
বিটলস ব্যান্ডের বারোখানা অ্যালবামের মধ্যে লেট ইট বি (Let it be) ছিল সর্বশেষ। অ্যলবামখানা রিলিজের পঞ্চান্ন বছর চলে এখন। বিদেশি গানবাজনার খবর যারা কমবেশি নিয়ে থাকেন, তারা নিশ্চয় জানবেন,—সংগীতের ইতিহাসে অন্যতম সেরার তকমা গায়ে চড়ানো এই অ্যালবামকে ঘিরে নাটক জমে উঠেছিল সেইসময়। গত শতাব্দীর সত্তর দশকে পা রাখার বছরে লেট ইট বি বাজারে আনে বিটলস। দলে ততদিনে ভাঙনের সুর প্রবল হয়েছে। চার মহারথি জন লেনন, জর্জ হ্যারিসন, পল ম্যাককার্টনি ও রিঙ্গো স্টার-এর মধ্যে বোঝাপড়া অতীত দিনগুলোর মতো নয় মধুর। ব্যান্ডদলের গড়াভাঙা বিশ্ব জুড়ে স্বাভাবিক ঘটনা, তবে নামখানা বিটলস হওয়ার কারণে শ্রোতামহলে আলোড়ন ও বিচলন তীব্র ছিল :
বলে কী! বিটলস ভাঙছে! ড্রামস পিটাতে রিঙ্গো স্টারকে আর দেখা যাবে না! জন লেননের সন্তসুলভ লেখনী ও কোমল কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসবে না নতুন কোনো গান! গিটার হাতে জর্জ হ্যারিসনকে দেখব না রকগানে চিরাচরিত আর্তি ও চিৎকার ছুড়ে দিতে! পল ম্যাককার্টনি কি তবে একলাই গানের কথা লিখবে? বসাবে সুর? জন লেননের সঙ্গে মিলে কথা ও সংগীত আয়োজনের খেলায় তবে ইতি ঘটতে যাচ্ছে চিরতরে! বাস গিটার ও পিয়ানোতে সুরের ঝর্না বহানোর ক্ষণে কি শোনা হবে না আর পলের আওয়াজ?
বিটলসকে নিয়ে গানপ্রেমীদের বিচিত্র শঙ্কা তখনকার পটভূমি বিবেচনায় নিলে অস্বাভাবিক ছিল না। গায়কদলে গড়াভাঙা যদিও নদীর এক পার ভেঙে অন্য পার গড়ে উঠার মতো প্রাকৃতিক। এক পারে নদী সব ধসিয়ে দিতে থাকে, আর অন্য পারে জেগে ওঠে নতুন চর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হয়তো এ-কারণে তাঁর অবিনশ্বর কণ্ঠে নদীকে প্রশ্ন রেখেছিলেন :
এ কূল ভেঙে ও কূল তুমি গড়ো
যার একূল ওকূল দুকূল গেল তার লাগি কি করো?
নদীর ঠেকা নেই হেমন্তের প্রশ্নের উত্তর করবে! ভাঙাগড়ার ভিতর দিয়ে বয়ে চলাতে তার যত আনন্দ। মানবজীবন কি সেখানে অ-প্রাকৃতিক? ভাঙন ঠেকাতে মরিয়া সবসময়? ভাঙনকে কি নিজে অনিবার্য করে না সেখানে? যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে ভাঙন ঠেকাতে পরে কেন তাকে উতলা দেখি এমন! উত্তর ভাবতে বসে দুটি সম্ভাবনাকেই সমান সত্য ধরে নিতে হয়। মানুষ গড়ে;—আবার কুঠার হাতে ভাঙতেও নামে। একই মানুষ ভাঙন ঠেকানোর জন্য মরিয়া হয় পরে! কখনো সফল হয়। বাকিটা সময় বিফল হওয়ার খেদ তার মনে সব ছাপিয়ে প্রবল হয়ে ওঠে।
বিটলস-এর উচ্ছল তারুণ্য গানের জগতে যে-প্রাসাদ একটু-একটু করে গড়ে তুলেছিল, কার্যকারণদোষে তারাই ভাবছে তখন,—প্রাসাদ টিকিয়ে রাখার কাজে কামলা খাটা বোধহয় আর সম্ভব নয়! জর্জ হ্যারিসন আপাতত টা টা বলে দিয়েছে দলকে। দাম্পত্যঝড়ে জন লেনন বিধ্বস্ত। আর, নিজের ভবিতব্য ভেবে রিঙ্গো স্টার ও পল ম্যাককার্টনি হতবিহ্বল! ওদিকে, একলা গান করার ভাবনা সকলের মাথায় মোটামুটি চেপে বসেছে। ছন্নছাড়া অবস্থায় শেষবারের মতো হলেও ফিরে আসার চেষ্টায় পল কেবল একলা মরিয়া ছিলেন সেখানে।
লেট ই বি অ্যালবামের দুই পিঠজুড়ে প্রকাশিত গানগুলো মূলত সেই প্রচেষ্টার ফল হয়ে সত্তরে রিলিজ করে। অ্যালবামের শিরোনাম ব্যবহার করে তথ্যচিত্রের আদলে ছবিও তৈরি হয় তাৎক্ষণিক। ঘটনা এখানে শেষ নয়। দলের নিজস্ব স্টুডিওর ছাদে সম্ভবত শেষবারের মতো লাইভ কন্সার্ট করে বিটলস। লোকজন সবে কাজে বেরুচ্ছে তখন। তার মধ্যে ছাদ থেকে ভেসে আসছিল চিৎকার :
Get back, get back
Get back to where you once belonged
Get back, get back
Get back to where you once belonged
Get back Jojo
কারা গাইছে তা আঁচ করতে পাবলিকের এক সেকেন্ডও লাগেনি। গানের ধরন থেকে আরম্ভ করে অ্যাপল স্টুডিওর সবটাই তাদের চেনা। ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। দিনের কাজবাজ ফেলে পথচারীদের অনেকে দাঁড়িয়ে পড়েন রাস্তায়। ছাদ থেকে ভেসে আসা সংগীত-লহরির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা তখন গাইছেন :
Everybody had a hard year
Everybody had a good time
Everybody had a wet dream
Everybody saw the sunshine
Oh yeah (oh yeah)
ছাদে আয়োজিত কন্সার্ট লেট ইট বি শিরোনামে নির্মিত ছবির জন্য পরিকল্পিত ছিল। সিগনেচার সং লেট ইট বি-কে বিটলস রেখে দিলেন স্টুডিওর জন্য। ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছিল বৈকি। নিজেদের স্টুডিওতে বসে গলা ছাড়লেন পল :
And when the broken hearted people living in the world agree
There will be an answer, let it be
For though they may be parted, there is still a chance that they will see
There will be an answer, let it be
সেই চিরাচরিত বিটলস। আধ্যাত্মিক শুশ্রুষায় নিজেকে সুধীর করতে আকুল বিটলস। সব যখন ধসে পড়ছে, ভেঙে যাচ্ছে এতদিনের চেনা দুঃখ চেনা সুখের ঘরকন্না,—তবে ভেঙে পড়ুক তারাও। ভেঙে পড়তে দাও, উচ্ছন্নে যেতে দাও, ধসে পড়তে দাও সব। ধসের গভীরেই-না লুকিয়ে থাকে নতুন করে গড়ার আয়ুধ। মরণের মধ্যে যেমন সংগোপন থাকে জীবনের বীজ। লেট ই বি হচ্ছে জ্ঞানীর মুখে নিঃসৃত বচন;—যেখানে নিহিত পুনরুজ্জীবন।
গানযাত্রায় বিটলস শুরু থেকে মরমি ও অনুভূতিপ্রবণ। জন লেনন ও জর্জ হ্যারিসনের মধ্যে পরে যেটি দুর্বার হতে থাকা আধ্যাত্মিক শান্তি অন্বেষণের ক্ষুধাকে আরো প্রগাঢ় করেছিল। ভারতীয় ধর্মগুরু মহর্ষি মহেশ যোগীর শিষ্য বনে যায় দলটি। রবিশঙ্করের উদ্যোগে আয়োজিত কন্সার্টে বাংলাদেশকে নিয়ে গান করার সুবাদে আমাদের পরমবন্ধুতে পরিণত জর্জ হ্যারিসন ভারত সফর করেন। ওইসময়ের হিপি-বিটনিক আন্দোলনের তীব্রতায় যা স্বাভাবিক ঘটনা।
যাইহোক, ভাঙনের টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত একটি দলের পক্ষে লেট ইট বি-র মতো অ্যালবাম কী করে সম্ভব হলো, সে এক বিস্ময় বটে! অন্যদিক থেকে ভেবে দেখলে তাদের জন্য এরচেয়ে সহজ কাজ আর ছিল না। কারণটি মূলত দলের সদস্যদের মধ্যে সক্রিয় আধ্যাত্মিক জীবনবেদে নিহিত। পরিস্থিতি বাজে জেনেও সেখান থেকে উত্তরণের রসদ ও মনকে প্রশান্ত করার মেজাজ যে-কারণে লেট ইট বি-র গানগুলোয় শ্রোতারা ভালোই টের পায়। বিটলস-এর বেলায় এই পরিস্থিতি পরে খারাপ ফলাফল বয়ে এনেছিল, তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। আগেই বলেছি,— ঈসায়ী সত্তর সনে দলে ভাঙনের ঢেউ তীব্র হয়। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বসেন তাঁরা। এবং, ওইসময় দুনিয়াকে আবারো চমকে দিয়ে পল ম্যাককার্টনির হেই জুড (Hey Jude) রিলিজ হয় অবশেষে।
গানের কথা ও গায়ন পলের, কিন্তু এ-গানের নেপথ্য কাহিনি বিটলস-এর ওয়েবসাইট আর সংগীত ম্যাগাজিন রোলিং স্টোন-এ গমন করলে অনায়াসে মিলবে। প্রথম স্ত্রী সিনথিয়ার সঙ্গে জন লেননের বিচ্ছেদ ততদিনে প্রায় নিশ্চিত হতে চলেছে। দাম্পত্য সঙ্কটের দিনগুলোয়, আমরা জানি, লেনন লিখে উঠবেন ও গাইবেন অ্যাক্রোস দ্য ইউনির্ভাস। যত গান তিনি লিখেছেন ও বিটলস-এর হয়ে গেয়েছেন সকলে মিলে, তার মধ্যে এই গানটিকে রাখবেন নিজ-পছন্দের শীর্ষ তালিকায়। যেটি তাঁর মতে, ছিল সবচেয়ে সহজ কথায় সবচেয়ে গভীর আর কাব্যিক ভাষায় লেখা গান।
গীতিকার হিসেবে জন লেনন এখানে বব ডিলানের চেয়ে এককাঠি সরস ও নির্দয়। বিশ্বমাতানো যেসব গান তিনি লিখেছেন, তার একটিও তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। গান লিখতেন, পরিবেশনের পর শ্রোতারা সেগুলো লুফে নিয়েছে ঝটপট। ছক্কা হাঁকিয়েছেন সমানে। কিন্তু, বালকবয়স থেকে ব্যতিক্রম ইংলিশবয় বিদ্যালয়ের গণ্ডিতে আটকে না থেকে সবকিছু নিরিখ করেছেন সর্বদা। মারাত্মক সফল এক-একটি গানের কথাকে যে-কারণে অবলীলায় আবর্জনা বলে বাতিল করতে দ্বিধা করতেন না লেনন।
শ্রোতা ও সমালোচকরা অবশ্য তাঁর এই অতি নির্দয় আত্মসমালোচনাকে পাত্তা দেওয়ার ঠেকা বোধ করেনি কখনো। কারণ, তারা জানতেন,—বিটলস হচ্ছে এমন একটি দল, যারা নামসর্বস্ব রকগানের দল নয়; তাদের গানের কথা ও পরিবেশনায় থাকে জীবন-সংবেদ; থাকে আধ্যাত্মিক তৃষ্ণায় নিজেকে গুম করার বাসনা। গানের কথা ও আয়োজনে সদা ছলকায় শান্তি ও ভালোবাসার সুস্থির দ্যুতিময় বার্তা। সত্তরের টালমাটাল দ্রোহকালে বিটলস-এর গানে শ্রোতারা ছলকে পড়তে দেখেছেন ধ্রুপদি মানবিক আর্তি। এই আর্তির কোনো জাত-ধর্ম-স্থানকাল হয় না। এটি ছিল মানবজাতির দিকে দলটির ছুড়ে দেওয়া আবেগবিধুর উচ্ছল ভালোবাসা, আর সেখানে মিশে থাকত কোমল মনোবিধুর বিষন্নতা। বব ডিলান হয়তো এ-কারণে কোনো এক কথালাপে বলেছিলেন :
বিটলস…! ওরা তো রক নয়! রক-এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবা যায় তাদেরকে। রক তো পোলাপানদের জিনিস। যৌবনের প্রাণবন্যা থেকে এটি বেরিয়ে আসে। সেখানে সমাধি ঘটে গানের। বিটলসকে এরকম ছকে আপনি বেশিক্ষণ ভাবতে পারবেন না। রক গানে লেগে থাকার বাহানায় বিচিত্র পথে তারা গমন করে। রকমেজাজ থেকে নিজেকে এভাবে বাইরে নিয়ে যায় তারা। কোনো একটি মার্কায় শহিদ হতে চায়নি বলেই তারা বিটলস হতে পেরেছে।

গানভাণ্ডারি বব ডিলানের কথা মিথ্যে নয়। বিটলস-এর বরণীয় সব গান ও তার বাইরে আরো যেসব কম্পোজিশনের দেখা অন্তর্জালের সুবাদে আমাদের কাছে এখন সুলভ,—সেগুলোয় কান পাতলে ডিলানের কথার সত্যতা টের পাওয়া যায়। এরকম দিনকালে সুতরাং জন লেনন লিখছেন অ্যাক্রোস দ্য ইউনির্ভাস, আর পল ওদিকে এটি ভেবে চিন্তিত,—সিনথিয়ার সঙ্গে লেননের বিচ্ছেদ ও এর প্রভাব তাদের সন্তান জুলিয়ানের ওপর কতটা গভীর হতে চলেছে। হেই জুড-এর ইন্সপিরেশন আসলে সেখান থেকে এসেছিল।
জন লেনন স্বয়ং গানটি আগে লিখেছেন। পলকে শেয়ার করতে বসে পরে তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়ে আসে আজো সমান আবেদনঘন মিনতি আর চিৎকারে গাঁথা আধ্যাত্মিক সান্ত্বনা ও ইতিবাচক মনোভাবে অটল গানখানা। উদ্দেশ্য,—লেননপুত্র জুলিয়ানকে এই আশ্বাস যোগানো,—ভাঙনে সব শেষ হয়ে যায় না বাছা। জীবন এক অতিকায় মঞ্চ আর সেখানে তুমি-আমি নতুন রূপে অভিনীত হতে বাধ্য বটে :
Hey Jude, don’t make it bad
Take a sad song and make it better
Remember to let her under your skin (oh)
Then you begin (let it out) to make it better
Better, better, better, better, better (let yourself go)
গানের কথায় এই-যে সকল দুঃখ-সুখকে ত্বকের গভীরে রেখে দেওয়ার কথা আওরাচ্ছেন পল ম্যাককার্টনি, সেটি বিটলস-এর প্রায় সকল গানে অল্পবিস্তর বিদ্যমান। স্মৃতি হচ্ছে এমন সামগ্রী, যেটি মানুষকে অনুভূতশীল প্রাণী করে তোলে। হেই জুড-এ যারপরনাই জন লেনন ও সিনথিয়ার রসায়নকে ধরে রাখার বার্তা পল আসলে লেননপুত্র জুলিয়ানকে দিচ্ছেন। তারপর বলছেন আসল কথাখান : make it better.
পল ম্যাককার্টনির কণ্ঠে পরিবেশিত হেই জুড-এর সঙ্গে এখানে এসে নিবিড় ঐক্য তৈরি করছে অ্যাক্রোস দ্য ইউনির্ভাস গানটি। দুস্থদের জন্য ফান্ড রাইজিংয়ের অংশ হিসেবে গানটি ওইসময় গেয়েছে বিটলস, যদিও এর প্রতিটি চরণে সংগোপন ছিল জন লেননের একান্ত ব্যক্তিগত জীবন ও জীবন-ভাবনার টানাপোড়েন।
বিটলস-এর ওয়েবসাইটে চোখ রাখলে দেখতে পাচ্ছি, লেনন পরে নিজমুখে বলছেন,—গানটির পয়লা চরণ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তাঁর মাথায় প্রথম হানা দিয়েছিল। সিনথিয়ার পাশে শুয়েছিলেন গায়ক। দুজনে হয়তো টুকটাক কথার ছলে কলহে লিপ্ত ছিলেন কিছুক্ষণ। তার মধ্যে Words are flowing out like endless streams. চরণখানা লেননের মস্তিষ্কে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সিনথিয়া ততক্ষণে গভীর ঘুমের দেশে তলিয়ে গেছেন। ওদিকে ঘুম মাটি করে লেনন তখন এ-কথা ভেবে বিরক্ত,—কাব্যরসে গদগদ এমন একখানা চরণ কেন মাথায় খেলছে তাঁর? সিনথিয়ার সঙ্গে যা-চলছে এখন, সেখানে বরং মুখরা রমণী বশীকরণ টাইপের কোনো চরণ মাথায় আসা উচিত ছিল! Why are you always mouthing off at me? কী-কারণে হে রমণী, তুমি মুখরা থাকো সারাখন? এমনধারা ভাবাশ্রিত চরণ মাথায় আসলে সেটি বাস্তবিক হতো।
এই-যে বিপরীতমুখী চরণের উদয়, যেটি তাৎক্ষণিক জন লেননকে বাধ্য করল কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়তে। রাত তখন গভীর হতে চলেছে। আধো ঘুম ও আধো জাগরণে লেনন কথার ভাঁজ খুলতে ব্যস্ত। কলমে নামাচ্ছেন গানের প্রথম স্তবকটি, যার পুরোটাই সহজ কথার ব্যঞ্জনায় ধারণ করছে সাংকেতিক গভীরতা। লিখছেন :
Words are flowing out
Like endless rain into a paper cup.
প্রথম স্তবকে পাচ্ছি Pools of sorrow, waves of joy / Are drifting through my opened mind-এর মতো ব্যঞ্জনাগর্ভ চরণ। প্রবাহ অতঃপর সুমসৃণ এগিয়েছে রূপক-গভীর ব্যঞ্জনায়। যেখানে Images of broken light/ Which dance before me like a million eyes-এর মতো দ্যুতিনিবিড় চরণে চমকে ওঠে মন। গানটির ভার্স অংশ সাকুল্যে তিনখানা। আর বাদবাকি অংশ মূলত পুনারাবৃত্তিমূলক;—কোরাসের ভূমিকা মিটাতে লিখছেন লেনন। আধ্যাত্মিক সংরাগে স্নাত গায়ক মহর্ষি মহেশ যোগীকে জয় গুরুদেব বলে বন্দিয়াছেন সেখানে। স্মরণযোগ্য যে, গানটির মধ্যে নিহিত আধ্যাত্মিক প্রশান্তিকে দৃঢ় করতে মহর্ষি চাইছিলেন,—আরো ইতিবাচক গভীরতা যেন গানের কথা ও সংগীত-আয়োজনে সংযুক্তন করে বিটলস। লেনন তা করেছিলেনও।
মোটামুটি এই হলো গানটি রচিত হওয়ার কাহিনি-সংক্ষেপ। আর, এর সংগীত আয়োজনে ছিল পাশ্চাত্য ও ভারতীয় বাদনপ্রণালীর মেলবন্ধন। ঘরানার দিকে থেকে সাইকেডেলিক পপ-রকে গায়কদল অটল থাকলেও গিটার বাদন, ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র তাম্বুরার ব্যবহার ছাড়াও গায়কিতে ছিল মহাজাগতিক বিস্ময় ও ধ্যানকে উচ্ছল জীবনরসে একীভূত করার প্রয়াস। গানটি এদিক থেকে জন লেননের শান্ত সুধীর কণ্ঠস্বর বাদ দিলে দ্রুতলয়ের। প্রকৃতির দিকে থেকে বেশ উচ্ছল। লেনন পরে বলেছেনও,—সুখ-দুঃখের অতীত আবাহনে বুঁদ হওয়ার আকাঙক্ষার সঙ্গে গানটির সংগীত আয়োজন শতভাগ খাপ খায়নি। জন লেননের খুঁতখুঁতে স্বভাবে এটি অবশ্য স্বাভাবিক ঘটনা।
চ্যারিটি অ্যালবামে প্রথমে সংযুক্ত হলেও, লেট ইট বি অ্যালবামের স্টুডিও সংস্করণে গানটিতে গসপেল তথা চার্চ সংগীতের আবহ আমদানির পাশাপাশি বাদনপ্রণালীতে ভিন্নতা আনে বিটলস। চ্যারিটি অ্যালবামে সংকলিত সংস্করণকে ততদিনে শ্রোতারা ভালোই পছন্দ করে বসেছেন, আর পরে বিটলস প্রযোজিত গানভাণ্ডারে জেম হিসেব একে বিবেচনা করতে সমালোচকরা এক পায়ে দাঁড়িয়েও পড়েন।
অ্যাক্রোস দ্য ইউনিভার্স আদতে লেট ইট বি অ্যালবামের মূল ফিলোসফি ধারণ করে অনেকখানি। অর্থাৎ, রবি ঠাকুরের হঠাৎ দেখা কবিতার চরণ এখানে চিরসত্য : দিনের তারা লুকিয়ে থাকে রাতের গভীরে। সুতরাং যা ভেঙে পড়ল তার থেকে কুড়িয়ে নাও যেটুকু কুড়ানোর ছিল। এর থেকে আরো ভালো কী করা যায় সে-কথা একবার ভাবো। মানবজনম হচ্ছে নিজেকে কী-করে আরো নিখুঁত করা যায় তার অন্তহীন চেষ্টা। সুতরাং ভাঙনে শেষ নয়, ধরে নাও এটি হলো নতুন শুরু।
. . .

. . .
সংযুক্তি :
সং লিস্টে মহাকাশ ছাপিয়ে যাওয়া গানটির বাংলায় ভাষান্তরিত ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে নির্মিত দুটি নমুনা সংযুক্ত থাকছে। অতীতে বলা কথাটি পুনরাবৃত্তি করতে হয় এখানে,—গানের কোনো ভাষান্তর হয় না। ভাষান্তর উপযোগী সংগীত আয়োজন খুব একটা কাজের কিছু নয়। মূল গানের সঙ্গে তার মিলন অসম্ভব ও অবান্তর থেকে যায় শেষ পর্যন্ত। মূল গানের গভীরে প্রবিষ্ট হতে তথাপি এই ধরনের চেষ্টা মাঝেমধ্যে সাহায্য করে। এদিকটা শ্রোতারা বিবেচনা করবেন আশা করি।
গানটির কবিতা-উপযোগী ভাবানুবাদে আমরা যাইনি ইচ্ছে করে। এতে করে তা হয়ে উঠত বিটলস-এর প্রেরণা থেকে তৈরি বাংলা গান। আপাতত এটি জরুরি নয় এখানে। এর পরিবর্তে বাংলা ভাষান্তরে গাইতে পারা যাবে এরকম ভাবনা থেকে এআইকে দিয়ে নিজের পছন্দ ও ভাবনমাফিক দুখানা সংস্করণ আমরা তৈরি করেছি। বিটলস-কে এটি অনুসরণ করেনি এখানে, তবে পাশ্চাত্য রকমেজাজের আবহকে ব্যবহার করেছে যথাসম্ভব। এবং সেক্ষেত্রে সাইকেডেলিক রকের কিছু অনুষঙ্গ গান দুটিতে আমরা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। এআইকে দিয়ে যতটা সম্ভবপর, ততটা। সামনে হয়তো আরো ভালোভাবে করা যাবে তা। যেহেতু, সময়ের সঙ্গে এআই অ্যালগরিদম কুশলী হচ্ছে ক্রমশ।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দিয়ে গান করানোর ক্ষেত্রে কতিপয় মৌলঅন্তরায় এই সুবাদে বিবেচনায় রাখা জরুরি, যেমন,—গানের চরণ বুঝে গায়কের কণ্ঠস্বরে ভ্যারিয়েশন আনা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে এখনো দুরূহ থেকে গেছে। ইচ্ছে থাকলেও জন লেনন যেভাবে গেয়েছিলেন, অর্থাৎ তাঁর কণ্ঠস্বরের খাঁজভাঁজ ও স্বকীয়তা (তারওপর বাংলা উচ্চারণে) সৃজন করা সম্ভব নয়। আবার যেরকম কণ্ঠ দরকারি, সেটি সব গানে আশানুরূপ পাওয়া যায় না। এআই অ্যালগরিদম এদিক থেকে এখনো শৈশব পার করছে। পরিপক্ক হতে সময় লাগবে আরো।
বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে নিরীক্ষা ও স্বাধীনতার সুযোগ যথেষ্ট রয়েছে, তবে ফ্রি ভার্সনে এর সবটা সহজপ্রাপ্য থাকে না টাকা খর্চা করলে কিছু বাড়তে সুবিধা মিলে অবশ্য; যেটি আবার (অন্তত বাংলা গানের ক্ষেত্রে) আহামরি নয়। গানের চরণ ও শব্দের ঝোঁক অনুযায়ী কোন যন্ত্র কীভাবে কতখানি সংগত করলে সুবিচার হয়… ইত্যাদি নিরীক্ষার সুযোগ ও অনুশীলন সময়ের সঙ্গে আরো গভীরতা পাবে মনে হচ্ছে।
কাস্টমাইজড অ্যারেঞ্জমেন্ট দেওয়ার পরে অনেকসময় দেখা যায়, এআই তার অ্যালগরিদম দিয়ে তা ঠিকঠাক ধরতে পারেনি। নিজ থেকে বাঁধা ফরমেটে চলে যায় তখন। বাংলা ভাষান্তরে বিদেশি কোনো গান করানোর সময় উপযুক্ত মডেল বাছাইয়ের অন্তরায় বেশ ভোগায় এখানে। উচ্চারণগত ত্রুটি ও স্বরবিচ্যুতি কতকক্ষেত্রে সুরসংগতি মাটি করে দেয়।
সময়ের সঙ্গে এসব প্রতিকূলতা দূর হবে, সে-কথা বলাই যায় এখন। বাংলা ভাষায় গান করানোর ঘটনায় এআই সৃষ্ট পরিবেশ ক্রমশ চৌকস হয়ে উঠেছে। নিরীক্ষার পরিসর সেখানে আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। যান্ত্রিক পদ্ধতিকে সুতরাং নেতিবাচক ভাবার কারণ নেই। অচিরে এটি হয়ে উঠবে আরো সংগীত সহায়ক। মানুষকে তথাপি টেক্কা দেওয়া তার পক্ষে অসাধ্যই থেকে যাবে। গুণী সংগীতকারদের সুযোগ থাকবে তাকে কাজে লাগানোর। নতুন আঙ্গিকে গান সৃজনের পরিসর তাতে বাড়বে ছাড়া কমবে না। হাস্যকর কাজ যেমন হতে থাকবে, তার মধ্য থেকেই ভালো কাজও আসবে বেরিয়ে। সহায়ক হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা শ্রোতাদের জন্য খারাপ নয় বলেই মনে হচ্ছে। গানের বিচিত্র সব খুঁটিনাটি বুঝতে তারা নিজেরাও এআইকে ব্যবহার করছেন। এর ফলে এসব ব্যাপারে ধারণা ও এক ধরনের কান তৈরি হচ্ছে। এআইয়ের ওপর খাপ্পা অনেক গুণী সংগীতকার এদিকটা ভাবছেন বলে মনে হয়নি।
যাইহোক, বিটলস-এর মূল গানের গানের পাশাপাশি বাংলায় করা ত্রুটিপূর্ণ দুখানা যান্ত্রিক সংস্করণ যারা শুনতে তথাপি আগ্রহ বোধ করবেন, তাদের প্রতি সবিনয় অনুরোধ থাকবে,—একে সিরিয়াসলি নেবেন না প্লিজ! সেইসঙ্গে সীমাবদ্ধতাগুলো বিবেচনায় রেখে যদি শোনেন তাহলে উষ্মা প্রবল হবে না।
. . .




আর কিছু চায়না মনে গান ছাড়া..
চমৎকার আয়োজন। এআই দ্বারা গাওয়ানো বাংলা অনুবাদে গান দুর্দান্ত। ১ম ভার্সন টা বেশি ভালো লেগেছে। এমন গান আরও চাই।