তোমারই জীবনে এলো কি আজ বুঝি
নতুন কোনো অভিসার?
আমি এসেছি জেনে কি, তোমার মনে কি
ফাগুন খুলে দিল দ্বার?
. . .
ক্যাচি এই গানটি মেহরীন ও ঐশীকণ্ঠে হঠাৎ শুনতে বসে নাজমা জামান চোখে ভাসছেন। গানটি শুনছি আর তাঁকে মনে পড়বে না,—এ হতে পারে না। গত শতাব্দীর ষাট থেকে আশির কালসীমানায় যারা বেড়ে উঠেছেন, তাদের অনেকের নিশ্চয় মনে থাকার কথা,—জনপ্রিয় গানটি নাজমা জামানের কণ্ঠে প্রথম শুনেছিল বাংলাদেশ। ষাটের শেষ দিকটায় এসে জিংগা শিল্পী গোষ্ঠী গানটি বাজারে আনেন। অ্যালবামের অন্য গানগুলোর সঙ্গে এই গানটিও অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দশ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল তখন। বাংলাদেশের গানবাজারে কোনো অ্যালবামের সেলমার্জিন বিবেচনায় অনন্য নজির হিসেবে যা এখনো টিকে আছে। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশের প্রথম পপ-কুইনের নাম যদি নিতে হয়,—নাজমা জামান সেখানে অটো চয়েস। পারিবারিক গানের দল হিসেবেও জিংগা অভিনবত্ব দাবি করতে পারে। দলটি যে-সময় আত্মপ্রকাশ করে, বাংলাদেশের তখনো জন্ম হয়নি।
দেশে ব্যান্ড গানের প্রসারে চাঁটগা ও খুলনার আবদান কারো অজানা নয়। নামকরা ব্যান্ড ও শিল্পীদের বড়ো অংশ মূলত ওই অঞ্চল থেকে উঠে এসেছিলেন। নব্বই দশক পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও খুলনার স্বকীয়তা অন্য লেভেলের ছিল। স্বাধীনতার আগে-পরে মিলিয়ে পঞ্চাশ বছরের কালপর্বে দেশের শিক্ষিতসমাজ বেশ প্রগতিমনস্ক ও আধুনিক জীবনবেদকে আলিঙ্গন করতে আগ্রহী ছিলেন, মোল্লা ও মবসত্রাসের এই দেশে যার ছিটেফোঁটা এখন আর অবশিষ্ট নেই!
সে যাইহোক, পাশ্চাত্য ঘরানায় পপগান পরিবেশনে নিবেদিত জিংগা শিল্পী গোষ্ঠীর জন্মও চাঁটগায়। কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় শাফাত আলী ও বন্ধুরা মিলে জিংগার গোড়াপত্তন করেন। পরে ছোট দুই বোন নাজমা ও শেহলা আর স্ত্রী নিঘাতকে নিয়ে পুনর্গঠিত দলটি পায় পূর্ণতা। দল গড়ার কারণ গানের কথা ও সুরে তাঁরা জানিয়েছিলেন বটে। বিটিভির যেসব ফুটেজ এ-পর্যন্ত ইউটিউবে আমরা পাচ্ছি, সেখানে জিংগার বেশ কিছু পরিবেশনা স্থান করে নিয়েছে।
পাশ্চাত্য ধাঁচের গানবাজনাকে দলের সদস্যরা ভালো রপ্ত করেছিলেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আবহে একে মানিয়ে নেওয়া কেবল বাকি ছিল। রবি ঠাকুর ও কাজী নজরুলের গান ব্যান্ড ফরমেটে পরিবেশনের ঝুঁকি নিতেও তাঁরা তখন দ্বিধা করেননি। ষাট দশকের শেষভাগে পা দিয়ে প্রথম অ্যালবাম বাজারে আনে জিংগা। অ্যালবামটি বাজিমাত করার কিছুদিন পর শাফাত আলীরা ঢাকায় শিফট করেন। সত্তর দশকে নিজের স্টুডিও তৈরির দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন আপাদশির আধুনিক এই মানুষটি। তারপর থেকে প্রায় তিন দশক জুড়ে নাজমা জামানের জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জিংগাও শ্রোতাপ্রিয়তা ধরে রাখে।
জিংগার গানগুলোয় দুটি প্রবণতা (আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায়) পরিলক্ষিত হয়। সত্তর ও আশির দশকে সুইডিশ অ্যাবা (ABBA) আর জ্যামাইক্যান বনি এম. (Boney M.) দুনিয়াজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপযোগী করে অ্যাবা ও বনি এম.-র কিছু গান ভাবানুবাদ করেন শাফাত। জিংগার ব্যানারে গানগুলো নিয়ে তাঁরা শ্রোতাদের সামনে হামেশা হাজির থেকেছেন। বনি এম.-র আইকনিক গানগুলোর অন্যতম রাসপুতিন ও হলিডে-র জিংগা পরিবেশিত বাংলা সংস্করণ কিন্তু শুনতে মন্দ নয়।
ফাঙ্ক-পপকে একত্রে মিশিয়ে উচ্ছল, মজাদার, আর মেলোডিয়াস গানের জোয়ারে অ্যাবা ও বনি এম. আজো উপভোগ্য। বনি এম. আবার এককাঠি সরেস সেখানে। ফাঙ্ক-পপের সঙ্গে জ্যামাইক্যান রেগে মিউজিক আর ক্যালিপসো ধাঁচের নাচ মিলেমিশে উচ্ছল ঢং ছলকায় তাদের গানে। মা বেকার গানটি এই তো চল্লিশ পার করল কিছুদিন আগে। গানটিকে নতুন করে উদযাপনে মেতে উঠেছিল সারা বিশ্ব। মুনওয়াকার মাইকেল জ্যাকসনের নাচের স্টাইল গানে জুড়ে টিকটকের বন্যা বইতে দেখেছি তখন।
স্মরণ রাখা চাই, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে আরবান সাবকালচারের কাণ্ডারি খ্যাত পঞ্চপাণ্ডব আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, সিরাজ সাঁই, ফকির আলমগীর ও পিলু মমতাজরা আসার আগে থেকে জিংগা পপ ধাঁচের গানে নিয়মিত ঘটনা ছিল। বাংলাদেশে ব্যান্ড গানের বিকাশে পঞ্চপাণ্ডবের অবদান যুগান্তকারী হলেও, জিংগার নামখানা সেখানে অনেকের মনে থাকে না।
পঞ্চপাণ্ডবের গান ও গায়কির মধ্যে শ্রোতারা চমৎকার ভ্যারিয়েশন পাচ্ছে তখন। সদ্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরত আজম খান তাঁর বাংলাদেশ গানটির ভিতর দিয়ে আদি রক-আর্তনাদকে গুঞ্জরিত করেন। দ্রোহ আর মর্মযাতনা যেখানে ছলকে উঠেছিল। একই আজম খান আবার আলাল ও দুলাল-এ দারুণ মজাদার! পুরান ঢাকার খুনসুটিভরা বুলি সেখানে দবদব করছে।
চিরকালের স্টাইলিশ ফেরদৌস ওয়াহিদ অ্যাবাসহ পাশ্চাত্য গায়ন-প্রণালীর উচ্ছল ভাওটিকে বাংলা ভাষায় দান করলেন নতুনত্ব। মামনিয়া বা এরকম গানে প্রাণোচ্ছল ফেরদৌস ওয়াহিদকে তা-বলে অনুকরণসর্বস্ব বলা যাচ্ছে না। পাশ্চাত্য গায়নরীতি অনুসরণ করলেও তাঁর গানের ভাষা ও আবেদন প্রচণ্ড স্থানিক। গানগুলো যে-কারণে আজো নতুন লাগে কানে। বাংলায় গণসংগীতের বহুচর্চিত ধারায় ফকির আলমগীর জুড়েছিলেন নতুন তূণ। গ্রামবাংলার গন্ধ যোগ করেছিলেন সেখানে। ও সখিনা দিয়ে বাজিমাত করার আগে থেকে ফকিরের গান তা বহন করছিল। সিরাজ সাাঁইয়ের গানে শ্রোতারা পেলেন মাইজভাণ্ডারির ইশকে জিসম।
ইশকুল খুইলা ছে রে মাওলা কবিয়াল রমেশ শীলের কারণে অমলিন থাকবে চিরদিন। মাইজভাণ্ডার শরিফে গানটির কাওয়াল ধাঁচের পরিবেশনায় সিরাজ সাঁই নয়া মাত্রা যোগ করেন। গানটি-যে নিছক যুগ-চাহিদা মিটাতে নতুন করে গেয়েছিলেন, সে-কথা এখন আর বলা যাচ্ছে না। তাঁর কণ্ঠে এই গান তৃতীয় একটি পরিসর জন্ম দিয়েছিল। এবং, সেটি কবিয়াল রমেশ শীলের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ও মানহানি না করেই ঘটিয়েছেন সিরাজ সাঁই। আর, পিলু মমতাজ তাঁর চমৎকার কণ্ঠে তুলে আনছিলেন পপগানে উচ্ছলিত যৌনাবেদন;—যেটি পরে আমরা বেবি নাজনীন, ডলি সায়ন্তনী ও আরো পরে মেহরীন বা এখন ঐশীর মধ্যে পাচ্ছি অনেকখানি।
পঞ্চপাণ্ডবরা এভাবে আশির দশকে স্ট্রাগল-লিপ্ত আইয়ুব বাচ্চুদের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন। যার ওপর ভর দিয়ে নব্বই দশকে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের বৃহৎ বিস্ফোরণ ঘটে। গানের ভাষা ও বয়ানের জন্য এ-কারণে আমাদের ব্যান্ড দলগুলোকে ভারতবর্ষের দিকে চাতকপাখির মতো তাকিয়ে থাকতে হয়নি। সরাসরি বিশ্ব সংগীতের প্রবাহে নিজেকে তাঁরা সংযুক্ত রাখতে পেরেছিলেন।
পঞ্চপাণ্ডব ছাড়াও জিংগা শিল্পী গোষ্ঠী সেখানে পালন করেছেন নীরব ভূমিকা। জিংগার হয়ে ও একলা কণ্ঠে গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা নাজমা জামানকে এসব কারণে বাংলাদেশের প্রথম পপ-কুইন হিসেবে আমরা বিবেচনায় রাখতে পারি। ববকাট চুলের সঙ্গে আবেদনময় মুখশ্রীর শিল্পী আশির দশক মাতিয়ে রেখেছিলেন পুরোটা। বিটিভির অপরিহার্য তালিকায় ঢুকে পড়া নাজমা জামান ও তাঁর দলের শ্রোতা-চাহিদায় কমতি ঘটেনি কখনো।
একদিকে অ্যাবা ও বনি এম.-কে জিংগা শিল্পী গোষ্ঠীর কাণ্ডারি শাফাত আলী ও নাজমা জামানরা বাংলাদেশের উপযোগী করে গাইছিলেন। অন্যদিকে, নিজেদের গানে তাঁরা মিশিয়ে নিচ্ছিলেন পাশ্চাত্যরীতির পরিবেশনা। বাংলা উচারণ যেখানে স্পষ্ট ও সাবলীল। আবার একই নাজমা জামান আরবি মিশমাখদুম গাইতে থাকার সময় ছিলেন সমান আবেদনময়ী। শুনে মনে হতো না,—বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর গান শুনছি!
বিদেশি ভাষায় গান করার ঘটনায় রুনা লায়লা বরাবর স্বচ্ছন্দ থাকলেও অ্যাজ অ্যা পপ সিঙ্গার নাজমা সেখানে পিছিয়ে ছিলেন না। আজকে যারা মেহরীনের গান পছন্দ করছেন, তারা যদি নাজমা জামানকে খেয়াল করেন, তাহলে মেহরীনের গায়নশৈলীতে জিংগার হয়ে দেশমাতানো শিল্পীর প্রভাব অনায়াস ধরতে পারবেন। নাজমা জামান ওইসময় দেখা না দিলে মেহরীনকে পাওয়া দুষ্কর ও প্রলম্বিত হতো মনে হয়। ইন্সিপিরেশন লাগে। মেহরীন থেকে আজকের ঐশী-কর্নিয়াদের জন্য নাজমা সেরকম একজন!
নাজমা জামান তাঁর তিন দশকের ক্যারিয়ারে ঘরকন্না সামলে নিয়মিত গান করেছেন। আধুনিক বাংলা গানে ফিমেল ভয়েসের হিসাব টানতে বসলে একাধিক যুগাবর্ত আমরা পাবো। ফেরদৌসী রহমান, আঞ্জুমান আরা বেগমরা সেখানে একটি ধাপ ছিলেন। কিন্নরকণ্ঠী শাহনাজ রহমতুল্লার পাশাপাশি রুনা, সাবিনা, শাম্মী, আবিদারা আসলেন তারপর। দুয়ের মাঝখানে চপল কিন্তু উপভোগ্য, সোজা বাংলায় পার্টি সঙয়ের চাহিদা মিটানোর মতো শিল্পীর খামতি তখনো থেকেই যাচ্ছিল। রুনা ইচ্ছে করলে খামতি পূরণ করতে পারতেন, কিন্তু সিনেমার গানে মারাত্মক চাহিদা থাকায় সেটি সম্ভব ছিল না। এন্তার চপল গান গাইলেও, পপ-কুইন হওয়ার মেজাজ তাঁর মধ্যে ছিল না। নাজমা জামান এখানে এসে গুরুত্ব তৈরি করছেন। যদিও বাংলা সিনেমা তাকে তখন ব্যবহার করেনি।
নাজমা জামান পপগানের পাশাপাশি ডিস্কো ঘরানার গান করলেও বাজিমাত করতেন মনে হয়। পাকিস্তানে ততদিনে নাজিয়া ও জোহেব হাসান ভাইবোনের জুটি উপমহাদেশে ডিস্কোফ্লেভারকে ডিস্কোজ্বরে তুলে দিয়েছিল। যেটি আরো কিছুদিন পরে বাপ্পী লাহিড়ী ও মিঠুন চক্রবর্তীর হাত ধরে ডিস্কো ড্যান্সার ছবি রিলিজের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে। বাংলাদেশের রক্ষণশীল জলবায়ু দেশি কোনো ডিস্কো শিল্পীকে মেনে নিতে আপত্তি করবে ভেবে নাজমা জামান মনে হচ্ছে সেদিকে যাত্রা করেননি। খেয়াল রাখা প্রয়োজন,—পপ গাইলেও দেশের সাংস্কৃতিক আবহ মাথায় রেখে পোশাক ও গায়কি বেছে নিতেন জিংগার শিল্পীরা।
যাকগে, আশির অন্তে এসে নাজমাসহ পরিবারের বাকি সদস্য আমেরিকায় পাড়ি জমানোয় জিংগার অন্ত ঘটে যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি স্বাভাবিক মানতে হবে। নাজমা জামান চাইলেও পপ গানের ক্যারিয়ারকে দীর্ঘদিন টানতে পারতেন না। এটি বাংলাদেশ;—ইউরোপ-আমেরিকা নয়। ম্যাডোনা বুড্ডা বয়সে এখনো স্টেজ মাতায়। শাকিরা, জেনিফার লোপেজ, লেডি গাগারা পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বা পঞ্চাশ পার করলেও পুরামাত্রায় ফিট। নাজমা জামান এদিক থেকে পারফেক্ট থাকলেও পপগানে নিরন্তর যে-অ্যানার্জি দিতে হয়, এর ধকল সমালানো কঠিন। সামাজিক টাবুও সেখানে বাধা।
শাফাত আলীর প্রয়াণ দলটির গান তৈরির চাকাকে অনেকখানি মন্থর করে দিয়েছিল। সুতরাং, নাজমা জামানের ক্যারিয়াগ্রাফকে আমরা পরের তিন দশকে ভিন্ন খাতে মোড় নিতে দেখেছি। আজকের নাজমা জামান সাংবাদিক, সংবাদ পাঠিকা, টকশো হোস্ট হিসেবে স্বতন্ত্র আবেদন তৈরি করেছেন। ফাঁক বুঝে সিনেমাও প্রযোজনা করেছেন দু-একটি। মানতে হবে, এসব ভূমিকায় তাঁকে যাচ্ছেতাই ভাবার সুযোগ তিনি দেননি। একটি ব্যক্তিত্ব ধারণ করেছেন সবসময়,—এবং পড়ন্ত বয়সে তা ধরেও রেখেছেন বেশ।
জিংগা কি তাহলে অবলুপ্ত পুরোপুরি? এ-কথা বোধহয় বলা যাচ্ছে না। শাফাত আলীর পুত্র শায়ান আলী বিদেশে কর্মব্যস্ত জীবনের মধ্যেও ঐতিহ্য বহন করছেন। ফুপু নাজমার তোমারই জীবনে গানটির নতুন সংস্করণ তাঁর কণ্ঠে ভালোই লাগল শুনে! উপভোগ্য ও প্রাণোচ্ছল। নাজমা জামান ও জিংগার কাণ্ডারিগণ কি প্রাপ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন? প্রশ্নের সোজা উত্তর হলো,—এই খবিসাতুল ইনসানের দেশে কার ভাগে কবেই-বা জুটেছে প্রাপ্য স্বীকৃতি!
. . .
. . .



