তোমরা গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে;—সমগ্র আসাম তল্লাট জুড়ে লোকপ্রিয় ভাওয়াইয়া গানটি ছেলেবেলায় শুনেছি ভূপেন হাজারিকা ও প্রতিমা বড়ুয়ার কণ্ঠে। একক ও যৌথ সংগতে গানটি দুজনে গেয়েছেন তখন। ভাওয়াইয়ার মক্কা বলতে আমরা এখন রংপুর-কুড়িগ্রাম-কোচবিহারকে বুঝে নেই ঝটপট। আসামের কথা সহসা মাথায় আসে না।
আসামের লোকায়ত গানের খনি বলতে বিহু, ঝুমুর ইত্যাদি আগে মনে ভাসে। মাঠে শস্যবীজ রোপণ ও ফসল তোলার পরব আর বর্ষবরণকে ঘিরে আবর্তিত উৎসব হচ্ছে বিহু। ঝুমুর মূলত চা-বাগানকে ঘিরে আবর্তিত জীবনছবির পরিচয় তোলে ধরে। আসাম তল্লাট জুড়ে বিহু ও ঝুমুরকে কেন্দ্র করে বিচিত্র লোকগানের চর্চা অতি সনাতন। লোকায়ত পরিসরে যেমন গানের দুটি ধারার প্রচলন ব্যাপক,—শাহরিক জীবনেও তাদের প্রসার থেমে নেই।
ভাওয়াইয়ার সঙ্গে আসামের সংযুক্তি এদিক থেকে খণ্ডিত। আসামের যে-অংশ বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সীমান্ত রচনা করেছে, সেখানে বিহু গানের সঙ্গে ভাওয়াইয়া চলে খুব। স্মরণ রাখা প্রয়োজন,—আসাম স্বয়ং রংপুরের অংশ ছিল একসময়। রংপুর রাজ্যকে ভেঙে আসাম নামে পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চল পরে গড়ে উঠেছিল। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সীমান্ত রচনাকারী অঞ্চলে ভাওয়াইয়াসহ অন্যান্য লোকায়ত সংস্কৃতির সংযোগ যে-কারণে বেশ প্রাচীন।
যাইহোক, উত্তরবঙ্গে ভাওয়াইয়া গানে গরুর গাড়ি ও তার চালক গাড়িয়াল ভাইয়ের রেফারেন্স আমরা ঘুরেফিরে শুনে অভ্যস্ত। মোটরকারের প্রসার ঘটার আগে গরুর গাড়ি গ্রামবাংলার প্রধান বাহন থেকেছে। ভাটিয়ালি গানে যেমন নদী-নৌকা ও মাঝি অবিরাম বিশেষ চিহ্নসূত্রে দাঁড়িয়ে যায়, ভাওয়াইয়ার গায়নরীতি গরুর গাড়ি ও গাড়িয়াল ভাইকে চিহ্নসূত্রে পরিণত করায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর গানের বাহিরানা বইয়ে ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালির সুর ও গায়নপ্রকৃতির তফাত নিয়ে মনোবিধুর আলোকপাত করেছিলেন একসময়।
ভাটিয়ালি অবশ্য কেবল অপেক্ষা ও বিচ্ছেদে থাকেনি সীমিত। নদী ও নৌকার সংযোগ বাউল মহাজনদের হাতে পড়ে দেহতত্ত্ব কেন্দ্রিক গানের অতিকায় পরিসর সেখানে জন্ম দিয়েছে। তার সঙ্গে নাইওরযাত্রা ছাড়াও আরো কত-না রকমারি অনুষঙ্গ ভাটিয়ালির মীড়ে-মীড়ে বইছে! শচীনকর্তার গানে যে-কারণে ভাটিয়াল টান আমরা ফিরে-ফিরে আসতে দেখি। হিন্দি ছবির গানে সুর দিতে বসেও ভাটিয়াল ঢুকিয়ে দেওয়ার নেশা প্রবল ছিল শচীনকর্তায়।
ভাওয়াইয়া গানে সুরলয়তালে উচ্চগ্রামের বড়ো কারণ হয়তো উত্তরবঙ্গের রুক্ষ জলবায়ু ও জীবনপ্রকৃতি। পক্ষান্তরে উজান থেকে ভাটিতে নামার সঙ্গে জলের বিস্তারে যে-প্রকৃতি রচিত হয়, সেখানে সুরের নমনীয়তা ও প্রলম্বিত টান অধিক। এই প্রলম্বিত টান আবার হাওর অঞ্চলে বেশ উচ্চগ্রামে মোড় নিয়েছে। যার কারণটি হেমাঙ্গ বিশ্বাস চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন। বিস্তীর্ণ হাওরে নাও ভাসিয়ে চলা মাঝিরা একে অন্যকে গলা তুলে যদি না ডাকে, তাহলে সে-ডাক কানে পৌঁছায় না। সুতরাং গানে এর প্রভাব পড়েছে।

মাহুত বন্ধুর কথায় ছিলাম;—সেখানে ফেরত যাই। আসাম অঞ্চলে এই গানের জন্ম হওয়ার কারণে হয়তো গাড়িয়ালকে স্থানচ্যুত করে হাতির পিঠে আসীন মাহুত জায়গা নিয়েছেন। একথা বিদিত,—আসাম তো নিশ্চয়, তার ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সিলেট অঞ্চল জুড়েও আজ থেকে এক-দেড়শো বছর আগে হাতির বাড়বাড়ন্ত ছিল। পাহাড়ি প্রকৃতির কারণে হাতির প্রাধান্য অত্র অঞ্চলে ব্যাপক ছিল সেকালে। ইংরেজ আমলে সিনিয়র থ্যাকারে যবে সিলেটে চুনাপাথর ও কাঠের ব্যবসায় দাও মারার লোভে আগমন করেন,—হাতির ছড়াছড়ি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। এমসি কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবন থ্যাকারে তাঁর থাকার জন্য তৈরি করেন তখন। আত্মজীবনীতে এর বিস্তারিত বিবরণ সায়েব দিয়ে গেছেন। সুরমা নদী অধ্যক্ষের বাসভবনের আরো নিকটবর্তী ছিল, আর ঘন পাহাড়-জঙ্গলের ঘেরা তল্লাটে বাঘ-গণ্ডার-অজগরের সঙ্গে হাতিও ছিল বেশুমার।
আব্বার মুখে শুনেছি,—ফেঞ্চুগঞ্জসহ সিলেটের একাধিক অঞ্চলে বাচ্চা ও বালেগ হাতিকে পোষ মানানোর জন্য ফাঁদ বা খেদা তৈরি করা হতো। সুড়ঙ্গের মতো গর্ত খুঁড়ে ওপরের অংশ লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। হাতি দলবদ্ধ প্রাণী। বুদ্ধিমান ও দলবেঁধে চলাফেরা করতে অভ্যস্ত। চলার সময় পা হড়কে গর্তে পড়ে যেত দলের কোনো হাতি। তারপর শুরু হতো তাকে বশ করার ট্রেনিং। প্রশিক্ষক স্বয়ং সুড়ঙ্গে বানানো কোঠায় হাতির সঙ্গে যাপন করতেন কিছুদিন। এভাবে বশে এলে, লোকালয়ে নিয়ে আসা হতো তাকে। ট্রেইনারের সঙ্গে সম্পর্ক মোড় নিতো নিখাদ বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসায়।
ভারী জিনিস টানানো থেকে আরম্ভ করে যাত্রী বহন… এরকম কত কাজ ওইসময় হাতিকে দিয়ে করানো হয়েছে, তার কোনো লেখাজোঁকা নেই। লাউয়াছড়ায় নিজ চোখে হাতিকে দিয়ে গাছ টানানো অনেকবার দেখেছি। এখন চল ওঠে গেছে মনে হয়। আসাম অঞ্চলে হাতি শিকার ও পোষ মানানো নিখাদ পেশায় রূপ নিয়েছিল সেইসময়। কঠিন এই পেশায় জীবনমৃত্যুর দোলাচল ছিল তীব্র! ভূপেন হাজারিকা গানটির সে-ইতিহাস বর্ণনা করেছেন বৈকি। পেট চালানোর তাগিদে ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করতে তখন দ্বিধা করেনি মানুষ! মাহুত বন্ধু গানের বিবরণে অনিশ্চয়তার দোলাচলটি এর রচয়িতা প্রতাপ বরণ রায় চিরভাস্বর করে রেখেছেন। ভাওয়াইয়ার সুরজালে সময়কে যেন বন্দি করেছেন লোকায়ত সংস্কৃতির মহান জনকরা।

প্রতিমা বড়ুয়া প্রবাদপ্রতিম লোকগানের শিল্পী। মাহুত বন্ধু নামে যে-ছবিটি তখন তৈরি হয়,—তার সংগীত আয়োজনের ভার পড়েছিল ভূপেন হাজারিকার ওপর। প্রতিমাকে পাদপ্রদীপে আনার কৃতিত্বও তাঁর। ছবির লোকায়ত সব গানে তাঁর সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছিলেন ভূপেন। বাকিটা ইতিহাস। ভূপেনের সঙ্গে পরে গণসংগীতও গেয়েছেন প্রতিমা।
মাহুত বন্ধু রে গানটি তারপর আরো অনেকে গেয়েছেন। ভাওয়াইয়া গানে অবিনশ্বর আব্বাসউদ্দীন গেয়েছিলেন বলে মনে হয় না, তবে তাঁর কন্যা ফেরদৌসী রহমান গেয়েছেন। যেমন পরে গেয়েছেন লোপামুদ্রাসহ অনেকে। আর, সম্প্রতি বগা তালেবের কণ্ঠে গানটি মন্দ লাগেনি কানে;—যদিও ভূপেন গাওয়ার সময় কণ্ঠকে কোমল করে আনেন, যার মধ্যে ধরা পড়ে বিষাদ ও এর নেপথ্যে সক্রিয় নির্মম ইতিহাস। প্রতিটি লোকায়ত গানের পেছনে এরকম সব গল্পরা মুদ্রিত। সেটি জানা থাকলে গান গাওয়ার ধরন বদলায় বৈকি। কথাটি যদিও আমরা স্মরণ রাখি না বিশেষ।
. . .
. . .



