নেটালাপ

সিরাজ সিকদারের লাল সন্ত্রাস

. . .

সিরাজ সিকদারের কর্মকাণ্ড সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয়কর ছিল। বিপ্লবের নামে বিরামহীন উৎপাত তিনি তৈরি করেছিলেন। আবার সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সেক্টরে প্রভাবও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ডা. জাফরুল্লাহর স্মৃতিচারণে সিরাজ সিকদারের সাথে তার যোগাযোগের বিষয়টি উঠে এসেছিল। একাধিকবার তাদের দেখা হয়েছে। জাফরউল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে সিরাজের স্ত্রী জাফরুল্লার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আত্মগোপনে ছিলেন। নোটবুকের সূত্র ধরে জাফরুল্লাহও গ্রেফতার হোন। সিরাজ সিকদারের মৃত্যু ভবিষ্যত রাজনীতির ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী হয়। 

শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডে সিরাজ অনুগামী নূর, ডালিম সরাসরি জড়িত ছিলেন। জাফরুল্লাহর ভাষ্যমতে, গ্রেফতারের পর সিরাজ সিকদারকে ধানমন্ডি ৩২-এ বঙ্গবন্ধুর সামনে হাজির করা হয়। বঙ্গবন্ধু  তার সাথে কথা বলেন। দুজনের রাস্তাে একই জানিয়ে সিরাজকে এসব কর্মকাণ্ড বাদ দিতে বলেন বঙ্গবন্ধু। তখন সিরাজ জানান,- আপনি বুঝতে পারছেন না, আপনার সময় শেষ। শেখ মুজিব ধৈর্যহারা হয়ে তাঁকে সামনে থেকে নিয়ে যেতে বলেন। পরবর্তীতে সিরাজ সিকদার পুলিশের গুলিতে নিহত হোন।

Siraj Shikder Controversy; Source – Saral Khatak Sahedin YTC

. . .

এইটা আওয়ামী ন্যারেটিভ হয়ে গেল জাভেদ। বিরামহীন উৎপাত তৈরি করাটাই বিপ্লবীর কাজ। তার কাজ নয় গোলাপ হাতে একনায়ক হয়ে ওঠা রাষ্ট্রকে শুভেচ্ছা স্বাগতম জানানো। সময়টাই ছিল বিপ্লবের বারুদে ঠাসা। চারু মজুমদারের নকশাল ইন্দিরা জামানায় চাপানো নজিরবিহীন ইমার্জেন্সির মধ্যে শ্লোগান দিত, চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। লক্ষ্য ছিল, চীনের আদলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটানো, যেন কৃষক-মজুর তার ভাগ বুঝে পায়। 

কবীর সুমন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাড়ির পাশে খাল দিয়ে নকশাল যুবকের লাশ ভেসে যেতে দেখেছি। ভাসমান লাশের মিছিল দেখেও নকশালরা জিকির তুলত,- বন্দুকের নল সকল ক্ষমতার উৎস। তার কাছে রাষ্ট্র অশ্লীল, কাজেই একে ধ্বংস না করা অবধি নতুনভাবে নির্মাণ সম্ভব নয়। অরাজকতা ছাড়া বিপ্লব তার মিশন কমপ্লিট করতে পারে না। এই জায়গা থেকে দেখলে বিপ্লব ও জঙ্গি নিকটবর্তী। আমরা কেবল দুটিকে তারা কী করতে চাইছে ওই নিরিখে পৃথক করি। 

বিপ্লবী তো রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতেই নামে, তারপর গড়ার চিন্তায় গমন করে। এখন এর ভুলত্রুটি নিয়ে অন্তহীন তর্ক চলতে পারে, কিন্তু বিপ্লব ঘটাবে বলে যারা মনস্থির করেছে, তারা ওভাবে আগায়।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব একটি ইতিবাচক হাইপ নিয়ে এসেছিল সেকালের যুবাদের চেতনায়। এখন যেমন ইসলামি বিপ্লবকে অনেকানেক যুবা ইতিবাচক গণ্য করছে। কারণ তার সামনে ফাঁপা ভাবাদর্শ ছাড়া কিছু পড়ে নেই। সমাজতন্ত্র ও ইসলামে আসমান-জমিন তফাত থাকলেও মিশন সফল করতে হলে তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী হতেই হবে। জনগণকে ওই ভাবের আওতায় আনতেও হবে, যেন তারা রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান করে এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনের লড়াই বলে বিপ্লবকে বরণ করতে পারে। ইসলামি জঙ্গিরা এই জায়গায় আবার বিপ্লবী হতে পারেনি এখনো। জনগণকে ব্যাপকভাবে মোটিভেট করে নিজ পক্ষে টানার হ্যাডম তাদের নাই। যে-কারণে সন্ত্রাস পয়দা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করছে। যদি বিকল্প পথে হাঁটত তারাও বিপ্লবী গণ্য হতো তখন। 

বিপ্লবী তো রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতেই নামে, তারপর গড়ার চিন্তায় গমন করে। এখন এর ভুলত্রুটি নিয়ে অন্তহীন তর্ক চলতে পারে, কিন্তু বিপ্লব ঘটাবে বলে যারা মনস্থির করেছে, তারা ওভাবে আগায়। বিপ্লবকে সংহত করতে দরকার নিখাদ পার্টিলাইন। লেলিনের মতো নেতা, যারা জানেন দেশলাইয়ে আগুন ঠোকার পর কী ঘটতে পারে এবং কখন থামতে হবে। তবু দেখুন, রুশ বিপ্লব শতভাগ সফল হতে পারেনি। প্রতিবিপ্লবের শঙ্কা ঘনিয়েছে। ট্রটস্কিকে হত্যা করা হয়েছে। বিপ্লবকে দেশগঠনের লাইনে নিতে স্টালিনকে নির্দয় হতে হয়েছে। 

. . .  

সিরাজ সিকদারের জন্ম এমন এক পটভূমিতে যারা একাত্তরের পরে প্রতারিত বোধ করছিলেন। কেন করছিলেন সেটি লম্বা ইতিহাস। শেখ মুজিব স্বাধীনতার চারণকবি। স্বাধীনতার পর পথহারা অনিকেত। কাজেই পাল্টা আঘাত উনার জন্য অনিবার্য হচ্ছিল। আর, সিরাজ সিকদারকে যেভাবে হত্যা করা হয় সেটি মর্মান্তিক। অবশ্য বেঁচে থাকলেও উনি বেশিদূর আগাতে পারতেন না। কারণ, উনার প্রতিরোধ তখনো সুসংগঠিত ছিল না। যে-কারণে পরে যশোর, ঝিনাইদহ জুড়ে সিরাজ সিকদারের উত্তরসূরিদের আমরা দিশেহারা দেখেছি। রাষ্ট্রের সঙ্গে ফাইট দিতে-দিতে ক্লান্ত যোদ্ধারা পরে ডাকাত সর্দারে পরিণত হয়েছিল। নব্বই অবধি টিকে থেকেছে। পরে আর পারেনি। 

নকশালরা এখনো মাওবাদী রূপে বিহার-ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে নিজের অস্তিত্ব জিইয়ে রেখেছে। রাষ্ট্র যতই তাদেরকে আতংকবাদীর লেবেল পরিয়ে ন্যারেটিভ বানাক না কেন, তারা এখনো নিজেকে বিপ্লবী ভাবে। আমাদের এখানে সেটি ঘটেনি। জিয়াউর রহমান জানতেন, কর্নেল তাহের তাঁর জন্য কতটা বিপজ্জনক বিপ্লবী। কাজেই তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে লটকাতে কালবিলম্ব করেননি। বঙ্গবন্ধু ওদিকে নিজের দলের ডাকাতগুলাকে যদি সামাল দিতে পারতেন ইতিহাস ভিন্নও হতে পারত। বাংলার আগামেমন সেটি পারেননি। 

ON RED ROAD – A Journey with Charu Majumdar; Source – Esha YTC

. . .

সংযুক্তি : বেয়নেট হোক যত ধারাল/ কাস্তেটা শান দিও বন্ধু

চারু মজমুদারের সহযোদ্ধা কমরেড আজিজুল হকের কথাগুলো আমরা শুনতে পারি আরেকবার। সাচ্চা বিপ্লবী আপস করে না। মচকায় তবু ভাঙে না। তার বিশ্বাসকে আপনি উপহাস করতে পারেন, খারিজ করতে পারেন, কিন্তু তাতে তার কিছু যায় আসে না। সে ওই অমিয়ভূষণ মজুমদারের নভলেটে বর্ণিত ব্যর্থ বিপ্লবীর মতো নিহত শুয়ে থাকে এই আশায়… একদিন সফল হবোই।

বিপ্লবীর মস্তিষ্ক মনে হচ্ছে ভিন্ন ধাতু দিয়ে গড়া। পরিবর্তীত সময়ে লড়াইয়ের ধরন সে পাল্টায় কিন্তু হাল ছাড়ে না। বিপ্লবীর মরণ নেই… যতদিন না কার্তুজ খালি করে কেউ শেষ বিপ্লবীকে গুলি করবে। শেষ বিপ্লবীকে গুলি করা সম্ভব নয়, কারণ ওই শেষের মধ্যে নতুন বিপ্লবীর বীজ জন্ম নেয়। দীনেশ দাশের কবিতাচরণ হয়তো বিপ্লবীর সংজ্ঞাকে খানিক নির্ধারণ করে যায় : বেয়নেট হোক যত ধারালো/ কাস্তেটা শান দিও বন্ধু…। বিপ্লব তাই অন্তহীন ব্যর্থতার মধ্যেই নিজের সফলতা খোঁজে।

Comrade Ajijul Haque about Intellectual and Maoist; Source – Ispat YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 1

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *