ময়ুখ চৌধুরীর কবিতাপাঠে শেষ কবে ইস্তফা দিয়েছিলাম, সে এখন আর স্মরণ নেই। আট-দশ বছর তো হবেই। ছোটকাগজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার দিন থেকে তাঁর নাম কানে এসেছে। ক্রমান্বয়ে জেনেছি,—কবির নিবাস চট্টলায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ানোর পাশাপাশি কবিতা, গান ও গদ্য লেখেন। শামসুর রাহমান ছাড়াও সাহিত্যের একাধিক বিষয়ে নিবিড় ছিলেন গবেষণায়। জেনেছি,—তাঁর রাজনৈতিক বোধি প্রখর।
খুচরো এসব তথ্য ছাপিয়ে ময়ুখ চৌধুরীর কবিতামগ্নতার কথা ফিরে-ফিরে সামনে এসেছে। সিলেটের যেসব কবিলেখক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন একসময়,—কবি ময়ুখ চৌধুরীর ব্যাপারে তাঁদেরকে উচ্ছসিত হতে দেখেছি। রাজধানীবাসী কবিমহলের অনেকে কবির এই কবিতামগ্নতাকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে কথা বলতে ত্রুটি করেননি। সুতরাং, ধারাবাহিক পাঠে গরহাজির থাকলেও স্মৃতিপটে তিনি সদা থেকেছেন তরতজা।
মাঝখানে লম্বা সময়ের জন্য কবি ময়ুখ চৌধুরী পাঠতালিকার বাইরে চলে গেলেও এটি একপ্রকার মনে গেঁথে গিয়েছিল,—চট্টলানিবাসী কবি প্রচারধর্মী কবিতা পারতপক্ষে লিখেননি। গোড়া থেকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন দুর্গম পথ;—কবিতা যেখানে শৈল্পিক শুদ্ধতার সঙ্গে আপস করতে নারাজ। কবিতায় সাজানো পঙক্তিরা তাৎক্ষণিক ইশতেহার হওয়ার বাসনা রাখে না। দূরগামী অনুভবকে কবিতায় ধরতে বেশি লিখে বাছাই প্রকাশের পন্থা আরাধ্য করেছেন এই কবি। এ-কথা বলা যেতেই পারে,—ময়ুখ চৌধুরীর কবিতারা আড়ালহীন নয়। খোলসের মধ্যে ওইসব ব্যঞ্জনার তালাশে থেকেছেন তিনি, যেগুলো বাংলা কবিতায় ত্রিশের দশক থেকে একটি ধারা হিসেবে কবিতায় ভাষা পেতে মরিয়া ছিল।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বা সিকদার আমিনুল হকের সঙ্গে এখানে এসে কি কোনো সংযোগরেখা তৈরি করেন ময়ুখ? এতদিন পর তাঁকে পড়তে বসে প্রশ্নটি মনে জাগছে। কবিকে যাঁরা নিয়ম করে পাঠ করেছেন অতীতে, এবং এখন পড়ে চলেছেন,—আমার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতেও পারেন। সে যাকগে, কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ কালো বরফের প্রতিবেশী-র কবিতাগুলো একসময় পড়তে ভালো লেগেছিল। বইয়ের শিরোনামে ব্যবহৃত কবিতাটি তার মধ্যে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল মনে পড়ে! কবিতার শব্দবিন্যাসে সংগোপন সারার্থের কিছু তখন মাথায় ঢোকেনি!
এক দশক পর আবারো সেই অ-বোধগম্য কবিতাটির কথা ইয়াদ হচ্ছে। সময়-ক্যালেন্ডারের হিসাবে প্রায় দুই যুগ আগে প্রকাশিত কবিতাটি ধরে আগাই বরং। কবি লিখেছেন :
আপাদমস্তক কালো কান্না জমে আছে
বরফকঠিন ঘুমে স্তব্ধ জাগরণ।
নীলিমা-সমুদ্র-মাটি অবিরাম স্বপ্নের এলবাম
তার চোখে তুলে ধরে, হাওয়া লাগে।
কাঁপে ত্রিভুবন।
তিন যুগ স্বপ্নদেখা শেষে,
বামদিকে জোনাকীর সবুজ মাংসের ছোঁয়া পেয়ে
জেগে ওঠে হিমগুল্মলতা,
বিস্ফোরণমুখী এক কালাে নীরবতা।
তারপর শুরু হলাে গাঢ় অন্বেষণ,
হাত-পা বেরিয়ে আসে প্রবাহিত বরফের নামে।
প্রতিবেশী মরুর আকাশ
মেঘলা কষ্টের ভাজে প্লাবনের পটভূমি করেছে সঞ্চয়।
এইভাবে
ঘনত্রিভুজের মধ্যে জেগে ওঠে আদিম হৃদয়।
পিরামিড আয়ােজন গলে যেতে দেরি নেই বেশি
কল্লোলিত স্বপ্ন দেখে কাঁদে
কালাে বরফের প্রতিবেশী।
কবিতাটি এবে পড়তে যেয়ে অবোধ্যই থেকে গেল মনে হচ্ছে! সারার্থ ধরা দিয়েও ধরা দিচ্ছে না! ‘আপাদমস্তক কালো কান্না জমে আছে/ বরফকঠিন ঘুমে স্তব্ধ জাগরণ’… পঙক্তি দুখানা অবশ্য মনে আবেশ জাগাচ্ছে যথাবিহিত! অন্যদিকে, ‘পিরামিড আয়োজন’-এর মতো শব্দযুগল কেন জানি ক্লিশে শোনাচ্ছে কানে! পিরামিড ও প্যারিস নিয়ে কবির ফ্যাসিনেশন রয়েছে বোঝা যায়। কথাটি বলার কারণ রয়েছে। অনেকদিন পর পাত্তা লাগাতে গিয়ে দেখছি,—পিরামিড সংসার ও প্যারিসের নীলরুটি নামে আস্ত দুখানা কবিতাবই যথাক্রমে ২০০১ ও ২০১৭ সনে বাজারে প্রকাশ করেছেন কবি।
কালো বরফের প্রতিবেশী কবিতাটি নব্বই দশকের দ্বারপ্রান্তে পা রাখার দিনকালে ছেপেছিলেন তিনি। হতে পারে, আরো আগে লিখেছেন, কিন্তু পত্র-পত্রিকা ও বই মারফত পাঠকের কাছে পৌঁছায় নব্বইয়ের সূচনাগ্রে। যেখানে, ‘পিরামিড আয়োজন’-এর মতো ব্যতিক্রম শব্দযুগল মেটাফোর তৈরি করে দিয়েছিল। প্রায় দেড় যুগ পরে প্রকাশিত পিরামিড সংসার কবিতায় পৌঁছে মেটাফোরটি লাভ করেছে গাঢ়তা। কবিতাটি সুতরাং পড়তে চাই একবার :
দায়ভার বলে
বন্ধুকে কান্তার কথা বলেই ফেলেছি।
দায়ভার বলে
শিশুকে উদ্ধার করে বেঁধে দিই মায়ের আঁচলে।
দায়ভার বলে
নদীকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছি মোহনার কাছে।
চারিদিকে কোলাহল,
শুনি।
বারুদের গন্ধে ফুল ফোটে,
দেখি।
তাঁবুকে দোফাল্লা করে শরণার্থী শিশুর ক্রন্দন, লিখে রাখি।
মনুষ্যজন্মের স্মৃতি আছে বলে মানুষের সঙ্গে দেখা করি,
কবিদের দেখাদেখি আঁধারকে বলেছি শর্বরী।
সমস্ত দিনের শেষে জামা কাপড়ের ভাঁজ থেকে
নিজেকে আলগা করে দেখি
খুব একা।
পাথরে শ্যাওলার মতো পড়ে আছে মন
পিরামিড সংসারে বেঁচে আছি মমির মতন।

বোঝা গেল, কালো বরফের প্রতিবেশী কবিতায় বসানো পিরামিড আয়োজন শব্দযুগল ছিল এমতো মেটাফোর, যেটি এখন পিরামিড সংসারে নিজের পূর্ণতা খুঁজে নিচ্ছে। মেটাফোরকে কবি মাত্রই সচরাচর এভাবে ব্যবহার ও বহন করেন! সকল কবির মধ্যে কমবেশি প্রবণতাটি সুলভ বলে ধারণা করি। সেইসঙ্গে এটি খেয়াল করতে হচ্ছে,—কবিতাটির গঠনসৌকর্য ময়ুখ চৌধুরীর অন্যান্য কবিতার মতোই নির্মেদ। কবি বেশ হিসাব করে শব্দ জোড়েন কবিতায়।
বেশ, ধরে নিলাম হিসাব করে শব্দ জোড়েন কবি; কিন্তু, লম্বা বিরতি ভেঙে কালো বরফের প্রতিবেশী কবিতাটি পড়তে যেয়ে আমি-পাঠকের কাছে কেন অ-বোধগম্য থেকে যাচ্ছে এখনো! শব্দবিন্যাস ও প্রতীকায়ন এই কবিতায় দৃশ্যব্যঞ্জনা তৈরিতে খামতি রাখেনি;—এবং তা টের পেতে খুব-যে অসুবিধে হচ্ছে এমন নয়। আমি-পাঠকের সঙ্গে তথাপি সংযোগ কেন ঘটেও ঘটছে না! এখন তাহলে কী করা! কবিতাটিকে কি ব্যর্থ ধরে নেবো? মন বলছে,—ধরে নিতে পারো চাইলে, কিন্তু পরবর্তী পঙক্তিস্তবক আরেকবার পড়ে দেখো কেমন লাগে। প্রথম দুই পঙক্তির সঙ্গে সংযুক্ত স্তবকে কবি বলছেন :
নীলিমা-সমুদ্র-মাটি অবিরাম স্বপ্নের এলবাম
তার চোখে তুলে ধরে, হাওয়া লাগে।
কাঁপে ত্রিভুবন।
তিন যুগ স্বপ্নদেখা শেষে,
বামদিকে জোনাকীর সবুজ মাংসের ছোঁয়া পেয়ে
জেগে ওঠে হিমগুল্মলতা,
বিস্ফোরণমুখী এক কালাে নীরবতা।
—যদি ধ্যান দাও তাহলে পরপর সাজানো লাইনগুলো তোমাকে সৃষ্টির আদিলগ্নে ফেরত নিয়ে যাচ্ছে কি-না বলো?
: হুম! তাই তো দেখছি! আসমুদ্রহিমাচল অন্ধকার থেকে প্রথম প্রাণের জাগরণ ঘটার মতো কিছু অনুভূত হচ্ছে। এবং, সেখান থেকে পরবর্তী লাইনগুলোয় চোখ রাখলে দেখতে পাচ্ছি,—কবি জানান দিচ্ছেন অন্বেষণের কথা। বরফচাঁই ঠেলে প্রাণকল্লোল বেরিয়ে আসার প্রাণান্ত কসরতের ইশারাও পাচ্ছি বটে! অতঃপর, মোক্ষম স্থানে উপনীত হয়েছেন কবি। বেশ বলেটলে দিচ্ছেন,—আদিম প্রাণ মাতৃজরায়ুতে ঘনীভূত অন্ধকার থেকে নেমে আসতে বড়ো দেরি নেই আর :
ঘনত্রিভুজের মধ্যে জেগে ওঠে আদিম হৃদয়।
পিরামিড আয়ােজন গলে যেতে দেরি নেই বেশি
এ-পর্যন্ত ধরা গেল। ধাঁধায় ফেলছে শেষের দুলাইনে। কবি সেখানে যতি টানছেন :
কল্লোলিত স্বপ্ন দেখে কাঁদে
কালাে বরফের প্রতিবেশী।
সারার্থ কি দাঁড়াচ্ছে তাহলে? কবি কী বার্তা পুরে দিলেন,—সে একমাত্র তিনি ভালো জানেন। আমি-পাঠকের কেবল এই বোধ অনুভূত হচ্ছে,—সৃষ্টি হলো অনন্ত ক্রন্দন! মানবপ্রাণের আগমন ক্রমশ অনিবার্য হতে থাকাটা রোমাঞ্চক, এবং একইসঙ্গে দুঃসহ ভারে ভারাক্রান্ত। আগমনের পর সে একটি বাস্তবতার সম্মুখীন, এবং তা নয় বড়ো সুখকর, বরং অনিশ্চয়তার অমানিশায় আবিল!
বরফ শ্বেতশুভ্র হলেও ময়ুখ চৌধুরী এর রংকে ভ্যান গখের মতো বদলে দিচ্ছেন কবিতায়। এই বরফ অথবা বরফচাঁই নিকষ কালো। এতটাই কালো,—সে নিজে এখানে রচনা করে বসেছে জমকালো অমাবস্যা। কার অসাবস্যা? আমি-পাঠকের কাছে তা অস্তিত্ব ও একে নিয়ে উদ্বেগ হিসেবে আপাতত ধরা দিচ্ছে।

অস্তিত্ব হলো অনন্ত উদ্বেগের অপর শিরোনাম। কুলকিনারা করতে না পেরে সার্ত্রে একে দুর্ঘটনায় বিশেষায়িত করেছিলেন। কবি ময়ুখ চৌধুরী কি তাহলে অনন্ত অসীম মাতৃগর্ভের বরফকালো অন্ধকার থেকে অস্তিত্বিক আলোয় ভূমিষ্ট হওয়ার পরিণাম ভেবে উদ্বিগ্ন? উদ্বেগ জানান দিতে কালো বরফের প্রতিবেশী শিরোনামে কবিতাটি লিখলেন তখন? হতেও পারে;—আবার নাও হতে পারে। কবি একমাত্র জানেন, সাংকেতিকতায় আচ্ছাদিত কবিতাটি কী সারার্থ বহন করছে হেথায়। আমি-পাঠক কাজেই কবিতাটিকে এতদিন পরে এসে যে-সারার্থে বুঝে নিচ্ছি, কবি হয়তো বিপরীত কিছুর তাড়নায় লিখেছিলেন তখন।
ময়ুখ চৌধুরীর কবিতাভাণ্ডারে কালো বরফের প্রতিবেশী আমার কাছে চাবির মতো। এটি ঘোরাতে পারলে আগে-পরে যেসব কবিতা কবি পরপর লিখেছেন,—কেন জানি মনে হচ্ছে সেগুলো টপাটপ খুলে যাবে। আরো সব কবিতায় ব্যাপ্ত কবিসত্তাকে ধরতে পারা দুরূহ থাকবে না। কিছু কবিতাংশ এই ফাঁকে পড়তে চাই একটানা :
জাল কি জলের ওড়না না-কি মাছেদের?
অনিশ্চয়তার নুনে ভিজিয়ে রেখেছি এই জিজ্ঞাসাকে বহুদিন ধরে।
এই চিত্রনাট্য জানি, আদিম আদম থেকে আজকের অববাহিকায়
সাপের মতন চলে বুকে ঘঁষে সিনেমার ফিতে।
পাতালের খাঁজে, বুনাে ঝােপঝাড়ে একচোখা ভূতের মতন
একটি বােতাম জ্বলে প্রচণ্ড ক্ষুধায়, তার শরীরের যুগল রন্ধ্রে।
প্রচ্ছদের মতাে আলগা হয়ে আসে ক্রমে।
সর্প কিংবা বৃক্ষ কিংবা মানুষের লজ্জার বাকল। ক্রমান্বয়ে
থর থর কেঁপে ওঠে অন্য এক মাকড়সার জাল,
জলের ভেতর মগ্ন প্রশ্নভুক মাছ
ধীরে ধীরে গিলে খায় শিকারী জালের সব সুতাে।
[মাছ আর মাকড়সার জাল]
. . .
– এবার কোন দিকে স্যার ?
– সব দিকে যাও । চন্দ্রমল্লিকা যেহেতু নেই কোনােখানে,
তার মানে সব দিকে আছে।
তুমি আরও যেতে থাকো,—
আকাশে আরেক চন্দ্রমল্লিকার ইশারা তাে পাবে!
[চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি]
. . .
সহে না সহে না আর যৌবনের ভার,
চর্যার হরিণ ছােটে বন ফেলে সভ্য লােকালয়ে।
ছায়া হয়ে তাড়া করে নিষাদ যৌবন,
সত্তরের প্যারিসে এখন।
শত্রু তার মাংস আর চিত্রল প্রচ্ছদ,
শত্রু তার মৃগনাভি, অভিশপ্ত গম।
সমস্ত শরীরে বিষ, নীল গম, সকাল বেলায়
নীলরুটি পড়ে থাকে একা বিছানায়।
চিমনির ধোঁয়ার মধ্যে পুড়েছিলাে বেশুমার দেহ—
প্যারিসের নীল চোখা শিকারী যুবক ছাড়া
এ কথা জানে না আর কেহ।
[এইসব বিধবা হরিণ]
. . .
সিগারেট পোড়াতে দেখেছ সিগারেট পুড়তেও দেখেছ
কখনো দেখেছ তুমি—তুমি আছ, আমি আছি
মাঝখানে কী যেন কী নাই,
কখনো দেখেছ তুমি—
অপেক্ষার নামে
দু’ঠোঁটের মাঝখানে
নিভে যাওয়া আগুনের ছাই?
[অপেক্ষার ছাই]
. . .
বুক ঘষে-ঘষে বুক ঘষে-ঘষে পাড়ি দিচ্ছি
পথ।
বুক ঘষে-ঘষে বুক ঘষে-ঘষে বাড়ি যাচ্ছি—
কবিতার।
[হে কবিতা, অপেক্ষা করাে]

আপাতত এ’কটি থেকে যে-কণ্ঠস্বর পাচ্ছি তার সঙ্গে কালো বরফের প্রতিবেশী কবিতাখানার সংযোগরেখা কি কিছু স্পষ্ট হলো? নিবিড় করে তাকালে দুটি প্রসঙ্গ পাচ্ছি বৈকি। প্রথমত, এমন এক ব্যক্তির কথা কবিতারা বলছে, যে-ব্যক্তিটি বাস্তবিক পারিপার্শ্বে বিচরণের অভিজ্ঞতা থেকে পলকে প্রবেশ করছে এমনতরো বাস্তবতায় যেটি আসলে অচিহ্নিত। অনন্ত বরফচাঁইয়ে সে আচ্ছাদিত এখানে। অস্তিত্ব বন্দি এমন এক জালে, যেখানে রয়েছে চন্দ্রমিল্লাকার কাছে যাওয়ার বাসনা ও তাকে না পাওয়ার রোদন। রয়েছে প্রবল মাংসল যৌনবাসনা ও সকাতর প্রেমশরে জখম নীলমাছি। ফরাসি চিত্রকরের আঁকা ছবির মতো এটি প্রকাশ্য ও বিমূর্ত। সুতরাং ব্যক্তি-অস্তিত্ব নিজেকে জালে আটকানো মাছের অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে। ধারালো দাঁত দিয়ে জালখানা কেটে লাফ দিতে চাইছে এমন জলে, যেটি বরফচাঁইয়ে আচ্ছাদিত হলেও সেখানে প্রবেশের বাসনায় সে মরিয়া।
ময়ুখ চৌধুরীর কবিতায় সৃষ্টি, স্থিতি, বিলয় ও পুনরায় আর্বিভাবের জটিলতা কি তাঁকে দিয়ে প্রতীকী দৃশ্যব্যঞ্জনা তৈরি করায়? হতেও পারে। কবি জানেন তা ভালো। আমি-পাঠকের কাছে তাঁর কবিতা এভাবে পাঠযোগ্য ঠেকছে। তাঁকে রোমান্টিক ও ব্যক্তিবাদী ইত্যাদি শিরোনামে সংজ্ঞায়িত করার প্রবণতা অনলাইন ঘাঁটতে গিয়ে কিছুটা দেখতে পেলাম। ওসব ঢেঁড়া পেটানো অভিধায় কবিকে হয়তো দাগানো যায়, কিন্তু আমি-পাঠকের তাতে পোষাচ্ছে না বড়ো।
এই কবি সরল-সুবোধ্য নন। তাঁর শব্দচয়নে অলঙ্কার নেই। শব্দকে ইমেজ করে তোলার বাড়তি প্রয়াস প্রবল নয়। আবেগ পরিমিত বা সেখানে আতিশয্যের বাড়াবাড়ি নেই। এমনকি পরপর লাইন টেনে বিশেষ কোনো বার্তা দিতে তিনি উন্মুখ,—আমার তা মনে হয়নি। আমাদের পরিচিত শব্দ ব্যবহার করে তিনি বরং কবিতায় দার্শনিক জিজ্ঞাসাকে মুখ্য করছেন বলে ধারণা করছি।
প্রকাশিত হওয়া ও অবলুপ্ত হওয়ার মধ্যবর্তী পরিসরটি হচ্ছে জীবন ও বাস্তবতার তটরেখা। কবি সেখানে বিচরণ করতে-করতে, চন্দ্রমল্লিকাদের সঙ্গে গাঢ় প্রণয়-কাহিনি কইতে-কইতে ক্রমশ বেরিয়ে যাচ্ছেন পরিসরটি ছেড়ে;—এবং প্রবেশ করছেন অস্তিত্বিক অন্ধকারের কালো বরফচাঁইয়ে।
ময়ুখ চৌধুরীর কালো বরফের প্রতিবেশী কবিতাটিকে সুতরাং সিগনেচার পোয়েম ধরে নিচ্ছি আমি। কবি হয়তো অতোসব মানবেন না। হাসবেন ধরে নেওয়ার বহর দেখে। আমি-পাঠকের তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ, পাঠকের এটুকু স্বাধীনতা আছে তো,—সে তার মতো করে বানিয়ে নেবে জগৎ;—যেখানে ময়ুখ চৌধুরী হয়ে উঠবেন তার চেতনায় পঠিত সত্তা। তিনি কী ভেবে কবিতার জাল বুনছেন, সেটি ধরে অগ্রসর হতে পাঠক নয় দায়বদ্ধ।
এবং, অবশ্যই এখানে চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন কবিতা সিরিজের কবিতারা থাকছে বিশেষ বিবেচনায়। সবগুলো কবিতা সহজ ঢংয়ে লেখা, কিন্তু তারা কবিমনে সক্রিয় আলো-অন্ধকারের গমনাগমন ও অস্তিত্বিক অনিবার্যতার দ্বন্দ্ব থেকে বিচ্যুত, বিরহিত মোটেও নয়। কিছু বাছাই পঙক্তি পাঠ করা যেতে পারে :

আমার খারাপ লাগে—
আমি রোদ পোহাই, অথচ আমার ছায়া তা পারে না। (ওর শীত তো আরও বেশি)।
রোদ প্রচণ্ড হলে আমি আকাশমণির নিচে দাঁড়াই,
সেখানে তাকে আনতে পারি না।
ওকে আমি বোঝাতেও পারছি না : একদিন এমন অন্ধকারে যাবো,
যেখানে তাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
আজ, জানলা দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম : আমার নিঃসঙ্গ ছায়াটা একা একা রোদ পোহাচ্ছে। এবং আমি নেই।
[চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন-১]
. . .
ডাকাতের মতো ধুমধাম ঢুকে পড়লো নার্গিস।
পর্দা জানলা বিছানা—সবই লণ্ডভণ্ড।
দীর্ঘ চুলগুলোকে এমনভাবে আলুখালু করে দিলো,
মনে হচ্ছে আকাশের ছবি।
বৃষ্টিও হলো।
স্নায়ুর এক্যুরিয়াম থেকে নেমে কয়েকটা রঙিন মাছ
গরম কড়াইয়ের তেলে সাঁতার কাটছে।
তার নিচে জ্বলছে, বন্ধুদের নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের অহংকার।
[চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন-৩]
. . .
মাইকিং—‘একটি শোক-সংবাদ’,
পোস্টার—‘আমাকে বাঁচান’, পত্রিকা—‘আবার মিছিলে গুলি’।
গাছেরা মিছিল করতে পারে না,
তাই সারিবদ্ধ এক মিনিট নীরবতা পালন।
চোখ থেকে ঝরছে শুকনো অশ্রু, পাতা।
আমি হাঁটতে পারি, হাঁটি।
রেলিঙে ভর না দিয়ে তরতর উঠে যাই তিনতলায়।
কিন্তু, সঙ্গে সঙ্গে অক্টোপাসকেও নিয়ে আসি, ডালপালাসহ।
শাওয়ারের নিচে ধুয়ে ফেলতে চাই এসিডদগ্ধ মুখ।
তারপরও, ভাতের টেবিলে বসে ভাত নয়, অজস্র ধানের লাশ দেখি,
শাদা কাফনের রঙে সাজানো থালায়।
[চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন-১২]
. . .
ডানপায়ের স্যান্ডেলটা সেলাই করা হলো,
বামেরটাতে লাগবে না।
অথচ একই চামড়ার সহোদর ওরা, এমনকি যমজ।
দুজনেই হাঁটাহাঁটি করেছে সমান-সমান।
বেড়াতেও গিয়েছে একই জায়গায় (তবে হোঁচট খেয়েছে অন্য কোথাও)।
জীবনেরও দুটো পা আছে, এবং একজোড়া স্যান্ডেল।
বাম পা-টা মা-বাবার সংসারে, ডান পা-টা ক্যাকটাসের টবে।
[চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন-২০]
. . .
যে যার নিজের কক্ষে, আমি কক্ষপথহীন গ্রহ।
আকুল আগ্রহ নিয়ে অগ্নিপূজারীর মতো ঘুরপাক খাই।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের বক্ষে অমোঘ নিয়তি কাজ করে।
হয়তো মানুষ নই—উদ্বাস্তু উল্কার পিণ্ড, পৃথিবীতে ভস্মীভূত ছাই।
[চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন-১৬৮]
এর বাইরে আর কী-কী থাকছে? থাকছে আরো কিছু কবিতানিচয়,—মেহনতি মানুষের সঙ্গে কবির একাত্মতা ঘোষণার উচ্চারণ যেখানে মুদ্রিত। উদ্ধৃতির প্রয়োজন দেখি না। কারণ, এগুলো তাঁর কবিকণ্ঠের মূল ধ্বনিস্বর বলে অন্তত আমার কাছে বিবেচ্য নয়। কবি ময়ুখ চৌধুরী যে-আঙ্গিকে কবিতা লেখেন, সেখানে কেবল শিল্পের দায় থাকে না,—মগ্নজটিলতাও থাকে কমবেশি। বাস্তবতাকে ধারণ করে তারা অতিক্রম করে বাস্তবতার সীমানা;—হয়ে ওঠে ঈষৎ অধিবিদ্যক ও মায়াবিহারী।
তাঁকে পুরোদস্তুর মেটাফিজিক্যাল বলার উপায় নেই। রিয়েলিস্টিক বলা যাবে কি একবাক্যে? এই কবি বরং ইন্দ্রিয়কাতর সীমানায় থেকে জলের ভেতর মগ্ন প্রশ্নভুক মাছ। তিনি প্রশ্নশীল ও দ্বিধান্বিত। সুতরাং, তাঁর পক্ষে পুরস্কৃত হতে চাওয়ার বাসনায় নিমজ্জন বেশ কঠিন। যে-কারণে হয়তো লিখেছেন :
পরীক্ষায় ‘ধরা’ দিয়ে পাঁচটি বাক্য ঠিকই পারতাম।
তবু,
বইমেলা ধরতে শিখিনি।
লেখক হওয়ার স্বপ্ন হয়তো-বা থেকে যাবে মলাটবিহীন।
নাদানের মতো তবু লিখে যাচ্ছি ছাইপাঁশ সব।
এসব ইতরছানা
—তাদেরও তো শীত লাগে, গরম কাপড় কিংবা ছালা
—এ রকম বিবেচনা অলস চাদর ছেড়ে বেরোতে শেখেনি।
কেবল পাখির মতো ডিম-পাড়া, প্রাকৃতিক আনন্দই সার,
কী করে অমলেট ভেজে খেতে হয়
আজও শেখা হলো না আমার।
[অক্ষমতা]
এই কবির ভবিতব্য ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দেওয়া সংগত। মণীন্দ্র গুপ্ত তো সেই কবে বলে গেছেন :

কবি কোনোকালে গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় না। সুতরাং কবিতালেখক, আপনি নিজেকে দুর্ভাগা মনে করবেন না, উদ্বিগ্ন হবেন না, রেডিও টেলিভিশন সংবাদপত্রে প্রচারিত হবার জন্যে ছুটোছুটি করবেন না ৷ বরং বাসনাহীন হয়ে বইটি নিজের খরচায় ছাপুন, এবং তারপর শক্ত মলাটে বাঁধিয়ে, ভালো করে কীটনাশক মাখিয়ে কালের গর্ভে নিক্ষেপ করুন। মৃত্যুর পরে, অনেক দিন পরে, আপনি জানতে পারবেন আপনি কবি ছিলেন কিনা। আর যদি আমার কথা না শোনেন, ইহজন্মেই মার্কামারা কবি হতে চান, তবে করুনগে ছুটোছুটি।…
কোনটা চান আপনি? একজন জীবিত কবির প্রেত হতে, নাকি মরণের পরে কবিদেহে পুনরুত্থিত হতে?
[হিতোপদেশ, চাঁদের ওপিঠে : মণীন্দ্র গুপ্ত]
ময়ুখ চৌধুরী পড়ে মনে হলো,—তিনি এই পথ বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছায়। সুতরাং, তাঁকে অপেক্ষায় থাকতে হবে আরো অনেকদিন।
. . .
. . .




One comment on “কালো বরফের প্রতিবেশী”