দেখা-শোনা-পাঠ - পোস্ট শোকেস

মহসেন নামজুর কোরানগান

Reading time 5 minute
5
(59)
Mohsen Namjoo; Iamge Source – Deviant Art, Google Image

লায়লী-মজনুর অমর প্রেমকাহিনির নির্যাস থেকে বিরচিত আই সারেবান-এর (Eye Sareban) স্রষ্টা মহসেন নামজুর পরিচয় ও লোকপ্রিয়তা সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই। নামজু হলেন সেই সংগীতকার,—ফার্সি ভাষার নমনীয় ধ্বনিমাধুর্যে পাশ্চাত্য বাদনপ্রণালী ও সংগীত-ঘরানাকে সাবলীল একত্রে জুড়েছেন। ঐকতান নির্ভর বাদনপ্রণালী সহযোগে গানের পরিবেশনা তাঁকে বিশিষ্টতা এনে দিয়েছে। আরব অঞ্চল, বিশেষ করে মিশরে জনপ্রিয় ঐকতান নির্ভর বাদনপ্রণালী থেকে যদিও তাঁর পরিবেশনরীতি একেবারেই আলাদা।

ব্লুজের (Blues) মনোবিধুর বিষাদে রকগানের উচ্চলয়কে মহসেন নামজু একীভূত করে বসে থাকেন না;—ইরান তথা সমগ্র মধ্য এশিয়া জুড়ে প্রবাহিত লোকায়ত ব্যঞ্জনাও সেখানে মিশে থাকে সুনিপুণ। ইরান ও কুর্দিস্তান জুড়ে ছড়ানো লোকগান এভাবে কুড়িয়ে বেড়ান নামজু। সেগুলোকে পুঁজি করে গান লেখেন। গানে সুর বসান। সংগীত আয়োজন করেন একলা হাতে। দেশে-বিদেশে স্বকণ্ঠে গেয়ে বেড়ানো তো থাকছেই। সোজা কথায়, কমপ্লিট মিউজিশিয়ান রূপে ইরান, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপ-আমেরিকায় তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি বহুদিনের।

পাশ্চাত্য রক ও ব্লুজ ঘরানায় গীতিধর্মী লোকগানের সংমিশ্রণ মহসেন নামজুর গায়কি ও বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের রীতি-নিয়মকে পৃথক করেছে। আই সারেবান, শিরিন শিরিনাম, জুলফ, হোশাম বেবার, নামেহ, আল্লাহ, চে খবর… এবং আরো অনেক গানে এর স্বাক্ষর মুদ্রিত। অনলাইনে সুলভ এসব গানে কান পাতলে মহসেন নামজুর স্বাতন্ত্র্য সহজেই চিনে নেওয়া যায়।

Ey Sareban by Mohsen Namjoo; Source – Mohsen Namjoo YTC

আই সারেবান গানটির কথা ধরা যাক। লায়লী-মজনুর চিরভাস্বর আবেদনকে গানে ব্যবহার করেছেন নামজু। ফার্সি সারেবান বলতে প্রিয় ও বিশ্বস্ত কিছু বোঝায়। উটের পিঠে কাফেলা চলেছে। মজনুর প্রিয়তমা লায়লীকে নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে কাফেলা। নামজুর গীতিধর্মী গানে লায়লী রূপ নিয়েছে গায়িকায়। কাফেলা ও লায়লী দুজনেই ভালোবাসার শর্ত ভঙ্গ করে এখন মজনুকে ছেড়ে যাচ্ছে। বুকে দাগা দিয়ে রজনিগর্ভে বিলীন হচ্ছে তারা! মজুনর মনের মধ্যে বইতে থাকা অনুভূতির ঝড়কে মূলত গানে তুলে ধরেছেন নামজু।

গানে লাইল অর্থাৎ রাত্রির সঙ্গে লায়লীকে অভিন্ন করেছেন শিল্পী। রাত্রিবক্ষে উটের পিঠে সওয়ার লায়লীকে রকদরাজ কণ্ঠে সম্বোধনের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে বুকচেরা নিবেদন ও আর্তি। গানের আবহকে ঐকতান বাদন ও রকদরাজ কণ্ঠ করে তোলে সুগভীর। মনে হতে থাকে,—মজনু আর কখনো লাইল ও লায়লীকে ফিরে পাবে না!

গানকে আবেদন ভাস্বর উচ্চতায় উঠিয়ে নিতে পারঙ্গম মহসেন নামজুর সঙ্গে পরিচয় পুরোনো হলেও কোরানের সূরাকে সাংগীতিক আদলে পরিবেশনের খবর জানা ছিল না। আজ হঠাৎ শামস নামে তাঁর পুরোনো একটি ভিডিও চোখে পড়ল। কোরান থেকে চয়নকৃত সূরার অংশবিশেষ শিল্পী নিজস্বতা বজায় রেখে গেয়েছেন। শোনার পর ভালো লেগেছে,—কথাটি চট করে বলতে পারছি না। এর বড়ো কারণ সম্ভবত অনভ্যস্ততা। কোরানের সূরাগুলোর তেলাওয়াত শুনে আমরা অভ্যস্ত;—এবং তা অসম্ভব শ্রুতিমধুর। ক্বারী আব্দুল বাসেত, আবদুর রহমান আস-সুদাইস, সাদ আল গামদি, রাদ আল কুর্দির মতো নামকরা কোরানে হাফেজদের কণ্ঠে শ্রুত তেলাওয়াত তো আছেই,—দেশে-বিদেশে কোরানপাঠ গায়নপ্রণালী ছাড়াই শ্রুতিমধুর শোনায় কানে।

Surah Yaseen – Recited by Sa’ad al Ghamdi; Source – Sufyan Qadhi YTC

কোরানের সিংহভাগ সূরা, বিশেষ করে মক্কাপর্বে অবতীর্ণ সূরাগুলো কেউ যখন তেলাওয়াত করেন,—এর ভিতরে সঞ্চারিত কাব্যিক বিভূতি ও সাংগীতিক লয়তান আপনা থেকে কানে লহরি খেলায়। ভাষান্তর ছাড়া কোরানের ধ্রুপদি আরবি আমরা ভালো বুঝি না, তা-বলে আবেশে বিঘ্ন ঘটে এমন নয়। কোরানের ইংরেজি ও বাংলা ভাষান্তরের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক যুগ-যুগ ধরে চলে আসছে। মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ভাষান্তরিত কোরান পাঠ কিংবা শ্রবণে ঐশীগ্রন্থে মর্মরিত কাব্যগুণ টের পেতে বড়ো একটা অসুবিধেয় পড়তে হয় না। কোরানের আয়াত সমূহে আরবি কবিতার ঐতিহ্য সক্রিয় মূল মিশনের কথা বিবেচনা করে আল্লাহ যদিও তাঁর বার্তা-প্রচারকের ওপর নাজিল আয়াতকে কবিতা ভাবতে মানা করেছেন। মোহাম্মদ প্রচারিত বাণীকে আরব গোত্ররা সেকালে কবিতা ধরে নিচ্ছিল। কবিতা হিসেবে এর গুণাগুণ বিচার ও এসব নিয়ে মশকরা জুড়তে ত্রুটি করত না। আল্লাহর পক্ষ থেকে সুতরাং এমতো নিদান অনিবার্য ছিল।

এর প্রভাবে ধারণা করি,—কবিতা ও গানের ওপর পরস্পবিরোধী হাদিসগুলো পরে সংকলিত হয়। যেখানে এর একাংশ লাবিদের মতো কবিকে এলাউ করেছে মোহাম্মদের দোহাই দিয়ে। ইন্দ্রিয়ানুভূতি তীব্র করায় এমন কবি ও কবিতা, যেমন ইমরুল কায়েসের কাব্যশক্তির প্রশংসা করা হয়েছে, তবে এই ধারায় রচিত কবিতাকে হারাম রায় দিতে অকুণ্ঠিত থেকেছেন সুন্নীদের জন্য নির্ধারিত ছয়টি ও শিয়াদের চারটি পৃথক হাদিস সংকলক।

স্মরণ রাখা ভালো,—গানবাজনার ব্যাপারে কোরানে খোদাতালা সরাসরি আয়াত নাজিল করেননি। পরস্পরবিরোধী একগুচ্ছ হাদিস থেকে মনমতো বেছে নিয়ে তফসির প্রণেতারা কোরানের আয়াতকে এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। তাঁদের পাঠরীতি ও কোরানব্যাখ্যার পাল্লায় পড়ে গানবাজনাকে হারাম চিজ রূপে মুসলমানরা মেনে চলছেন যুগ-যুগ ধরে। ধর্মব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বাদ্যযন্ত্র ছাটাই করে খালি গলায় আল্লা ও রসুলের শানে প্রশংসাসূচক কাসিদা, হামদ, নাত, গজল, কাওয়াল ইত্যাদিকে একপ্রকার মেনে নিয়েছেন ইসলামি আলেম-উলামা সমাজ। সেলিব্রেটি ওয়াজিরা যেখানে হরহামেশা হিন্দি ও বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় গানের সুরে সুর বসিয়ে খোদাতালার প্রশস্তি করেন বেজায়! এই স্ববিরোধিতা অদ্ভুত বটে!

সে যাইহোক, খালি গলায় কোরানের সুমধুর তেলাওয়াত শুনে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে মহসেন নামজুর পরিবেশনা প্রথম-প্রথম কানে বেখাপ্পা লেগেছে! ফার্সি কবি যেমন হাফিজ অথবা সাদীর কবিতাকে নামজু তাঁর স্বতন্ত্র গায়নরীতি কাজে লাগিয়ে গেয়ে থাকেন। শুনতেও দারুণ তা। কোরানের সূরা থেকে বেছে নেওয়া আয়াত গাইতে বসে অপূর্বতা মনে হলো কেটে কেটে যাচ্ছে। রক গায়কির সঙ্গে বাদনরীতির মিলন, এবং এর সমানুপাতে নামজুকণ্ঠের ওঠানামা ও স্বরাঘাত… সব মিলিয়ে আজব লাগছিল শুনে! গানটির মন্তব্য বিভাগে সিংহভাগ শ্রোতা দেখলাম আমার মতো বিড়ম্বনায় পড়েছেন!

কোরানের সূরাকে মিউজিক স্ট্রাকচারে গাওয়া কঠিন নয়। আমার তা মনে হয়েছে সবসময়। বাদ্যযন্ত্র ও গায়কির পরিমিত প্রয়োগ যদি ঘটানো যায়,—কোরানকে সেক্ষেত্রে গানে রূপদান অবান্তর থাকছে না। বাদনপ্রণালী সেখানে সূরার অর্থ ও ভাবার্থ বুঝে স্থির করা যেতে পারে। লেবানিজ একটি রক ব্যান্ড (নাম এখন আর মনে নেই) যেমন সূরা ইখলাসকে রক ফরম্যাটে গেয়েছিলেন। শুনতে মন্দ ছিল না তা। বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গায়কির সংযোগ সেখানে সূরার ভাবগাম্ভীর্যকে আহত করেনি।

Shams – Quran Recitation in Music by Mohsen Namjoo; Source – Lorcean YTC

মহসেন নামজু এখানে এসে ব্যতিক্রম হয়ে উঠছেন। কোরানের আয়াতকে গান-আঙ্গিকে পরিবেশন করতে যেয়ে সাউন্ড ডিজাইন ও বাদনকে যথেষ্ট ড্রামাটিক করে তুলেছেন নামজু। এহেন বাদনপ্রণালীকে মন্দ বলা যাবে না। তবে, আজব লেগেছে কণ্ঠের ব্যবহার! একাধিক আয়াতে নামজু তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কণ্ঠ উচ্চনাদে তুলেছেন;—ভৌতিক আবহ মনে জাগানোর জন্য পরক্ষণে নিচু ও খসখসে স্তরে নামিয়েও এনেছেন। এর ফলে কোরান তেলওয়াতে শ্রুত সূরা আদ দোহা বা আশ শামসের একঘেয়ে কিন্তু সুরেলা আবেশ আর বজায় থাকেনি। উলটো সার্কাস্টিক ফিলকে তা তীব্র করেছে! কেন? সে-কথাই ভাবছি, কিন্তু সুরাহা মিলছে না!

গানের আঙ্গিকে কোরানের আয়াত পরিবেশনের মামলায় মহসেন নামজু, ধারণা করি,—খালি গলায় তেলাওয়াতের সময় মনে জাগরুক আবেশকে সচেতনভাবে ভেঙে দিতে চাইছিলেন। কোরানের আয়াত গাইবার সময় সাসপেন্স তীব্র করেছেন যে-কারণে। কেন করেছেন, তার উত্তর নেট ঘেঁটে পেলাম না!

কোরানের সঙ্গে তাহলে কি মহসেন নামজুর সংগোপন মনোবিরোধ রয়েছে? তেলাওয়াতের ভঙ্গিতে সূরার আয়াত গাইবার সময় যেটি তিনি উগড়ে দিচ্ছেন? একাধিক জায়গায় মনে হয়েছে,—ইচ্ছা করে মশকরা বা পরিহাস কণ্ঠে তীব্র করে তুলছেন শিল্পী! মন্তব্য বিভাগে ইরানদেশি শ্রোতাদের অনেকে অবশ্য বলছিলেন,—নামজুর গায়কি পাশ্চাত্য ও ইরানি স্থানিকরসের অপূর্ব মেলবন্ধন থেকে সৃষ্ট;—কোরানের সঙ্গে তাঁর সংঘাতের খবর অন্তত তাদের কারো জানা নেই।

তাই বটে! লন্ডন শহরে বিবিসি স্টুডিও আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঐকতান বাদনপ্রণালী সহকারে পরিবেশিত শ্রোতাপ্রিয় গানগুলোয় মহসেন নামজু যথারীতি অপূর্ব! সেখানে আল্লাহ গানটি স্বকীয়তা বজায় রেখে দুর্দান্ত গেয়েছেন তিনি। মকারির কোনো ফিল গানটি শোনার সময় অনুভূত হয় না!

বুদ্ধকে নিয়ে সোহরাব সেফরির লেখা গানেও নামজু দারুণ! শানত সেভাগ (shant sevag) ছবিতে ব্যবহৃত গানে বুদ্ধের জন্মচক্র ও নির্বাণের কসমিক ফিল বহমান। ভারতীয় নাচের মুদ্রা (সম্ভবত কত্থক অথবা ভারতনাট্যম হবে), তুর্কি সুফি ঘূর্ণী নৃত্য, ট্রাইবাল ডান্স, আর জ্যামাইকান রেগের আবেশ মিলিয়ে ফানা-উচ্ছল মহাজাগতিক আবেশ শ্রোতা ভালোই টের পায়। সংগীত আয়োজন এখানে ব্যতিক্রম, কিন্তু ভীষণ উপভোগ্য! বেখাপ্পা নয় একটুও। কোরানের আয়াত গাইতে যেয়ে বিশেষ ঢং কী কারণে বেছে নিলেন শিল্পী? পেছনের কারণ হয়তো কেবল তিনি ভালো বলতে পারবেন!

Buddha by Mohsen Namjoo; Movie – Shant Sevag; Source – Shant Sevag YTC

তবে, এ-কথা সত্য,—পরপর কয়েকবার শোনার পর নামজুর এই আজব কোরানগান ভালো লাগতে শুরু করে! কোরানের আয়াত তিনি গাইছেন,—এ-কারণে হয়তো আমাদের অভ্যস্ততা ও সংস্কার ঘাপলা বাঁধায় প্রথম-প্রথম;—বারবার শোনার পর তা কেটে যেতে থাকে। আফটার অল, অন্য ধর্মগ্রন্থকে গানের আদলে পরিবেশনা আগাগোড়া বৈধ ও স্বীকৃত। যবুর, তাওরাত, ইঞ্জিল, বেদ-গীতা-ত্রিপিটকের বাণী প্রচারে গায়নরীতির ব্যবহার অতি পুরাতন।

কোরান নিজেকে সকল সংগীতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সকল কবিতার চেয়ে উত্তম রায় দিয়ে থাকে। গানের প্রবেশ সেখানে যে-কারণে অবরুদ্ধ। এর সাংগীতিক গঠন যদিও গানের স্কেলে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। গুণী মিউজিশিয়ান বা সংগীত গবেষকের পক্ষে সাতসুরে এর স্কেলিং বেঁধে ফেলা কঠিন নয় বলেই মনে করি। ইসলাম নিজেকে সংস্কারের অতীত গণ্য করায় তার মৌলিকত্ব আজো অটুট রয়েছে। অটুট এই মৌলিকত্ব আবার সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রতিদিন। মুসলমানরা তা হাড়ে-হাড়ে টের পেলেও চোখমুখ বুজে থাকেন। অন্ধবিশ্বাসে অন্ধ থাকাটাই তাদের নিয়তি। সুতরাং, কোরানকে নিয়ে অধিক দূরে গমন সুকঠিন।

কোরানের বিচিত্র ব্যাখ্যা ও সেখান থেকে গান-কবিতা ইত্যাদি নিষ্কাশন ছাড়া মুসলমানের উপায় নেই। যুগ-যুগ ধরে সেটি চালু আছে বটে! মহসেন নামজু মূলে গমন ও সেখানে হাত দেওয়ার ঝুঁকি নিয়েছেন! এই দুঃসাহসের কারণে হলেও মারহাবা তিনি দাবি করতেই পারেন।

. . .

Mohsen Namjoo – Collage – @thirdlanespace.com; Image Source – Google Image

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 59

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *