—পাকিস্তান তখন আসলে ছিল ক্ষমতাহীন এক রাষ্ট্র, যে-তার শূন্যতা ঢাকছিল সহিংসতার মাধ্যমে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো organized loneliness বা সংগঠিত একাকীত্ব। পাকিস্তানি সেনারা কারফিউ জারি করে। গ্রামে গ্রামে গুপ্তচর বসায়। প্রতিবেশীর ওপর সন্দেহ চাপিয়ে দেয়। মানুষকে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন করা হলো,—কেউ কারো ওপর আস্থা রাখতে পারছিল না। এই ভয় আর নিঃসঙ্গতা প্রতিরোধকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আরেন্ট যেমন বলেছিলেন,—মানুষকে যদি সামাজিক বন্ধন থেকে আলাদা করে দেওয়া যায়, তবে সে আর নিজের সাথেও সংলাপ বজায় রাখতে পারে না, কেবল ভিড়ের অংশ হয়ে যায়।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকায় যে-গণহত্যা চালিয়েছিল, তা নিছক সামরিক অভিযান থাকেনি, এটি হয়ে উঠেছিল ideology + terror–এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পাকিস্তানি সেনারা নিজেদের বোঝাচ্ছিল,—‘আমরা দেশ বাঁচাচ্ছি, ইসলাম বাঁচাচ্ছি, ভারতীয় ষড়যন্ত্র ভাঙছি।’ বাস্তবতা ছিল ভিন্ন; কিন্তু মতাদর্শ দিয়ে তারা নিজের কাজকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রাবাস, এমনকি সাধারণ ঘরবাড়ি লক্ষ্য করে নির্বিচার গুলি চালায়। এর উদ্দেশ্য কেবল মানুষ হত্যা নয়, পুরো জাতিকে ভয় ও আতঙ্কে ফেলে নিঃসঙ্গ করে দেওয়াটাই ছিল মূল্য লক্ষ্য। আরেন্টের ব্যাখ্যা ধার করে বলা যায়,—এটি ছিল মতাদর্শ ও সন্ত্রাস মিলে সংগঠিত নিঃসঙ্গতা (organized loneliness) তৈরির নিখুঁত কৌশল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ সহিংসতাকে কেবল Banality of evil দিয়ে ব্যাখ্যা করলে সেটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আইখম্যানের মতো চিন্তাহীন আমলা এখানে অবশ্যই ছিল, যারা কেবল আদেশ পালন করেছে। কিন্তু পাশাপাশি ছিল মতাদর্শী পরিকল্পনাকারী, হিংস্র মব, ভয় সৃষ্টিকারী সন্ত্রাস, এবং সেই সন্ত্রাসের নিচে তৈরি হওয়া নিঃসঙ্গতা।

আরেন্ট আমাদের শিখিয়েছেন,—অশুভ শুধু তখনই জন্মায় না, যখন কেউ দানবীয় ইচ্ছায় হত্যা করে, বরং তখনও তার জন্ম হয়, যখন মানুষ চিন্তা করতে অস্বীকার করে। ১৯৭১–এ আমরা দুটো চেহারাই দেখি। কেউ ছিল অন্ধ আনুগত্যের দাস, আবার কেউ ছিল মতাদর্শী নকশাকার। উভয়ের সংযোগে তৈরি হয়েছিল গণহত্যার নীলনকশা। রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী ছিল স্থানীয় সহযোগী, যারা মব–এর চরিত্র বহন করছিল। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, ধর্মীয় উন্মাদনা, কিংবা দখলবাজি,—এসব কারণে তারা স্থানীয় মানুষজনকে টার্গেট করত। কিন্তু যখন তারা পাকিস্তানি সেনাদের আদেশে কাজ করেছে, তখন তারা হয়ে পড়েছে চিন্তাহীন ভিড়। আরেন্ট হলে বলতেন,—এখানে মব আর মাস মিশে গেছে। একদিকে লোভ-প্ররোচনায় অন্ধ মব, অন্যদিকে আত্মহীন ভিড়, যারা ব্যক্তিগত নৈতিক দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছে।
টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী এবং এদেশীয় দোসর গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী প্রমুখ এরা নিছক চিন্তাহীন আমলা অথবা রাজনৈতিক নেতা ছিল না; বরং তারা ছিল সুস্পষ্ট পরিকল্পনাকারী। গণহত্যার নকশা ও কৌশল, কাকে কীভাবে দমন করতে হবে—এসব তারা পরিকল্পিতভাবে সাজিয়েছিল। এদের ক্ষেত্রে Banality of evil-এ নিহিত ধারণা পুরোপুরি খাটে না, কারণ তারা অন্ধভাবে আদেশ পালন করে বসে থাকেনি, বরং নিজেরা আদেশ দিচ্ছিল ও মতাদর্শ তৈরি করছিল।
গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামীরা সে-সময় পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে নিজের মতাদর্শ প্রচার করেছিল। অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় আর ভারতের ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় কীভাবে ভূমিকা পালন করতে হবে, এই প্রচারণা তারা চালিয়েছে। ৭১ জুড়ে প্রকাশ্যে সেটা করেছে, যার সবটাই ডকুমেন্টেড হয়ে আছে। জাতিকে মেধাশূন্য করার মিশনে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার কাণ্ডারি তো তারাই ছিল তখন। তাদের এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডকে বুঝতে Banality of evil যথেষ্ট নয়; বরং হিটলার ও স্টালিনবাদী ব্যবস্থার মতো একচ্ছত্রবাদী শাসন, যা মতাদর্শের মাধ্যমে গণহত্যাকে বৈধতা দেয়, সেটিই এখানে প্রযোজ্য।
. . .

আমাদের প্রেক্ষাপটে হানা আরেন্টের প্রাসঙ্গিকতা আপনার ব্যাখ্যায় সবিস্তারে উঠে এসেছে জাভেদ। মূল লেখায় আপনি আমাদের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে হানার প্রাসঙ্গিকতাকে কেবল ছুঁয়ে গিয়েছিলেন। ব্যানালিটি অব ইভিলের পাশাপাশি একনায়কতন্ত্র কায়েমের রসদ আইডিওলজি অ্যান্ড টেরর, প্রসঙ্গটি উঠে আসায়, তা এখন পূর্ণতা পেল। নাজিবাদে নিহিত সন্ত্রাসকে যদি খতিয়ে দেখি, তাহলে দেখব, সেখানে এটি তখন ধর্মীয় বিশ্বাসের মতো শক্তিশালী মারণাস্ত্রে পরিণত হয়েছিল। হিটলার উচ্চমাত্রার মেধাবী ও ক্যারিশম্যাটিক লোক ছিলেন;—এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। নিটশের উবারম্যানশ বা অতিমানবের দার্শনিক প্রতিমাকে তিনি নিজ মাপে কাটছাট করে নিলেন সেইসময়।
হিটলারকে আপনি কিন্তু চিন্তাশক্তহীন বলতে পারছেন না কোনোভাবে। জন্মসূত্রে অস্ট্রিয়ান হয়েও জার্মান জাতিসত্তার ওপর তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য ও সম্মোহনের নেপথ্যে সেকালের পরিস্থতি গুরুতর অবদান রাখলেও, তিনি তা সুচিন্তিতভাবে ব্যবহার করেছেন। মানুষের মধ্যে সহজাত শ্রেষ্ঠত্বের বাতিককে ব্যবহার করেছিলেন হিটলার। ট্রাম্প যেমন তা করার চেষ্টা করছেন অন্যভাবে। ভারতে মোদি হয়তো অন্যভাবে তা করছেন সুচতুর পন্থায়। আরো অনেকে অতীতে করেছেন অথবা সামনে করবেন। এটি সম্ভব হচ্ছে, কারণ, ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে দেখতে পছন্দ করে;—সামাজিক ও জাতিগতভাবেও করে। একধরনের পশুপ্রবৃত্তি এটি। বিবর্তনসূত্রে জিনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে; তবে অন্য পশুদের ক্ষেত্রে এর সীমারেখা প্রাকৃতিক। মানুষের ক্ষেত্রে তা আর নিছক প্রাকৃতিক নেই। হানার ভাবুকতা এই জায়গায় এসে ভীষণ প্রাসঙ্গিক।
আমরা বলি বটে, মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী;—কিন্তু অতি অল্পসংখ্যক আসলে চিন্তা করেন বা বড়ো স্কেলে চিন্তশীল হয়ে উঠেন। বিপুল সংখ্যক মানুষ ঐতিহাসিকভাবে চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হতে পছন্দ করেন। যেখানে চিন্তাকে ফিরে প্রশ্ন করা ও তলিয়ে দেখা তাদের পোষায় না। তারা অতদূর আদৌ যেতে চান না বা যাওয়ার প্রক্রিয়াটি মানব সভ্যতার বিকাশলগ্ন থেকে অবরুদ্ধ। মুসোলিনি ও হিটলার মূলত এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে টেররকে বৈধ করে তুলেছিলেন। আইখম্যান বলুন, আর গোয়েবলস অথবা হিমলার… এরা সবাই এই বৈধতাকে তখন ন্যায্য ভেবেছেন,—সময়ের অনিবার্য সমাধান ভেবেছেন একে। এখন তা কেবল হিটলারের প্রভাবে ঘটেছিল বললে ভুল হবে, তাদের মধ্যেও সেরকম কর্তৃত্ববাদের প্রতি অনুরাগ ও সমর্থন ছিল। হানা কেন জানি এদিকটা ভাবেননি মনে হচ্ছে।
কথাটি বলার কারণ আছে। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে আইখম্যান জান বাঁচাতে ধূর্ততার আশ্রয় নেয়নি, সকল দোষ হিটলারের থিংক ট্যাঙ্কের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেকে এর শিকার হিসেবে তুলে ধরেনি… এই গ্যারান্টি স্বয়ং হানাও দিতে পারতেন কি? অ্যালবার্ট স্পিয়ারের কথা ধরুন। হিটলারের কাছের লোক ছিলেন। মেধাবী প্রকৌশলী। নাজিবাহিনির অস্ত্রশস্ত্র ও শহর দখলের প্রকৌশলগত নকশায় তাঁর বিরাট অবদান রয়েছে। ফাইনাল সল্যুশন মানে ১৯৪২-এর সেই বিখ্যাত সভা, যেখানে ইহুদি গণহত্যার ব্যাপারে পরিষ্কার রূপরেখা চূড়ান্ত হলো, স্পিয়ার তো সেই ছকের অন্যতম কুশীলব হয়ে উঠলেন পরে।
একই ব্যক্তি কিন্তু ট্রায়ালের সময় নিজেকে ওই আইখম্যানের মতোই সিস্টেমেটিক কিলিং মিশনের একজন আজ্ঞাবহ রূপে তুলে ধরতে মরিয়া থেকেছেন। তিনি নাকি হিটলারের অভিসিন্ধ তখন বুঝে উঠতে পারেননি, এবং এ-নিয়ে তার মনে দ্বন্দ্ব ও হিটলারের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল! পরে যদিও তদন্তে উঠে এসেছিল,—স্পিয়ার জেনেবুঝে এবং মর্মান্তিক ঘৃণার জায়গা থেকে হিটলারের ডানহাত হতে দিয়েছিলেন নিজেকে
কর্তৃত্ববাদের সঙ্গে মিশেল ফুকোর ব্যাখ্যা মোতাবেক ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ সংযোগ থাকলেও, ফ্যাসিজম আদতে ক্ষমতার চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে সেখানে। এমন এক গভীর বিশ্বাস, যেখানে কুযুক্তি ও কুতর্ক শেষাবধি যৌক্তিক ও বৈধ হতে থাকে। আমাদের এখনে যেমন হচ্ছে এখন। হানা এদিকটা আরো তলিয়ে দেখতে পারতেন। আইডিওলজি ও টেরর-র প্রশ্নে তিনি সে-তুলনায় সহজ ফরেমেটে চিন্তায় জারি থেকেছেন। তা-সত্ত্বেও এর মধ্য দিয়ে মবসন্ত্রাস ব্যাখ্যার জায়গাটি হানায় অসাধারণভাবে পাই আমরা।
জাতিসত্তা কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ ততক্ষণ ভালো, যতক্ষণ তা একটি জাতির স্থানিক বিবর্তন ও সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য জাতির বিবর্তন ও সংস্কৃতিতে বিনিময়ী থাকে। পথটিকে যখন সংকীর্ণ করে তোলা হয়, তখন তা বিপজ্জনক। আমাদের এখানে যেমন হিন্দু ও ইসলাম ধর্মকে কেন্দ্র করে সংঘটিত দ্বন্দ্ব আখেরে জাতিরাষ্ট্র গঠন কিংবা সেকুলার স্টেট গঠনের পথটিকে দুরূহ করে তুলেছে।
. . .

. . .



