টাইম লুপ বা খানিকটা ঘুরিয়ে বললে সময়চক্রের ফাঁদে ধরা খাওয়া নিয়ে অনলাইনে মাঝখানে বেশ রব উঠেছিল। ভারতের অনলাইন বাজারে যারা করে খাচ্ছেন, তাদের মধ্যে কিছু লোক বলা-কওয়া নেই বিষয়টি নিয়ে এন্তার ভিডিও ছাড়তে আরম্ভ করেন। জনপ্রিয় ইউটিউবার কুলদীপ সিংহানিয়া বাজার কাটতি ভিডিও ও রিলস ভালোই ছাড়েন বটে! তিনি হঠাৎ বলতে শুরু করলেন,—সময় ক্যালেন্ডারের হিসাবে ২০২৫ সনের পৃথিবীতে বসবাস করছি মনে হলেও, আমরা আসলে ১৯৪১ ঈসায়ী সনকে যাপন করছি এখন!
১৯৪১ সনে যেসব ঘটনা মানুষের জীবনকে প্রভাবিত ও বিপর্যস্ত করে তুলছে,—২০২৫ সনের ক্যালেন্ডারে সংঘটিত ঘটনার সঙ্গে সেগুলোর যোগসূত্র বেশ নিবিড়! যেরকম, ২০১৯ সনে বিশ্ব জুড়ে দেখা দেওয়া অতিমারি কোভিড-19 আর স্প্যানিশ ফ্লুর তাণ্ডব বাৎসরিক ক্যালেন্ডারে গমন করলে অভিন্ন মনে হবে! ঈসায়ী ক্যালেন্ডারের হিসাবে কোভিড-19 মূলত ২০১৯-র শেষ দিকটায় এসে শুরু হয়েছিল। পরের বৎসর মহামারিতে মোড় নেয়। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষভাগ, সম্ভবত ১৯১৮ সনের দিকে স্প্যানিশ ফ্লু শুরু হয়, এবং পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে এটি ভয়াবহ মহামারি আকারে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
সময় ক্যালেন্ডার থেকে তুলে আনা বিচিত্র ঘটনার দিন-তারিখ-বছরের হিসাব ও প্রায় অবিকল পুনরাবৃত্তি নিয়ে কাল্পনিক গল্প-আখ্যান ও সিনেমা আমরা হামেশা দেখে আসছি। টাইম লুপ বা সময়ফাঁদে ফেঁসে যাওয়ার কাল্পনিক বয়ান পুঁজি করে এখন বাজার গরম করে তুলেছেন ভারতীয় ধর্মগুরু আর কুলদীপের মতো কিছু ইউটিউবার। মানুষের কাছে তাঁদের আবেদন ও গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক, সুতরাং সময়চক্রের ফাঁদে ধরা পড়ার মুখরোচক চাটনি তারা দেদারসে গিলছেন বৈকি!
কুলদীপদের বানানো রিলসগুলোকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে নাকচ করা সংগত, যদিও ২০২৫ ও ১৯৪১ সনের মধ্যে যেসব সাদৃশ্য তিনি তুলে ধরেছেন, সেগুলো মনকে তাৎক্ষণিক চমকে দেয়! কুলদীপদের দাবি,—আমরা মানি বা না মানি, বাস্তবতা হচ্ছে,—মি. টাইম ওরফে সময় মহাশয় পুনরাবৃত্তি পছন্দ করেন। ২০২৫ সনে পা দিয়ে আমরা এরকম এক পুনরাবৃত্তির ফাঁদে বন্দি হতে চলেছি!
আসলেও কি তাই? প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে ১৯৪১ ও ২০২৫ সনকে বোঝার চেষ্টা করা যাক। ১৯৪১ ছিল মানব-ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ একটি বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা ১৯৩৮-এ বেজে উঠলেও, এর আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত ঘটে ৪১-এ। ওই বছর তা বীভৎসতা ছড়াতে শুরু করেছিল। দেশে-দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, গণহত্যার কারণে বছরটি বিশ্ববাসীর জন্য হাবিয়া দোজখে মোড় নেয়। ১৯৪১ সনে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহের মঞ্চ পেছনে ফেলে আসা পাঁচ-দশ বছরে তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ, পেছনের বছরগুলো যে-পরিস্থিতিটি সামনে হাজির করে,—১৯৪১-এ পা দিয়ে তা টাইম লুপ বা সময়ফাঁদে মোড় নিতে শুরু করে। ফাঁদটি পরবর্তী এক দশক পৃথিবীকে টালমাটাল রেখেছিল।
একই ফাঁদ আবার পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে চরিত্র পালটে ভিয়েতনাম যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢালে। কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার ও উপনিবেশের পায়ের নিচে নিষ্পেষিত জাতিগুলোর নিজেকে মুক্ত করার লড়াই তীব্র হয় এইসময়। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের গেরিলা সংগ্রাম পায় নয়া মাত্রা। বিপ্লব চলাকালে ও পরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিপ্লবী সরকারগুলো অনেকক্ষেত্রে নির্দয় চেহারায় বিভীষিকা ছড়াতে আরম্ভ করে। জনগণের একাংশকে বিপ্লবের শত্রু দাগিয়ে নির্বাসন ও গণহত্যার খেলায় লিপ্ত হয়েছিল তারা। ছাত্রবিদ্রোহ, সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখল, আর মন্বন্তর ছিল পুরো কালপর্বজুড়ে স্বাভাবিক ঘটনা।
টাইম লুপ তত্ত্বে বিশ্বাসীরা মনে করেন,—দুইহাজার পঁচিশ সনে এরকম একখানা ফাঁদ পুনরায় জন্ম নিতে চলেছে। পেছনে ফেলে আসা পাঁচ-দশ বছরে সংঘটিত ঘটনাগুলোর যোগফল পঁচিশে এসে পুনরাবৃত্তির আরেকখান চক্র বাস্তব করে তুলছে ক্রমশ। এর প্রভাব পরবর্তী এক থেকে দুই দশক অবধি জারি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। চরিত্রের দিক থেকে দুইহাজার পঁচিশে দেখা দেওয়া পুনরাবৃত্তির চক্রটি ১৯৪১ সনের ক্যালেন্ডারে সংঘটিত ঘটনার প্যাটার্ন অনুসরণ করে অগ্রসর বলে তাঁরা মানছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান, ডানপন্থী ভাবাদর্শের আধিক্য, ধর্মীয় গোঁড়ামির বাড়বাড়ন্ত, প্রযুক্তিকে মারণাস্ত্র রূপে ব্যবহারের প্রবণতা, খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে পরিকল্পিত বৈষম্য জিইয়ে রাখার মতো ঘটনা ১৯৪১ সনকে টাইম লুপ নামক টাইমবোমায় পরিণত করেছিল। দুইহাজার পঁচিশ সনের এরকম বোমায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নাকি প্রবল!
টাইম লুপ ফ্রিকদের এসব হইচইয়ের মধ্যে ভিউ বাড়িয়ে টাকা কামানোর মতলব নিশ্চয় রয়েছে, তবে এ-কথা মিছে নয়,—মানব-সমাজে যেসব ঘটনা সভ্যতার সূত্রপাত থেকে ঘটে আসছে, সেগুলোকে সময় ক্যালেন্ডার ধরে হিসাব করলে শতকে-শতকে তৈরি হতে থাকা অনেকগুলো টাইম লুপ বের করা সম্ভব। লুপগুলো এখানে সভ্যতার গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করছে। মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই ও এর জন্য বেছে নেওয়া পথকে করে তুলেছে সর্পিল ও বিপজ্জনক। দুইহাজার পঁচিশ সনে পা দিয়ে এরকম আরো একখান সর্পিল লুপে মানুষ হয়তো পা দিতে চলেছেন, যার দণ্ডি পরবর্তী দুই-তিন দশক ধরে দিতে হতেও পারে।
সে না-হয় হলো, কিন্তু টাইম লুপের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কি আদৌ রয়েছে? বিজ্ঞান কি বলে আমাদের! গুগলিং ও চ্যাট জিপিটির সঙ্গে কয়েক দফা আলাপ শেষে বোঝা গেল,— বিজ্ঞানীরা টাইম ট্রাভেল বা সময়ভ্রমণ নিয়ে মাথা খর্চা করেছেন, তবে সময়-ক্যালেন্ডারের পুনরায় ফেরত আসাকে অবাস্তব বলেই মনে করেন তাঁরা।
সিটিসি (Closed Timelike Curve) নামে একখানা তত্ত্ব অবশ্য আছে সেখানে। প্রতিভাবান গণিতবিদ কার্ট গোডেল মূলত অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের গাণিতিক কাঠামো সলিড করতে এটি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তখন।
ইউনিফায়েড ফিল্ড থিয়োরি বা একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্ব নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করার মতলবে আইনস্টাইন ততদিনে আমেরিকায় স্থায়ী হয়েছেন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সসম্মানে তাঁকে বরণ করে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ম করে বিকালবেলা হাঁটতে বের হতেন আইনস্টাইন। সেখানে তাঁর নিত্য সঙ্গী ছিলেন সন্দেহবাতিক মোহে আক্রান্ত গণিতবিদ কার্ট গোডেল। অ্যাটম বোমা তৈরির মূল কারিগর ওপেনহাইমারকে নিয়ে নির্মিত ব্লকবাস্টার মুভিতে দৃশ্যটি রেখেছেন ক্রিস্টোফার নোলান। ছবিতে গোডেল অবশ্য কেন্দ্রীয় কোনো চরিত্র নন। কয়েক সেকেন্ড তাঁকে ফ্রেমে ধরেছিলেন নোলান।
গাণিতিক মডেল নিয়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে তর্কালাপ ভীষণ পছন্দ করতেন গোডেল। সিটিসির গাণিতিক মডেল দিয়ে আইনস্টাইনকে চমকেও দিয়েছিলেন। আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী বৃহৎ মাধ্যাকর্ষণ বল ধরে রেখেছে, এরকম বস্তুর নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় আলোর গতি সোজা থাকার পরিবর্তে বেঁকে যায়। এর ফলে আমাদের দেখার ছকে ঘটে পরিবর্তন। সময় বিষয়ক ধারণাও এক থাকে না অতঃপর। গোডেল বোঝালেন,—অনুরূপ বক্রতার কারণে সময়ের পুনরায় ফেরত আসার সম্ভাবনা গাণিতিকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে গিয়ে পুনরায় অতীতে ফেরত আসার ধারণাটি গাণিতিক মডেলে অবান্তর নয়।
The Institute of Art YTC
কার্ট গোডেলের অপূর্ণতা বিষয়ক প্রতিপাদ্য (Incompleteness Theorem) রজার পেনরোজকে ভাবিয়েছে বেশ। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর Conformal Cyclic Cosmology আমাদের জানায়,—বিগ ব্যাং বা বৃহৎ বিস্ফোরণ পরবর্তী মহবিশ্ব এই-যে সীমানাবিহীন সম্প্রসারিত হচ্ছে, এখন তা অনন্ত হওয়ার কথা নয়। মহাসংকোচনের কারণে ঘনীভূত কণারাজ্যে সক্রিয় বলসমূহের কারণে সংঘটিত বিদারণ (Fission) ) ও সংমিশ্রণ (Fusion) হচ্ছে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের গণ্য কারণ। একে যদি মহাবিশ্ব সৃষ্টি ও সম্প্রসারণের মূল ভাবি, তাহলে নিয়ম অনুসারে মহাবিশ্ব কোনো এক পর্যায়ে আবার সংকোচন দশায় যাওয়ার কথা। বৃহৎ বিস্ফোরণের পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা সুতরাং অবান্তর নয়।
গোডেলের সিটিসি ও পেনরোজের সিসিসি মূলত তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা। বাস্তবে তত্ত্ব দুটি প্রমাণ করা কঠিন। তাদের যৌক্তিকতা তা-বলে খারিজ হয়ে যায় না। মজার ব্যাপার হলো, কেন খারিজ হচ্ছে না, সেটি স্বয়ং গোডেল প্রস্তাবিত ও সুপরিচিত তত্ত্ব অপূর্ণতার প্রতিপাদ্যকে (Incompleteness Theorem) বিবেচনায় নিলে সহজে বুঝতে পারব। কার্ট গোডেল মূলত তাঁর এই তত্ত্বের কারণে বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ মহলে পৃথক গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। প্রস্তাবিত প্রতিপাদ্যে গোডেল দেখাচ্ছেন :
একটি শক্তিশালী গাণিতিক পদ্ধতি বা মডেল এমন সত্য ধারণায় উপনীত হতে পারে, যেটি আবার স্বয়ং ওই পদ্ধতির সাহায্যে সত্য প্রমাণ করা সম্ভব নয়। গাণিতিক পদ্ধতি, যুক্তি ও ভাষার সীমাবদ্ধতা এখানে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্য প্রচলিত উদাহরণটি আমরা বিবেচনায় নিতে পারি :
ঈশ্বর বা গডকে এই উদাহরণে গাণিতিক একক G ধরে নেওয়া হচ্ছে। জনৈক গণিতবিদ G-এর অস্তিত্বিক সত্যতা আছে মানলেও, তাঁর গাণিতিক মডেলের সাহায্যে এর সত্যতা প্রমাণ করা সম্ভব নয় বলে রায় দিয়েছেন। গণিতবিদের রায়কে এখানে স্ট্যাটমেন্ট বা বিবৃতি ভেবে নিতে পারি আমরা।
G যদি কোনো একভাবে প্রমাণিত হয়ও,—গণিতবিদের তৈরি মডেলে G-র অস্তিত্ব মিথ্যেই থেকে যাবে। যেহেতু, এই মডেল বলছে,—G-কে গাণিতিক পদ্ধতির সাহায্যে অনুমান করা গেলেও, তাকে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, G যদি প্রমাণ করা না যায়, সেক্ষেত্রে কথা বাড়ানোর কারণ থাকছে না। গণিতবিদ তো বলে দিয়েছেন,—অস্তিত্ব যদি থাকেও, গাণিতিক মডেল দিয়ে G-কে প্রমাণ করার সুযোগ নেই।
গোডেল এই প্রস্তাবনার সাহায্যে বোঝালেন,—গাণিতিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হওয়ার সময় এমন সত্য সামনে আসতে পারে, যেটিকে আবার ওই গাণিতিক পদ্ধতির সাহায্যে সত্য প্রমাণ করা যায় না। ভাষা এখানে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গাণিতিক যুক্তির ধাপগুলো সমস্যা তৈরি করে। সর্বোপরি, যেসব বিধি-নিয়ম একটি গাণিতিক মডেল ওরফে সিস্টেমকে জন্ম নিচ্ছে, সেগুলো G-র মতো সত্যকে প্রমাণ করে উঠতে পারে না।
গোডেলের অপূর্ণতার প্রতিপাদ্য ব্যবহার করে পরে অনেকে এ-কারণে বলতে চেয়েছেন,—ঈশ্বর বা গড হচ্ছেন এমন এক সত্য, তাঁর অস্তিত্ব অমোঘ, কিন্তু তাঁকে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। গোডেল স্বয়ং প্রগাঢ় ঈশ্বরবিশ্বাসী লোক ছিলেন। অপূর্ণতার প্রতিপাদ্য অবশ্য ঈশ্বরকে প্রমাণ করার দায় থেকে তিনি ভবেননি। এর পেছনে আরেক প্রতিভাবান গণিতজ্ঞ হিলবার্টের দাবিকে অসার প্রতিপন্ন করার চাপ ছিল মনে।

হিলবার্ট এমন একখানা গাণিতিক মডেল তৈরিতে মরিয়া ছিলেন, যার সাহায্যে যে-কোনো সমস্যার সত্য-মিথ্যা ও যৌক্তিকতাকে প্রমাণ করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ, প্রতিটি গাণিতিক সত্যকে লজিক বা যুক্তির মধ্য দিয়ে অকাট্য প্রমাণ করা যাবে। কোনোপ্রকার স্ববিরোধিতা সেখানে থাকবে না। গণিত দিয়ে সলিডিফাই করা যাবে এর ভিত।
গোডেল এখানে কুঠার হানলেন। তিনি দেখালেন,—গাণিতিক তত্ত্ব যত নিখাদ হয়ে উঠুক-না-কেন, তার পক্ষে সকল সত্যকে সত্য প্রমাণ করা সম্ভব হবে না। আগের উদাহরণ যদি ফিরে ভাবি, তাহলে আমরা সহজে বুঝতে পারছি,—কোনো গাণিতিক পদ্ধতির মাধ্যমে G অথবা এরকম সমস্যার সত্যমিথ্যা নিরূপণ সম্ভব নয়।
গোডেল যেহেতু ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, সমস্যার সুরাহায় লাইবনিজের পথ অনুসরণ করলেন। তিনি ধরে নিলেন,—ঈশ্বর হচ্ছেন সকল গুণের আধার ও স্বংয়সম্পূর্ণ। তাই যদি হয়, তাহলে তাঁকে মানবরচিত যাবতীয় পদ্ধতি ও মডেলের বাইরে সত্য ভাবা সম্ভব। গোডেলের ভাষায় এটি হলো মোডাল লজিক। লাইবনিজের মোনাডের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে বটে! ঈশ্বর হচ্ছেন সম্ভাব্য সর্বোচ্চ অস্তিত্ব; এবং, সে-কারণে তিনি আবশ্যিক বিদ্যমান। তাঁকে বাদ দিয়ে সৃষ্টির অস্ত্বিত্ব কল্পনা করা সম্ভব নয়।
গোডেলের এই প্রতিপাদ্যের আদি প্রতিধ্বনি আমরা পাচ্ছি ইসলামের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের যুগে দেখা দেওয়া ভুবনবিখ্যাত বিজ্ঞানী ও ভাবুক ইবনে সিনার তত্ত্বে। ঈশ্বর তথা স্রষ্টাকে ইবনে সিনা ওয়াজিব আল-ওজুদ বা প্রয়োজনীয় অস্তিত্ব ভেবেছেন।
বস্তুজগতে কোনোকিছু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তারা অন্যননির্ভর না হয়ে পরস্পর নির্ভর। এর ফলে তাদের পক্ষে জগৎসৃষ্টির কারণ হওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অনন্যনির্ভর কিছুর পক্ষে তা সম্ভব। আল্লাহ বা ঈশ্বর হচ্ছেন সুতরাং জগৎসৃষ্টির নিয়ামক কারণ;—অ্যারিস্টোলের বিখ্যাত ফার্স্ট মুভার বা আদিচালক।
ইবনে সিনার তত্ত্ব এখানে ইসলাম কর্তৃক স্বীকৃত বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইসলামে (এবং বেশিরভাগ ধর্মীয় বিশ্বাসেও) স্রষ্টা রূপে আল্লাহ হচ্ছেন সৃষ্টির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক। সৃষ্টিকে খণ্ডিত ও পরস্পরনির্ভর করে তিনি সৃজন করেছেন। প্রবৃত্তি যেমন তাঁর সৃষ্ট। বিধি-নিয়ম ও নৈতিকতা তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং সৃষ্টি কোনোভাবে স্বাধীন নয়। সৃষ্ট এই জগৎ নির্ধারিত বিধির অধীন বা বিধিসাপেক্ষে স্বাধীন। সবকিছুর অন্তিম গতি স্রষ্টার অভিমুখী। তাঁর দিকে ঘটবে প্রত্যাবর্তন।
কোরান-এ যেমন আদম ও হাওয়াকে আদি মানব-মানবী রূপে সাব্যস্ত করা হচ্ছে, যেখানে স্রষ্টা আদমকে এক-এক করে সৃষ্টির সমুদয় উপকরণের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছেন। সৃষ্টির অন্যতম একক মানব প্রজাতিকে তিনি নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা দিয়ে ধরায় প্রেরণ করেন। অর্থাৎ, সে যা-কিছু করবে তার ফলাফল স্বরূপ শাস্তি কিংবা পুরস্কার তাকে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, ঈশ্বর বা আল্লাহ এখানে এমন এক নৈতিক একক, তাঁকে স্বীকার-অস্বীকার ও তাঁর স্থির-করা বিধি-নিয়ম পালন ও উপেক্ষার ওপর মানুষের পরিণাম নির্ভরশীল।
ইবনে সিনা উলটো সুর ধরেছেন এখানে। তাঁর বিবেচনায়, আল্লাহ একক, অনন্যনির্ভর, স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা হওয়ার কারণে পরস্পরনির্ভর, অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত সৃষ্টির মুখাপেক্ষী থাকার দায় তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণের মামলায় গমনের প্রয়োজন তাঁর নেই।
সৃষ্টি এখানে কেবল তাঁর অনন্যনির্ভর গুণের বিচ্ছুরণ। আলাদা করে এক-একটি গুণের সাহায্যে স্রষ্টাকে দায়বদ্ধ চিহ্নিত করা স্বয়ং তাঁর একত্বের বরখেলাফ। মানব জগতে ভালোমন্দ যা কিছু ঘটছে, এর সঙ্গে তাঁকে জড়িত করা যুক্তিসংগত নয়। তিনি হলেন আবশ্যিক অনন্যতা;—যেখান থেকে সৃষ্টির সূচনা ও বিস্তার ঘটছে। এই শর্তের বাইরে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই।
সিনার ঈশ্বরতত্ত্ব রূপকার্থে বিগ ব্যাং বা বৃহৎ বিস্ফোরণের সঙ্গে তুলনীয়। বৃহৎ বিস্ফোরণের পরিস্থিতিটি খুবই অনন্য ছিল। এটি হলো সেই অবস্থা যেখান থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও বিবর্তন সাধিত হয়ে চলেছে। বিস্ফোরণের পর থেকে এ-পর্যন্ত মহাবিশ্বের বিকাশ-বিবর্তন ও সম্ভাব্য পরিণতির জন্য আমরা বৃহৎ বিস্ফোরণকে আলাদা করে দায়বদ্ধ করি না। এটি একটি অনন্য অবস্থা ছিল, যেটি না ঘটলে সৃষ্টি সম্ভব হতো না। সোজা কথায়, সৃষ্টির জন্য একটি অনন্যনির্ভর অবস্থাকে যদি শর্ত ধরে নেই, তখন সেটি বিগ ব্যাং হতে পারে অথবা ঈশ্বরও হতে পারেন। এর বাইরে ওই অনন্যনির্ভর অবস্থার পৃথক কোনো ভূমিকা নির্ধারণ যৌক্তিক নয়।

লাইবনিজ, গোডেল, সিনা… এঁনারা মূলত ঈশ্বরকে সকল প্রকার মানবযুক্তির অতীত কারণ হিসেবে ভাবার চেষ্টা করেছেন। এমন এক নিখুঁত সিস্টেম, যে তার নিজমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মানব পৃথিবীতে বিরচিত কোনো সিস্টেমের সাহায্যে তাঁকে কাঁটাছেড়া করা, গ্রহণ কিংবা বাতিল কোনো অর্থ তৈরি করে না।
ভিটগেনস্টাইনও অনেকটা তাই। ভাষার সীমাবদ্ধতা ও সম্প্রসারণ বোঝানোর ছলে বলেছিলেন : Whereof one cannot speak, thereof one must be silent. অর্থাৎ, আমার ভাষা আমাকে যতদূর যেতে বলছে, ততদূর আমার যুক্তির সীমানা নির্ধারিত। তার বাইরে ঈশ্বরের মতো কিছু যদি থেকেও থাকে, এটি হচ্ছে এমন এক নীরবতা,—তাকে ভাষায় ধারণ করা সম্ভব নয়। ভাষা এখানে ইন্দ্রিয়াতীত ও যুক্তির অতীত রহসময়তায় গুম হয়ে আছে। সুতরাং কিছু সত্য এমনভাবে আমাদের সামনে আসতে পারে, যার ব্যাপারে নীরবতা সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। কারণ,—ভাষা, যুক্তি, গণিতের কিছু দিয়ে এই সত্যকে প্রমাণ করা কঠিন।
ফেরত আসি টাইম লুপের মামলায়। সময়ফাঁদের পুনরাবৃত্তিও এরকম একখান ঘটনা। তাত্ত্বিকভাবে এর সম্ভাব্যতা যদি থাকেও, বাস্তবে একে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং ১৯৪১-এর সঙ্গে ২০২৫-এর সাদৃশ্য থাকলেও তারা প্রথমত হুবহু এক নয়। দ্বিতীয়ত, কিছুটা কাকতালীয়। এবং, তৃতীয়ত, মার্ক টোয়েনের কথাই সঠিক,—ইতিহাস পুনরাবৃত্তি করে না, তবে তার মধ্যে ছন্দবদ্ধ চলন দেখা যায়।
অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কিছু প্রবণতা হয়তো ফিরে-ফিরে দেখা দেয়, মানুষ যাকে পুনরাবৃত্তি বলে ধরে নেয়;—এই যেমন,—ফ্যাসিবাদ, একচ্ছত্রবাদ, স্বৈরাচারী পীড়ন, প্রসাদ ষড়যন্ত্র ও গণহত্যা কিংবা মিডিয়ায় ছড়ানো গুজব ও একে ব্যবহার করে মিথ্যে পয়দার রাজনীতি ইত্যাদি।
হীরক রাজার দেশে ছবিটি এ-কারণে চির-অমলিন থেকে যাবে। কারণ, সত্যজিতের ছবিতে চিত্রিত প্রবণতাগুলো সময়ের সঙ্গে বারবার ফেরত আসতে দেখছি আমরা। দড়ি ধরে মারো টান/ রাজা হবে খানখান;—অত্যাচারী হয়ে ওঠা হীরক রাজা ও তাকে গদি থেকে বিতাড়নে একজোট প্রজা,—দৃশ্যটির পুনরাবৃত্তি বারবার ঘটেছে; এখন ও আগামীতে ঘটতেই থাকবে। সময় নয়, তবে প্রবণতা ফেরত আসছে এখানে।

মানুষের মন অগণিত ঘটনার মাঝে মিল খুঁজতে অভ্যস্ত। এর ফলে ইতিহাসের পাতায় মুদ্রিত ঘটনার সঙ্গে বর্তমানে সংঘটিত ঘটনার মিল দেখতে পেয়ে ভাবে ১৯৪১ সন বুঝি ফেরত এসেছে ২০২৫-এ! সময়ফাঁদে ফেঁসে গেছে বলে নিজেকে তারা ভাবে। বাস্তবে টাইম লুপ বলে কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণ করা শক্ত। তবে হ্যাঁ, সময়চক্র বা টাইম সাইকলের কথা আমরা বলতে পারি, যার মধ্যে জন্ম, মৃত্যু, ক্ষয় ও জায়মান হওয়ার ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে। টি. এস এলিয়ট তাঁর ফোর কোয়ার্টটেস-এর কবিতা চতুষ্টয়, বিশেষ করে ড্রাই স্যালভেজে বিষয়টি নিয়ে চমৎকার ভেবেছিলেন। যেখানে কবি বলছেন : time the destroyer is time the preserver. সময় সংহার করে, এবং সময়দেহে সংহারের অবশেষ সংরক্ষিত থাকে;—যেখান থেকে পুনরায় নতুনের জন্ম অনিবার্য হয়।
সময়ের এক-একটি চক্রে এভাবে সৃষ্টি ও লয়ের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়তা ঘটতে দেখি আমরা। সেখান থেকে পুনরায় জন্ম নেয় নতুন সময়চক্র। এর গতি থামতে পারে, যদি আমরা হয়ে পড়ি বরফস্তব্ধ! যেখানে সময় ছাড়া আর কিছু নয় প্রবাহিত। মশহুর গীতকবি জাভেদ আখতার তার ওক্ত কবিতায় রূপকটিকে চমৎকার ধারণ করেছিলেন।
চলমান যানবাহনের স্রোতে গাড়ির মধ্যে বসে কবি ভাবছেন,—আচ্ছা এমন কি হতে পারে না, রাস্তায় চলমান গাড়ির সারি থেকে আরম্ভ করে যা-কিছু গতিশীল,—তারা সবাই কাতারে কাতার ঠাঁয় দাঁড়িয়ে পড়েছে, এবং এভাবে গত হচ্ছে,—ওক্ত ওরফে সময় কেবল বয়ে চলেছে নিরন্তর!
কবির এই কাল্পনিকতা এখানে এলিয়টের প্রতিধ্বনিকে পুনরায় জীবিত করায়,—সময় হলো ফাঁদ! তাকে বাদ দিয়ে প্রাণবান জগতের বহমানতা অনুভব করতে মানুষ পারে না। সুতরাং, সময়কে দেখা না গেলেও তাকে আমরা দেখি। ভেবে নিতে বাধ্যও হই,—আমরা তার মধ্যে যাওয়া-আসা করছি, আর সময়স্রোতে ভেসে চলেছি নিরন্তর!
. . .
. . .



