আসুন ভাবি

দগ্ধ সমাজে বুয়িং-চুল হান-৩

Reading time 4 minute

স্বচ্ছতার সংস্কৃতি ও দগ্ধ সমাজ
বুয়িং-চুল হান-এর (Byung-Chul Han) দর্শন : তৃতীয় পর্ব

Leave me alone; Image Source – Google Image

বুয়িং-চুল হানের রচনা পাঠ করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন,—তাঁর চিন্তাশৈলীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিমানুষের সন্ধান, স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন, দূরত্ব ও নীরবতার প্রতি আকর্ষণ, সৌন্দর্যের প্রতি অন্তর্মুখী সংবেদনশীল অনুভব, আর ভাবনায় গভীর হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শূন্যতার অনুসন্ধানে তাঁকে আমরা নিমগ্ন দেখতে পাই। থার্ড লেন স্পেস-এ প্রকাশিত প্রথমদ্বিতীয় পর্বে আমরা দেখেছি আত্মশোষণ ও ক্লান্তির সংস্কৃতি ব্যক্তি মানুষকে কেমন করে ধীরে-ধীরে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ‘স্বচ্ছতা’ নামক নৈতিক চাপে ব্যক্তি তার গভীরতা, রহস্য ও আত্মমর্যাদা যেখানে হারাতে বসেছে।

গভীরতার এই অবক্ষয় ও মর্যাদার পতনকে বুয়িং-চুল হান গতিশীল সমাজের পরিণতি হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। তাঁর ভাষায়,—মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্য আমরা হারিয়ে ফেলছি। আমরা সবসময় ব্যস্ত, অথচ কাজের কাজ কিছু করছি না। আমরা সব জানি, কিন্তু কোনোকিছু উপলব্ধির ক্ষমতা যেন নেই! সামনের দিকে ছুটছি ঠিকই, কিন্তু কোথাও আসলে পৌঁছাতে পারছি না!

অতীতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সুস্পষ্ট পার্থক্য ও সীমারেখা মানুষ মেনে চলেছে। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়কে সে সর্বসমক্ষে নগ্ন করেনি। বর্তমান সমাজ মানুষের এই ব্যক্তিগত পরিসরকে ধ্বংস করছে দ্রুত। এখন বরং ধরে নেওয়া হয়,—উন্মুক্ত নয় এমন বিষয়কে সন্দেহের চোখে দেখা উচিত। যেটি গোপন করা হচ্ছে সেটি হয় মিথ্যে অথবা সমাজের জন্য বিপজ্জনক। এই মনোভাবে পতিত মানুষ নিজের ব্যক্তিগত পরিসরকে উন্মুক্ত করতে যে-কারণে আর দ্বিধান্বিত নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত শোবার ঘর থেকে আরম্ভ করে দাম্পত্য খুঁটিনাটি অবলীলায় পর্দায় তুলে ধরছে তারা। সবটাই সেখানে দৃশ্যমান;—এবং আড়াল সম্পূর্ণ অবলুপ্ত। কী গোপন করা শোভন আর কী নয়, তার সীমারেখা বিষয়ে মানুষের সহজাত কাণ্ডজ্ঞান লোপ পাচ্ছে দিনদিন!

সমাজে নতুন এক প্রবণতা জন্ম নিয়েছে এর ফলে। বুয়িং-চুল হান একে ‘ঘনিষ্ঠতার সমাজ’ (The Society of Intimacy) নামে ব্যাখ্যা করছেন। ঘনিষ্ঠতার সমাজ ধরে নিচ্ছে ‘সত্যিকারের সম্পর্ক মানে হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত সম্পর্ক।’ সমাজে ব্যক্তিগত অনুভূতিকে ফাঁস করে দেওয়ার প্রথাকে এভাবে বাধ্যতামূলক করে তোলা হয়েছে। ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি ও মানব-সম্পর্কের স্পর্শকাতর দিক সমূহ খোলামেলা তোলে ধরাকে স্মার্ট মানুষের লক্ষণ গণ্য করা হচ্ছে যেখানে। ডিজিটাল যুগে মানব-সমাজের প্রবেশ প্রবণতাটিকে আরো ত্বরান্বিত করে তুলেছে। গোপনীয়তা ও ব্যক্তিগত পরিসরের ধারণা বিলুপ্ত হওয়ায় মানব-সমাজে গোপনীয়তার প্রকৃত সৌন্দর্য অতীতে যেটুকু ছিল, এখন এর পুরোটাই দ্রুত ধ্বংস হচ্ছে।

How about another joke, Murray? – Joker Movie Scene by Todd Phillips; Source – Flashback FM YTC

বুয়িং-চুল হানের মতে এই বিলুপ্তি ‘স্বীকারোক্তিমূলক সমাজ’কে (confessional society) জন্ম দিয়েছে। আমাদের অনুভূতি, ব্যক্তিগত চিন্তা ও সম্পর্কের সকল খুঁটিনাটি প্রকাশ করার পন্থাটিকে মানুষ তার নিজেকে ভারমুক্ত করার উপায় হিসেবে ভাবে এখন! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন এক নতুন ধর্মমঞ্চ। নিজের ‘পাপ‘, ‘আনন্দ’, ‘অভিজ্ঞতা’র সবটাই যেখানে খোলাখুলি ঝেড়ে দিচ্ছে মানুষ।

ঘনিষ্ঠতার সমাজ কেবল ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাজনীতিতেও হানা দিয়েছে। অতীতে রাজনীতি ছিল কৌশল ও কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচায়ক। দূরদর্শিতা ও পরিকল্পনার প্রচণ্ড গুরুত্ব ছিল সেখানে। নতুন যুগবিশ্বে রাজনীতির মধ্যেও ‘ঘনিষ্ঠতার দর্শন’ ঢুকে পড়েছে। নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে রাজনীতিবিদ জনসমক্ষে হাজির করতে বাধ্য হচ্ছেন। উন্মুক্ত পরিসরে তাকেও এখন নিজের আবেগ প্রকাশ ও ব্যক্তিগত অভিমত প্রদান করতে হয়। ব্যক্তিগত অনুভূতির ভিত্তিতে মানুষ বিচার করছে তার সক্ষমতা। এতে করে রাজনীতির ময়দান ব্যক্তিগত নাটকে পরিণত হয়েছে। ‘ঘনিষ্ঠতার সমাজ’-এ রাজনীতি যেন ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারির মঞ্চ ছাড়া কিছু নয় আর!’

অতীতে মানুষ একটি সামাজিক আড়াল বজায় রাখত। আড়ালটি তার ব্যক্তিত্বকে শৃঙ্খলায় রাখতে সাহায্য করেছে তখন। ঘনিষ্ঠতার সমাজ ব্যক্তিত্বের এই ‘মুখোশটি’ সরিয়ে ফেলতে উদ্যত। মানুষকে সে বলে,—‘তুমি যেমন, ঠিক সেভাবে নিজেকে প্রকাশ করো। কোনোকিছু লুকিয়ো না।’ লুকিয়ে না রাখার চাপ বিপরীত দিক থেকে ভাবলে, মানুষকে ক্রমাগত অসহিষ্ণু করে তুলছে। ব্যক্তিগত পরিসরকে জীবন থেকে হাওয়া করে দিচ্ছে সে। নিজের কর্ম তো আছেই, তার পাশাপাশি একান্ত গোপন অনুভূতি ও চিন্তা সকলের সামনে আনার নৈতিক চাপ ও বাধ্যবাধ্যকতায় নিজেকে অবিরত জখম করে সে।

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপকে পর্যবেক্ষণে রাখে। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, ক্যামেরা,—সবকিছু তার গতিবিধি অনুসরণ ও লিপিবদ্ধ রাখায় নিয়োজিত। মানুষ এখন ‘ডিজিটাল প্যানোপটিকন’ (Digital Panopticon)-এ বসবাস করে। নিজেও জানে না,—তাকে সেখানে কারা, কখন ও কীভাবে নজরে রাখছে। নজরদারির ভয় তাকে তাড়া করে বেড়ায়! ওই ভয় থেকে স্বেচ্ছায় তার আচরণ পালটে নিচ্ছে সে। নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখার অভ্যাস তার মধ্যে তীব্র হতে দেখছি আমরা। এই মানুষকে সুতরাং স্বেচ্ছা-শৃঙ্খলিত বলা যেতেই পারে।

Important Things – Good Morning Movie Scene by Yasujirō Ozu; Source – jon YTC

আধুনিক নিয়ন্ত্রিত সমাজ স্বতন্ত্র প্যানোপটিকনের আকার ধারণ করছে। জেরেমি বেন্থামের প্যানোপটিকনের বাসিন্দারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছিল;—বর্তমান যুগের বাসিন্দারা সেখানে একে অন্যের সঙ্গে জালবদ্ধ ও হাইপার-সংযোগে আবদ্ধ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে,—আজকের ডিজিটাল প্যানোপটিকনে বাসিন্দারা নিজ থেকে এর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে সক্রিয় অংশ নিয়ে থাকে। তারা নিজেকে প্রদর্শন ও অনাবৃত করে;—এবং এভাবে প্যানোপটিকনে গড়ে ওঠা বাজারে নিজের দেহমনের সবটুকু বাজারজাতও করে তারা! পর্নোগ্রাফি ও প্যানোপটিক যেন-বা পরস্পরের পরিপূরক এখন!

নিয়ন্ত্রণের সমাজ তখন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, যখন মানুষ বাইরের বাধ্যবাধকতার চাপে নয়, বরং অন্তর্জাত এক চাহিদা থেকে নিজেকে প্রদর্শন বা উন্মোচন করে। চাহিদাটি এত প্রবল হয়,—সকল গোপনীয়তা ও ব্যক্তিগত পরিসর খোয়া যাওয়ার ডর-ভয় উপেক্ষা করে তারা নির্লজ্জের মতো নিজেকে প্রকাশ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। গোটা পৃথিবী আজ তাই প্যানোপটিকনে পরিণত হতে চলেছে। ‘বাইরের’ পরিসর বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। প্যানোপটিকন সেখানে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। আর কোনো দেয়াল নেই, যেটি ভেতরকে বাইরের থেকে আলাদা করবে।

গুগল ও সমাজমাধ্যম, নিজেকে যারা স্বাধীনতার ক্ষেত্র হিসেবে তুলে ধরতে মরিয়া,—তারাও কার্যত প্যানোপটিকনে রূপ নিয়েছে। নজরদারি সেখানে পুরনো কায়দায় কাজ করে না,—যে-কায়দায় অতীতে সরকারি গুপ্তচর বা রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োজিত এজেন্ট নাগরিকের গতিবিধির ওপর নানা নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ ঘটাত। আজকের মানুষ স্বেচ্ছায় প্যানোপটিকনের আওতায় প্রবেশ করছে। নিজ ইচ্ছায় ডিজিটাল প্যানোপটিকনে অংশ নিচ্ছে সে। নিজেকে সেখানে নগ্ন করতে একটুও দ্বিধায় ভুগছে না। ডিজিটাল প্যানোপটিকনে বন্দি মানব যেন-বা একইসঙ্গে অপরাধী ও শিকার। স্বাধীনতার দ্বান্দ্বিকতা আসলে এই সঙ্কটের মধ্যে নিহিত। স্বাধীনতা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ। সামগ্রিক বিষয়টিকে বুয়িং-চুল হান যে-কারণে নিয়ন্ত্রণের সমাজ নামে ব্যাখ্যা করেছেন।

এখান থেকে ঝাঁকের কৈয়ে মানব-সমাজের ভিড়ে যাওয়ার বৈনাশিক প্রবণতাকে তিনি বিবেচনায় নিয়েছেন। তাঁর In the Swarm: Digital Prospects-এ ঝাঁকের কৈ হওয়ার আশু পরিণাম হলো প্রধান আলোচ্য বিষয়। বইটিতে হান দেখিয়েছেন, ডিজিটাল মাধ্যমগুলো মানুষকে কেমন করে বায়বীয় জগতে সক্রিয় ঝাঁকে (swarm) মিশে যেতে বাধ্য করছে। মাধ্যমগুলো সেখানে মানুষের অন্তর্জগৎ, আচরণ, অনুভব, চিন্তা, ও পারস্পরিক সম্পর্ক-যাপনের কাঠামোয় নীরব কিন্তু গভীর রূপান্তর ঘটাচ্ছে, যার ব্যাপারে মানুষ এখনো গভীরভাবে সচতন নয়।

মানুষ এই পরিবর্তনের অংশ হওয়া সত্ত্বেও তা টের পাচ্ছে না। মানব প্রজাতি আজ যে-সঙ্কটের মুখোমুখি সেটি তার অন্ধত্ব ও বোধহীনতার ফলাফল। সাংস্কৃতিক সন্ধিক্ষণে সে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সবকিছু তাৎক্ষণিক, ক্ষণস্থায়ী ও প্রতিক্রিয়াশীল। মানুষের ভবিষ্যৎকে নিয়ে যে-কারণে আশাবাদী হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুয়িং-চুল হান মনে করেন সময়ের সবচেয়ে গভীর সংকট এখানেই নিহিত; আর সেটি হলো,—ভবিষ্যতের অনুপস্থিতি।
. . .

We’ve Never Felt So Alone – Byung-Chul Han Philosophy; Source – Wise Quotes YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 35

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *