ভাষাযোদ্ধা আহমদ রফিক চলে গেলেন। প্রায় শতায়ু হওয়ার পথে নিভে গেল দীপ। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িতদের সকলে একে-একে বিদায় নিচ্ছেন। বিদায়ের তালিকায় আহমদ রফিকও নিজের নাম লেখালেন। তাও এমন এক সময়, যখন আরো একবার রাষ্ট্র ও জাতিসত্তাকে গড়ে তুলতে না পারার আফসোস অশক্ত শরীরে তাঁকে দেখে যেতে হচ্ছিল। যেখানে, তাঁর অকৃত্রিম প্রেম বাংলা ভাষা ও রবীন্দ্রনাথ শুধু নয়,—দেশটাই মর্মান্তিক পরিণতি বরণ করতে চলেছে। প্রায় শতায়ু আহমদ রফিক এমন এক বাংলাদেশ রেখে যাচ্ছেন, যেটি এখন ফেরত যাচ্ছে অতীত-গহ্বরে;—যেখান থেকে বেরিয়ে আসার লড়াই তাঁরা করেছিলেন একসময়। ভাষাযোদ্ধার বিদায়ক্ষণে দৃশ্যটি উপহাসের মতো লাগছে বটে!
দেশভাগের ঐতিহাসিক প্রতিক্রিয়ার জের ধরে বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ ও বিদ্বানমহল শুরু থেকে দুটি পক্ষে বিভাজিত ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অনিবার্যতাকে যেখানে আবার অনিবার্য বাস্তবতা গণ্য করেছেন দুপক্ষই। বাঙালি জাতিসত্তার প্রশ্নে ধর্মীয় বিভাজন প্রসূত বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পুনর্গঠনের বিপক্ষে থেকেছেন একটি পক্ষ। দেশভাগের নেপথ্যে ইংরেজসৃষ্ট বিভাজননীতি ও কংগ্রেসের আত্মঘাতী ভূমিকাকে দায়ী করলেও, মুসলিম লীগকে তাঁরা সংগতকারণে বৈধতা দিতে বিমুখ বোধ করেছেন। অন্য পক্ষটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের অনিবার্যতাকে বাঙালি মুসলমানের স্বকীয়তা গঠনের নিয়ামক গণ্য করতেন। ইসলামি বিশ্বাস ও জীবনবোধের নিরিখে ভাষা ও সংস্কৃতির অনুশীলনকে জাতিসত্তার বনেদ রূপে দেখার বাসনা তাঁদেরকে পৃথক কক্ষপথে ঢুকতে প্ররোচিত করে তখন।
ভিন্ন দৃষ্টিকোণ জন্ম নেওয়ার কারণে দ্বিজাতিতত্ত্বকে একটি পক্ষ আত্মঘাতী চিহ্নিত করে বয়ান তৈরিতে সক্রিয় থেকেছেন হামেশা। অন্য পক্ষ ছিলেন বিপরীতগামী;—ভারত প্রভাবিত বয়ানকে বাতিল ও এর থেকে বেরিয়ে আসাকে মন্ত্র ধরে তাঁরা অগ্রসর হয়েছেন। ভারতবিরোধী রাজনীতির ভাষা-ভাও রপ্ত করা যেখানে সব ছাপিয়ে অন্তিম হয়ে উঠেছিল তাঁদের কাছে। আজো তাই বটে!

সোজা কথায়, জাতিসত্তার ঐতিহাসিক বিবর্তনরেখায় ভারতকে অনুঘটক ভাবার জের ধরে একটি পক্ষ ভারতবিরোধিতার প্রশ্নে নমনীয় থেকেছেন। অন্য পক্ষটি খণ্ডিত ও সাংঘর্ষিক বাতাবরণ থেকে তুলে ধরেছেন ভারতবিরোধিতার যৌক্তিকতা। প্রায় শতবর্ষী আয়ুষ্কালে সাংঘর্ষিকতার এই জায়গাটি আহমদ রফিক ফিরে-ফিরে বোঝার চেষ্টা করেছেন। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও পরিণাম, আর রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তাঁর তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণী ব্যাখ্যার বনেদ মূলত এখান থেকেই গড়ে উঠেছিল। প্রথম পক্ষে অটল থাকলেও তাঁর ব্যাখ্যা ও যুক্তি বিস্তারে নির্মোহ বিশ্লেষকমনের পরিচয় আমরা পাই।
দেশভাগের বাস্তবতা ও ধর্মসমস্যার পরিণাম কখনো উপেক্ষা করেননি আহমদ রফিক। নির্মোহ মন নিয়ে বিভাজনের উৎস ও কারণ নিয়ে ভেবেছেন। রেফারেন্স ব্যবহারে ছিলেন যত্নশীল ও তথ্যনিষ্ঠ। ব্যাখ্যায় সুবেদী ও বিবেচক। হিন্দুয়ানি ও মুসলমানির ছকে ফেলে জাতিসত্তা গঠনের অশুভ পরিণামকে তথাপি চিনে ওঠার ঘটনায় তাঁর মধ্যে দোলাচলের লেশমাত্র ছিল না। মুক্তচিন্তার যে-ধারাটি দেশে একদিন পরিপুষ্ট হয়েছিল,—আহমদ রফিক এর প্রতিনিধিত্ব করেছেন; এবং সেখানে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সংশয়ের সুযোগ তিনি কখনো দেননি। না জাতি তাঁকে বিভ্রান্ত বা মতলবি হতে দেখেছিল কখনো। তাঁর ও পরবর্তী প্রজন্মের অনেকের মধ্যে গুণটির ঘাটতি বরং ব্যাপক দেখেছি আমরা। বাংলাদেশের বিদ্বানমহলের বড়ো অংশ কার্যকারণফেরে বিচ্যুত ও মতলবি বান্দা রূপে ভোল পালটেছেন ঘনঘন! আহমদ রফিক এর বাইরে ছিলেন। আখেরে অবশ্য লাভ হয়নি কিছু। প্রতিক্রিয়াশীল আততায়ীদের হাত বাংলাদেশকে জিম্মি হতে দেখার বেদনা সঙ্গী করে বিদায় নিতে হলো তাঁকে!
ভাষা আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর কাজের কথা আমরা জানি। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি হওয়ার কারণে এর অনিবার্যতাকে তিনি যেভাবে ব্যাখ্যা করে গেছেন, সেটি গুরুত্ব রাখছে। এক্ষেত্রে বদরুদ্দীন উমরের কাজকে আমরা গ্লোরিফাই করে গেছি দীর্ঘদিন; এবং তা গভীরভাবে তলিয়ে না দেখে! আহমদ রফিকের ভাষা আন্দোলন বিষয়ক স্মৃতিচারণা ও এ-সংক্রান্ত আলাপ কখনো সেখানে পৃথক পরিসরে ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। যেমন, আমরা ভেবে দেখিনি,—তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ আরেক কালান্তরে ও দেশভাগ ফিরে দেখায় সংকলিত রচনাগুলোয় যেসব কথা তিনি বলে গেছেন,—সেগুলোর মাহাত্ম্য ও প্রাসঙ্গিকতা। বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজে ক্রমশ বিরল হয়ে ওঠা মুক্তচিন্তকদের একজন ছিলেন আহমদ রফিক। যে-কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অ্যাবসার্ডিটির মধ্যে নিহিত ভাঙনের বীজ বুঝে নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে হয়নি তাঁকে। পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও বইয়ের-পর-বইয়ে এর কার্যকারণ ও পরিণাম বিশ্লেষণ করে গেছেন।
ভাষা আন্দোলনের অনিবার্যতায় তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকাকে মুসলমানি আত্মপরিচয়েরে পৃষ্ঠপোষক ও মরমে-মরমে পাকিস্থানপন্থীরা কেবল নয়, অদ্য ফরহাদ মজহারদের মতো ভণ্ড বামরা শুধু নয়, আরো অনেকে গ্লোরিফাই করতে ত্রুটি করেন না। আহমদ রফিক তমদ্দুনের অবদানকে স্বীকার করেই পরিষ্কার লিখছেন :
… বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে কর্মতৎপরতার সূচনা বাঙালি জাতীয়তাবোধে বা প্ৰগতিবাদে বিশ্বাসী কিছুসংখ্যক রাজনীতিসচেতন বুদ্ধিজীবীর হাতে, শুরুটা তমদ্দুন মজলিসের হাতে নয় যেমনটি তারা আজকাল নানা উপলক্ষ্যে দাবি করে থাকেন। অন্যদিকে ভাষা বিষয়ক সক্রিয় ও বাস্তব কর্মতৎপরতা তথা বিক্ষোভ, আন্দোলন ইত্যাদিও, পরবৰ্তী আলোচনার দেখা যাবে যে, তমদ্দুন মজলিস এককভাবে করেনি। যদিও শেষ সাতচল্লিশে এবং আটচল্লিশে আরো অনেকের সাথে মজলিস বিক্ষোভে-আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল। তাই ‘তমদ্দুন মজলিস ভাষা আন্দোলনের জনক’, তাদের এমন দাবি নিতান্তই ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক। আর বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে তাদের সংগঠনগত তৎপরতা যে প্রায় অনুপস্থিত সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাঁর কথার মাহাত্ম্য এই মুহূর্তে বোঝার অবস্থায় আমরা আছি বলে মনে হয় না। ওপরে উদ্ধৃত কথাগুলো বাহান্নর ভাষাসংগ্রামে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে আহমদ রফিক বিভিন্ন সময় বলেছেন। প্রাসঙ্গিক রেফারেন্স সহকারে এসব কথা তাঁকে বলতে ও লিখতে দেখেছি আমরা। সেইসঙ্গে, ভাষা আন্দোলনে মতো যুগান্তকারী ঘটনা জন্ম দেওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনমানসে বাঙালি ও বাংলাদেশী পরিচয়কে কেন একীভূত করা সম্ভব হলো না?—এই জিজ্ঞাসা তাঁকে করে-কুরে খেয়েছে। উত্তরটি পুনরাবৃত্তির মতো এক গোলকধাঁধায় খুঁজে বেড়িয়েছেন রফিক! প্রশ্ন তুলেছেন ঘুরেফিরে। যে-কারণে আমরা তাঁকে লিখতে দেখছি :
বাঙালি মুসলমানের মধ্যে একদা যে সম্প্রদায়ভিত্তিক স্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনা প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে সম্প্রদায়-স্বার্থ সংরক্ষণের কারণে প্রকাশ পেয়েছিল, সাতচল্লিশ পেরিয়ে সেখানে বাংলা ভাষার অধিকার সংক্রান্ত জাতীয়তাবাদী চেতনার উপাদান উর্দুভিত্তিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভুত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাই বলে পূর্বোক্ত সঙ্কীর্ণ চেতনা লোপ পেয়েছে এমন মনে করা সঠিক হবে না। বরং বলতে হয়, উল্লিখিত দুই বিপরীতধর্মী চেতনার অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে জাতিসত্তাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের নিরঙ্কুশ ও বাধাবন্ধনহীন বিকাশ পদে পদে ব্যাহত হয়েছে; এমনকি—একুশের দিগন্তবিস্তারী আন্দোলনেও তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে নি।
সমাজে বাঙালি জাতিসত্তা ও বাংলাভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ যদি পরিপূর্ণ হতো তাহলে এই প্রক্রিয়ার শুরুতে ভাষা সমস্যার সমাধানে এবং ষাটের দশকে বহুখ্যাত ছয় দফায় ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোয় শুধু আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিই প্রধান হয়ে উঠতো না, এই উভয় ক্ষেত্রেই ভাষাভিত্তিক ও জাতিসত্তার মর্মবস্তুসম্পন্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাবি উচ্চারিত হতো, যেখানে মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান প্রভৃতি বাংলাভাষাভাষী সম্প্রদায়ই শুধু নয়, ব্যাপক রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের একাধিক জাতিসত্তা ও সংস্কৃতিবিশিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীও অন্তর্ভুক্ত হতে পারতো এবং হওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু আমরা এই সমাজবিজ্ঞানসম্মত চিন্তা নিয়ে অগ্রসর হই নি বলেই কি আটচল্লিশে বাহান্নের ভাষা আন্দোলনে এর বিপরীত ধারার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ের কাজ সচেতনভাবে এবং জোরেশোরে করতে পারি নি। ভাষা আন্দোলনের এই অন্তর্নিহিত দুর্বলতা অস্বীকারের উপার নেই। আর সেকথা মনে রেখেই ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তার স্বরপ ও চরিত্র রাজনৈতিক বিচারে কতখানি পরিস্ফুট তা নির্ধারণ করা জরুরি।
দীর্ঘ উদ্ধৃতি এ-কারণে,—নয়ের দশকের গোড়ায় প্রকাশিত বইয়ে আহমদ রফিক পুনরায় ভাবছেন,—কী সেই গলতি, যার কারণে স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পরেও জাতিসত্তাকে সম্মুখগামী ও সকল দিক থেকে প্রাগ্রসর চরিত্র দানে বাংলাদেশ আজো ব্যর্থ! আর, এখন তিনি যে-বাংলাদেশ রেখে বিদায় নিলেন, সেখানে তাঁর কথাগুলো নির্মম সত্য হতে দেখছি!
ট্রাজেডিই মানতে হয়! কী নির্মম আমাদের ঔদাসীন্য! আহমদ রফিক স্বয়ং চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র হলেও ডাক্তারিকে পেশা করা হয়ে ওঠেনি। ভাষা আন্দোলন সব উলোট-পালোট করে দিয়েছিল। রবীন্দ্র সাহিত্য ও ভাষা আন্দোলনের অলিগলি চষে বেড়ানোকে জীবনের বীজমন্ত্র করেছিলেন। মানুষের কাছে এর মূল্য ও স্বকীয়তা তুলে ধরতে নিরলস কাজ করে গেছেন। সকল শক্তি ও মেধা সেখানে ব্যয় করে গেলেন! জীবনের শেষ বয়সে সেই মানুষটিকে চিকিৎসার খর্চা যোগাতে হিমশিম খেতে হয়েছে! একজন ভাষাসৈনিকের প্রতি রাষ্ট্র উদাসীন থেকেছে। তবু কী অনড় মনোবল ছিল তাঁর! রাষ্ট্রের কাছে কোনো কিছু প্রাপ্তির আশা ভুলেও করতে যাননি আহমদ রফিক। শেষ বয়সে এসে হাসিনা সরকারের পতন ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বুঝে নিতেও বিলম্ব হয়নি তাঁর। ফিরে-ফিরে ভুল আর অসমাপ্ত আন্দোলনের খেসারত দিতে দেখার দৃশ্য দেখতে-দেখতে নিভে গেল আয়ু! আমরা কিছুই দিতে পারিনি তাঁকে;—নির্মম অবহেলা ছাড়া!
এই নিরাশার মধ্যেই আহমদ রফিকরা বাঙালি ও বাংলাদেশী পরিচয়ের মিলনমোহনায় দাঁড়িয়ে জাতিসত্তার অনুশীলন করে গেছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরপরই রবীন্দ্রনাথকে খারিজ করার ন্যারেটিভ ও সরকারি ফরমান জারি হতে থাকে। আহমদ রফিকরা সেখানে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যেসব খারিজভিত্তিক ন্যারেটিভ দশকের-পর-দশক পেরিয়ে একুশ শতকেও সমানে চলছে,—এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে বহুমাত্রিক রবীন্দ্রচর্চায় তাঁর গুরুত্ব কাজেই অমলিন থাকবে।
রবীন্দ্রনাথকে কেন চাইলেই অবান্তর করা যায় না, তার উদ্দেশ পেতে আহমদ রফিকের ধারাবাহিক ও প্রায়-নিরবচ্ছিন্ন লেখালেখির মূল্য অপরিসীম। অন্তত এই সময়ে, যখন রবীন্দ্রনাথকে পুনরায় উচ্ছেদে সক্রিয় একদল খবিস। জানে, উচ্ছেদ সম্ভব নয়; তবু সক্রিয় তাঁরা ওই পাকিস্তান আমলের ছকে! পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়,—আহমদ রফিকের প্রস্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তন্নিষ্ট রবীন্দ্রচর্চার একটি যুগ বিদায় নিলো। তাঁর সঙ্গে আরো যাঁরা ছিলেন একসময়, তাঁদের প্রায় সবাই আগে বিদায় নিয়েছেন। আর, জায়গাটি দখলে নিয়েছে সলিমুল্লাহ ও আজম খানদের মতো আততায়ীর দল। যাদের মিশন,—রবীন্দ্রনাথকে কেটেছেটে বনসাই করে তোলা; পারলে অপ্রাসঙ্গিক করা চিরতরে। যেহেতু, বাঙালি মুসলমান জাতিসত্তার প্যারামিটারে তাঁকে খাপ খাওয়াতে তারা পারছে না কিছুতেই। বুদ্ধিবৃত্তিক এসব বদমায়েশি প্রতিহত করতে আহমদ রফিকদের প্রয়োজনীয়তা অন্তিম হলেও, একে-একে নিভিছে দেউটি!
রবীন্দ্রনাথ, তাঁর চর্চার মূল বিষয় হলেও আহমদ রফিক জীবনানন্দসহ আরো অনেককে নিয়ে কাজ করেছেন। তবে, একটি গ্যাপ বোধহয় এখানে যে,—বাংলাদেশে বিকাশমান সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে যারা ওপারবাংলার আদল থেকে বের করে নিজস্ব স্বকীয়তা এনে দিলেন,—এই দিকটির ওপর সবিস্তারে কাজ অতটা করতে দেখা যায়নি তাঁকে। ভ্যাকুয়ামটি কেবল আহমদ রফিক নয়, তাঁর প্রজন্মের প্রায় সকল সম্মুখগামী বিদ্বান ও ভাবুকমহলে কমবেশি পাবো আমরা। এটি ক্ষতির দিক বটে! আব্দুল মান্নান সৈয়দ পরে শিবির বদল করলেও, তিনি ছাড়া এদিকটায় অন্যরা ধারাবাহিক ছিলেন না বা হতে পারেননি কখনো।
যাইহোক, আহমদ রফিকের প্রস্থান একটি যুগের ওপর যবনিকা টানছে। এমন এক ক্রান্তিকালে তাঁকে বিদায় নিতে হলো, যখন বাংলাদেশ ফেরত যাচ্ছে সাতচল্লিশের অন্ধকূপে। তাঁর রেখে যাওয়া জিজ্ঞাসা ফেরত আসছে পুনরায় : সমাজবিজ্ঞানসম্মত চিন্তা নিয়ে অগ্রসর হই নি বলেই কী আটচল্লিশে বাহান্নের ভাষা আন্দোলনে, এর বিপরীত ধারার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ের কাজ সচেতনভাবে এবং জোরেশোরে করতে পারি নি। লড়াই আসলেও অসমাপ্ত এখনো। যেখানে, আহমদ রফিকদের অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকবে সামনে।
. . .
. . .



