এই শহরে একজন বিদিত লাল দাস ছিলেন। ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ খান, প্রণেশ দাশ, পণ্ডিত রামকানাই দাস, সুজেয় শ্যামরা ছিলেন বৈকি! সুবীর নন্দী, আকরামুল ইসলাম, জামাল উদ্দিন হাসান বান্নারা ছিলেন কাছাকাছি,—কাতারে কাতার। সেই শহর এখন গুণী সংগীতকার পায় না খোঁজে! গায়ক অনেক, তা-বলে সুবীর নন্দীরা নয়কো সুলভ। বিদিত লাল দাসরা তো আরোই দুর্লভ! তিনি কেবল গান করতেন না! গান কুড়িয়ে বেড়াতেন। যতন করে নতুন সুর বসাতেন গানে। নিজের গানের দল নিয়ে ঘুরতেন দেশবিদেশ। শহর তথা সমগ্র অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো জনসংস্কৃতির অলিগলি চষে বেড়াতে জানা লোকজন আমাদের এই শহরে ছিল,—এ-কথা কেন জানি এখন বিশ্বাস করতে মন ওঠে না!
সে যাকগে, বিদিত লাল দাসের সুর ও স্বকণ্ঠে গাওয়া কিছু গান অনলাইনে পাচ্ছি অবশ্য। জনপ্রিয় কয়েকটি গান গ্রামোফোন ও ক্যাসেট থেকে ঝন্টু আর্ট প্রোডাকশন ইউটিউবে সংরক্ষণ করেছেন। স্বকণ্ঠে গীত ২৫টি গান একত্রে সংরক্ষণ করেছেন বাংলাদেশ বেতার। জামালউদ্দিন হাসান বান্নার কণ্ঠে কয়েকটি গান যদিও সেখানে ঢুকে বসে আছে! বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ইউটিউব চ্যানেলে কিছু গান পাচ্ছি;—দেশবিখ্যাত শিল্পীরা যেগুলো বিদিত লাল দাসের সুরে একসময় গেয়েছিলেন। বিচ্ছিন্ন অডিও-ভিডিও ফুটেজ আছে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
হেলাল খান নির্মিত ও অভিনীত হাসন রাজাসহ আরো কিছু ছবির গানে সুর দিয়েছিলেন বিদিত লাল দাস, তবে চলচ্চিত্রে মিউজিক করা তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল না। তখনকার যে-পরিবেশ, ইচ্ছে করলে ঢাকায় ঘাঁটি গাড়তে পারতেন। ঢাকাই ছবির স্বর্ণযুগে দেখা দেওয়া মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করা তাঁর জন্য কঠিন ছিল না। সেদিকপানে যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়নি। সিলেট শহরে দিনরজনি পার করেছেন লোকগানের এই ভাণ্ডারি। পারিবারিক জমিদারির ভগ্নাবশেষ পুঁজি করে আমৃত্যু সাংস্কৃতিক তৎপরতায় ছিলেন সক্রিয়।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন, লোকগানের শিল্পী হলেও ছেলেবেলা থেকে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিয়েছিলেন বিদিত লাল দাস। ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ ও প্রণেশ দাশের কাছে তালিম নিয়েছেন তখন। শুনেছি,—পাখোয়াজ দারুণ বাজাতেন। আফসোস, বাদ্যযন্ত্রী বিদিত লাল দাস ও গানে তাঁর সুরদান বিষয়ে বিস্তারিত জানার সুযোগ অপ্রতুল।
তাঁকে নিয়ে উইকিপিডিয়ার পেজটি অবশ্য মন্দ নয়। কারা এটি তৈরি করেছেন জানি না, তবে তথ্যবহুল। এর বাইরে অনলাইনে বিশেষ কিছু চোখে পড়েনি। সিলেট অঞ্চলে গীত লোকগানের ভাণ্ডার তাঁর ও পণ্ডিত রামকানাই দাসের সংগ্রহে থাকবার কথা। জানি না, সেগুলোর কী হালত এখন!
বিদিত লাল দাস, রামকানাই, ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের সঙ্গে বিজড়িত কিছু মনে হয় না কেউ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন আজোবধি। এরকম কোনো মিউজিয়াম শহরে নেই। শিল্পকল্পা ও বাংলা একাডেমিও মনে হয় না এগিয়ে এসেছেন কখনো। সিলেটের আরেক কৃতি সন্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের রূপকার মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী কিছু করে থাকতে পারেন। গান বিষয়ে তাঁর লেখালেখি ও গবেষণা বিবেচনায় রেখে কথাটি বলছি। সিলেট অঞ্চলে ছড়ানো বিচিত্র লোকায়ত সংস্কৃতির তালাশে যিনি ঘোরেন, সেই সুমন কুমার দাশ হয়তো করেছেন। আমার সঠিক জানা নেই।
ছোটকাগজে কেবল সিলেট অঞ্চলের শিল্পীদের নিয়ে সংখ্যা অনায়াস করা যায়। লোকায়ত সংগীতে আপাদশির নিমগ্ন বিদিত লাল দাশ, ওস্তাদি গান ও লোকায়ত গানে সমান কুশলী পণ্ডিত রামকানাই দাস, আর মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীদের মতো গুণী মানুষকে নিয়ে কাজ হওয়া উচিত। হিমাংশু বিশ্বাস, জামাল উদ্দিন হাসান বান্না, ডাক্তার ফজল মাহমুদরা এখনো বেঁচে আছেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপে ওই সময়কার সিলেটের সাংস্কৃতিক তৎপরতার ব্যাপারে ভালো তথ্য পাওয়া সম্ভব।
সমস্যা হলো, আমাদের এখানে সুধীর চক্রবর্তীর মতো মানুষের আকাল ঘটে গেছে। বাউল-ফকিরদের তালাশে অবিরাম বীরভূম, মেদিনীপুর, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ ছাড়াও নানান অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন এই গুণী। বিচিত্র গান, গায়নরীতি ও শিল্পীদের সঙ্গে ছিল চেনাজানা। বিদগ্ধতার সঙ্গে মাটির রসে চোবানো মন ছিল তাঁর। যে-কারণে গভীর নির্জন পথে-র মতো বই লিখতে পেরেছেন অনায়াস। সম্পাদনা করেছেন ছোটকাগজ। আমাদের এখানে এই মান ও উচ্চতার মানুষ এখন নেই। আগে ছিলেন;—এখন সবটাই ধু ধু মরুভূমি।
কালিকাপ্রসাদের মতো গুণী শিল্পী কি আছেন এখন? গৌহাটি, শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির সঙ্গে সিলেটের ঐতিহাসিক বন্ধন শিথিল হওয়াটা এক্ষেত্রে সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসাম অঞ্চলের সঙ্গে সিলেটের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বিগত নব্বইয়ের দশকেও জীবন্ত দেখেছি। এখন তা অতীতের মতো প্রাণবন্ত নয়। সিলেটি সম্প্রদায় সংখ্যায় সেখানেও বিরাট। তাদের শিকড়-বাকড় বাংলাদেশে। সময়টানে সীমান্তের এপার-ওপারে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে জন্ম নিয়েছে দূরত্ব ও অবিশ্বাস। ক্ষতিকর… ভীষণ ক্ষতিকর।
সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিদিত লাল দাসরা একটি ঘরানার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। সত্তর থেকে নব্বই দশক অবধি মহিমায় চির ধরেনি। উক্ত কালপর্বে সিলেটি জনসমাজে অন্য ঘরানার প্রতিপত্তিও কম ছিল না।। সিলেট থেকে দূর কলকাত্তায় পাড়ি জমানো খালেদ চৌধুরী ও হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মশাল বহন করছিলেন দিলওয়ারের মতো কবি, আর ভবতোষ চৌধুরীর মতো শিল্পীগণ। আমাদের এখানে বামপন্থী রাজনীতির সাফল্য যদি বলি, সেটি মূলত সাংস্কৃতিক জাগরণে ফিরে-ফিরে ভাষা পেয়েছে। নির্মলেন্দু গুণ যে-সময়পর্বে দুই হাত খুলে বামমন্ত্রে উজ্জ্বল কবিতাগুলো লিখছিলেন,—কবি দিলওয়ারকে আমরা এরকম লিখতে দেখছি তখন।

রক্তে আমার অনাদি অস্থি/ বিদেশে জানে না কেউ-র মতো পঙক্তি চমকে দেয় বেশ! দিলওয়ারের বামপন্থা অবশ্য নিখাদ পার্টিলাইন মেনে বিকশিত নয়। সময়টানে মরমি আধ্যাত্মচেতনা সেখানে জুড়েছিলেন কবি। সিলেট অঞ্চলে ধর্মীয় প্রথা-আচারের ভূমিকা ও আবেদন শাহজালাল ও তিনশো ষাট আউলিয়াকে কেন্দ্র করে বিচিত্র মোড় নিয়েছে সর্বদা,—উত্তরাধিকার হিসেবে দিলওয়ার তা ঘাড়ে বহন করেছেন অকপট।
এটি আবার কবিপুত্র কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারকে অধিবিদ্যায় সমাহিত হতে প্ররোচনা যুগিয়েছিল। কবিপ্রতিভায় কিশওয়ার (আমার বিবেচনায়) দিলওয়ারের চেয়ে গভীর ছিলেন। সিজোফ্রেনিয়ার দুঃসহ যন্ত্রণা কুরে-কুরে তাঁকে শেষ না করলে, কিশওয়ার হয়তো দিলওয়ারকে ছাড়িয়ে যেতেন পুরোটা। যাইহোক, সে অন্য প্রসঙ্গ। দিলওয়ারের মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বাঁধাই কবিতা একটা সময় গানে রূপ নিতে আমরা দেখেছি। এবং সেখানে উদীচী ও কমিউনিস্ট পার্টির ব্যানারে ভবতোষ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর কেমিস্ট্রি মন্দ ছিল না। ভবতোষ নিজে গান লিখতেন, সুর দিতেন। অন্যদের কবিতা ও গীতিকবিতা সুরে গাইতেন হামেশা। নিখাদ বামপন্থায় ছিল বিশ্বাস। এদিক থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ফেলে যাওয়া লোকায়ত আর্তিকে ধারণ করেছিলেন শিল্পী।
ভবতোষকে আমরা স্বচক্ষে মঞ্চে গাইতে দেখেছি। নিজের গান গাইতেন। প্যারোডি করে গাইতেন অন্যের গান। অতুলপ্রসাদের ধন ধান্যে পুষ্পেভরা, আর বিদিত লাল দাসের সুরে সাধের লাউ গানের প্যারোডি তাঁর কণ্ঠে শুনেছি তখন। প্রিয় জন্মভূমিকে চোরের জন্মভূমি হতে দেখার মর্মান্তিক আক্ষেপ প্যারোডিতে ঠেসে দিয়েছিলেন ভবতোষ।
চল্লিশের উত্তাল দিনগুলো থেকে নব্বইয়ের সন্ধিক্ষণ অবধি গণসংগীতের জোয়ার দুই বাংলায় সুতীব্র থেকেছে। ভবতোষের গায়কি সিলেটকে সেখানে যুক্ত করে নিয়েছিল । সাংস্কৃতিক বোধির জায়গা থেকে যদি ভাবি, তাহলে এতে লাভ ছাড়া ক্ষতি হয়নি কারো। এগুলোই তো সকল উগ্রতা প্রতিহত করার রসদ ছিল তখন। রক্ষণশীল সিলেটের মানুষজন কিন্তু এটি এলাউ করতে দ্বিধা করেননি। আজকে করবেন কি-না তা নিশ্চিত নই আর! সব কুছ বদল গ্যায়া। ভবতোষের উত্তরাধিকার আমরা সঞ্জীব চৌধুরীর মধ্যে ফিরে পাচ্ছি মনে হয়েছিল। সুনামগঞ্জ থেকে উঠে আসা শিল্পীর অকালপ্রয়াণে তা ফানুসের মতো উবে গেল। দলছুটকে সঞ্জীবের মতো করে টানার ক্ষমতা বাপ্পা মজুমদারদের ছিল না, সুতরাং বাতি নিভে যেতে সময় লাগেনি।
এসব কার্যকারণে সিলেট অঞ্চল সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে ফকিরে পরিণত হয়েছে। লোকসমাজের পাশাপাশি শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক শাহরিক সমাজ এই অঞ্চলে একদিন গড়ে উঠেছিল। কালের ধারায় সেখানে ছেদ পড়েছে। ইংরেজ ও পাকিস্তান আমলে বিকশিত শিক্ষিতশ্রেণিতে যারা ছিলেন, আজকে ওই মান ও উচ্চতার বিদগ্ধ মানুষ তন্ন-তন্ন করে খুঁজলেও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আয়ুব শাহীর আমলে রানী এলিজাবেথের উপহার ভাউচার সিলেটকে ক্রমশ বদলে দিলো।
সিলটিদের বিলেত গমন অসাধারণ ঘটনা ছিল, কিন্তু শিক্ষার অবনতি ছিল তারচেয়েও মর্মান্তিক। সেইসঙ্গে দেশের বাদবাকি অঞ্চলের সঙ্গে সিলেটবাসীর চিরাচরিত দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতাকে এটি আরো সুতীব্র করে দিয়েছে। বিলেতমুখী হওয়ার সুবাদে সিলেটের অর্থনীতি বিকশিত হয়েছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব ঠেকানো যায়নি। ওই-যে মড়ক শুরু হলো, আজো তা অব্যাহত বটে!
শহরজুড়ে এখন খাবার দোকানের মচ্ছব ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না। জামাকাপড় আর ঝা চকচক শপিংমলের বাহার সার হচ্ছে কেবল! এগুলো সময়ের অনিবার্যতা, কিন্তু এসবের পাশাপাশি একটি শহরকে চেনাজানার মতো আরো-আরো স্মারক প্রয়োজন হয়;—তার কিছু কি দেখছি এখন?
. . .
. . .




One comment on “মৃত শহরে এক গুণী”