পোস্ট শোকেস - সাহিত্যবাসর

হাওরজীবন-৩ : চেনা গান অচেনা গীতিকার — সজল কান্তি সরকার

Reading time 11 minute
5
(22)
Haorer Mukh by Sajal Kanti Sarker; Image Source – Collected; @thirdlanespace.com

২০১৬ সাল। তাহিরপুরে হাওর উৎসবের আয়োজন করা হয়। লোকগান ও শিল্পীদের অংশগ্রহণ নিশ্চত করার জন্য আমি বিশ্বম্ভরপুর উপজেলাধীন কৌয়া গ্রামে যাই। আমার এক বন্ধুর মাসীর কাছে। তিনি ভালো ধামাইল, পুরাণ ও গীত গাইতে পারেন। কৌয়া গ্রামে গিয়ে জানতে পারি তিনি সপরিবারে জীবিকার তাগিদে সিলেটের হরিপুরে থাকেন। আমি হরিপুর যাই। তার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা। বিশেষ করে গীত নিয়ে। তিনি অনেক গীত গেয়ে শোনান। তাঁর বাবা ছিলেন গীতিকার। একটি পাণ্ডুলিপি তিনি আমাকে দেখান। সারাদিন গীতে-গানে কেটে যায়। একপর্যায়ে ললিতা ও লীলাবালির কথা আলোচনা হয়। ললিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,—আদ্যিকাল্যিয়া গানে ললিতা বেশি আছিন। আমার মনে অয়, এই ললিতা একটা উপলক্ষ। এই নামে কেউ আচিন-টাচিন না। মা-খুড়িরা গান লেক্কিয়া হের নামে চালাইয়া দিচ্ছে।

ধামাইল গান নয়। মাসীমার সাথে গীত নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। ফলে লীলাবালি ও গীত নিয়ে আমার নতুন ভাবনা শুরু হয়। যা নিয়ে শেষের দিকে বিস্তারিত লিখছি। এবার মূল কথায় আসি। ২০১৭ সাল। রাধারমণ নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি হবে। নলুয়া পাড়ের গান। কাজটি করে ৭১ টিভি। আমি ও আমার স্ত্রী তাতে সম্পৃক্ত হই। কতৃপক্ষ আমাকে মূল আলোচনায় রাখেন। পাশাপাশি ধামাইল গানের পরিবেশনাও কিছু তুলে ধরতে হবে। আমি ধামাইল গানের একটি ভালো দলের সন্ধানে নানা জায়গা থেকে শিল্পী সংগ্রহ করতে গিয়ে একপর্যায়ে দীলিপদা’র সহযোগিতায় ছাতকে দুজন ভালো সুরেলা শিল্পীর সন্ধান পাই। ধামাইল গান নিয়ে তাদের সাথে বেশ সংগত হয়। একপর্যায়ে উঠে আসে ললিতার কথা। তখন শিল্পী মনসা সরকার একটি গান গেয়ে শুনান। গানটির প্রথম পদ হলো :

আমি কি করি উপায় গো
বল গো সখি কোথায় শ্যামরায়…

গানটি ‘রনদা’ বান্ধা। অনেক কথার পর জানতে পারি গানটি শিল্পীর (মনসা সরকার) নিজের লেখা। কিন্তু তিনি ‘রনদা’ নামে এই গানটি প্রকাশ করেছেন। তার কারণ বা বিষয়বৃত্তান্ত জানতে চাইলে তিনি বলেন :

মাইনশে হুনল্যে কইবো, কত বড় গাতকী অইয়া গেছে? গান লেখে! এর লাগি রনদার নাম দিছি। এইডাই খালি! কত মাইনশে রাধারমণের নামও দিছে।

আমি শুনলাম কিন্তু অবাক হলাম না। কেননা এ-কথা আমি এর আগে বহুবার বহুজনের কথায় শুনেছি। যাইহোক, এদিকে পাশে বসে থাকা আরেকজন শিল্পী ঠিক তখনই কথা কেড়ে নিয়ে বলেন :

আগে ত অত ধামাইল গান আছিন না। সবেই রাধারমণের গান গাইত। একটা গান আর কত গাওন যায়। নতুন গান পাইত কই? পরে আমিও একদিন একটা গান বান্দি। কিন্তু মাইনশে যদি হুনে আমি বানছি তা-অইলে ত মন্দ কইব্য। কইব্য, জানা নাই হুনা নাই মুর্খ বেডি গান বানরুয়া অইয়া গেছে? মাইনশে আরও নানা কথা কইব্য। গান বান্দা কিতা যেনতেন কাম! গান বানলে সাধনা লাগে। এর লাগি বুদ্ধি কইরা আমিও অন্য নাম দিয়া দিলাম। এই বুদ্ধি আমারে ঠাম্মায় হিকাইছে। তারও একটা গান আছে।

Radharaman Song – Lalita Bishakha Shyamke Aine Dekha; Sushama Das; Source – Rajib Chakraborty YTC

২০২৫ সাল। ললিতা নিয়ে কথা বলা আপাতত ক্ষান্ত হয় আমার মায়ের সাথে কথা বলার পর। মায়ের বয়স এখন সেপ্টেম্বর মাসে ৮৬-র উপরে হবে। তিনি গীত-গান মনেপ্রাণে ধারণ করেন। শুদ্ধ নিয়মে ভালো গাইতে পারেন। ধামাইল গানের আদি বিষয়াদি নিয়ে ভালো বলতেও পারেন। তাঁর বাবাও ছিলেন কবিগানের সরকার। মা নিজে ভালো একজন লোকশিল্পী ও গীতিকার। তাই বংশ পরম্পরায় আমার মায়ের মাঝে এই গুণ বিশেষভাবে প্রভাবিত। সর্বশেষ ললিতা প্রসঙ্গে মা বললেন :

রাধা-কৃষ্ণ প্রেমলীলায় আদি যে-ধামাইল গান আছে সেই কিছু গানে ললিতার কথা পাই। আগের গীতে ভণিতা নাই। এখন দেয়। ধামাইলে যে-গানে সখিগণের বা ললিতার ভাব আছে, সেই গানের ভণিতায় হয়তো কেউ-কেউ ললিতা জুড়ে দিছেন। কেউ কেউ সরমে নিজের নাম না দিয়া ললিতা দিচ্ছে। মাঝে-মাঝে আমার মনে হয় গানের ভাব-আবেগকে শক্তিশালী করতেই ললিতা ব্যবহার করা হইছে। ললিতার মতো এমন আরও কতজন আছে। আরও কত চিনা গান আছে, যার রচিতকর্তাকে কেউ চিনে না। কত গান আছে রচয়িতার কোনো নামগন্ধ নাই। বিশেষ করে কীর্তনে! কে লেখছে এই গান কে জানে! এই গানের কোনো বইও নাই। মুখেমুখে বান্ধা, মুখেমুখেই গান টিকে আছে। আমরা এখন এই গানরে ‘মুখ্যাদ্যিয়া’ গান’ কই।

এবার মুখ্যাদ্যিয়া গান সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য গীত সম্পর্কে একটু ধারাণা নেওয়া যায়। কেমন ছিল গীতে-গানে ওই ভাটির ময়াল, কেমন ছিল তার শানমান।

. . .

Pankhili – A Wedding Ritual celebrated in the lower part (Vati-Bangla) of Bangladesh; Image Credit – Sajal Kanti Sarker; @thirdlanespace.com

বিয়ের গীত :
ভাটির ময়ালে বিয়ের গীতই সর্বাধিক জনপ্রিয় ও প্রচলিত বলে মনে হয়। বিয়ের নানাপর্বে সম্পন্ন হয়ে থাকে, তাই গীতও বেশি। বাংলা লোকসাহিত্যে ভাটির বিয়ের গীত প্রাচীন ঐতিহ্যর দলিল। ভাটির বিয়ের গীত একান্তই মেয়েলি সম্পদ। যার আগাগোড়া মহিলা মাত্রিক। তাই এ-গীতকে মেয়েলিগীতও বলা হয়। তাছাড়া গীতমঙ্গল প্রকাশের সুর-ধ্বনি, ফলে তাকে মঙ্গলগীতও বলা হয়। আঞ্চলিকতা বা পল্লী সংলগ্নতার কারণে অভিজাত শ্রেণির মহিলাদের গীতে অবদান নেই। কেননা আভিজাত্য নগরকেন্দ্রিক বিশেষণ। তাই গ্রামের অবলা, সরলা, কিষাণি, জেলেনি, ধোপানি, সোহাগিনী, বিনোদিনী ও দুঃখিনী মেয়েদের গীতগুলো পল্লীর সম্পদ ও লোকসাহিত্যের ডোয়ার (*গহীন জলাশয় ও মাছের স্থায়ী আশ্রয়স্থল*)।

নদী যেমন গতি পরিবর্তন করলেও ডোয়ার স্থির রেখে তার গভীরতায় জল ধরে রাখে, ঠিক তেমনি লোকসাহিত্যের নানা শাখার পরিবর্তন হলেও ডোয়ারের মতো অনড় থেকে পল্লী মেয়েদের গলায়-গলায় গীত ভরে থাকে। পুরুষ নারীর কত অধিকার কেড়ে নিয়েছে, পারে নাই শুধু গীতের অহংকারী মুকুট ছিনিয়ে নিতে। তাই গীত শব্দটিও স্ত্রীবাচক শ্রীধন। আবার ভাষাগত দিক থেকে গীত আঞ্চলিক ভাষার সম্পদ। আর ভাবগত দিক থেকে শাস্ত্র ও লোকভাবনায় মাটির রসে দরদ মাখা। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েই মাঙ্গলিকপর্বে গীত গাওয়া হয়। তাই গীত জাতপাতহীন লোকসম্পদ।

মেয়েলিগীতে শব্দ প্রয়োগের বাহাদুরি নেই। মেদহীন কথ্যভাষায় তা রচিত হয়। মেয়েলিজীবনাচার সম্পৃক্ত অনুষঙ্গগুলো উপমা হিসেবে গীতে বেশি স্থান পায়। ব্যাকরণের অনুশাসন ও অন্ত্যমিলের অভাব থাকে। মেয়েলিগীতে সম্বোধন সূচক শব্দের ব্যবহার বেশি হয়। যেমন : মা, বাবা, ভাই, বোন, চাচা, চাচী, নানা, নানী, কালা, শ্যাম, কানু, রাই, সই, সখী, যাদু, মণি, লাল, মানিক, গো, তে, লো, হে, হায়, ওগো ইত্যাদি। তাই মেয়েলিগীতের সাথে চণ্ডীদাসের গীত, গাথা, গীতিকা, গীতিকবিতা, গীতিনাট্য, পুরাণ, গান ও পাঁচালী এক করা যাবে না। লোকসাহিত্যে গীত শব্দটি কেবলি মেয়েলি ‘তাজ’ হয়েই গীতনিবৈইনাইনদের (*যেসব নারী মেয়েলিড়ীত গেয়ে থাকেন*) রানি করে রেখেছে।

ভাটির ময়ালে বিয়ে কেন্দ্রিক গীতের ব্যবহার ও প্রচলন লক্ষ করলে দেখা যায়, ষোড়শ শতাব্দীর কাছাকাছি সময় থেকেই তার প্রচলন ঘটে। হিন্দু বিয়ের গীতে শাস্ত্রীয় মন্ত্রপাঠের বা ধর্মীয় বিধি-বিধানের অনুলিপি মুখের ভাষায় রচিত হয়ে সুরে-সুরে বিষয়ভিত্তিক বর্ণনা হয়েছে, যা বিয়ের গীতের শাস্ত্রীয় ধারা। যাতেও অনেকটা পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের মত দায় ও বাধ্যকতা আছে।

লোকমনে বিশ্বাস আছে কোন বিষয়ের কার্যকালে সংস্কৃত ভাষায় মন্ত্রপাঠে সম্পন্ন ক্রিয়াদি ও লুকায়িত অজানা শক্তির মঙ্গলবারতা গীতসহজ ভাষায় প্রকাশ করে। ফলে বিষয়ভিত্তিক পর্বের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য উপলব্ধিতে শুভ ফল আসে। গীত কার্যকাল সম্পর্কীয় সুরেলা বাক্য, তার ব্যতিক্রম হলে গীতের ভিত থাকে না। গীত অবহেলিত হয়। যেমন, কথায় আছে, ‘ধান ভানতে শিবের গীত।’ অর্থাৎ অনুষ্ঠান বা কাজের সাথে গীতের মিল নেই, এমনটি গীতের ধর্ম নয়। তবে গানের ক্ষেত্রে তা হতে পারে। তাই গীত এবং গান এক নয়। গান গীত আশ্রিত, কিন্তু গীত গান আশ্রিত নয়। গীত পরমশক্তির সরল সুরেলা প্রকাশ। তাই এ-দিক থেকে গীত অনেকক্ষেত্রে জনমনে মন্ত্রের চেয়েও অধিক ক্রিয়াশীল, কেননা গীতে কঠিন মন্ত্রসারসহ বাস্তব ক্রিয়াদির বর্ণনা জনসমুখে সরল ভাষায় তুলে ধরা হয়। ফলে পর্বটিতে প্রাণের সঞ্চার হয়। বিশ্বাস ও ভাব-ভক্তির দৃঢ়তা বাড়ে। এ ক্ষেত্রে কন্যাদান অনুষ্ঠানের একটি উদাহরণ দেওয়া যায়।

কন্যাদানে মন্ত্র : ওঁ সমীভবে থাম্।
অর্থ: তোমরা (বর-কনে সমভবে পরস্পরের সন্মুখবর্তী হও।

কন্যাদানে গীত : কন্যাদানে বইলা গো রাজা সে তো বড় ভাগ্যবান
সামনা-সামনি বসাইয়া গৌরী শিবকে করেন দান /

মনাইর বিয়া অইল রে
মনে শান্তি নাই
মনের মানুষ ঘর ছাড়া
করিতে কামাই।

Monai: Poem and Sketch: Sajal Kanti Sarker

তাই গীত অনেকক্ষেত্রে শাস্ত্রনির্ভর কার্য সম্পাদনের সরল গীতিকবিতা। তবে গীতশাস্ত্র, পার্যা ও রস নির্ভর হয়ে থাকে। গীত কোনও অবসরকালীন বিনোদন মাধ্যম নয়। যদিওবা ব্যাঙ্গ করে বলা হয়ে থাকে : ‘আজাইরা গীত’। মূলত গীত সময়োপযোগী মাঙ্গলিক বিষয়ের কার্য-কারণ সমন্ধীয় সুরেলা ভাষ্য। তাই বলা হয়ে থাকে :

সময়ে গীত গায়,
অসময়ে কিলমুড়া খায়।

গীত মানবজীবনের সময়কালীন ঘটনাপ্রবাহের সুর-ধ্বনির মাধ্যমে জাগরণ বা প্রতিবাদী বয়ানও বটে। নারীগণ গীতের একমাত্র জননী। গীত লোকসাহিত্যের অতি প্রাচীন অনুষঙ্গ নির্ভর রচনা। গাঁয়ের মা-খুড়িদের মুখে শাস্ত্র-পুঁথি ও লোকাচার নির্ভর ভাবনা থেকে গীতের উদ্ভব। গাঁয়ে মূলত গীতের ভিত ও সজীব অবস্থান। বয়ষ্ক মহিলাগণ পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ঘরের বারান্দা বা অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক নির্দিষ্ট স্থানে একত্রে বসে সাধারণত গীত গেয়ে থাকেন। ‘বয়ষ্ক মহিলাগণ গীত গেয়ে থাকেন;এর সপক্ষে যুক্তি হলো,গীত যেহেতু শাস্ত্র-পুঁথি ও পার্যা নির্ভর বিষয়ভিত্তিক রচনা, সেহেতু গীত রচনায় গীতিকারকে এ সকল জ্ঞান-বুদ্ধি থাকা বাঞ্চনীয়, যা বয়ষ্কগণ তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দ্বারা সৃষ্টি করতে পারেন এবং উপলব্ধি করতে পারেন বলেই যৈক্তিক।

গীতশক্তি সহজিয়া সুর ও কথা প্রধান হয়। তাই গীতে রাগের ভিন্নতা আছে, তবে বিচ্ছিন্নতার বাহাদুরি নেই। মেয়েলি গীতের সরল রাগিনী, বয়ষ্ক গায়িকাদের রাশভারী কণ্ঠ যার মূল কারণ বলে মনে হয়। গীতে একজন গাওইয়া বা গীতনি প্রথমে একটি পদ গেয়ে যান, পরে বাকিরা দোহার দেন। গীত দলীয় পরিবেশনা। গীতে দিশা থাকে। অর্থাৎ মুখপদ। দিশা গীতের সারমর্মরূপ বাক্য। তাই গীতে প্রতিটি পদ গাওয়া শেষে সকলে মিলে দিশা দোহার দিয়ে মূল বিষয়ের জানান দেওয়া হয়। আদি গীতে কোন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল না। বর্তমানে হয়। গীতের সুরে নাসিক্যধ্বনির আধিক্য বিদ্যমান। ভাষার অস্পষ্টতাও তার একটি সহজিয়া দিক। এক্ষেত্রে গায়কের বয়স ও অনেকক্ষেত্রে দন্তহীন মুথগহ্বর ও পান মুখে দিয়ে বসে-বসে দীর্ঘক্ষণ গাওয়ার কারণ অনেকটা দায়ী বলে মনে হয়।

গীত পরিবেশনে শুরু ও শেষ করার নিয়ম আছে। গীতের কথাগুলি অনেকটা ব্রতকথার মতোই গুরুত্ববহ, যা কেবল সুরে-সুরে প্রকাশ পায়। গীত ও ব্রতকথার প্রচলন বিশ্লেষণে মনে হয় ব্রতকথা গীতেরও আদি। তবে ব্রতের পাঁচালী ব্রতকথার পরবর্তী ধারা, যা গীতাশ্রয়ী। তবে এ নিয়ে দ্বিমতও করা যায় যে কারণে তা হলো,—ব্রতকথা অপরিবর্তনীয়;গীত স্থান-কাল বা পর্ব ভেদে পরিবর্তনশীল। তাই সংগ্রহ এবং গবেষণা এখানে একবাক্যে সিদ্ধান্ত দেওয়ার দৃঢ়তা রাখে না যে, ব্রতকথাই আদি। তবে লোকসাহিত্যে গীত আদি সুরেলা প্রকাশ। স্বর ও ধ্বনির সমন্বয়ে অর্থযুক্ত কথা সুর ও তালে প্রকাশিত হওয়াই গীত। আবার কারও মতে,‘কথা, সুর ও তালের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করাকে গীত বলে।’

Brotokotha by Sajal Kanti Sarker; Image Source – Collected; @thirdlanespace.com

গীতে শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ ও বাক্যের ব্যকরণগত ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা কম। তবে ছন্দ ও মাত্রা ব্যবহারের স্বাভাবিকতা আছে। আদি মেয়েলিগীতে ভণিতা নেই। তাই এখানে লেখক-সুনাম, গ্রন্থমালিকানা ও সাহিত্য পুরস্কারের সুযোগ নেই। বর্তমানে গীতে ভণিতা দেওয়া শুরু হয়েছে। পুরুষগণও গীত রচনায় নাম লিখিয়েছেন। এ-প্রসঙ্গে আমার মা দয়া রানী সরকার একদিন আক্ষেপ করে বলেছেন :

দেশভাগের পর শাস্ত্রীয় গীতের পারিবারিক সংগ্রহ অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকি যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, ৭১ ও ৭৫-এ শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই তখন প্রয়োজনের তাগিদে বিয়েকে কেন্দ্র করে পুরুষ শাস্ত্রকারগণ শাস্ত্রীয়গীত রচনা করেন। বিশেষ করে ভাটির ময়ালে মধুরবান্ধা, অদ্বৈতবান্ধা ও প্রতাপবান্ধা গীত প্রচলিত আছে। কিছু-কিছু আদি গীত মুরুব্বিদের মুখে মুখে থেকে যায়। এ-নিয়েই এখন কোনোরকম বিয়ে-থা চলছে।

তিনি আরও বলেন :

পার্যা বা লোকাচার নির্ভর গীতগুলো আমরাও নিজেরা বান্ধিয়া গাইছি। এগুলা ‘মুখ্যাদ্যিয়া’ গীত। কমবেশি সকলেই বান্ধতে পারে। মহলা তো আরও সহজ। একটা পদ বান্ধিয়া শুধু ‘রাবিদা’ অথবা ‘উপমা’ বদলানো। তবে শাস্ত্রীয়গীত সবাই বান্ধতে পারে না।

এ পসঙ্গে অর্পণা রানী দাশ (৬৮)। স্বামী : মৃত যোগেন্দ্র কুমার দাশ; সাং : কৌয়া; উপজেলা : বিশ্বম্ভরপুর; জেলা : সুনামগঞ্জ। তিনি বলেন :

শাস্ত্রীয়গীতের মাহাত্ম্য এখন আর কেউ খুঁজে না। বিয়া অইলেই খালি ঢঙ্গল্যিয়া গীত গায়।

গীত নিয়ে তাঁর সাথে বেশ আলাপ হয়। একপর্যায়ে তিনি গেয়ে উঠলেন রসের গীত

লাল বৈঠা লীল বৈঠা, কৈনার মা সুন্দরী রে,
নৌকারে সাজাইল কোন কলে,
সেই নৌকা লাগল্য গিয়া সুনামগঞ্জের হাটে রে
লাল বৈঠা লীল বৈঠা, কৈনার মা সুন্দরী রে…।

গীতটির সুর এখনও হৃদয়ে বাজে। তাঁর সাথে ছিলেন, নিয়তি রানী দাশ (৮১)। তিনিও গীতের ফাঁকে-ফাঁকে পান খেতে-খেতে রসিকতা করে গাইলেন :

গাও রে গীতনি বৈন্যাইন ভাবনা কইর না,
কৈনার মায় পান দিছে চুন দিছে না…।

গঙ্গা আনয়ন ও দরশন গীত : গীত পাঠ করতে এখানে চাপুন


চল চল ওগো সখি গঙ্গা দরশনে
পঞ্চঘটি সঙ্গে লও গঙ্গা আনয়নে
বল বল ও গো সখি আরও কি কি লাগে গো সই।
পঞ্চব্রতী নারী লাগে মাটির পঞ্চঘটি
গঙ্গা দরশনে লাগে আরও ঘৃতের বাতি
বল বল ও গো সখি আরও কি কি লাগে গো সই।
ধান্য লাগে দূর্বা লাগে আরও প্রদীপ ঝারি
ভক্তি লাগে শক্তি লাগে ব্রতের পঞ্চনারী
বল বল ও গো সখি আরও কি কি লাগে গো সই।
জয়জোকার দিয়া গঙ্গা কর আনয়ন
তৈল-সিন্দুর দিয়া তাঁরে কর দরশন
বল বল ও গো সখি আরও কি কি লাগে গো সই।
মকর বাহনে গঙ্গা দিলা দরশন
পঞ্চব্রতী গিয়া গঙ্গা আনিল তখন
সুরধনির তীরে গঙ্গা হইল দরশন।
চল চল ও গো সখি গৃহে ফিরে যাই।

Wedding Ritual: Bringing and worshipping the Ganges; Image and Song Credit Source: Sajal Kanti Sarker

অনেকক্ষণ আলাপের একফাঁকে অর্পণা রানী দাশ আক্ষেপ করে বলেন :

গান, কীর্তনের লাগ্যিয়া পরাণ দেওয়ানা অইয়া যায়’গা, অহন সংসারের আফাঞ্জালে পইরা সব মন থাক্কিয়া ঠাফাইয়া থরাখ্ছি।

গীত নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের ফিল্ডওয়ার্কের অভিজ্ঞতা থেকে যা মনে হয়েছে, গীত রচনায় আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারই গীতকে দরদি করে তুলেছে। এ-প্রসঙ্গে ফতেপুর সুনামগঞ্জনিবাসী জ্যোৎস্না চৌধুরী দীর্ঘ আলাপকালে আক্ষেপ করে বলেন :

অহনের গীতে কি-যে বিলাতি ভাষা দেয় খাপছাড়া খাপছাড়া লাগে।

মীরা চৌধুরী ও শিপ্রা রানী দাশ, তাঁদেরও আক্ষেপ এই-যে :

এখনের বিয়া-সাদীতে আগের মত বিধি-ব্যাহার নাই! সব খালি শটকাট! বিয়ার মর্ম কেমনে বুঝব?

এ-বিষয়ে ধর্মপাশা উপজেলার নওয়াগাঁও নিবাসী শেফালি রানী সরকার (৭০), তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন :

আগের মত আল-গিরস্তি নাই, বিধি-ব্যাহারও কম্মিয়া গেছে। বারোমাসে তেরোপার্বণ, গীরস্থালি গীত কিছুই নাই।

তাঁর কথায় সায় দিয়ে বীণা সরকার গেয়ে উঠলেন :

আয় গো তোরা সখিগণ
নূতন বধুর কর্ম্ম দেখি জুড়াব নয়ন \ দিশা \
হাতে লৈইয়া পিত্তল ঝারি, ছিটা দিলা সকল বাড়ি,
ঘর দরজা দিলা ঝাড়ু হরষিত মন \
শ্বাশুরীর আজ্ঞা পাইয়া, গো গৃহেতে প্রবেশিয়া,
গোবর ফেলায় বধু করিয়া যতন… \

ভাটির ময়ালে এছাড়াও সাধভক্ষণ, ‘হাট্টিয়ারা’ ও অন্নপ্রাশনসহ নানা লোকাচার নির্ভর গীত প্রচলিত আছে। আর এ-সকল পর্বভিত্তিক গীতের সার্বিক দিক বিবেচনায় আমার মনে হয় গীতকে প্রথমত দুটি ধারায় ভাগ করা যেতে পারে, যথা : ১. শাস্ত্রীয় বা ধর্মীয় গীত ২. পার্যা বা লোকগীত। মন্ত্র বা শাস্ত্র-পুরাণ-কোরআন-পুঁথি অনুশাসনে অর্থযুক্ত কথায় সরল অনুবাদে রচিত গীতই শাস্ত্রীয় গীত। শাস্ত্রীয় গীত আবার দুধরনের হতে পারে, যথা : ১. শাস্ত্র-পুথিঁ নির্ভর ২. সৃষ্টিতত্ত্ব নির্ভর। এ-গীতগুলো যথেষ্ট সচেতনভাবে লেখা হয়ে থাকে। বয়ষ্ক, অভিজ্ঞ ও শাস্ত্র-পুঁথি-সৃষ্টি জ্ঞানসম্পন্ন মহিলাগণ এ-ধারার গীত রচনা করেন, যা বিশ্বাস-ভক্তিতে অবিচল থেকে কালে কালে গীত হয়ে আসছে।

Wedding ritual and song in bhati-bangla by by Sojol Kanti Sarker; Image Source – Collected; @thirdlanespace.com

দেশাচার ও লোকাচার নির্ভর গীতই লোকগীত। লোকগীত আবার চার ধরনের হতে পারে, যথা : ১. আচার-অনুষ্ঠান নির্ভর ২. গৃহস্থালী ও নারীশিক্ষা ৩. মনোশিক্ষা ও দেশপ্রেম ৪. তামসিক। লোকগীতগুলো পর্বভিত্তিক আচার নির্ভর সমকালীন বিধায় উপস্থিত মুহূর্তেও রচনার সুযোগ আছে। তাই লোকগীতগুলো রচনাশৈলীল দিক থেকে দুটি অনুশাসনের গাঁথুনিতে বেশি প্রকাশ পায় : ১. মুখ্যাদ্যিয়া; ২. মহলা।

পর্বের উপাচার, সময়কাল, আশপাশ ও অনুষঙ্গ বিবেচনায় আসরে তাৎক্ষণিক নারীদের মুখে-মুখে রচিত গীতকেই মুখ্যাদ্যিয়া গীত বলে। এ ধরনের গীত রচনায় একে অন্যের মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে পদ তৈরি করে গীতকে সমৃদ্ধ করতে পারে। গীতে যেহেতু গীতিকারের বাহাদুরি নাই, সেহেতু সকলেই গীতের স্রষ্টা। তাই মিলেমিশে গীত রচনা কারও অপারগতা নয়, বরং সফলতা ও সমৃদ্ধির অহংকার। এসব গীত কখনও লিখে রাখার প্রয়োজন হয় না। গীতের ধারা ও অনুষঙ্গগুলি জানা থাকলে গীত রচনা খুব কঠিনও হয় না। যেমন :

বসনভূষণ দিব আমি দিব নীলাম্বরী।
নাকে কানে দিব ফুল কাঞ্জা সোনায় গড়ি \
গন্ধ তৈল দিয়া তোমায় বান্ধিয়া দিবাম কেশ।
ঘরে আছে দাসী বান্দী সুখের নাই শেষ \
হীরামনি যেথায় পাইবাম ভালা বান্যিয়া দিয়া।
লক্ষ টাকার হার তোমায় দিবাম গড়াইয়া \
আর যে কত দিবাম কন্যা নাহি লেখাযোখা।
সোনাতে বান্ধিয়া দিবাম কামরাঙা শাখা \
উদয়তারা শাড়ি দিবাম লক্ষ টাকা মূল।
হীরামণি দিয়া তোমায় জুরাইয়া দিবাম চুল \
চন্দ্রহার গড়াইয়া দিবাম নাকে দিবাম নথ।
নূপুরে ঝুন্ঝুনি কন্যা দিবাম শত শত \

মুখ্যাদ্যিয়া গীত লিখে রাখা হয় না। মুখে-মুখে টিকে থাকে বিধায় এ-গীত ময়ালে-ময়ালে ঘুরে তার শব্দের গাঁথুনি বদল করেনানা আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারে গীতের ভিত হয়ে যায় সর্বময়ালী। ‘শব্দান্তর’ গীতের প্রচলিত ধারা, যা ময়ালভেদে হয়ে থাকে। যেমন উপরের মুখ্যাদ্যিয়া গীতটিতে ‘দিব’ এবং ‘দিবাম’ শব্দদুটি ব্যবহার না হয়ে শুধু ‘দিবাম’ ব্যবহার হলে এটি ভাটি অঞ্চলের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষার গীত বলে গণ্য হতো, কিন্তু ‘দিব’ শব্দটির ব্যবহার তা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যেমন : ‘দিব’ শব্দটি প্রমিত, যা নগর আশ্রিত ভাটির শব্দ। ‘দিবাম’ বা ‘দিয়াম’ শব্দদুটি নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল ও হবিগঞ্জসহ ভাটির ময়ালে কমবেশি প্রচলিত। ‘দিমু’ সুনামগঞ্জের পূর্বাঞ্চল, সিলেট ও মৌলভীবাজারের আঞ্চলিক শব্দ। তবে এ গীতটি ভাটির ময়ালে ‘দিয়াম’ শব্দযোগেই বেশি গীত হয়।

মহলাও মুখ্যাদ্যিয়া গীত, তবে তার রচনাশৈলী খুবই সহজ। একটি পঙক্তিতেই মহলা গীতটি রচিত হয়ে থাকে। তারপর গীতের ভাব-অর্থ সংশ্লিষ্ট একটি শব্দ পরিবর্তন করে পঙক্তিটি একাধিক হয়ে পূর্ণ গীতে পরিণত হয়। যেমন :

আইজ কৈইনার পানখিলি জ্ঞাতি-গোষ্ঠী আও রে
ধ্যান্য দুর্ব্বা মাথায় দিয়া আশীর্বাদ করি যাওয় রে \
আইজ কৈইনার পানখিলি মা-বাবা আও রে
ধ্যান্য দুর্ব্বা মাথায় দিয়া আশীর্বাদ করি যাওয় রে \
আইজ কৈইনার পানখিলি জেঠা-জেঠি আও রে
ধ্যান্য দুর্ব্বা মাথায় দিয়া আশীর্বাদ করি যাওয় রে… \

নারীর অবদান কালেকালেই অবহেলিত। নারীর জীবনাচারসহ ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি কিংবা সাহিত্যে নারীর যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। সর্বক্ষেত্রেই নারীদের অনেক অবদান ‘রাইয়ত’ সত্বের মতো অন্য আশ্রয়ে বা অন্যের অধীনস্থ হয়ে সর্বমঙ্গলে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। অনেক বিদগ্ধগণ নারীর অলিখিত ও অস্বীকৃত অবদান স্বীকার করে নারীকে ‘অসামান্য ধন’ বলে মত প্রকাশ করেছেন। বাউল দীন শরৎ নাথ তাঁদের একজন। তাই তিনি গেয়ে উঠেছেন :

নারী নয়রে সামান্য ধন
নারী ভক্তি মুক্তি সাধন ভজন \
নারী সাধন করবার তরে গঙ্গাধরে-গঙ্গা ধরে
মরার মত আছেন পড়ে বুকে ধরে নারীর চরণ \
স্বয়ং কৃষ্ণ বৃন্দাবনে প্রেম কইরা গোপিকার সনে
শ্রীমতি রাধার চরণে খত্ দিলেন সেই রাধারমণ \
চণ্ডিদাস আর রজকিনী বিল্লমঙ্গল চিন্তামণি
তাই প্রেমের শিরোমণি করে গেলেন সাধ্য-সাধন \
দীন শরৎ বলে ভূমণ্ডলে এমন রসিক কয়জন মিলে
ঘটে যদি ভাগ্য ফলে ব্রজনারীর যুগল চরণ \ 

. . .

Din Sharat Song – Sohag Pramanik; Source – Murshid Vhajan YTC

. . .

আগের পর্ব :
হাওরজীবন-১ : চেনা গান অচেনা গীতিকার — সজল কান্তি সরকার

হাওরজীবন-২ : চেনা গান অচেনা গীতিকার — সজল কান্তি সরকার

লেখক পরিচয় : ছবি অথবা এই লিংক চাপুন

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 22

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *