দেখা-শোনা-পাঠ - পোস্ট শোকেস

ও তরঙ্গ লাফাও

Reading time 5 minute
5
(61)

বাংলা একাডেমির জুলাই কবিতা সংকলন নিয়ে কবি ও অকবিরা কোঁদলে লিপ্ত, আর ওদিকে একজন কবির শব্দহীন প্রস্থান ঘটে গেল! রাহুল পুরকায়স্থ চলে গেলেন অনাড়ম্বর। হৃদযন্ত্রের ত্রুটি সারাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কবি। এক্সটার্নাল পেসমেকার বসানোর পর মনে হচ্ছিল আবারো ফিরবেন কবিতায়। লিখবেন ফের :

বলি, ও তরঙ্গ লাফাও
বলি, ভাসাও কাঙ্ক্ষিত
বলি, ও চণ্ডাল জাগো
আমি মৃত, জীবন্মৃত

শব্দে আনি প্রাণ
জলশব্দে লেখা গান
আমাকে আঁকড়ে ধরে
আমি ভাসি যে অক্ষরে

শূন্য পরবশ
মলমূত্রযশ
বলি, ভাসো হে কাঙ্ক্ষিত
আমি ক্ষিপ্র, অতর্কিত

না;—এবার আর ফেরা হলো না তাঁর। হাসপাতাল থেকে গঙ্গাযাত্রা করলেন কবি। শেষযাত্রাটি তাঁর কবিতার সঙ্গে আশ্চর্য মিলে যাচ্ছে বটে! হৃদযন্ত্রের ত্রুটির কারণে কবি একপ্রকার মৃত ও জীবন্মৃত ছিলেন। ‘শ্রুতি ও স্মৃতির মাঝে’ ধীরে উঠে বসার লড়াই ছিল জারি। কিন্তু সময় তাঁকে সময় দিতে নারাজ ছিল এইবার। কবি কাজেই একরাশ কবিতায় জীবন ও মরণের প্রহেলিকা অসমাপ্ত রেখে চলে গেলেন! আমাদের জন্য রেখে গেলেন আশ্চর্য চরণ : বলি, ও তরঙ্গ লাফাও।

Poet Rahul Purkayastha; Image Source – Collected

‘ও তরঙ্গ লাফাও’ নামে কবির অস্ত একখানা বই রয়েছে। অনেক দিন আগে পড়েছিলাম। অবুঝ মুগ্ধতায় টানা পড়া গিয়েছিল শব্দের মিতবাক সংযমে বাঁধাই কবিতারা। তারপর ফিরে পাঠ করা হয়নি কখনো! কেন ফিরে পাঠ করিনি সে-কথা ভেবে এখন অনুতাপ হচ্ছে। আমি পড়িনি তো কী হয়েছে! কবি লিখেছেন নিয়মিত। ছোটবড়ো মিলিয়ে কুড়িটির মতো কবিতার বই ছেপে বেরিয়েছে! বাছাই কবিতার দেখলাম তৃতীয় সংস্করণ বের করেছেন দেজ পাবলির্শাস। দুই বাংলার কবিতামহলে কাজেই রাহুল পরিচিত ও পঠিত ছিলেন ভালোই।

ছোটকাগজ আর অনলাইন সাহিত্যপত্রে কবি লিখেছেন নিয়ম করে। শব্দের জগতে সন্ন্যাস নেওয়ার কারণে তাঁর অবশ্য না লিখে উপায়ও থাকেনি। ছিলেন সাংবাদকিতায় সক্রিয়। যে-কারণে হয়তো রাহুল পুরকায়স্থর চলে যাওয়ার খবর ওপার বাংলার গণমাধ্যম গুরুত্বের সঙ্গে সামনে এনেছেন। বাংলাদেশে তাঁর পরিচিত কবিতা-বন্ধুরাও তাঁকে ইয়াদ করতে ভোলেননি। এসব ঝটিতি জানছি এখন;—যেহেতু, মধ্যবর্তী সময়টায় ও তরঙ্গ লাফাও-র দ্যুতিগর্ভ উচ্চারণ বাদ দিলে স্মৃতি থেকে তিনি একপ্রকার মুছে যেতে বসেছিলেন।

অনলাইন কাগজগুলো কেবল মাঝেমধ্যে কবিকে আচমকা নজরে নিয়ে আসত, আর তখন ও তরঙ্গ লাফাও চরণখানা মগজে জ্বলে উঠত তাৎক্ষণিক। চরণটি মনে করিয়ে দিত,—ইনি রাহুল পুরকায়স্থ। গেল তিন অথবা চার দশক ধরে কবিতায় সক্রিয় রয়েছেন। অনেকানেক কবির ভিড়ে ব্যতিক্রম শব্দসন্ন্যাসী। কবিতায় এখনো ধ্যানি বক। শব্দকে ঠোঁটে শিকার করার পিয়াস যাঁর আজো মিটেনি।

অনলাইন জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো রাহুলের কবিতা ও গদ্যগুলোয় চোখ রাখতে গিয়ে মন চমকে উঠছে ক্ষণে-ক্ষণে! কেন জানি মনে হচ্ছে,—রাহুল পুরকায়স্থ তাঁর কবিতাযাত্রায় আগাগোড়া ওই একটি কবিতায় ধ্যানস্থ ছিলেন; আর তা হলো,—দেহকে ঘিরে ঘনীভূত হতে থাকা প্রবল অনিকেত-উদ্বাস্তু এক সুচেতনা। অবক্ষয়-অবলুপ্তির মাঝে দেহসত্তার পরিপূর্ণ উত্থানে নিজের সকল বিশ্বাস কবি জিম্মা করেছেন;—যেখানে, এটি তাকে নিরতিশয় মনোযোগী রাখে শব্দ শিকারে।

রাহুল এদিক থেকে আটপৌরে শব্দশিকারি কবি হলেও তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত শব্দরা নিশ্চিত অবলুপ্তির সম্ভাবনায় বিদীর্ণ দেহকে ঘিরে সংশয় ও অসমাপ্ত সব উত্থানের বার্তা রেখে যায়। বৌদ্ধসাধক যেমন নিরত মনোসংযোগ করে দেহে, যেখানে দেহকে অতিক্রম করে নিরালোকে সমাহিত হওয়ার অভিলাষ তাকে তাতিয়ে তোলে অবিরত,—নিজের কবিতায় সক্রিয় ইন্দ্রিয়ঘন পরিপার্শ্বের সঙ্গে রাহুল পুরকায়স্থর বোঝাপড়া সেরকম বটে!

কবি মাত্রই জীবন ও মরণের দোলাচলকে শব্দে শিকার করেন। রাহুল পুরকায়স্থও করেছেন তা। কিন্তু তাঁর করাটা ছিল এমন একখানা সমাধিফলক লেখার সাধনা,—যেটি তাঁকে স্মৃতি ও শ্রুতির মাঝে বারবার জাগিয়ে রাখবে। পুনরাবৃত্তির মতো কবির শব্দসাধনা তাই বুঝি শিকার করেছে ঔষধি;—দেহের অমোঘ অবক্ষয় যে-ঔষধির গুণে ঠেকাবেন কবিতায়। এ-কারণে হয়তো লিখেছেন পরপর অন্তহীন টানা মিতভাষে :

Poet Rahul Purkayastha; Image Source – Collected

. . .
মগ্নমরীচিকা

অর্ধেক কলঙ্কে ঢাকা
অর্ধেক প্ৰণয়


আমিও যে বাঁচি
এই কৃষ্ণপারাবারে


আমাকে চেনো না রাত্রি!
চেনো না আমার গতিপথ!


যতদূর বহে বায়ু, কল্পনার শ্বাস
আমি স্বপ্নক্রীতদাস

. . .
শস্যে ও শ্মশানে জাগো,
দেখো, জিহ্বা উড়ন্ত, উধাও

আমাদের খিদেরক্ত
রাঙা করে তাকে

আহারে ও অনাহারে জাগো,
ঘোরো পরী দেহে দেহে, আর

ক্ষুধামান্দ্য থেকে উঠে
ভাত বাড়ো, অন্নপূর্ণা, মৃতের আহার

. . .
বিপদরেখার দিকে পাখি উড়ে গেলে
তার ছায়াখানি ফেলে যায় আমার শরীরে!
শ্রুতি ও স্মৃতির মাঝে উঠে বসি, ধীরে

. . .
শবের শকটে উঠি পক্ষীভাবে আমি
মাঝে মাঝে মেঘে চড়ি, মাঝে মাঝে নামি
গুহার সংসারে আর সংসার-গুহায়
এভাবেই মৃত্যু ও শিল্প জন্মায়

. . .
আশ্রয় চেয়েছি আমি প্রতিটি সন্ধ্যায়
যেভাবে গাছের ছায়া গাছেই মিলায়
ভালবেসে


এ-শহরে প্রেম আসে
উল্কাপাত হয়


প্রতিটি সন্ধ্যাই জানি
বিগ্রহের রতিচ্যুত ক্ষয়

. . .
ভাষারহস্যের দিকে যে-রাস্তাটি গেছে আমি সেইদিকে যাই

বন্ধুভাবে দেখি চারপাশ।
বৃক্ষ দেখি, মেঘ দেখি, মৃত নক্ষত্রও দেখি পরপর।


এককোণে গনগনে কামারশালায় দেখি জ্বলছে অক্ষর।
তুমি তাকে গড়ো-পেটো, নতুন রূপের টানে বারবার নিভৃতি শেখাও।


একটি পাখির ডাক তোমার শরীরে বন্ধু,
তুমি তাকে শব্দরূপ দাও

. . .

বিচ্ছিন্ন সব কবিতা এগুলো। হয়তো কবির কোনো-না-কোনো বইয়ে তারা নিয়েছে ঠাঁই। হয়তো এর কোনোটা এখনো বইয়ে মলাটবন্দি নয়। সে যেমন হোক,—পঙক্তির গাঁথুনিতে ও তরঙ্গ লাফাও-র মতোই রাহুল পুরকায়স্থ বরাবরের বাকসংযমী। কবি ততটুকু বলছেন, ততটুকু প্রকাশিত হতে দিচ্ছেন, ততটুকু ধরা দিচ্ছেন,—যেটুকু না হলে নয়। এর বাইরে সবটা ওই ‘একটি পাখির ডাক’;—যে তাঁকে কেবল একটি কথাসংকেত লিখতে বলছে কবিতায়। শঙ্খ ঘোষ তো এই পাখির ডাক বক্ষে ধরে কবির শেষ পরিণামের ইশতেহার লিখেছিলেন একদিন :

এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর

লেখো আয়ু লেখো আয়ু

ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে

স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও

রাহুল যেন-বা শঙ্খ ঘোষের যমজ! শব্দকে শব্দহীন করে দিতে একটি পাখির ডাকে-র উপমা জুড়ছেন কবিতার-পর-কবিতায়। কবির জন্য কবিতা একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়, যখন সে এমতো ধ্যানি বক হয়ে ওঠে, যে-বক এখন জানে,—শব্দশিকার তার দেহের অমোঘ বিনাশ ও কবিতাকে মরণে টেনে নিলেও কেবল এই পথে সে পরিপূর্ণ। রাহুলও তাঁর কবিতাযাত্রার মোক্ষম এপিটাফটি এভাবে রেখে গেছেন আমাদের জন্য :

গিয়েছি ভুলের থেকে আরও আরও ভুলের ভিতরে
দেখেছি ভুলের পোকা নেচে নেচে গান গায়
ফসলের ক্ষেতে

আমি তো ভাগের চাষী,
শব্দের ফসলে তারা গুনি

ঘর ভাসে, পথ ভাসে অনিশ্চিত
স্বরহীনতায়

এইরূপে ক্রমে ক্রমে কবিতা মৃত্যুর দিকে যায়

Poet Rahul Purkayastha; Image Source – Collected; @thirdlanespace.com

এরপর আর বলার কিছু থাকে না! রাহুল পুরকায়স্থ তবু ফিরতে চেয়েছিলেন। হৃদযন্ত্রে অনুভব করছিলেন একটি পাখির ডাক। সেই ডাক কি জীবনের? নাকি যে-দেহকে তিনি এতদিন ইধার-উধার সর্বত্র ঘুরতে দিলেন, যেটি একান্ত তাঁরই দেহ ছিল বটে, সে এখন নিথর হওয়ায় পাখি আর ডাকবে না!

না;—পাখি ডাকবে না, কিন্তু তার কূজন থাকবে জেগে কবিতায়। ও তরঙ্গ লাফাও বলে যে-কবিতারা মাঝেমধ্যে আচমকা মনে করিয়ে দেবে,—এই কবির পূর্বপুরুষদের দেহ কোনো একদিন শ্রীহট্ট নামে বিদিত অঞ্চল থেকে কলকাতায় পাড়ি দিয়েছিল। পেছনে ছিল মানচিত্র খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার বিপন্নতা। কবি জন্ম নিয়েছিল বটে কলকাতায়, কিন্তু সে জানত,—তার দেহটি অনিকেত! জানত,—তার আসলে কোনো ঘর নেই; না আছে স্থায়ী ভেবে কোথাও বিরাম নেওয়ার সুযোগ।

দেহকে ঘিরে রাহুল পুরকায়স্থর ফ্যান্টাসিঘন টানাপোড়েন, আর, তাকে ফিরে-ফিরে অনিকেত টের পেয়ে সমাধিফলক লিখে ওঠার চেষ্টায় দেশভাগের যন্ত্রণা মনে হচ্ছে বড়ো অবিচ্ছেদ্য ছিল! তাঁর বাংলাদেশী কবিবন্ধুরা রাহুলের হৃদযন্ত্রে কান পেতে কখনো শুনেছেন কি সেই রক্তক্ষরণ?

একটি পাখির ডাক তোমার শরীরে বন্ধু,
তুমি তাকে শব্দরূপ দাও
. . .

Poet Rahul Purkayastha reciting Rabindranath Tagore; Source – Collected

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 61

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *