আসুন ভাবি

বই পড়াটা কি তবে মিথ?

Reading time 2 minute
5
(4)

বইমেলায় বই বেচাকেনার পরিসংখ্যান আর পাঠকের বই পাঠের অভ্যাস নিয়ে চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের একখানা বক্তব্য কবি ফজলুররহমান বাবুল থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পেশ করেছিলেন। দুইহাজার চব্বিশে কলকাতা আন্তর্জান্তিক বইমেলা তখন সবে শুরু হয়েছে। মেলাচত্বরে বাঙালির বইপাঠের অভ্যাস নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বভাবসুলভ ঢংয়ে বক্তব্যটি রেখেছিলেন চন্দ্রিল। তাঁর কথাগুলো শুনতে বসে সালমান রুশদিকে মন পড়ল আচমকা! কোনো এক সাক্ষাৎকারে রুশদি বলেছিলেন,—তাঁর বইয়ের বেচাকেনা মোটামুটি মন্দ নয়। তবে যেসব পাঠক সচরাচর তাঁর বই কিনে থাকেন, এখন তারা তাঁকে আদৌ পাঠ করেন বলে তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি। বই কিনে বাড়ি ফেরত যাওয়ার পর তারা আসলে কী করেন সেটি জানার কৌতূহল তাঁকে মাঝেমধ্যে খোঁচায়।

সালমান রুশদি এখানে এসে বলছেন,—লেখালেখির জগতে দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকার সুবাদে তিনি এই ধারণায় উপনীত,—ক্রেতাদের বড়ো অংশ বিচিত্র কারণবশত তাঁর বই কিনলেও পাঠকের সংখ্যা সেখানে নগণ্য। বাড়ি ফেরার পর দু-একবার উলটে-পালটে দেখার পর তাকে তোলে রাখেন। পরে আর সময় হয় না হাতে নেওয়ার। তাদের বৃহৎ অংশ কাজেই ক্রেতা কিন্তু পাঠক হয়তো নয়। রুশদি যদিও নিজমুখে একথাটি অনেকবার বলেছেন, বই হচ্ছে চাকুর মতো তীক্ষ্ম ঘটনা, আর তিনি সমালোচকদের জন্য নয় বরং পাঠকের জন্যই লেখেন।

Salman Rushdie: ‘Write for readers, not for critics’; Source – Big Think YTC

স্টিফেন হকিংয়ের প্রথম বই অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম লক্ষ-লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। মনে আছে, বইটি বিদেশে বেস্ট সেলার হতে-না-হতে ওপার বাংলা থেকে এর বাংলা ভাষান্তর আমাদের হাতে পৌঁছায়। স্বত্ব সংক্রান্ত বিষয় মাথায় রেখে অনুবাদক তখন ইংরেজি বইয়ের প্রকাশক মারফত হকিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। হকিং অনুমতি দিয়েছিলেন এবং এর জন্য কোনো টাকা-পয়সাও নেননি তখন। হকিং পরে তাঁর কোনো এক বইয়ে রসিকতার সুরে বলেছিলেন,—ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বেস্ট সেলার হওয়ার পেছনে বইয়ের বিষয়বস্তুর কোনো ভূমিকা নেই। সহজ করে লেখার চেষ্টা তিনি করেছেন, কিন্তু এর জন্য লোকে লাইন দিয়ে বইটি ক্রয় করার কথা নয়। প্রকাশক ওই-যে মোটর নিউরন আক্রান্ত একজন বিজ্ঞানীর এরকম জটিল বিষয়ে বই লেখার কথা ফলাও করে প্রচার করলেন, সেইসঙ্গে তাঁর ভাঙাচোরা দেহের ছবি জুড়লেন প্রচ্ছদে,—মূলত সে-কারণে বইয়ের দোকানে লোকজনের লম্বা লাইন পড়েছিল। বইটির সঙ্গে বাস্তবে যুদ্ধ করেছেন এমন লোকের সংখ্যা বেশি হওয়ার কথা নয়।

রুশদি ও হকিংয়ের সন্দেহকে অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। বই বেচনাকেনার সঙ্গে তাকে পাঠ করে ওঠার সম্পর্কটি আসলেই এক ধাঁধা! সময়ের পালাবদলে বিশ্ব জুড়ে বইয়ের প্রসার ও বেচাকেনায় নতুনত্ব এসেছে, কিন্তু পড়ুয়ার সংখ্যা আসলেও বেড়েছে কি? মনে হয় না বেড়েছে। তবে এটি মানতে হচ্ছে,—মানুষের পাঠাভ্যাসে বৈচিত্র্য নতুন সব মোড় নিচ্ছে অবিরত। পড়া মানে কেবল ছাপাকাগজে মুদ্রিত বস্তু;—সর্বজনীনন ধারণাটি তথ্য-প্রযুক্তির নববিকাশপর্বে ক্লিশে হতে বসেছে। ছাপানো বই থেকে শুরু করে ডিজিটাল মিডিয়ায় ছড়ানো অডিও-ভিডিওর সবটাই এখন পাঠখোরাকি সরবরাহে তৎপর। গ্রাহক প্রচুর, যদিও এর কোনো প্রভাব ঠার করা আবার মুশকিল লাগে অনেকের।

অভ্যাস বা হুজুগে পড়ে মানুষ বই কেনে ও পাঠের ভান করে;—এরকম যারা ভাবেন, তাদের কথাকে কাজেই চট করে খারিজ করতে মন ওঠে না। সীমিত সংখ্যক হয়তো আছেন, পাঠের অসীম খিদে মেটাতে বইদোকানে ও মেলায় হানা দেন। অনলাইনে বইয়ের অর্ডার হাঁকেন। বাদবাকিরা মনে হচ্ছে বেহুদা গাঁটের পয়সা খর্চা করেন সেখানে। বই পড়াকে মাঝেমধ্যে যে-কারণে মিথ বলে মনে হয়। সামাজিক প্রগতির সঙ্গে মিথটাকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ যেটিকে সংস্কৃতি পরম্পরায় রক্তে বহন করছে। সামাজিক প্রগতিতে আমি পিছিয়ে নেই প্রমাণ করতে খামোখা বই কেনা ও পাঠের ভানে তারা নিজেকে জড়ায়!

বেঁচে থাকার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না এরকম অনেককিছুর পেছনে মানুষ অকারণে খর্চা করে। বই বস্তুটি হয়তো সেরকম কিছু। অপ্রয়োজনে প্রয়োজন রূপে তাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। সভ্যতার আয়ু ও বৈচিত্র্যের জায়গা থেকে মানুষ তাকে দেখে। তারা যেহেতু নিজেকে অসভ্য বা বন্য ভাবতে লজ্জা বোধ করে, সভ্য-সুশীল ও সংস্কৃতিমনস্ক দেখতে চায় নিজেকে, এখন এর শানমান রক্ষায় নেহায়েত দায়ে পড়ে বই কেনে। বই তারা কেনে, তবে পাঠ করে হাতেগোনা দু-একজন!

. . .

The fall – The Theory of Everything movie scene; Binge Society YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 4

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *