কবিতা সিরিজ : জীবনানন্দ, তোমাকে ভেবে
(নিরীক্ষা ও বিনির্মাণে জীবনানন্দ দাশের অন্ধকার)
রচনা : হেলাল চৌধুরী

খেজুরের গা
কুয়াশায় ঘেমে গেছে পাতা চিরল চিকন আঙুল
তার
অঙ্গে অঙ্গে
ভার;
হৃদয়ে শুয়ে আছে — ভোরের শিশিরের জলফুল
রাইকিশোরীর ভাঁড়;
ঋতুবতী শুয়ে শীতের রাত
ঠোঁটে ও শরীরে
তার
মাঘীর অশ্রুবিন্দু
চুয়ে চুয়ে ঘামছে
উপত্যকা তার
খেজুরের শরীরে ঋতুর ক্বাথ;
শীতের হাড়
দিঘির পাড়
কামিনীর ঘাড়
কষ্টনীল প্রগাঢ় ঘামে ভার
আজ মালভূমি তার
যেন
দ্বাদকিশোরী সে
উন্দালে যার উপচে পড়ে — গা ভরে ডেগচির মাড়;
তার
দক্ষিণ ঘাড়ে নিশ্চুপ
একাকিনী দাঁড়কাক
চোখে তার
দেখার
হাওর
কবেকার আহ্লাদ, বুঝি হলুদ রোদের বায়োস্কোপ।
. . .
সরোজিনী নাইডু হয়ে জাগো
আমি যেন জীবনানন্দ
আবারও এসেছি তোমাদের নবান্নের মাঠে
কার্তিকের কাক হয়ে;
দেখি, সবুজ ঘাসে হেমন্তের মরা নদী কাঁদে!
এখানে বারবার নেমে আসে অশোকের ধূসর জগৎ
অশোকের সে-ধূসর — এ জগতে
ইলা তুমি জাগো, সরোজিনী নাইডু হয়ে জাগো…
জীবনানন্দ
এখানে তোমার পথ হাঁটা এখনও অশেষ
এখনও তোমার পেঁচারা
হামাগুড়ি দিয়ে নামে তিমির উদরের ঘন অন্ধকারে
দলে দলে পিরামিড মানুষেরা হাঁটে
কালো কালো আলখাল্লা পরে
কাঁদে তোমার শেফালিকা বোস দুপুরের মাঠে!
এখানে বারবার নেমে আসে অশোকের ধূসর জগৎ
অশোকের সে-ধূসর — এ জগতে
ইলা তুমি জাগো, সরোজিনী নাইডু হয়ে জাগো…
. . .
তোমার নীলিমাকে
তোমার কাকের বিশীর্ণ অক্ষিগোলক
তার ভোরের নদীতে শুয়ে আছে
তবু আজও দুপুরের রৌদ্রে আমার চোখে বায়োস্কোপ
কোনও-এক প্রভাতের বিস্তীর্ণতায়
তোমার নীলিমাকে তাই আমারও প্রিয় অভিভাবিকা মনে হয়…
বাতাসে তোমার কোনও প্ররোচনা নয়
প্রতিজ্ঞার আরও-এক নতুন বিস্ময়
তার, আমার হৃদয় উচ্ছল আরও-এক স্থির শুভ্র অবসর তখন
কোনও-এক প্রভাতের বিস্তীর্ণতায়
তোমার নীলিমাকে তাই আমারও প্রিয় অভিভাবিকা মনে হয়…
তোমার চোয়ালের মাংস ক্ষীণ দেখে
স্ফীত করে তুলেছি চুমুয় চুমুয় জলের যুগল ঢেউ
তোমার বেরিলমণির কাছে তার মিরুজিন নদীর একলা বুক
কোনও-এক প্রভাতের বিস্তীর্ণতায়
তোমার নীলিমাকে তাই আমারও প্রিয় অভিভাবিকা মনে হয়।
. . .

তোমার কার্তিকের কাক
ধানের ছড়ার পাশে আজ শেয়ালেরা উদগ্রীব
কার্তিকের মাঠে ধানসিঁড়ি জলে দুঃসহ বান
যখন সন্ধ্যার কাক আকাশের মেঘে নিশ্চুপ
তখন তোমার কার্তিকের কাক জোছনার তরে হায় চিল
হায় চিল বুঝি আজও সবুজ ঘাসের দেশ দারুচিনি দ্বীপ…
তোমার হলুদ নদীর জলে চিতার চোখ জ্বলে
হোগলায়-মাঠের ভিতর অজস্র লাশের স্তূপ
যখন মনিয়ার ঘরে রাত শীতের শিশিরের জল খোঁজে
তখন তোমার কার্তিকের কাক জোছনার তরে হায় চিল
হায় চিল বুঝি আজও সবুজ ঘাসের দেশ দারুচিনি দ্বীপ…
মাঝরাতে কালো কালো নক্ষত্র দোলে বাবলার ডালে
তারা কুড়ি কুড়ি বছর করে গেছে পার, তবু
যখন হামাগুড়ি দিয়ে নামে তোমার অজস্র বুনোহাঁস
তখন তোমার কার্তিকের কাক জোছনার তরে হায় চিল
হায় চিল বুঝি আজও সবুজ ঘাসের দেশ দারুচিনি দ্বীপ…
. . .
আজও তারা যেন তোমার শেয়ালেরা
এখানে — এখনও দলে দলে
হাঁটে, হাঁটে কালো কালো আলখাল্লা হাঁটে
হাঁটে পিরামিড-মানুষেরা হাঁটে
হাঁটে তারা আজ দুপুরের মাঠে;
তোমার যেই সব শেয়ালেরা একদিন হাঁটিত অন্ধকারে
আজ তারা হাঁটে ভোরের আলোর ভেতর দাপটে…
রাতে — অন্ধকারে নয়
তারা নেমে আসে আজ ভোরের আলোয়
নেমে আসে তারা আলো ভালোবেসে নয়
ভালোবেসে কালো কালো কবেকার বিবরের বিস্ময়!
তোমার যেই সব শেয়ালেরা একদিন হাঁটিত অন্ধকারে
আজ তারা হাঁটে ভোরের আলোর ভেতর দাপটে…
আজও তোমার বরফের রাশি
তোমারই জ্যোৎস্নায় শুয়ে — যেন যূথচারী নারী
শুয়ে আছে সেই সব হৃদযন্ত্র স্নায়ুর আঁধারে
এখানে তাই বারবার তোমার নিরভিসন্ধি কেঁপে ওঠে;
তোমার যেই সব শেয়ালেরা একদিন হাঁটিত অন্ধকারে
আজ তারা হাঁটে ভোরের আলোর ভেতর দাপটে…
. . .

পাঠ-সংযুক্তি : নেটালাপ
থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে সংকলিত

জীবনানন্দের কবিতাকে ব্যবহার করে আপনার নিরীক্ষা-যাত্রা কি শেষের দিকে হেলাল ভাই? গ্রুপে এ-নিয়ে কয়েকদফা আলাপ আমরা করেছিলাম। তার একাংশ আপনার কবিতাসহ সাইটের ‘নেটালাপ’ বিভাগে তুলেছিও। আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন তা। আলাপের আরো একটি অংশ এখনো তুলিনি। সামনে তুলতে পারব আশা করি। গ্রুপে কবিতাসহ অন্যান্য লেখাপত্র দিয়েন নিয়মিত, এতে আমাদের খানিকটা সুবিধে হয়।
. . .

জীবনানন্দকে সরাসরি ব্যবহার করে এই সময়ে সংগোপন অন্ধকার ও তা অতিক্রমের প্রেরণা কবিতায় ধারণের নিরীক্ষা পাঠকের কাছে বোধগম্য করে তোলা আপনার জন্য বড়ো চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে হেলাল ভাই। বই আকারে কবিতাগুলো যদি বের করেন, সেক্ষেত্রে আপনার নিজস্ব একখান ব্যাখ্যা বোধহয় পরিশিষ্টে সংযুক্ত করা অন্তিম হয়ে দাঁড়াবে। অন্যথায় প্রথম-পাঠে পাঠক ভাবতে পারে,—আপনি জীবনানন্দ দাশের স্বকীয়তাকে ডিরেক্ট কপি করছেন এখানে। গ্রুপে এর আগে যে-কবিতাগুলো দিয়েছেন, তার সঙ্গে তুলনায় যদি যাই, তাহলে সাম্প্রতিক দুটি কবিতায় জীবনানন্দ অধিক মাত্রায় তীব্র, এবং সে-কারণে চ্যালেঞ্জ বাড়ছে আপনার;—পাঠকের কাছে জীবনানন্দের স্বর যে-এখানে বিশেষেভাবে বিনির্মিত,—সেটি প্রতিষ্ঠিত করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে সামনে।
. . .

ঠিক ধরেছ। পাঠকের জায়গা থেকে তোমার পাঠ-প্রতিক্রিয়াটি আমার ভালো লেগেছে। বই প্রকাশের সময় পরামর্শটি আমলে নেব।
. . .

কবিতাগুলো একে-একে গ্রুপে দিতে থাকেন হেলাল ভাই। এগুলো নিয়ে প্রাথমিক আলাপ নিরীক্ষা ও বিনির্মাণে জীবনানন্দ দাশের অন্ধকার শিরোনামে দুই পর্বে সাইটে তুলেছি আমরা। তৃতীয়টি সামনে আসছে। আর এখন যেগুলো দিচ্ছেন, সেগুলোকে ওই তৃতীয় পর্বে সংযুক্তি হিসেবে সন্নিবেশিত করব। বই যখন বেরুবে, ইচ্ছে করলে এসব আলাপাচারিতার বাছাই অংশ আপনি পরিশিষ্টে যুক্ত করতে পারবেন। তাতে করে পাঠকের ধরতে সুবিধে হবে আপনার নিরীক্ষাযাত্রার ইতিবৃত্ত। বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে।
এসব কাজ আসলে ছোটকাগজের করার কথা ছিল। নিরীক্ষাকে সে ধারণ করবে। ব্যতিক্রম, সাহসী ও তর্কালাপের পরিসর তৈরি করছে এমনসব কাজ খুঁজে নেবে।দুঃজনকভাবে বাংলাদেশের ছোটকাগজে প্রবণতাটি সবল নয়। আর, এখন তো ছোটকাগজ স্বয়ং নিজেকে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলছে বেজায়। যাইহোক, থার্ড লেন স্পেস নিখাদ সাহিত্যের জন্য নিবেদিত কোনো সাইট নয়। সেই উদ্দেশ্য থেকে আমরা এটি চালুও করিনি, তবে এই ধরনের কাজগুলো সাগ্রহে তুলে রাখি, যদি পাই।
. . .

নিরীক্ষা ও বিনির্মাণে জীবনানন্দ দাশের অন্ধকার-৩
নিরীক্ষা ও বিনির্মাণে জীবনানন্দ দাশের অন্ধকার-২
নিরীক্ষা ও বিনির্মাণে জীবনানন্দ দাশের অন্ধকার-১
. . .

লেখক পরিচিত : হেলাল চৌধুরী :
ওপরের ছবি অথবা এই লিংক চাপুন
. . .


