
বাংলাদেশে যাঁরা সুফিবাদ চর্চা করেন, তাঁরা এর অর্ন্তিহিত সত্য কি ধারণ করেন? উপমহাদেশে সুফিবাদের ঐতিহাসিক বিকাশের সঙ্গে আরববিশ্ব বা আরো নির্দিষ্ট করে বললে উত্তর আফ্রিকার মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোয় চর্চিত সুফিবাদের মিল ও প্রভেদ দুটোই রয়েছে। পারস্য থেকে আসা মরমি প্রভাব উপমহাদেশে সুফিবাদকে পৃথক চরিত্র দান করেছে তখন। বৈদিক ও বৌদ্ধ প্রভাবও তাকে পরিপুষ্ট করেছে। এখানে চর্চিত সুফিবাদ গোড়া থেকে স্থানিক ভাবরসে নিজেকে অনেকবেশি পরিপুষ্ট করে বিচিত্র পথে মোড় নিয়েছিল।
আমাদের এখানে সুফিবাদ মূলত পীর-দরবেশ-আউলিয়া ও মাজার কেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে ধারণের মধ্য দিয়ে আত্মিক বিকাশ ও মুক্তির পথ উপলব্ধিতে নিবেদিত থেকেছে। গুরু-শিষ্যের পরম্পরা সেখানে গুরুত্ব বহন করেছে সবসময়। এখন এটি কতখানি শরিয়তের পাবন্দি করছে, গাজ্জালির তাসাউফ কেন্দ্রিক ব্যাখ্যার সঙ্গে মিল-বেমিলের জটিল বিতর্কে আপাতত যাচ্ছি না। মোটা দাগে আমরা দেখে এসেছি,—পীর ও মাজার ব্যবসার নামে ভাওতাবজির আধিপত্য থাকলেও উপমহাদেশে সুফি ও মাজারপন্থীরা বেশ সহিষ্ণু। হাদিসশাস্ত্রে ঠেকনা দিয়ে দাঁড়ানো শরিয়তকে ব্যাখ্যা-বিবেচনার প্রশ্নে তুলনামূলক উদার, নমনীয় ও সহনশীল। ভারতীয় সংস্কৃতিতে পল্লবিত খুঁটিনাটির সঙ্গে পারস্য প্রবাহিত সংস্কৃতির ছাপ-তিলক সমানে অঙ্গে ধারণ করেছেন। সংগতকারণে, এখানকার সুফি সাধনায় গুরুমুখী বিদ্যার সঙ্গে গুরুভক্তির সবটাই সুসমন্বিত।
সুফিবাদের চূড়ান্ত স্তরে আরোহনের সোপান হিসেবে নবিভক্তি ও নবিবন্দনার গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের কবি-লেখকদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা সুফিপন্থাকে কলবে জায়গা দিয়েছেন, যেখানে তাদের মধ্যে নবিভক্তির জোশ আবার অতটা প্রবল নয়! নবির চেয়ে যে-সিলসিলার অনুসারী বলে নিজেকে তাঁরা চিহ্নিত করেন, এর গদিনশিন পীরের গুরুত্ব সব ছাপিয়ে বড়ো হয়ে দাঁড়ায়। গুরুকে কেন ভক্তি করতে হবে এ-বিষয়ে ভারতবর্ষের সুফিবাদী পন্থার শক্তিশালী ব্যাখ্যা ও যুক্তি অবশ্য রয়েছে। গুরু সম্ভবত সেই সোপান, যাঁর কাছে বয়েত নেওয়ার মধ্য দিয়ে স্রষ্টা ও নবির মহিমা শিষ্য তার ইলমে ধারণ করেন। এবং, সেখান থেকে ক্রমশ ফানা-বাকা ইত্যাদি গুহ্যসাধনার রহস্য তার কাছে উন্মোচিত হতে থাকে। নবিভক্তি অথবা পীরভক্তির বাহানায় ডেমিগড বা ঈশ্বর-অবতারকে ঈশ্বরতুল্য মহিমায় ভক্তি প্রদানকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঐতিহাসিক বিতণ্ডাকে বিবেচনায় নিলে সুফিপন্থা সবসময় বিতর্কিত ছিল ও এখনো তাই আছে।
আমার যৎসামান্য কোরান পাঠে নবিকে পৃথক পরিসরে মহিমান্বিত করার ঘটনা অধিক চোখে পড়েনি। হ্যাঁ, মোহাম্মদের শানে স্রষ্টার প্রশংসাবাক্য ও তাঁকে কেন অনুসরণ করতে হবে ইত্যাদি নিয়ে আয়াতের অভাব কোরানে নেই, তবে সেগুলো আসছে দীনের প্রচারে নবিগণের গুরুত্ব, ধারাবাহিকতা ও একে পূর্ণতা দানের প্রয়োজন থেকে। কোরান শরীফ-এ হযরত মোহাম্মদ-এ কেন্দ্রীভূত আয়াত ছাপিয়ে আরো জরুরি সব প্রসঙ্গ বড়ো আয়তনে বিদ্যমান দেখে পাঠক।
কোরানের কাঠামোকে যদি আমরা নজরে আনি তাহলে দেখতে পাবো, প্রথমত, জিবরাইল মারফত ওহি নাজিলের ছলে স্রষ্টা স্বয়ং নবিকে শিক্ষা দান করছেন। শিক্ষার এখানে আবার দুটি দিক পাচ্ছি। তাঁকে পূর্ববর্তী নবিদের ব্যাপারে খুব ভালোভাবে অবহিত করা হচ্ছে। যার মধ্য দিয়ে স্রষ্টা এই বার্তা মোহাম্মদকে জানিয়ে দিচ্ছেন,—তিনি যে-দীনের প্রচার করছেন তা নতুন নয়। একত্ববাদের মর্মবাণী সনাতন। একের-পর-এক বার্তাবাহক অনুরূপ বাণী প্রচার করতে অতীতে ধরায় আগমন করেছেন। মানুষ তার স্বভাবসুলভ হঠকারিতায় মৌলবাণীকে বারবার বিকৃত করায় স্রষ্টাকে ফিরে-ফিরে পথপ্রদর্শক পাঠাতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ শেষ পথপ্রদর্শক;—এভাবে গড় করাটা সুতরাং সরলীকরণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি একাধারে নবি ও রসুল। তাঁর ওপর জিবরাইল মারফত ওহি নাজেল হচ্ছে, এবং ওহির মাধ্যমে তাঁকে শরিয়ত প্রদান করছেন স্রষ্টা। এই অর্থে তিনি সর্বশেষ। ওহি ও ওহিবাহক দিকনির্দেশনা প্রদানে ভবিষ্যতে কোনো পথপ্রদর্শক আসবেন না, কিন্তু মানুষকে দূর ভবিষ্যতেও পথ দেখানোর জন্য নায়েবে রসুল বা রসুলের বাণীর প্রচারকগণ আসতে থাকবেন। ওলি-দরবেশরা সম্ভবত এই ছকে পড়ছেন।
অন্যদিকে মোহাম্মদ যেহেতু ওহিবাহক, এখন এর স্বরূপ কেমন আসলে? কোরানের মদিনাপর্বে নাজিল হওয়া সূরাগুলো পরপর ধারাবাহিক পাঠ করলে তার একটি আন্দাজ আমরা পাই। মদিনাবাসের সময় মোহাম্মদের কাছে প্রেরিত সূরাগুলোর আয়াত মোটা দাগে ইসলামে শরিয়ত বলতে স্রষ্টা কী বোঝাতে চাইছেন তার পটভূমি তোলে ধরে। এখানে আবার দুটি ভাগ পরিলক্ষিত হয়। একটি ভাগে নবিকে জাগতিক মামলা ডিল করতে দেখছি। তার কিছু তিনি নিজের ধীশক্তি ব্যবহার করে সম্পন্ন করছেন, এবং সেখানে স্রষ্টা তাঁকে নজরে রেখেছেন। জটিল সমস্যায় সরাসরি বলে দিচ্ছেন তাঁকে কী করতে হবে। তার মধ্যে আবার এমন কিছু বিষয়-আশয় রয়েছে, যেগুলো কেবল মোহাম্মদের জন্য নির্ধারিত। অনুসারীদের জন্য সেগুলো প্রযোজ্য নয় অথবা বাধ্যবাধ্যকতা সেখানে শিথিল ধরা যেতে পারে।
সালাহ/ সালাত আদায়ের প্রশ্নে কোরান নির্দিষ্ট করে বলেনি সুন্নিদের মতো পাঁচ ওয়াক্ত বা শিয়াদের মতো তিন ওয়াক্ত পড়তে হবে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত ও রজনীতে কখন স্রষ্টাকে স্মরণ করা উত্তম, তার আভাস কেবল দিচ্ছে। সূরা বাকারায় পাচ্ছি, স্রষ্টা বিবেচনায় রাখছেন,—দিনের বেলা মানুষ কর্মব্যস্ত থাকায় তাঁকে ইয়াদ করার জন্য সালাতে গমন বা এবাদত বন্দেগিতে লিপ্ত হওয়া অনেকসময় সম্ভব নাও হতে পারে। লাইল, অর্থাৎ রজনি সেক্ষেত্রে এবাদতের উৎকৃষ্ট সময়। তখন সে ঘরে ফিরেছে এবং কাজের চাপ প্রবল নয়। সেখানেও আবার গভীর রাত্রির উপাসনা বা তাহাজ্জুদকে স্রষ্টা নবির জন্য বাধ্যতামূলক রেখেছেন। বাকিদের জন্য সেটি অন্তিম নয়।
সালাত, কোরান খুললে জটিল একটি বিষয় হিসেবে পাঠকের চোখে ধরা দেয়। ফার্সি নামাজ বলতে আমরা সোজাসপাটা যা বুঝি, তার সঙ্গে সালাতের গুণগত প্রভেদ কোরানে স্পষ্ট। সালাত কেবল স্রষ্টার উপাসনায় সীমাবদ্ধ নয় মোটেও। একটি মানুষের জীবন প্রণালি হচ্ছে সালাত। যে-কারণে কোরানে পাখি ও বৃক্ষদের নজির পেশ করা হয়েছে। স্রষ্টা স্বয়ং নবিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বৃক্ষ ও পাখিরা স্রষ্টা নির্ধারিত পন্থায় সালাত আদায় করে। তারা তা কীভাবে করে, কোরানে এর আভাস পাঠক পায় না। পাখিদের জীবনপ্রণালীর মধ্যে সালাতকে বুঝে নিতে হয় তাকে। সুফি পন্থায় সালাত হচ্ছে ধ্যানমগ্ন সাধনা, যার ভিতর দিয়ে ব্যক্তি দেহাতীত সীমানা অতিক্রম করে কসমিক ফিলে একীভূত করছেন নিজেকে। যার মধ্য দিয়ে স্রষ্টার মাহাত্ম্য তার চেতনায় তরঙ্গ তুলছে। এখান থেকে সালাত আবার জিকিরের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করছে ইত্যাদি।
মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যাপক ভিন্ন নয়। পরিধি কেবল বাড়ছে সেখানে। মানুষের জন্য স্রষ্টা নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাঁকে স্মরণ ও এবাদতের কথা বলেছেন। সিয়াম ও হজের পুরোনো প্রথা কীভাবে পালন করতে হবে তা ক্লিয়ার করেছেন। অর্জিত সম্পদের ওপর গরিবের হক ও তা মিটানোর প্রসঙ্গ ফিরে-ফিরে এসেছে সেখানে। সোজা কথায় নৈতিক জীবনাচার অনুসরণের মধ্য দিয়ে সে যেন উত্তম মানব হতে পারে, কোরানে আয়াতের-পর-আয়াতে সে-কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পুরস্কার হচ্ছে জান্নাত, যেটি জন্মসূত্রে ইহুদি অজ্ঞেয়বাদী গবেষক লেসলি হ্যাজেলটনের ভাষায় অতিশয় ফ্যাকান্ড বা উর্বর। দুনিয়ায় যেসব বস্তু মানুষ কামনা করে তার সবটাই সেখানে মজুদ রয়েছে। কোরাননিষ্ঠ পথে নিজেকে গড়তে না পারলে পানিশমেন্টের ব্যবস্থা মানে নরক বা দোজখ। এখন এই নরক আসলে কেমন তার খুঁটিনাটিতে স্রষ্টা গমন করেননি। আগুনের প্রসঙ্গ কেবল ফিরে-ফিরে এসেছে।
তার মধ্যে সূরা আ’রাফ-র বয়ানটি আকর্ষণীয়। বাইবেলের মতো একাধিক স্তর সেখানে পাচ্ছি। যারা মুমিন বা মুমিনা তারা সরাসরি খোদাসৃষ্ট জান্নাতে প্রবেশ করবে। যারা পাপী তারা যাবে দোজখে। মাঝখানে একটি দলকে জান্নাত বা দোজখের কোনোটায় না পাঠিয়ে অপেক্ষায় রাখা হবে। তাদের জন্য পুরষ্কার বা শাস্তি কোনোটাই থাকছে না। একটি মেয়াদ পর্যন্ত তারা সেখানে থাকবে এবং পরে জান্নাত পাবে। জান্নাতে হুর, গেলমান ইত্যাদি বা তার কাঠোমো সংক্রান্ত ডিটেল কোরানে নেই!
কেন নেই সেটি আবার মুহকাম ও মুতাশাবিহাত নামে দুটি শব্দে স্রষ্টা ক্লিয়ার করছেন। মুহকাম বলতে কোরানের ওইসব আয়াতকে বোঝানো হয়েছে, যেগুলো সুগঠিত ও তাদের অর্থ সরল। একজন মুমিন কীভাবে ধরায় জীবন কাটাবে, স্রষ্টার একত্ব বলতে কী বুঝবে সে, কোনটা শিরক আর কোনটা নয়… এরকম আয়াত মুহকামের সংজ্ঞায় পড়ছে। মুতাশাবিহাত হচ্ছে এমন সব আয়াত যেখানে স্রষ্টা দ্বৈত বা দ্বিরার্থক কিছু হয়তো বোঝাচ্ছেন। যেমন, হুর কেমন হতে পারে তার আভাস দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এই সৃষ্টি নিয়ে বিস্তারিত বলেননি। রুহ, জান্নাত, জাহান্নাম, হাশর… এসব ব্যাপারেও পরিষ্কার ছবি কোরান থেকে উদ্ধার করা দুরূহ। ইসলামের রুহের সঙ্গে বেদ-উপনিষদ ও বৈদিক দর্শনে বর্ণিত আত্মার তফাত পণ্ডিতরা দিয়ে থাকেন, বাস্তবে রুহ কেমন তার ব্যাপারে কোরান বিস্তারিত কিছুই বলে না।
মানুষ প্রাণবায়ু ত্যাগ করার পর রুহ তার দেহ ছেড়ে যাচ্ছে এবং সেখানে তার জার্নির একটি বিবরণ পাঠক পাচ্ছেন কেবল! একনিমিষে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমপরিমাণ পথ সে পাড়ি দিতে থাকে। রুহ এখানে অদৃশ্য পন্থায় স্রষ্টা কর্তৃক মানবদেহে সংযোজিত অ্যাপস অথবা মস্তিষ্কের মধ্যে সচেতনা জাগরণে ভূমিকা রেখে চলা মাইক্রোটিউবল টাইপের সূক্ষ্ম নিউরন কি-না, ইত্যাদি ঘিরে জল্পনা চলতে পারে, তবে সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কাজেই এ-নিয়ে গবেষণা করা না করা সমান।
কোরানে কাজেই এ-সমস্ত নিয়ে অধিক জল্পনায় গমন করতে মানুষকে নিষেধ করা হয়েছে। জল্পনার সঙ্গে বাস্তবতা নাও মিলতে পারে। অথবা সেটি একজনের ব্যাখ্যা হবে, স্রষ্টার নয়। এখান থেকে কোরানে পুনরায় দুটি ভাগকে আমরা আমলে নিতে পারি। একটি ভাগে স্রষ্টা তাঁর রসুলকে ডিল করছেন, এবং সেখানে এমন অনেক মামলা আসছে যেগুলো ওইসময়ের পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত। কোনো প্রয়োজন নেই একে আজকের সঙ্গে রিলেট করার। প্রাসঙ্গিক হলে করা যেতে পারে, অন্যথায় না করলেও ক্ষতি নেই। অন্যভাগে নবিকে দিয়ে তিনি সমগ্র মানজাতির কাছে বাণী প্রচার করছেন। যেমন স্রষ্টার একত্ব। স্রষ্টা মনে হচ্ছে অনেকটা কোয়ান্টাম সুপারপজিশনের তরিকা ব্যবহার করে একইসঙ্গে সর্বত্র উপস্থিত থাকেন। তিনি আদিঅন্ত বা সময়হীন বিরাজিত থাকায় তার অসীমতাকে সৃষ্টিতুল্য ভাবলে একত্ব আর থাকে না। সেটি তাৎক্ষণিক বিনষ্ট হয়।
৫৭ নাম্বার সূরা আল হাদিদ-র ৩ নাম্বার আয়াতে তাই বলা হচ্ছে : তিনিই আদি, তিনিই অন্ত, তিনিই ব্যক্ত ও তিনিই গুপ্ত এবং তিনি সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত। সূরা নূর-র ৩৫ নাম্বার আয়াতাংশে ‘নূরুন আলা নূরিন’ অর্থাৎ Light upon light-এর উপমায় স্রষ্টা তাঁর অসীম স্বরূপের ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আভাস দান করেছেন :
আল্লাহ আসমান ও পৃথিবীর জ্যোতি
তাঁর সেই জ্যোতি যেন-বা দীপাধার
যেখানে রয়েছে কাচপাত্রে ঢাকা প্রদীপ,
কাচপাত্রটি যেন জ্যোতির্ময় নক্ষত্র
পবিত্র জলপাই বৃক্ষের আলোয় প্রজ্বলিত
এটি পূর্ব কিংবা পশ্চিমের নয়
অগ্নি তাকে স্পর্শ করেনি তবুও সে প্রদীপ্ত
জ্যোতির ঊর্ধ্বে জ্যোতি;
আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে
সেই জ্যোতির অভিমুখী করেন।
উইলিয়াম ব্ল্যাকের উরিজেন-র সঙ্গে সূরা নূর-র আয়াতাংশ খানিক সাদৃশ্য ধরে। উইলিয়াম ব্ল্যাক অবশ্য বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বকে উপহাস করতে উরিজেনের কাহিনি ফেঁদেছিলেন! অনন্ত নিরাকারে অবস্থিত উরিজেন অজ্ঞাত উপায়ে অপ্রকাশ্য থেকে প্রকাশ্যে আবির্ভূত হয়। প্রকাশ্য হওয়ার কারণে জগৎ সৃষ্টির যজ্ঞে তাকে নিয়োজিত হতে হয় এবং সৃষ্ট জগৎকে শাসন করার ইচ্ছা তার মধ্যে জেগে ওঠে। জগৎ সৃষ্টি ও এর একচ্ছত্র প্রভু হওয়ার খেয়ালে মশগুল উরিজেন টের পায় না ইতোমধ্যে অনন্ত অপ্রকাশ্য থেকে রহসম্যয় অশুভ অর্কের (Orc) অভ্যুদয় ঘটে গেছে। শুভর সঙ্গে অশুভর উৎপত্তি ঘটায় দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং দ্বন্দ্বের কারণে শুভ না অশুভ, কে বেশি যৌক্তিক সে-প্রশ্ন সামনে চলে আসে।
দ্বন্দ্ব হচ্ছে যুক্তির জনক আর যুক্তি হলো অশুভের প্রতীক। যা কিছু অ-সৃষ্ট তা যুক্তিবিহীন, কিন্তু সৃষ্টকে যৌক্তিক হতেই হবে, অন্যথায় সে কেন বিরাজিত এই প্রশ্নের উত্তর মিলে না। সুতরাং জগৎ সৃষ্টির ধারা বজায় রাখা ও একে শাসন করা ছাড়া উরিজেনের মুক্তি নেই। ইচ্ছে করলেও তার পক্ষে নিজের অতীত অবস্থানে ফেরত যাওয়া সম্ভব নয়। আত্মপ্রকাশ একবার ঘটে গেলে তাকে আর নিরাকারে নিবারণ করা যায় না। উরিজেন এখন স্ব-সৃষ্ট জগতের ফাঁদে বন্দি! নিরাকারে যুক্তিবিহীন অবস্থায় সে বিরাজিত ছিল, নিরাকার ভঙ্গ করে আত্মপ্রকাশ ঘটানোয় নিজেকে যুক্তিযুক্ত করা ছাড়া উপায় নেই। যুক্তি অশুভের জনক কি-না, ব্ল্যাকের উরিজেন সে-প্রশ্ন রেখে যায় বটে!
কোরানের স্রষ্টাও এই ফাঁদে আটকা বোঝা যায়। যদিও এটি আমাদের অনুমান, এবং এই ব্যাপারে অধিক বিস্তারে না যাওয়াই সংগত। কারণ, স্রষ্টা যদি আলোসম ফোটন কণা দিয়ে গঠিত হয়ে থাকেন, এখন বিজ্ঞানের মতো তাঁকে স্থান-কাল-ভর ও মহাবিশ্বজুড়ে ক্রিয়াশীল বলের কাণ্ডকারখানা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে বটে, কিন্তু প্রমাণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং, তিনি অসীম অথচ সার্বত্রিক, তবে জগৎ সেখানে বৈদিক পরব্রহ্মার মতো তাঁর মধ্যে লীলা করে না। কুরুক্ষেত্র সমাগত হওয়ার ক্ষণে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে মায়াবলে ব্রহ্মাণ্ড দেখিয়েছিলেন, অন্যদিকে কোরানে বর্ণিত স্রষ্টা নিজেকে সৃষ্টি থেকে অবিরত পৃথক করেন। যার ফলে সুফি তরিকায় তাঁর মধ্যে অভেদ হওয়া ইত্যাদি কোরান হাতে নিলে টেকানো কঠিন।
সুফিবাদের বৃহদাংশ, এখন সেটি আরববিশ্বে প্রচলিত ও শরিয়তের সঙ্গে সংযোগ বজায় রেখে স্রষ্টার এবাদতে নিমগ্ন সুফিবাদ হোক, আর বড়ো পীর জিলানী থেকে শাহজালাল অবধি পরম্পরা হোক,—এখানে এর সবটাই সূরা নূর-র জ্যোতির ঊর্ধ্বে জ্যোতিকে উপজীব্য করে নানান ব্যাখ্যায় গমন করেছে। তার সঙ্গে সাধনতরিকা সৃষ্টি হয়েছে ব্যাখ্যা মোতাবেক। বয়ানের এক দুনিয়া হলো ইসলাম। শরিয়তপন্থীরা এই বয়ান তৈরিতে হাদিসকে ব্যবহার করছেন, যার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক সবসময় ছিল।

মোহাম্মদ এন্তেকাল করার দেড়শো থেকে দুশো বছর পরে হাদিস সংকলিত হচ্ছে। এখানে এটি যেসব তরিকা ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে,—তথ্য সংগ্রহের বৈজ্ঞানিক পন্থা বিবেচনায় নিলে প্রচুর গোজামিল চোখে পড়বে। যে-কারণে সহি আর জইফ বাছতে-বাছতে হাদিসশাস্ত্রবিদকে পেরেশান হতে হয়। কোরান আচারনির্ভর কোনো গ্রন্থ নয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল, মানুষের কাছে স্রষ্টার একত্ব প্রচার করা। তার সঙ্গে উত্তম মানব হওয়ার জন্য বাস্তবজীবনে মানুষের করণীয় সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। যার ষোলআনা কান্টের বিশুদ্ধ নৈতিকতার সঙ্গে খাপ খায়। কোরানের ভালো দিক হচ্ছে,—এটি প্র্যাগম্যাটিক। ইহকালের জীবনকে গুরুত্ব দান করা হয়েছে এখানে। সন্ন্যাসবাদ থেকে আরম্ভ করে গডফ্রিক হওয়ার মতো ঘটনাগুলোকে কোরান বরং নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করেছে।
মানুষের জন্য স্রষ্টার বন্দেগি ততটুকু রাখা হয়েছে, যেগুলো সে অনায়াসে করতে পারবে। সে মনে রাখবে,—স্রষ্টা একক। স্মরণ রাখবে,—একক স্রষ্টা তার জন্য জীবনবিধান প্রণয়ন করছেন এই ভরসায়,—নিজের আকল ব্যবহার করে সে একজন উত্তম মানব হয়ে উঠবে। সম্পদ অর্জনে বাধা নেই, কিন্তু সম্পদ যেন অন্যকে পীড়ন ও বঞ্চিত না করে, সেদিকপানে তার নৈতিক মানদণ্ড জাগরুক থাকবে। সে যদি এভাবে যাপন করে, তাহলে আপনা থেকে তার মধ্যে ভোগের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্ম নেবে;—ততটুকু ভোগ করবে, যতটুকু একজন মানুষের জন্য অন্তিম।
ন্যায় বা সাম্যের চেয়ে ন্যায্যতা বা ইকুইটিকে কোরান প্রাধান্য দিয়েছে। এখন, হাদিস ও মাজহাব প্রসূত আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে ইসলাম মূলত ইহুদিদের সমুদয় গঠনকে নিজের ভিতর আত্মীকরণ করল। সেইসঙ্গে হয়ে উঠল পলিটিক্যাল। যার ওপর আজো সে প্রচণ্ডভাবে নির্ভরশীল ও সেই চক্করে পড়ে ফিতনার বড়ো কারণ।
ফেতনা সৃষ্ট অনাচার থেকে নিষ্কৃতির লক্ষ্যে সম্ভবত সুফিবাদের জন্ম। এর মধ্য দিয়ে কোরানের মর্মবাণীর মধ্যে ফেরত যাওয়ার চেষ্টা চোখে পড়ে। সময়ের সঙ্গে যেটি আবার বিচিত্র ব্যাখ্যা ও ভাবাদর্শ নিজের ভিতর ঢুকিয়ে আরেকটি শয়িয়ত জন্ম দিয়ে বসেছে। হাদিসনির্ভর শরিয়তরে মতো কঠোর ও অভিসন্ধিমূলক নয়, তবে অতিরিক্ত মাত্রায় ভাববাদের রসে চোবানো, যার ওপর ভর দিয়ে প্রাত্যহিক জীবনের জটিলতা মোকাবিলা করা দুরূহ। সাচ্চা সুফিপন্থী এখানে এসে ওই বৈরাগ্যকে সম্বল করে জাগতিকতার বাইরে চলে যেতে থাকেন। আর, তাঁর ভক্তরা না-ঘর না-ঘট পরিস্থিতির মধ্যে কালাতিপাত করে। সে ভক্ত, কিন্তু তার ভক্তি স্রষ্টার অসীমত্বকে অনুভব করে কি?

প্রাচ্যে এই গুরুবাদী পন্থা মানুষকে ক্রমে যুক্তিবিরহিত মিথপূজারী করে তুলেছে। জাগতিক সংকটকে যে-কারণে সুফি ও মাজারপন্থীরা এখন আর মোকাবিলার শক্তি রাখেন না। সময় যত যাবে, তাদের এই জীবনধারা তাদেরকে মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপে রূপান্তরের সম্ভাবনা প্রবল করে তুলবে। সুফিকেও জীবনবাদী হতে হয়। তার মধ্যে সৃষ্ট ইশকের লহর যদি সমাজকে প্রভাবিত করতে না পারে, ভালোবাসার প্রয়োজনকে অমোঘ করে তোলার শক্তি না ধরে, প্রেমের প্রচারে শহিদ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে অগ্রসর হতে না পারেন, অন্যায়ে জড়োসড়ো থাকেন, ভক্তিরস ও কাওয়ালে নিরাময় খোঁজেন কেবল… এগুলো তাকে প্রকারান্তরে পলায়নবাদী করে।
সুফি তরিকার যাঁরা প্রণেতা… রাবেয়া বসরী, মনসুর হাল্লাজ, সোহরাওয়ার্দী, ইবনুল আরাবী, মাওলানা রুমি অথবা এখানকার নিজামউদ্দিন আউলিয়া, খাজা মইনুদ্দীন চিশতি, হযরত শাহজালাল… তাঁরা সকলে ইহকাল-ঘনিষ্ঠ ও জীবনবাদী ছিলেন। প্রচুর ঝুঁকি সয়েছেন জীবনে। সমাজকে ঝাঁকুনিও দিয়েছেন। শুদ্ধ নৈতিকতার সঙ্গে প্রেমের সাকি পান করে মানুষকে এই বার্তা দিয়েছেন অবিরত,—আচারনিষ্ঠতা মানে ধর্ম নয়, ধর্ম হচ্ছে এমতো সালাত, যেটি মানুষকে সৃষ্টির অসীম বিস্তার টের পেতে সাহায্য করে, আর মানুষ হয়ে ওঠে বিনয়ী, সহিষ্ণু ও উদার,—এবং প্রয়োজনে প্রতিবাদী। বাংলাদেশের সুফিপন্থায় এর কিছু তো দেখি না ভাই। আর কবিলেখকরা ঠিক কোন তরিকায় সুফি… সে এক উনারা জানেন, আর জানেন তাঁদের মুর্শিদ!
. . .
. . .



