
আরববিশ্বের প্রবাদপ্রতিম কণ্ঠশিল্পী উম্মে কুলসুমের নাম আম্মার মুখে প্রথম শুনেছিলাম। যে-সময়ের কথা বলছি, শহর ও গ্রামের ঘরে-ঘরে তখন রেডিওর রাজত্ব চলছে। অনেকের ঘরে টেলিভিশন পৌঁছালেও প্রসার ছিল সীমিত। মহল্লায় দশ ঘরের মধ্যে হয়তো দুই ঘরে রেডিওর পাশে সাদাকালো টেলিভিশন দেখো যেত। জিয়াউর রহমান দেশের ভাগ্যবিধাতা হওয়ার পর সম্ভবত বাংলাদেশ টেলিভিশন সাদাকালো থেকে রঙিন যুগে প্রবেশ করে। রেডিওর দাপট এরশাদ শাহীর পতন নজদিক হওয়ার দিনকালেও কমবেশি অটুট থেকেছে। টেলিভিশন ততদিনে ঘরে-ঘরে পৌঁছে গেলেও উন্মুক্ত গণমাধ্যমের পরিসর ছিল সংকীর্ণ। রাজনৈতিক টানাপোড়েনের খবর নিতে লোকজন বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা বেশ নিয়ম করেই শুনছেন তখনো।
যাইহোক, রেডিও কথিকা, নাটক, সংগীত ছাড়াও বিচিত্র অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বেতার সমৃদ্ধ তখন। দুপুর ও সন্ধ্যার মধ্যবর্তী অবসরে আম্মাকে দেখতাম,—বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বেগম অথবা গল্প-উপন্যাসের পাতা উলটাচ্ছেন। শ্রুতিনাটক, রেডিও কথিকা, সিনেমার বিজ্ঞাপন শুনতে রেডিও ছেড়ে রাখতেন। সপ্তাহে একদিন বিদেশি গানবাজনার অনুষ্ঠান প্রচার করত বেতার। রাতে আবার রিপিট হতো সেটি। লতা-আশা-সন্ধ্যা ও নূরজাহান, আর আমাদের এখানকার ফেরদৌসী রহমান, শাহনাজ রহমতুল্লা ও রুনা-সাবিনাদের পাশাপাশি মিশরের কোকিলকণ্ঠী শিল্পী উম্মে কুলসুমের গান মাঝেমধ্যেই তারা প্লে করতেন। ছোট্ট ভূমিকায় শিল্পী ও তার গানের ব্যাপারে আগাম ধারণা দিতেন উপস্থাপক। আম্মাকে বেশ কান খাড়া করে অনুষ্ঠানটি শুনতে দেখেছি তখন।
সংগীতের ভাষা সর্বজনীন। ভাষিক অন্তরায় থাকলেও সংযোগ স্থাপনে বড়ো একটা অসুবিধা পড়ে না মানুষ। আরবি ভাষা কিছু না বুঝলেও উম্মে কুলসুমের গানের সঙ্গে আম্মা নিজের মতো করে একটি বোঝাপড়া সেরে নিয়েছিলেন। পরে এই ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করলে হাসি দিয়ে বলতেন,—কোরান সুর দিয়া পড়লে যেমন লাগের, কুলসুমের গলায় আল্লায় হেই সুর ঢালি দিছইন। হুনতে ভালা লাগে। গানে শিল্পী কী বলছেন, আম্মার কাছে সেটি মুখ্য ছিল না। আরব গায়িকার কণ্ঠচিরে বেরিয়ে আসা ধ্বনিব্যঞ্জনার ওঠানামা তাঁকে বশ রাখত মনে হয়।
ইন্টারনেটের কল্যাণে মিশরদেশি গায়িকা এখন বিশ্বে সকলের কাছে সুলভ হয়েছেন। সেই থেকে আজো শুনছি তাঁকে। গুণীজনরা বইপত্র লিখেছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও তথ্যচিত্রও অনলাইনে সুলভ। তার কিছু দেখেছিও। কোকিলকণ্ঠী শিল্পী কী-কারণে আরববিশ্বের হৃদয় হরণ করেন তা টের পেতে কাজে লেগেছে বৈকি। উম্মে কুলসুমের গান পরিবেশনার জাদু বব ডিলানের মনোযোগ কেড়েছিল। লেড জেপেলিনের মতো রকগানের দল ছিলেন ইম্প্রেসড। মারিয়া কেরি, বিয়োন্সে বা শাকিরার মতো পপ কুইনরা তো আছেনই! গানের পাখির গানে কান পাতলে মুগ্ধতার কারণ বোঝা যায় বটে!
বড়ো কথা, উম্মে কুলসুমকে যতবার শুনতে বসেছি, আরবি ভাষা কিছু ধরতে না পারলেও, তাঁকে সংযোগ করতে অসুবিধায় পড়তে হয়নি। ইংরেজিতে তাঁর গানের ভাষান্তর অবশ্য এখন অনলাইনে পাওয়া যায়। গানের অন্তর্নিহিত আবেদন ধরতে শ্রোতাদের তাতে সুবিধা হয়েছে। উম্মে কুলসুমের গানে কথার চেয়ে বড়ো হয়ে দাঁড়ায় পরিবেশনরীতি, এবং সেটি শ্রোতাকে আটকে ফেলে গায়কি ও সুরজালের মায়ায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে দুজন শিল্পীর নাম নিতে হয়,—দেহ রাখার পর তাঁদের শেষযাত্রায় মানুষের ঢল নেমেছিল। আফ্রিকা মহাদেশের সন্তান ছিলেন দুজন। একজন আফ্রোবিটের জনক পপ তারকা ফেলা কুটি। তাঁর মারা যাওয়ার খবরে নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশে বিষাদ নেমে আসে। সংগীতকে আফ্রিকার স্বকীয়তা চেনানোর হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন ফেলা কুটি।
শ্বেতাঙ্গ মহাজনদের রেখে যাওয়া শোষণযন্ত্রের ভারবাহী ক্ষমতাচক্রের সঙ্গে বিরোধ যে-কারণে তীব্র ছিল। তাঁকে হেনস্থা করতে কিছু বাকি রাখেনি তারা। শেষযাত্রার দিনেও বিধিনিষেধ আরোপ করে নাইজেরিয়া সরকার। সেগুলো উপেক্ষা করে মানুষ রাস্তায় নামে। দশ লক্ষের ওপর মানুষ পপগুরুকে বিদায় জানাতে রাজপথে নেমেছিল সেদিন। আর, উম্মে কুলসুমকে শেষ বিদায়ে কায়রো শহরে ত্রিশ থেকে চল্লিশ লক্ষ লোকের ঢল নেমেছিল। শিল্পীকে শেষবার একনজর দেখার আকুতি মিটাতে কর্তৃপক্ষকে কায়রো শহরে তিন ঘণ্টা ধরে শিল্পীর মরদেহ নিয়ে ঘুরতে হয়েছিল। বিরল ঘটনাই বটে!
উম্মে কুলসুমের প্রবাদপ্রতিম মিথচরিত্রকে এটি আমাদের সামনে হাজির করে। তাঁর জনপ্রিয়তার মাত্রা আমরা ধরতে পারি এখানে। কবিতা, গান ও নৃত্যকলায় সমৃদ্ধ আরব জলবায়ুতে শিল্পীর স্বকীয়তা তথাপি বোঝা বাকি থেকে যাচ্ছে। এবং সেখানে আম্মার করা মন্তব্য, বব ডিলান, আর নাগিব মাহফুজের অনুভব বরং তাঁর মাহাত্ম্য টের পেতে সাহায্য করে বেশ। কুলসুমের গানের মধ্যে আম্মা কোরানকে সহি তরিকায় সুর দিয়ে পাঠের ধ্বনিব্যঞ্জনা টের পেতেন। আরবি ভাষা না বুঝলেও কোরানের সঙ্গে শিল্পীর কণ্ঠযোগ আম্মা তখন আবিষ্কার করেছিলেন, এবং তা অবাস্তব নয়।
মিশরের প্রত্যন্ত গ্রামে কুলসুমের জন্ম। বাবা মসজিদে ইমামতি করতেন। তিনি লক্ষ করলেন,—ঘরে কোরান পাঠের সময় কুলসুমের কণ্ঠে প্রতিটি আয়াতের শুদ্ধ উচ্চারণ ছাড়াও সাংগীতগর্ভ ব্যঞ্জনা কানে শ্রুতিমধুর শোনায়! নমুনা পেতে কুলসুম অভিনীত ছায়াছবিতে তাঁরই কণ্ঠে কোরানপাঠ শোনা যেতে পারে। বালিকা বয়সে আরব অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো গান তিনি চট করে কণ্ঠে তুলে নিতেন। শ্রুতিমধুর তো অবশ্যই, গানগুলো তাঁর কণ্ঠে নতুন দ্যুতি ছড়াত। মিশরের গ্রামাঞ্চলে ততদিনে মেয়েদের ওপর ইসলামের বিধিনিষেধ শক্ত হয়ে চেপে বসেছে। মেয়েদের পক্ষে এক কায়রো বা বড়ো শহর ছাড়া প্রকাশ্যে গানবাজনা করার উপায় ছিল না। মসজিদে ইমামতি করলেও উম্মে কুলসুমের বাবা মুক্তমনা লোক ছিলেন। মেয়েকে তিনি ছেলের ছদ্মবেশ পরিয়ে মঞ্চে তুলতে থাকেন। সময়ের সঙ্গে কুলসুম পরিপক্ক হয়ে উঠলেন। শহরের নামকরা সংগীতকারদের চোখ পড়ে তাঁর ওপর। আর এই সুবাদে যাত্রা ঘটে কায়রোয়। বাকিটা ইতিহাস।
এই-যে কায়রোয় শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন বুকে উম্মে কুলসুম গমন করলেন, নেপথ্যে ছিল গান গাওয়ার সময় তাঁর কণ্ঠের সূক্ষ্মতা আর আরবি শব্দ নিখুঁত উচ্চারণের কারণে সৃষ্ট ধ্বনিব্যঞ্জনা। ছেলেবেলায় কোরান পাঠের মধ্য দিয়ে এটি তিনি রপ্ত করেছিলেন। উম্মে কুলসুমের শব্দ উচ্চারণ ও ধ্বনিব্যঞ্জনা সৃষ্টির মাধুর্যকে আরবি ভাষায় বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ আরব জনগণ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে ভোলেন না। তাঁর শুদ্ধ উচ্চারণ নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে গবেষণাও হয়েছে অনেক। ড্যানিয়েলসন রচিত বই The Voice of Egypt, আর বিবিসির হয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র A voice like Egypt-এ মাইকেল গোল্ডম্যান আরব গায়িকার বিশেষ এই দিকটির ওপর আলো ফেলেতে ত্রুটি করেননি। হাল জামানার আরব শিল্পীরাও তাই। উম্মে কুলসুমের ধ্বনিগত ব্যঞ্জনা সৃষ্টির প্রতিভাকে সকলে সমীহ করেই কথা বলেন।
দ্বিতীয় বিষয়টি ধরা পড়ে নোবেলজয়ী লেখক নাগিব মাহফুজের করা একটুকরো মন্তব্যে। উম্মে কুলসুমের মধ্যে লেখক প্রাচীন মিশর ও পরে ইসলামবাহিত সংস্কৃতির মিলন মোহনা দেখতে পেয়েছিলেন। দুটি পৃথক ও সাংঘর্ষিক ঐতিহ্যকে কণ্ঠে ধারণ করেছেন শিল্পী, এবং ঘটিয়েছেন সম্মিলন। কুলসুমকণ্ঠে গীত আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা গানে কান পাতলে নাগিব মাহফুজের কথার সারসত্য শ্রোতারা ধরতে পারবেন।
বব ডিলানের রাখা বক্তব্যে অন্য আরেকটি দিক উঠে আসে। গানভাণ্ডারি ডিলান আশির মাঝামাঝি গানের কথা ও গায়কি নিয়ে এক আলাপচারিতায় তাঁর ব্যাপারে কিছু কথা বলেছিলেন। আরবদেশে গান করতে গিয়ে প্রথমবারের মতো শিল্পীর গান শোনেন ডিলান। তারপর থেকে তাঁর সকল সময়ের প্রিয় পছন্দের তালিকায় উম্মে কুলসুম স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। বব ডিলানের কাছে উম্মে কুলসুমের অবিশ্বাস্য লোকপ্রিয়তা ও দেহত্যাগের ঘটনাকে ঘিরে মানুষের বাঁধাভাঙা আবেগ অতখানি গুরুত্ব পায়নি। উম্মে কুলসুম শোনার সময় আরবি ভাষার একবর্ণ তিনি ধরতে পারেননি;—অকপটে সে-কথা বলেছেনও। গানের অর্থ ধরতে না-পারা এখানে তাঁকে বিচলিত করেনি একটুও। কুলসুমকে শুনতে গিয়ে ডিলানের কানে বরং ব্যতিক্রম গায়ন-পদ্ধতিটি তরঙ্গ তুলেছিল। কুলসুমের গায়ন-পদ্ধতি, বব ডিলানের মতে,—সমগ্র পাশ্চাত্য সংগীতের ইতিহাসে বিরল। এভাবে গান গাওয়ার নজির খুঁজে পাওয়া কঠিন।
গায়নরীতিকে এখানে গানের কথার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে সাব্যস্ত করেছেন ডিলান। তাঁর মতে,—গানে কথার ভূমিকা ও আবেদন সবসময় ছিল, থাকবেও,—কিন্তু কথাকে গাওয়ার প্রণালী হলো আসল চাবি। গায়নপ্রণালীর মধ্যেই কথার সারবত্তা ভাষা পায়। উম্মে কুলসুম এখানে এসে অনন্য হয়ে উঠছেন। পাশ্চাত্য রীতির অর্কেস্ট্রেশনের সঙ্গে আরবি কবিতার ধ্রুপদি ব্যঞ্জনা, এর ভাষারীতি ও ঐতিহ্যকে সুনিপণ গলায় তুলছেন শিল্পী। তাঁর একটি গান চল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা বা তারো বেশি সময় ধরে শ্রোতা শুনে চলে, কিন্তু তা তাকে বিরক্ত বা ক্লান্ত করে না কখনো! ঘটনাটি বিস্ময়কর!
একটি গানকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে লম্বা সময় ধরে গাইতে থাকেন উম্মে কুলসুম। একটাই গান এভাবে ফিরে-ফিরে গেয়ে চলার সময় গানের মেজাজ খুব-যে পালটায় তা নয়, কিন্তু শ্রোতা তথাপি নিবিষ্ট হয়ে শুনে চলে। নির্দিষ্ট কোনো স্তবক অথবা চরণ ঘুরেফিরের বারবার গাইবার সময় শ্রোতার এরকম মনে হয়,—ধ্বনিব্যঞ্জনা এখানে অন্তহীন সময় ধরে বইছে, এবং এই প্রবাহন বন্ধ না হলে ক্ষতি নেই। গলার খাঁজভাঁজ থেকে বেরিয়ে আসা গানকে এভাবে অপূর্ব সম্মোহন বিস্তারের মাধ্যমে গাওয়ার ক্ষমতা সত্যিই বিরল!
সমগ্র পাশ্চাত্য সংগীতে এই ধারার গায়কির দেখা মিলবে না বলে অভিমত রেখেছিলেন বব ডিলান। এমনকি তিনি যেভাবে গানের কথাকে ব্যালাড আঙ্গিকে সচারচর গেয়ে থাকেন, দীর্ঘ লয় বিস্তারের দিক থেকে সেটি উম্মে কুলসুমের সমগোত্র নয়। লম্বা সময় ধরে ব্যালাডধাঁচে কবিতার পরিবেশনা সংগীতের ইতিহাসে তুলনারহিত। উম্মে কুলসুমের শ্রোতাপ্রিয় ইন্তা ওমরি, আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা, আল আতলাল, ফাত আল মাদ ইত্যাদি গান শুনতে বসলে ডিলানের কথার সারার্থ ঠায়-ঠায় বোঝা যায়। সংগীতের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও সাফল্য পেয়েছিলেন শিল্পী। সিনেমায় তাঁর অভিনয় ও কণ্ঠযোজনা ছিল সাবলীল। রোমান্টিক বিষাদে আতুর প্রেমগাঁথা উম্মে কুলসুমের মূল উপজীব্য হলেও বাদনপ্রণালীতে ছিল নতুনত্ব।
কুলসুমের প্রতিভার শতভাগ উন্মোচনে মিশরের বিখ্যাত গীতিকার আহমাদ শাফিক কামেল আর সংগীত পরিচালক মুহাম্মদ আব্দেল ওয়াহাব ও রিয়াদ আল-সুনবাতির নাম না নিলে নয়। এঁনাদেরকে বাদ দিয়ে তাঁকে ভাবাটা অবান্তর। এঁনারাই মূলত মিশরের এই বিস্ময়কে গড়েপিটে নিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি হয়তো সুরের দেবী হয়ে লোকের আদর কুড়াতেন মাত্র। আমাদের এখানে লতা-আশা-সন্ধ্যাকে অতুল করে গড়তে শচীন দেব বর্মণ, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সলিল চৌধুরী ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো সংগীতকার বিরাট অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশে রুনা-সাবিনার গায়কিতে নিহিত বিশেষত্বও আলাউদ্দিন আলী, আলম খান, সত্য সাহা, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল প্রমুখের ছোঁয়ায় পেয়েছিল পূর্ণতা। মিশরে মুহাম্মদ আব্দেল ওয়াহাব অনুরূপ কাজটি করেছেন তখন।
পাশ্চাত্য বাদনপ্রণালীর মধ্যে আরববিশ্বে জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্রের সমাবেশ ছিল চমকপ্রদ ও সৃষ্টিশীল। এখানে তাঁকে সলিল চৌধুরীর সহযাত্রী বলা যেতে পারে। তবে উম্মে কুলসুমকে নিয়ে আয়োজিত এক-একটি কন্সার্টে আবদুল ওয়াহাবের ঐকতানধর্মী সুর সৃষ্টির ধাঁচ এতটাই বিশেষত্বে পূর্ণ,—সলিল চৌধুরীর মধ্যে সেটি পাওয়ার নয়। তাঁর গানে ঐকতানের ব্যবহার অন্যভাবে ঘটেছে, যেটি মূলত সিনেমার গানে প্রয়োগ করেছেন সলিল। ঐকতানধর্মী বাদনে চেলো, গিটার, পিয়ানো ইত্যাদির সঙ্গে আরববিশ্বে জনপ্রিয় ওদ-এর সংমিশ্রণ, স্ট্রিংয়ে বিশেষ দ্যোতনা ও ঝোঁক সঞ্চার, আর তার সঙ্গে কুলসুমকণ্ঠে নিঃসৃত ধ্বনিব্যঞ্জনা মিলেমিশে ধ্রুপদি সংগীত শ্রবণের আবেশ জাগে মনে। গীতিকবিতাই গাইছেন কুলসুম, কিন্তু সেখানে প্রতিটি চরণ কিংবা ইন্তা ওমরি বা উল্লে সুফতুর মতো বাক্যে নিহিত ধ্বনিব্যঞ্জনাকে মূর্ত করে তোলায় তাঁর দক্ষতার কথা ভাবলে অবাক হতে হয়!
উম্মে কুলসুমের গানে সঞ্চারিত একাকীত্বের মর্মবেদন ও বিষাদ ভারাতুল আকুলতার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিজীবনের সংযোগ ছিল গভীর। ক্লান্তিহীনভাবে তাঁকে গান করে যেতে হয়েছে দিনের-পর-দিন। ছিল একাকীত্বের যাতনাও। পঞ্চাশ-ঊর্ধ্ব বয়সে পৌঁছার পর বিয়ে করেন শিল্পী। তাঁর শিল্পীসত্তার সঙ্গে ব্যক্তিসত্তার এই টানাপোড়েনকে সম্প্রতি চলচ্চিত্রে ধারণ করেছেন ইরান দেশের নির্মাতা শিরিন নেশাত। উম্মে কুলসুমের সন্ধানে (Looking for Omm Kulthum) ছবিটি তাঁর ভাষায় ছবির ভিতরে ছবি হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজের আধিপত্য ছাপিয়ে আরব গায়িকার সাফল্যের কাহিনি ছবিতে পাচ্ছে দর্শক। কুলসুমকে নিয়ে ছবিটি যে-তৈরি করছে, সে আবার ইরান থেকে নির্বাসিত, এবং পিতৃতান্ত্রিক নিপীড়নের শিকার। দুই নারী সুতরাং এখানে সমান্তরাল দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। ছেলের ছদ্মবেশে মঞ্চে উঠে গান করার দিন থেকে জগৎবিখ্যাত শিল্পী রূপে আত্মপ্রকাশকে ক্যামেরায় পাশাপাশি অনুসরণ করেছেন শিরিন। লড়াই ও সফলতার নেপথ্যে যত বেদনা ও পীড়ন উম্মে কুলসুম সয়েছেন জীবনভোর, সেগুলোই তাঁর ব্যালাডধর্মী গীত-তরঙ্গকে এতটা মর্মভেদী করে তুলেছিল।
শিল্পীর প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি হয়ে ওঠার বড়ো কারণ মনে হয় এখানে নিহিত থেকেছে। তাঁর গানের প্রতি পরতে আরববিশ্বে বেড়ে ওঠা শ্রোতা অনুভব করে মরুভূমির জলবায়ু। সে অনুভব করে উটের পিঠে হাওদায় চলমান মরুযাত্রীকে। এবং, অনুভব করে, ইমরুল কায়েস, লাবিদ, আল মুতানাব্বিসহ আরো শত-শত আরব কবিকুলের রেখে যাওয়া কবিতায় ধ্বনিত মরুজীবনের খুঁটিনাটি, প্রেম, বিষাদ ও সকাতর যৌনবাসনা। অনুভব করে আরবি ভাষার ধ্রুপদি ব্যঞ্জনাও। এবং অনুভব করে, গানের গভীরে নিহিত এমন এক সুরধ্বনি, যেটি কোরানের সুরেলা প্রবাহকে মনে করায় বেশ।
এতগুলো চিহ্নকে অবলীলায় যিনি ধারণ করছেন কণ্ঠে, দীর্ঘ সময় নিয়ে গাইছেন অনায়াস, শুনে মনে হবে,—কখনো শেষ হবে না এরকম ব্যালাড গাইছে কেউ;—তিনি হেরিটেজ হবেন না এটি হতেই পারে না। মিশর, তিউনেশিয়া, লেবানন বা সিরিয়া… আরব অঞ্চলের বৃহৎ পরিসর জুড়ে উম্মে কুলসুম আজো প্রবাহিত ও সতেজ। তাঁর এই মিথরঞ্জিত আবেদন নিয়ে অবশ্য ভিন্ন প্রতিক্রিয়া আরববিশ্বে পাবো। ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও একে নিয়ে রাজনীতির সমস্যা আরববিশ্বকে দীর্ঘদিন ধরে ভোগাচ্ছে। আছে ঔপনিবেশিক মনোজগৎ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতে পর্যদুস্ত হওয়ার মর্মান্তিক ইতিহাস। আরব নারীরা দুর্ভোগ সয়েছেন অকল্পনীয়! উম্মে কুলসুমকে ক্রমশ মিথ করে তোলার মধ্য দিয়ে এসব ভোলানোর চেষ্টা আমিরা নওয়াইরার মতো অনেক নারীবাদী মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের মতে, এর ফলে আরববিশ্বে বিকল্প কোনো স্পেস থাকেনি, যেটি ষাট-সত্তর দশকে বালেগ তরুণ প্রজন্ম নিতে পারত।
বিটলস বা পাশ্চাত্য রক গানের আবেদন ও এর ভিতরে নিহিত দ্রোহ আরব প্রজন্মের অন্তরে তখন গভীরভাবে দাগ কাটেনি। উম্মে কুলসুমের ধ্রুপদি ব্যঞ্জনায় সম্মোহিত ও তাঁকে প্রশ্নতীত প্রতিমায় রূপ দিতে যেয়ে আরবরা এমনকি এখনো প্রত্যাখ্যান করে চলে অন্য সব বিকল্প, যেগুলো কুলসুমে পাওয়ার নয়। আমিরা নওয়াইরাদের কথায় যুক্তি আছে, তবে আরব ঐতিহ্যের প্রতিধ্বনি কণ্ঠে ও গায়কিতে কুলসুম এমনভাবে ধারণ করেছেন,—এর মিথ-আবেদনকে ছাটাই করা বিপজ্জনক; অনেকক্ষেত্রে অবান্তরও মনে হবে তা! সে যাকগে, আমিরা নওয়াইরার আপত্তি থেকে এটুকু বেশ বোঝা হয়ে যায়,—মিশরের গানের পাখিকে ভালোবাসার ঘটনায় আরববিশ্বে প্রজন্মান্তর বড়ো কোনো প্রভাব ফেলেনি এখনো। তারা আজো তাঁকে এল সেত বা দ্য লেডি হিসেবে সমীহ করেন, আর ভালোবাসেন হৃদয় দিয়ে।
. . .
. . .




One comment on “গানের পাখি উম্মে কুলসুম”