গানালেখ্য - পোস্ট শোকেস

গানালেখ্য : ঝিঙ্গা ফুল

Reading time 4 minute
5
(37)

ঝিঙ্গা ফুল
(সেইসব পাতি তোলা চা-শ্রমিকদের জন্য এই গান, যারা আজো তনখার জন্য লড়াই করছেন। যাদেরকে আমরা ঝুমুর আর ধামাসা মাদলে বড়ো বেশি নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। যাদের জীবন আজো সাঁঝে ফোটা ঝিঙ্গা ফুলের মতো রাত পোহালে ঝরে যায়, এবং যারা এখনো অচিহ্নিত ঝরে যাওয়া ফুল,—তাদের জন্য থার্ড লেন স্পেস-এর পক্ষ থেকে এই সামান্য নিবেদন।)
. . .

Jhingha Phul by Ahmed Minhaj, Version-1 in collaboration with AI; @thirdlanespace.com

সাঁঝে ফুটিল ঝিঙ্গা ফুল রে
ঝিঙ্গা ফুল নিলো জাতিকুল।

মনে বড়ো আশা ছিল
পাতি তোলা কাম লিবো
সায়েব দিলো
কোদাল মারার কাম রে…
ঝিঙ্গা ফুল নিলো জাতিকুল

সায়েব মোরে ইনাম দিবে
দুটি পাতি একটা কুঁড়ি
তুলি লিবো যতন করি
টিলা বাবু হিসাব লিবে
তনখা দিবে টুকুরি মেপে
মাথার ঘাম পায়ে ফেলিব
মনে বড়ো আশা ছিল…

ঝিঙ্গা ফুল ফুইটেছে সাঁঝে
রসিক নাগর ফুইটেছে মনে

পাতি তুলি টুকুরি ভরিব
সাঁঝবিহানে সায়েব দিলো
কোদাল মারার কাম রে
কোদাল মারার কাম…

ঝিঙ্গা ফুল নিলো জাতিকুল…
. . .

Jhingha Phul: Tea Garden Song; Version-2 by thirdlanespace: in collaboration with AI; @thirdlanespace.com
Jhinga Phul; Image Source – Collected; Google Image

সংযুক্তি : গান-রচনার ইতিবৃত্ত ও ঋণস্বীকার

হেমন্ত দিনের এক শেষ বিকেলে বাড়ির পাশে চা বাগানের টিলায় বসেছিলাম এম্নি। সেদিন সম্ভবত কোনো পরব ছিল বাগানে। কানে ভেসে আসছিল গৎবাঁধা বাংলা আর হিন্দি গানের আওয়াজ। সচরাচর যেমনটি হয়ে থাকে আজকাল,—পুজো-পরব ইত্যাদি এলে বাগানে প্যান্ডেল পড়ে, আর কান ঝালাপালা হয় ডিজে গানের হুল্লোড়ে। সেদিনও তাই চলছিল। নির্জনতা দুর্লভ সবখানে! চা বাগানগুলোও ব্যতিক্রম নয় এখন।

বাগানের গভীর থেকে গভীরে ঢুকলে কেবল সুধীর নির্জনতা মিলে অনেকখানি। তখন মনে হয়,—দেশের ভিতরে পৃথক দেশ হয়ে থাকার যে-খ্যাতি ও মহিমা চা বাগানকে সুরক্ষিত, প্রাকৃতিক রেখেছে,—তার স্বাদ বুঝি মিলছে। আমি বসেছিলাম বাগানের মধ্যবর্তী জায়গায়;—নাতিদীর্ঘ টিলার চূড়ায়। মাথার ওপর ছায়া দিচ্ছে ঋজু বৃক্ষ, যার নাম অজানা। বাগানে আগে শিশু গাছের বাড়বাড়ন্ত দেখেছি, এখন ছায়া দিতে নানা প্রজাতির গাছ লাগায়। চিনিও না তার সবটা।

যাইহোক, হুল্লোড়ের মধ্যে কানে আচমকা ভেসে এলো ঝুমুর গানের কলি। ক বালিকাকণ্ঠে ভেসে আসছিল ঝিঙ্গা ফুলকে উপলক্ষ্য করে বলা বাগানিদের মর্মকথা। বাগানি মহলায় ঝিঙ্গা ফুল গানের পরিচিত উপলক্ষ্য। সন্ধ্যায় ফোটেন। বালিকাকণ্ঠ এরকম একখানা গান গাইছিল বেশ।

মনে তখন উদয় হলো নব্বইয়ের মধ্য বা শেষ দিককার একখানা ঘটনা। কর্মসূত্রে থাকি মৌলভীবাজার। বাসে করে রোজ যাওয়া-আসা শ্রীমঙ্গল। সেখানে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে ঘটে পরিচয়। স্মৃতি বড়ো প্রতারক! তার নামধাম কিসসু মনে পড়ছে না এখন! ভদ্রলোক ঘুরতে ভালোবাসেন। আর ভালোবাসেন শুনতে গান। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য ধ্রুপদি সংগীতের সমঝদার শ্রোতা ছিলেন। তার বৈঠকখানায় বসে প্রথম শুনেছিলাম বিথোভেনের সপ্তম ও নবম সিম্ফনি।

ভদ্রলোকের সঙ্গে সপ্তাহে এক-দুদিন করে বিকেলবেলায় চা বাগানে ঘুরি। মাঝেমধ্যে ছুটির দিন পুরোটা কাটে বাগানিয়াদের সঙ্গে। রাবার বাগানের টিলায় বসে দেখি হংসবলাকা মালার মতো আকাশে উড়ছে। একদিন ঝুমুর গানের প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ হচ্ছিল বাগানি টিলায় বসে। শীত তখন বিদায় নেওয়ার পথে। রাবার গাছগুলো ততদিনে ন্যাড়া পুরোপুরি। পুনরায় সবুজ হওয়ার অপেক্ষায় প্রথম বৃষ্টির ক্ষণ গুনছে। এটাসেটা কথার মাঝে ঝুমুর গানের প্রসঙ্গ তুললেন ভদ্রলোক। এখানে যে-গান পেশ করা গেল, তার মর্মকাহন প্রথমত তার মুখে শোনা।

Tea Leaf Plucking; Image Source – Collected; Google Image

বাগানে ঘুরতে যেয়ে কোনো এক পরবদিনে ঝুমুরিয়া টানে তিনি শুনেছিলেন সে-কাহিনি। এক বাগানি কুলি-কামিনির মনের বেদন। ঝিঙ্গা ফুল ফুটেছে সাঁঝবেলায়। কামিনী যাবে মরদ-সাক্ষাতে। তখন তার মনে এই খেদ উতলে উঠছে,—চা শ্রমিকের জীবনে শ্রেষ্ঠ সম্মান হলো হাতের আঙুলে ঝুরিবোঝাই পাতা তোলার সুনিপুণ কর্মটি, যেটি তার নিজের নেই আর! এর জন্যই তো ইংরেজ সায়েবরা সেই কবে দূর-দূরান্ত থেকে তাদেরকে এই ভিনদেশে নিয়ে এলো। তাদেরকে দিয়ে জঙ্গল সফা করে গড়ে তুলেছিল চা আবাদের মাটি। সময়টানে নির্দিষ্ট হয়েছিল কাজের ধারাও। চা পাতা তোলার সুনিপুণ শিল্পটির জন্ম তখন।

দুখভরা জীবনে পাতা তোলার কাম যেন নেশা! কিন্তু তা আর থাকছে কোথায়! একশো কাজে তাদেরকে লাগায় বাগান বাবু আর ম্যানেজার। তনখা সামান্য। রেশন পর্যাপ্ত নয় আজো। আছে অনাদর অবহেলা আর বঞ্চনা। এখন সে কোনমুখে মরদকে বলবে, তুমি বাপু পাতি তোলা এক শিল্পীকে বিহা করতে যাচ্ছো। যতনে যদি রাখতে পারো, তবে সে বিয়া বইবে।

কাহিনির সঙ্গে গানের প্রথম দুটি কলি মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। বাকিটা মনে থাকেনি। ভদ্রলোক যে-গানটি সেদিন শুনিয়েছিলেন, সেটি পরে গাইতে দেখিনি কাউকে। খোঁজ করেও পাইনি কে বা কারা ঝুমুরিয়া টানে গানটি গেয়েছিল একসময়। উলটোরথের মানুষ উপন্যাসটি লেখার সময় গানটিকে নিজের অনুভবে কয়েকছত্র লিখেছিলাম। আজ অবশেষে তা পূর্ণতা পেল।

সেইসময় এসে সংগৃহীত কাহিনির ওপর ঠেকনা দিয়ে গানটি বাঁধছি, যখন চা বাগানের সংস্কৃতি পালটাচ্ছে। বাগানগুলো এখন বাঙালি শ্রমিকে ঠাসা। বাগানি কুলিদের কাছে তারা এক নতুন জাত। তারাও এখন মাটি কাটে, গাছ কাটে, গরু-ছাগল পালে, এবং পাতাও তোলে। বাড়ির পাশে যেহেতু চা বাগান, ঘটনাটি চোখে পড়ছে হয়ে গেল অনেকদিন। গানটির মধ্যে ওই পরিবর্তনের আভাস থাকছে।

এআইকে দিয়ে শতভাগ ঝুমুরিয়া টানে গানটি করানো মুশকিলের কাজ। অ্যালগরিদম ওইমাত্রায় পৌঁছায়নি এখনো। নিখাদ ঝুমুর উদ্দেশ্যও নয় বটে। সুতরাং একখানা মিশ্র পদ্ধতি বেছে নিয়েছি এখানে। ঝুমুরের স্বকীয় আরণ্যিকতায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের রাগ-রাগিনী আর ভাটিয়াল টানের নীরব প্রবাহন কান পাতলে মিলবে। এই দিকটা মাথায় রেখে তিনটি সংস্করণ এখানে সংযুক্ত করছি। সংগীত-আয়োজনে আরবানফিল রেখেছি অনেকটা, কারণ, আমি নিজে শহুরে, তা যতই ঘুরিফিরি বাগানে।

কতটা কী হয়েছে, আদৌ কিছু হয়েছে কি-না,—আমি নিশ্চিত নই। তবে, এটুকু বলাই যায়, এআই ক্রমশ পরিপক্ক হচ্ছে। এই ছাদের গান তাকে দিয়ে করানো কিছুদিন আগেও অকল্পনীয় মনে হতো! এখন অনেকটাই পারা যাচ্ছে। সামনে আরো ভালোভাবে পারা যাবে, এ-কথা অন্তত বলা যেতে পারে নিশ্চিন্তে। গানের এই সংগীত-আয়োজনে ভুলচুক নিশ্চয় ঘটেছে। দায় এখানে এআই-র নয়;—নিনান্তই আমার অসীম মূর্খতা ও অজ্ঞতা দোষে তা ঘটেছে।
. . .
—আহমদ মিনহাজ : অবদায়ক : থার্ড লেন স্পেস.কম

Jhingha Phul by Ahmed Minhaj, Version-2 in collaboration with AI; @thirdlanespace.com
Plucking Tea leaves; Image Source – Collected; Google Image

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 37

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *