খবরের কাগজে দেখলাম, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লাইফ সাপোর্টে আছেন। প্রথম আলো যদিও সর্বশেষ আপডেটে জানাচ্ছেন,—আগের চেয়ে স্থিতিশীল আছেন তিনি। সব ঠিক থাকলে এই যাত্রা সেরে উঠবেন আশা করা যায়। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রজন্মে অনেকে বেঁচে নেই। তাঁরা হলেন সেই প্রজন্ম,—স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সন্ধিক্ষণে ছিলেন টগবগে তরুণ। সার্বভৌম রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ও পরবর্তী সংঘাতের সবটা নিজের চোখে দেখেছেন। যেখানে, এসব ঘটনার সঙ্গে বোঝাপড়ায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রজন্ম ও এর আগেকার প্রজন্মে বেড়ে ওঠা গুণীদের মধ্যে ক্ষোভ-সংক্ষোভ, বিভ্রান্তি ও স্ববিরোধিতা প্রবল থেকেছে। ঘনঘন পালটি নেওয়া ও শিবির বদলের সার্কাস দেখে-দেখে চোখ পচেছে এতোগুলো বছর!
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে অবশ্য বিরলপ্রজদের তালিকায় রাখতে হচ্ছে। ভাও বুঝে পালটি নেওয়ার ক্যারিকেচার থেকে দূরেই থেকেছেন। সংগতকারণে, তাঁর অসুস্থতার খবর সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সকলে চাইছেন,—তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন; আয়ু দীর্ঘায়িত হোক তাঁর। মনে-মনে তবু ভাবছি,—সত্তর ঊর্ধ্ব সজ্জন মানুষটির এখন আর বেঁচে থেকে কী লাভ! জীবনভোর যে-বাংলাদেশকে লালন করলেন ভিতরে, তার ছিটেফোঁটা কি অবশিষ্ট আছে! এ-কোন বাংলাদেশ তাঁকে দেখে যেতে হচ্ছে বা হবে সামনে,—যদি বেঁচে থাকেন আরো দীর্ঘ-দীর্ঘ দিবস!
এই বাংলাদেশ দেখে তো আমাদের মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ কীট অসাড় বোধ করে! এমন নয় যে, আমাদের জানা ছিল না,—কোনদিকে গমন করছে দেশ ও সমাজ। সবটাই জানা ছিল কমবেশি। তথাপি, যতটুকু জানা বা অনুমেয় ছিল, তারচেয়ে খারাপ দাঁড়িয়েছে পরিস্থিতি! যেখানে বেঁচে থাকার, লড়াই করার, ফিরে আসার জন্য নিজেকে অনুপ্রাণিত করা পাহাড় ঠেলার সমান হয়ে উঠছে প্রতিদিন। যেখানে, শারীরিকভাবে নাজুক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতো সজ্জন বিবেচক মানুষটি না পারবেন মুখ খুলে কিছু বলতে,—না পারবেন অনাচার সইতে। যদি-না এর মধ্যে বয়সজনিত মতিভ্রম তাঁকে পেয়ে বসে!

যাইহোক, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে জাতি মোটের ওপর শিক্ষাবিদ ও লেখক রূপে জানে। এই মনজুরুল ইসলাম গুছিয়ে কথা বলেন, যেখানে বিনয় ও বিবেচনার ছাপ থাকে। ইংরেজির ছাত্র ও অধ্যাপক হওয়ার কারণেও বটে, বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর সখ্য নিবিড়। এসব নিয়ে লিখেছেন বেশ নিয়মিত। দেশি ও বিদেশি কবি-লেখকদের নিয়ে গবেষণা আর সমালোচনা সাহিত্যের ঘাটতি পূরণেও চেষ্টা করেছেন কমবেশি। এবং, কথাসাহিত্যে নীরবে কাজ করে গেছেন মাঝখানের টানা দেড়-দুই দশক।
মোটাদাগের সারসংক্ষেপ কি তাঁকে বুঝতে সাহায্য করে? আমার তা মনে হয়নি কখনো। দেশি-বিদেশি সাহিত্য পাঠ ও ব্যাখ্যায় সাবলীল সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে আমরা ছেলেবেলা থেকে জেনে এসেছি। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় অলস দিনের হাওয়া শিরোনামে বিদেশি সাহিত্য নিয়ে লিখতেন। তখন থেকে নামটি মাথায় স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। সময়ের সঙ্গে পরিধি বাড়িয়েছেন নিজের। নিরলস থেকেছেন সৃজন ও মননের অনুশীলনে।
ধারাবাহিক না হলেও অনিয়মিত এক ধারাবাহিকতায় তাঁর কাজকর্মের খবরবার্তা আমার মতো অনেকেই নিয়েছেন ধারণা করি। কুলদা রায়কে দেখেছি,—গল্পপাঠ-এ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করেছেন। যেখানে, কথাসাহিত্যিক মনজুরুল ইসলামকে আবিষ্কারের তাড়না ও আন্তরিকতা নজর এড়িয়ে যাওয়ার নয়। এরকম আরো কাজ হয়তো তাঁকে নিয়ে হয়েছে। তথাপি, সবসময় মনে হয়েছে,—সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে তাঁর একজীবন মেয়াদী লেখালেখির মধ্যে আবিষ্কারের জায়গাটি আমরা বোধহয় সংকীর্ণ করে রেখেছি। বহতা সময় ও পরিপার্শ্বকে যেভাবে দেখেন তিনি, এর সঙ্গে বোঝাপড়া সেরে থাকেন সচরাচর,—লেখার মধ্যে এর আভাস থাকলেও, সেগুলোকে সজাগ মন নিয়ে অবধানের চেষ্টা কম চোখে পড়েছে। এর ফলে তাঁকে ওই শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবীর ছাপ্পায় আমরা অনেক আগে খুন করে বসে আছি। মানুষটি নিছক মননপটু নয়, গুরুত্বের সঙ্গে নিজেকে সৃজনপটু প্রমাণে মরিয়া থেকেছেন;—‘নিম্নমাঝারি’ কবিলেখকে ভরপুর বাংলাদেশে তাঁর এই বিশেষ দিকটির ওপর বড়ো একটা আলো ফেলতে দেখা যায়নি কাউকে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে তাহলে পাচ্ছি কোথায়? আমার যৎসামান্য অন্বেষণে তাঁকে পাচ্ছি নাগরিকজনের সঙ্গে আলাপচারিতায়। সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ নিয়ে তাঁর কাছে হাজির কবিলেখক ও সাংবাদিক বাহিনির সঙ্গে বাতচিতের ক্ষণে। কথার কথা, পাঠক সমাবেশ আয়োজিত এক আলাপে, সারার্থটি তুলে ধরছি এখনে; সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সেখানে বলছেন :
ঢাকা শহরে আশি হাজার রিকশায় যে-ছবিগুলো আঁকা দেখছি, মানুষ তা গ্রহণ করছেন,—একে তো আমি শিল্প নয় বলে খারিজ করতে পারি না। তাহলে, এতো-এতো মানুষকে খারিজ করতে হয়। যেখানে আমিই সব জানি-বুঝি,—বাকিরা নয়;—এরকম একটি মত প্রতিষ্ঠা হয়। তাতে উপকার নেই, বরং জানাবোঝায় গলতি থেকে যায়।
একই আলাপচারিতায় এজরা পাউন্ডকে কোট করে বলছেন :
আধুনিকতা সবসময় ছিল; এবং থাকবেও। আধুনিকতা মানে হচ্ছে পরিবর্তীত সময়কে বোঝা ও সেখান থেকে তাকে নতুন করে আবিষ্কার ও গড়েপিটে নেওয়া।
সহজ করে বলছেন বটে, কিন্তু খেয়াল করলে দেখতে পাচ্ছি,—এই বিবেচনাবোধ তাঁর নিজের অথবা অতীত প্রজন্মের অনেক গুণীর মধ্যে দুর্লভ। জনসংস্কৃতি, ইংরেজি পপুলার/ পপ কালচার ধরে নিলে বোধহয় সারার্থটি আরো ভালো প্রকাশ পায়;—তো এই পপ কালচারকে বুঝে ওঠা কেন জরুরি, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সেই আভাস রেখে যাচ্ছেন এখানে। অন্যদিকে, পপ কালচারের সঙ্গে বোঝাপড়ার ঘটনাকে আমরা মোটের ওপর পোস্ট মডার্নিটি বা উত্তর-আধুনিকতার ফলপ্রসূ এক সম্প্রসারণ ধরে নিয়েছি। ধরে নেওয়াটা মিথ্যে নয়। তবে, মনজুরুল এই শ্রেণিকরণে না গিয়ে আধুনিকতায় স্থির থেকে জানাচ্ছেন,—সময়ের পালাবদলকে উপলব্ধি করা ও সেখান থেকে নিজের ভাবনা ও সৃজনশীলতায় নতুনত্ব সৃষ্টিই হচ্ছে আধুনিকতা; যেটি আসলে চিরনবীন। শ্রেণিকরণ ইত্যাদি করা যায় বটে, তবে তাতে মূল ধারণায় বড়ো কোনো হেরফের ঘটে না।
এই-যে দুখানা কথা তিনি বললেন, তাঁর সামগ্রিক লেখালেখির মধ্যে এর ছাপ আমরা পাবো। মনে পড়ছে, দৈনিক বাংলাবাজার-এর সাহিত্যপাতায় ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে মিলে তিনি একখানা ধারাবাহিক উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন। ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত নাগরিক জনসংস্কৃতির ধাত বোঝার প্রয়াস ছিল সেখানে। ঢাকাই ছবিতে হিরোইন হিসেবে দিতির তখন প্রবল চাহিদা! ক্রেজ ছিল তাঁকে নিয়ে। সৌন্দর্য ও ঢাকাই ছবিতে মাস অ্যাপিলের কারণে পাঠযোগ্য একখানা চিহ্ন হওয়ার দাবি তিনি করতেই পারেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বিবরণ দিতিকে ছুঁয়ে যেতে চেষ্টা করেছিল। যার মধ্যে মাস সাইকোলজি ধরার প্রয়াস ছিল মনে হয়।
ওপারবাংলায় দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত-এ এটি আমরা পাচ্ছি তখন। শ্রীদেবীর মাস অ্যাপিলকে বাঘারুবৃত্তান্তে স্পেস দিয়েছেন দেবেশ রায়। লম্বা পরিসর জুড়ে বয়ন করেছেন উত্তরবঙ্গের রুখু এলাকায় শ্রীদেবীর নাগিন প্রভাব। রোলাঁ বার্থের চিহ্নতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার সম্প্রসারণকে যা মনে করায়।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অতদূর যেতে পারেননি; তবে এই-যে বিবেচনা ও পর্যবেক্ষণ,—এর গুরুত্ব তাতে খাটো হয় না। যেহেতু, আমাদের এখানে শিক্ষিতজনরা সাহিত্য ও আর্ট-কালচার চর্চায় নেমে ক্রমশ গণবিচ্ছিন্ন ও অদ্ভুত হয়ে ওঠেন অধিক। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এখানে ব্যতিক্রম থেকেছেন। কথার কথা, মার্সেল প্রুস্ত অথবা জেমস জয়েস পাঠ মনের যে-ভিত গড়ে দিলো, এখন এর মূল্য তাঁর বোধিজগতে সযত্নে লালন করলেও নিজেকে সেখানে সিলগালা করার বাতিক তাঁকে পেয়ে বসেনি।
উচ্চাঙ্গের সাহিত্য-শিল্পকলার কদর করছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, চর্চায় বিরাম নেই, কিন্তু এর পাশাপাশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বা মাস অ্যাপিল তৈরি করে প্রতিনিয়ত,—এরকম বিষয়বস্তুকে অবহেলায় দূরে ঠেলার পরিবর্তে উপলব্ধি ও পর্যবেক্ষণ করেছেন সাগ্রহে। যে-কারণে তলস্তয় বা দস্তয়েভস্কি পাঠের প্রভাবে হুমায়ূন আহমেদকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বাতিল করার মেজাজ তাঁকে দখলে নিতে পারেনি।
হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে এখানে তাঁর পার্থক্য পাচ্ছি। আজাদ উপন্যাস ও অপন্যাসের যে-শ্রেণিকরণ তখন করেন, সেটি বানোয়াট নয়,—তা-বলে একে একমাত্র ধরে নিলে উন্নাসিকতা প্রবল হয় মাত্র! এরচেয়েও বড়ো বিষয় হলো,—জন-মনস্তত্ত্ব বোঝার রসদে ঘাটতি ঘটে তখন। বহুরৈখিকতায় দাঁড়িয়ে একটি বিষয় নিয়ে ভাবনা করা কঠিন হয়ে ওঠে। যার ফলে, জাজমেন্টাল হওয়া ছাড়া পথ খোলা থাকে না। হুমায়ুন আজাদ প্রচণ্ডভাবে দেশকাল সম্পৃক্ত মানুষ ছিলেন। দেশের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে সঠিক নিদান হেঁকে গেছেন। এসবই তাঁর থেকে আমাদের অর্জন; কিন্তু আজাদের সাহিত্য পাঠ ও বোঝার তরিকা একরৈখিক। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এখানে এগিয়ে থেকেছেন, এবং তা গোড়া থেকেই।
হুমায়ূন আহমেদ ওদিকে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজে এই-যে আইকন হয়ে উঠলেন, এখন এর সঙ্গে সুনীল গাঙ্গুলীর বিবরণ মোতাবেক,—চেকোশ্লাভাকিয়ার ট্যাক্সি ড্রাইভারকে কাফকা পড়তে দেখার ঘটনাকে মিলানো যাবে না। আমাদের এখানকার সমাজ-বিবর্তন যে-মানদণ্ড তৈরি করে দিচ্ছে, সমাজ যতখানি আগাতে পেরেছে অথবা পারেনি, তার বাইরে সাহিত্য ইত্যাদির যাওয়া কঠিন। সুতরাং, কমলকুমার মজুমদার বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে কেবল পড়ব, এবং হুমায়ূন আহমেদকে রাখব বাইরে,—এই উন্নাসিকতা বিপজ্জনক। তাতে করে কিছু গরিমার ছটা বের হয়, আখেরে ওই পাঠক ও লেখক এলিট-খাঁচায় নিজেকে বন্দি করেন স্বেচ্ছায়। বঙ্গীয় জনপদে যার প্রকোপ আজতক ব্যাপক।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে জীবন কাটালেও, সুশীল সমাজে মান্যগণ্য হয়ে হরহামেশা বিচরণ করলেও, পাঠবোধ ও বিবেচনায় অনেকের থেকে এগিয়ে এখানে। যে-কারণে বিদেশি বা আমাদের এখানকার সিরিয়াস লেখকদের নিয়ে অনায়াসে লিখেছেন, আবার হুমায়ূন আহমেদ ও হুমায়ুন আজাদের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতেও তাঁর আটকায়নি।
আরেকটি জায়গায় আমার কাছে তাঁকে প্রচণ্ড সৎ মনে হয়েছে সবসময়। যেসব গল্প তিনি টানা লিখেছেন মাঝখানে, সেখানে তিনি সেই জীবন নিয়ে মোটাদাগে লিখেছেন, যা তাঁর চেনাজানার পরিধিতে পড়ছে। সোজা কথায়, বাংলাদেশের বিকাশমান নগরজীবন ও নাগরিকতাকে ধরেছেন লেখায়। যেখানে আবার পাঠক ধরার নেশায় হুমায়ূন আহমেদের আসর নিজের ওপর পড়তে দেননি। কোনো-কোনো গল্পে হুমায়ূন উঁকি দিচ্ছেন মনে হলেও, তাঁর ভাষা-আঙ্গিক সামগ্রিকভাবে স্বতন্ত্রই থেকেছে। কারণ, হুমায়ূনের রচনাশৈলী বাংলাদেশের শহুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সঞ্চার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনোজগৎ বুঝে ওঠার রসদ দিয়ে গেলেও,—সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্বকীয়তার জমিনে দাঁড়িয়ে লিখেছেন ও এখনো লিখছেন।
তিনি লিখে উঠতে চেয়েছেন ওইসব গল্প, যেখানে বিষয়ভাবনা, ভাষা ও আঙ্গিকে বিদেশি বেশভূষার ছাপ থাকলেও, সেখানে প্রতিফলিত জনপদ অবিরাম বাংলাদেশের কাহিনিই বলছে। হাইব্রিড এই রচনারীতি, একে যদি আধুনিকতাকে সদা আবর্তনশীল ও পরিবর্তনশীল বলে মানি, তাহলে আমাদের জন্য অনেকটা নতুন। এখন, এই নতুনত্বের দিকটি নিয়ে বড়ো একটা আলাপ তুলতে দেখিনি কাউকে! হায়! আমাদের উন্নাসিক উদাসীনতা!
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শহীদুল জহির, এমনকি জলেশ্বরী বা ত্রাহির মতো রচনা নিয়ে হাজির সৈয়দ হককে যদি অ্যাকসেপ্ট করতে পারি,—সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কেন নয়? আজকের মাসরুর আরেফিনের কবিতা ও উপন্যাসে উচ্চকিত রচনারীতির সবটাই প্রচণ্ড বৈদেশি; যেখানে কাহিনি ও চরিত্ররা আদতে কোনো কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে নেই। যেখানে, মাসরুর আরেফিন কাহিনির ছুতোয় অ্যানালিস্ট হওয়ার দায় মিটাতে থাকেন; যেন পাঠক তাঁর শ্রেণিচরিত্রে সক্রিয় দ্বন্দ্ব ও জটিলতাকে বোঝার চেষ্টা করে। তারা যেন বোঝে,—কর্পোরেট লাইফে সচল এক মন নিজেকে এখানে উন্মোচিত করছে, এবং এর পাশাপাশি ডিফেন্ড করে যাচ্ছে সমানে। তলস্তয়ের মতো অনায়াস সহজতায়। এখন, একে নিয়ে উচ্ছাস দেখেছি বেশ। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বেলায় তাহলে কৃপণতা কেন? রহস্যটি আজো মাথায় ঢোকে না!
এর একটি কারণ বোধহয় আমাদের এই আজব হীনমন্যতা,—সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একজন প্রাবন্ধিক। একজন ঝানু শিক্ষাবিদ। অতি উত্তম পাঠক। তাঁর ওই গল্পটল্প এগুলো অতটা গুরুত্ব রাখে না। পাত্তা না দিলেও চলবে! আজব বটে আমাদের মনস্তত্ত্ব! এভাবে আমরা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরসহ অনেককে মার্ক করে বারোটা বাজিয়েছি। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের রচনারীতি বিষয় বুঝে নিজেকে পালটেছে ফিরেফিরে। রাষ্ট্র বা উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে যখন লিখছেন, তার সঙ্গে জয়নুল-কামরুল ও পোড়ামাটির কাজ নিয়ে লেখার ধাত মিলবে না। যেমন আলাদা থেকেছেন মেঘনার মতো গল্প লিখতে যেয়ে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কাজেই আমাদের জন্য বিরাট সমস্যা! এই-যে তাঁকে নিয়ে উদ্বেগ, হ্যানত্যান,—সেখানে লোকটির কথাসাহিত্যে নতুনত্ব তৈরির চেষ্টা আমরা বড়ো একটা আমলে নিতে চাই না! ভাব দেখে মনে হয়,—নব্বই থেকে শুরু হওয়া সাহিত্যের মচ্ছব কস্মিনকালেও তাঁর সৃজনশীল লেখক হয়ে ওঠার ধারাবাহিকতাকে আমলে নেবে না অতটা! তারা অবশ্য কী ও কাকে পাত্তা দেন, তা মগজের ওপর দিয়ে যায় আজকাল! অংবংছং বকাবকি ছাড়া কিছু দেখি না ছাই!
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আপনি আরো দীর্ঘদিন বাঁচুন এই কামনা করি। তবে, ভুলেও এই আশা করে বাঁচবেন না যে,—আপনাকে নিয়ে ভালোমন্দ ক্রিটিক কোনো একদিন এখানে হবে! এই আশায় বেঁচে না থেকে বরং মরে যাওয়া ভালো। আপনি বেঁচে থাকুন নিজের পরিবারের জন্য। বেঁচে থাকুন, এমন কোনো বিরল সুহৃদের আশায়, যে এসে আপনাকে বলবে,—স্যার, আপনার গল্পগুলো কিন্তু পড়তে বেশ! নতুন টেস্ট পাচ্ছি স্যার!
. . .

. . .



