গান কয়জনে বোঝে, গান কয়জনে বোঝে।
গানে গুণ প্রকাশ করে আঁধার ঘরে আলো সাজে॥
গানের দাম দেয় জ্ঞানী-গুণী, চায় না লম্বা রাগিনী,
আসলে কোরআনের বাণী, মানে না সমাজে।
বাংলা ভাষায় গায়কে গায়, বেহেলা সরাজে,
গান শুনলে আহাম্মকের দলে বলে, এইতা আজে বাজে।।
[পদ রচয়িতা : ফকির সমছুল; উৎস : ফকির সমছুল স্মরণ পুস্তক; সম্পাদনা : জায়েদ আলী ]
. . .
ছোটকাগজ জিন্দাবাজার-এর সম্পাদক মোহাম্মদ জায়েদ আলী বাউল অন্তপ্রাণ মানুষ। বাউল মহাজনদের ফিকিরে ঘোরেন। তাঁদের গান, সাধনা ও যাপনকে ছাপার অক্ষরে ধরতে নিরলস খেটে চলেছেন। কাজটি ভালোবেসে করেন বলে তাঁর নিজস্ব লেখালেখি ও সম্পাদনায় যত্ন আর আন্তরিকতার ছাপ থাকে। বাউল মহাজন মকদ্দস আলম উদাসী, দুর্বিন শাহ ও ফকির সমছুল স্মরণপুস্তকে আমরা এর প্রমাণ পাচ্ছি বটে।
বাউলা গানের অতিশয় উর্বর ভূমি সিলেটের বাউল সাধক, পদ রচয়িতা ও গানের শিল্পীদের নিয়ে ছাপার অক্ষরে চর্চা সময়ের সঙ্গে ঊর্ধ্বগামী মনে হতে পারে, তথাপি বৈচিত্র্য, গভীরতা ও ধারাবাহিকতার ঘাটতি সেখানে রয়েই গেছে। বঙ্গ তল্লাট জুড়ে যেসব বাউল মহাাজনের গান হামেশা মানুষ শুনছেন,— ছাপার অক্ষরে গানগুলোর তাৎপর্য অন্বেষণের তাড়না ও চর্চাকে এখনো ব্যাপক মানা যাচ্ছে না।
হাসন রাজা, রাধারমণ, সৈয়দ শাহনূর, শীতালং শাহ, আরকুম শাহ, শেখ ভানু, শাহ আবদুল করিম ও দুর্বিন শাহর গানের প্রসার সিলেট ছাপিয়ে দুই বাংলায় চিরায়ত রূপ নিয়েছে। বাউল গানের শিল্পীরা তো থাকছেনই,—অন্যরাও মহাজনসৃষ্ট গানের পদ পছন্দ মাফিক তরিকায় অহরহ গাইছেন। প্রসার মন্দ কিছু নয়, তবে প্রসারের সঙ্গে বাউল গানের অন্তরালে সক্রিয় জীবনবেদ বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যথায় এর মরণ ঠেকানো কঠিন হবে।
ছাপার অক্ষরে বাউল গান ও মহাজনদের নিয়ে বইপুস্তক ও সংকলনের প্রয়োজনকে তাই খাটো করে দেখার কারণ নেই। এই জগতে মর্মরিত ভাবের সঙ্গে শিক্ষিত সমাজের জানাবোঝার পরিসর তৈরিতে তারা বেশ কাজে দেয়। জায়েদ আলীর খাটাখাটনি এখানে এসে বেশ অর্থবহ হয়ে উঠছে। সেইসঙ্গে, নানান কারণফেরে উদ্বেগও জন্ম নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কারণ,—আমরা এখন যে-সময় পার করছি, তা বাউল ঘরানায় গানবাজনা চর্চার জন্য সুখকর নয়। দেশ জুড়ে অশুভের উত্থান ঘটেছে। যেসব উপকরণকে আমরা সেখানে প্রতিরোধের রসদ গণ্য করে এসেছি এতদিন,—তার কিছু আর টিকবে বলে মনে হচ্ছে না।
একটি প্রলম্বিত অমাবস্যা আসন্ন বটে! জায়েদ আলীর ছোট-ছোট কাজের মধ্য থেকে ঠিকরানো আলোকে এটি ঢেকে দিতে পারে। সম্ভাবনাটি বেশ প্রবল এখন। বাউল মহাজনরা আমাদের জন্য সেক্ষেত্রে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হলেও, অমাবস্যায় তাঁদেরকে হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকছে। কারণটি বাউল মকদ্দস আলম উদাসীর একটি গান দিয়ে আমরা হয়তো বুঝে নিতে পারি।
অত দামি কেমনে হয় মাটির বাসন গানের চরণে উদাসী যে-দেহতত্ত্বের মরমি পাঠ দান করে গেলেন,—এখন, এর সারার্থ বোঝার এলেম সমাজের কখনো ছিল না। তারা কেবল একটি গান শুনে এসেছেন এতদিন। গানের দেহে মর্মরিত আবেদনকে স্রষ্টার কুদরতি ঠাউরে উদাসীতে মজেছিল মন! বাউল মহাজন রচিত গানের চরণে নিহিত রূপক ও সংকেত এতদিন তালাবন্দি ছিল। ইংরেজিতে সাইফারড (Ciphered) বা এনকোডেড বললে বুঝতে সুবিধে হয়। তালাবন্দি সংকেতগুলো চাবি দিয়ে তারাই খুলতে পেরেছেন,—উদাসীর মতো মহাজনদেরকে যারা গুরু অথবা মুরশিদ মেনে নিয়েছেন সবক। এখন সেই তালা খোলার তাগিদ মোল্লাসমাজে প্রবল হতে দেখছি। অনেকে আবার ধনুকভাঙা পণ করতেও বাকি রাখছেন না! বঙ্গ ভূমিতে মোল্লাসমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তনে চোখ রাখলে, তাঁদের এই তালা খোলার পণ বাউল ঘরানার মরণ ডেকে আনার মতো পরিস্থিতি জন্ম দিতে পারে অচিরে।
শায়খ আহমাদুল্লাহকে সম্প্রতি দেখা গেল,—লালনগানের তালা খুলতে বসেছেন। খুলতে বসে লালনের গানে তিনি দেখতে পাচ্ছেন অফুরন্ত অশ্লীলতা, আর নাউজুবিল্লাহ মিন জালেক। ওয়াজ মাহফিলে প্রতিনিয়ত বাউল মহাজনের গানকে ডিকোড করছেন ওয়াজি হুজুরের দল। শ্রোতা কারা? উদাসীর বা লালনের বা সমছুলের গান যারা শুনেছেন এতদিন, এবং এখনো শুনছেন অল্পবিস্তর,—তারাই! তাদের মনোজগতে একটি দ্বন্দ্ব এতে করে তীব্র হচ্ছে। বাউলদের জন্য বলাবাহুল্য তা সুখকর হওয়ার সম্ভাবনা রাখছে না। বাউলের ব্যাপারে সমাজকে আগের মতো নেইভ বা সরল ভাবলে আমরা মারাত্মক ভুল করব। সহানুভূতি ও মমতার সুরক্ষাবলয় খোদ পল্লীবাংলায় ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। যারপরনাই, ফকির সমছুলের বসন্ত গুঁটিকা আক্রান্ত মুখচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বুক মুচড়ে উঠছে। তিনি দেহ রেখেছেন। তাঁর শিষ্যরা জীবিত। গান জীবিত বটে! কিন্তু কতদিন? প্রশ্নটি নিয়ে সংকলনের লিখিয়েরা ডিল করবেন ভেবেছিলাম। না পেয়ে নিরাশ হয়েছি।
বাউলরা গুরু-শিষ্য পরম্পরায় যে-ঘরানা এতদিনে তৈরি করেছেন, সেটির ভোক্তা হলেন আপামর সমাজ। গ্রামীণ ও মহুরে সকলে সেখানে কমবেশি বিরাজেন। আপামর এই সমাজ কি আসলেও বাউল গান বোঝেন? ধরতে পারেন এর সিলসিলা? জায়েদ আলী সম্পাদিত স্মরণ পুস্তক-এ দেখছি ফকির সমছুল তাঁর গানের পদে বলছেন :
গান কয়জন বোঝে, গান কয়জন বোঝে
গানে গুণ প্রকাশ করে আঁধার ঘরে আলো সাজে।।
আসলেও কি তারা বোঝেন,—কি বলতে এখানে আকুল ছিলেন বাউল মহাজন? যদি বুঝতেন, তাহলে এই আপামর সমাজ স্বয়ং হয়ে উঠতেন এক সিলসিলা;—যেটি ফকির সমছুলদের সুরক্ষিত রাখার জন্য সচেতনভাবে থাকছে নিবেদিত। সিলেট অঞ্চলের বাউল মহাজন ও তাঁদের রচিত গান এদিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে এখানকার বাউল গানের বিকাশ-বিস্তারে কোনো সিলসিলা গড়ে ওঠেনি। সিলেটি শ্রোতােসমাজের হাতে তাঁরা গচ্ছিত রেখেছেন নিজের ভবিষ্যৎ। যেটি এখন ঘোর মোল্লাতান্ত্রিক অমাবস্যায় নিপতিত।
কুষ্টিয়ার লালন আখড়া বাদ দিলে, বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলগুলোয় বাউল গানের চর্চা ও বিকাশকে বিশেষ সুগঠিত বলা যাবে না। কুষ্টিয়ায় লালনের খানকা থাকায় তাঁর বাউল দর্শনকে বক্ষে ধরার একটি সিলসিলা গড়ে উঠতে পেরেছে। ঢাকা ও মানিকগঞ্জে দেওয়ানরা বংশ পরম্পরায় এভাবে আরেকখানা সিলসিলা জন্ম দিয়েছেন।
সিলেট এদিক থেকে ব্যতিক্রম। এখানে গুরু বা মুর্শিদের কাছে সবক নেওয়ার প্রথা জারি থাকলেও, এক-একজন বাউল মহাজনকে কেন্দ্র করে পৃথক-পৃথক সিলসিলা গড়ে ওঠেনি। এর ফলে একজন বাউল মহাজন যেসব পদ রেখে গেলেন, এবং যেগুলো নানাজন গাইছেন মাত্র! মহাজনপদে নিহিত গুহ্যকথার মর্ম ও গায়েন প্রণালীকে ধারাবাহিকতায় ধারণ ও অনুশীলনের গুরু-শিষ্য-শ্রোতা পরম্পরা সুতরাং বজায় থাকছে না।
সোজা কথায়,—ওপার বাংলার বীরভূম ও নদীয়ায় বাউলরা স্বয়ং একটি কমিউনিটি বা সম্প্রদায় রূপে বসবাস করেন। বীরভূমে একচক্রা বাউলরা শান্তিনিকেতন ও এর পরিপার্শ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকায় বাউল গানের সাধন-ভজন ও গায়কির পরম্পরা সেখানে সংরক্ষিত। লালন প্রভাবিত নদীয়ায় ফকিরি ও দরবেশী গানও মূলত এই ছকে আবর্তিত। যেটি আমরা নদীয়ার প্রতিবেশী কুষ্টিয়ায় লালন আখড়ায় পাচ্ছি। অর্থাৎ স্কুল বা সিলসিলা যাই বলি,—সেটি বজায় থাকায় বিচিত্র পথে গাইতে যেমন বাধা থাকছে না, অন্যদিকে মূল বনেদ সংরক্ষিত থাকছে।

সিলেটের বাউলা গান গোড়া থেকে এভাবে গড়ে ওঠেনি। এখানে সৈয়দ শাহনূরের যেমন আলাদা পরম্পরা নেই, আরকুম শাহ কিংবা শাহ আবদুল করিমেরও নেই। শিষ্য সবসময় ছিল অবশ্য। তাঁদের মধ্য থেকে পরে পদ রচয়িতা মহাজনও জন্ম নিয়েছেন। এর বাইরে বাদবাকিরা শিল্পী পরিচয়ে গানগুলো গেয়েছেন ও এখনো গাইছেন। কিন্তু, শাহনূর, আরকুম শাহ, শীতালং শাহ অথবা তুলনামূলক সাম্প্রতিক করিম-দুর্বিন শাহর কবরস্থানকে কেন্দ্র করে কোনো খানকা ও সাধন প্রণালীর চল সিলেটে ঐতিহাসিকভাবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। এর ফলে স্কুলিং ও একে ঘিরে আবর্তিত শিষ্য-শ্রোতা পরম্পরার এখানে সবল নয়।
রুহি কিংবা রমেশ ঠাকুর হয়তো করিম থেকে দীক্ষা নিয়েছেন। দুর্বিন শাহর থেকে নিয়েছেন আমির উদ্দিন। এখন উনারা অস্ত যাওয়ার পর বাউল মহাজনদের গানের গুহ্যতরিকা ও গায়েনরীতির খুঁটিনাটি সংরক্ষিত ও চর্চিত হওয়ার পরিসর দুর্বল হতে থাকবে। একদিক থেকে ভেবে দেখলে,—এটি এই অঞ্চলে দূর ভবিষ্যতে নতুন করে বাউল মহাজন ও পদরচয়িতার বিকাশকে রুদ্ধ করে দিতেও পারে। তাঁদের গান তখনো শিল্পীরা গাইবেন নিরন্তর; কিন্তু সেখানে লালনের খানকা কেন্দ্রিক গানের যে-পরম্পরা চালু আছে, যেটি এই গানের মূল ফিলোসফিকে মূলত চর্চায় নিবেদিত, কেবল আপামর শ্রোতার ওপর ভর দিয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় নয় অধীর;—সিলেট অঞ্চলে এর ঘাটতি হতে যাচ্ছে নিশ্চিত। যে-কারণে খেয়াল করলে দেখব,—সৈয়দ শাহনূরের যৎসামান্য দু-একটি গান শিল্পীরা ঘুরেফিরে গাইছেন। শীতালং শাহও তাই। এমনকি আরকুম শাহের অনেক গান অদ্য আর কানে আসে না।
এবং সেখানে,—মকদ্দস আলম উদাসী, ফকির সমছুল বা খোয়াজ মিয়ারা হয়তো শেষ প্রজন্ম, যাঁরা মুর্শিদ থেকে শিখেছেন, তারপর স্বয়ং বাউল পদ রচনা ও গেয়েছেন। পরবর্তী যারা এই বিদ্যা রপ্ত করলেন,—তাঁদের মধ্য থেকে বাউল পদ রচয়িতা বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ হতে চলেছে।
সম্ভাবনা তৈরির মতো জনভিত্তি ও সিলসিলা সিলেট অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাউলরা হারিয়েছেন। এমতাবস্থায়, জায়েদ আলী এই-যে দুর্বিন শাহ, উদাসী ও ফকির সমছুলকে নিয়ে পুস্তক বের করছেন, সেখানে বাউলকে গ্রাস করতে চলা অমাবস্যার বিষয়টি আসা প্রয়োজন ছিল মনে হয়।
. . .
গান গাওয়া নয় কালাম পড়া, বিচার করে আরিফ যারা,
গান শুনে রসিকেরা নীরবে নিস্তেজে।
কয় সমছুলে দিন যায় চলে ভাবলে না চোখ মুজে,
আপনাকে না চিনিলে, কী করবে রোজা নামাজে
[পদ রচয়িতা : ফকির সমছুল; উৎস : ফকির সমছুল স্মরণ পুস্তক; সম্পাদনা : জায়েদ আলী ]
সিলেট অঞ্চলে বাউলা গান সিলসিলা কেন্দ্রিক নয়, বরং গ্রামীণ জনসমাজে সহজাত পন্থায় চর্চিত হওয়ার ঐতিহ্যে তা গরিয়ান। বাংলাদেশের যে-বিবর্তন এখন দেখছি আমরা, সেখানে এ-কথা ভেবে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে,—সিলেট অঞ্চলের আপামর শ্রেতাসাধারণ দীর্ঘকাল যেভাবে এই বাউল মহাজনদের গানকে স্বেচ্ছায় লালন ও ধারণ করেছেন, —সেটি আগামীতে কঠিন হতে চলেছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কেবল এর একমাত্র কারণ নয়, সমাজে সামগ্রিকভাবে শরিয়তনির্ভর ধর্মচর্চার প্রসার ঘটায় হাওর অঞ্চলের মানুষের মনোজগৎ করিম-দুর্বিন কিংবা তাঁদের শেষ প্রতিধ্বনি মকদ্দস আলম উদাসী, ফকির সমছুল কিংবা খোয়াজ মিয়াদের গানে ব্যাপ্ত দীনশিক্ষাকে আমলে নেওয়ার মানসিকতা রাখবেন না। এটি হলো বাস্তবতা।
শরিয়তের সঙ্গে বাউল মহাজনদের চিরন্তন লড়াইকে ধরে রাখতে সিলসিলা তথা স্কুলিং কিছুটা হলেও কাজে দেয়। লালনের আখড়া ধর্মন্ধরা সুযোগ পেলে গুঁড়িয়ে দেবে সন্দেহ নেই, তবে সেখানে তবু ওরা শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধের চেষ্টা করবে। করিম কিংবা সমছুলের কবর তো ব্যাপার না এখানে,—তাঁদের গানবাজনা প্রকাশ্যে খোদ গ্রামের লোকজন কতটা আগের মতো চর্চা করবেন, লন্ডনের সিলেটি সমাজ কতখানি সাগ্রহে এসব গান শুনবেন, শিল্পীদের নিয়ে যাবেন দেশ থেকে,—আমি সন্দিহান।
মোহাম্মদ জায়েদ আলী সম্পাদিত ফকির সমছুল স্মরণ পুস্তক-এ তাঁর লেখা একটি পদ পাঠ করতে যেয়ে দুর্ভাবনাটি মাথায় এলো। সমছুল ওইসময় যে প্রতিকূলতা নজরে নিয়ে শরিয়তের কাউন্টার রিডিং গানটি রচনা করেছেন, এবং এরকম আরো-আরো গান কমবেশি অন্য বাউল মহাজনরা গেয়েছেন অবিরল,—পরিস্থিতি এরচেয়েও ভয়াবহ হতে চলেছে। ওই-যে ফকির সমছুল বলছেন : গান কয়জন বোঝে, এবং যেভাবে গানকে তিনি দীনচর্চার বনেদ রূপে পাঠ ও প্রতিষ্ঠা দিচ্ছেন,—শয়িরত কম জানায় আমপাবলিক তাঁর যুক্তিকে কেবল অনারই করেনি, একে ধারণও করেছে একসময়। তারা ছিল বাউলের আসল রক্ষক। যেখানে, বাউল মহাজনকে ইসলামের বৈচিত্র্যময় ভিন্নতার স্মারক রূপে ধারণ ও ঐতিহ্য ভেবে পরম মমতায় পাহারা দিয়েছে। এখন কি তা সম্ভব? আমার সে-বিশ্বাস উবে গেছে। ফকির সমছুল তাঁর পদে গাইছেন :
গানের দাম দেয় জ্ঞানী গুণী, চায় না লম্বা রাগিণী,
আসলে কোরআনের বাণী, মানে না সমাজে।।
সমছুল তখন গানটি গেয়ে পার পেয়ে গেছেন হয়তো;—এখন তাঁর উত্তরসূরি যে-শিল্পী ও তাঁকে শুনতে থাকা সিলেটি সমাজ,—তারা মনে হয় না আর সদয় হয়ে শুনতে চাইবেন এই শয়িরত প্রতিরোধী টেক্সট :
গানের ভেদ মর্ম জানিয়া, যে নামিল কাজে
বোঝে না সে কালির লেখায়, খুঁজে বেড়ায় নিজকে নিজে।।
বাংলাদেশের সমাজ যে-বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অশুভ। সেখানে ফকির সমছুলের লড়াইকে ধারণ করার মানুষ সংখ্যায় কমছেন। শ্রোতা আছে বাউল গানের, কিন্তু এর দর্শন ধারণ করার মতো সিলসিলা স্তিমিত। সিলেটের বাউলা গনের জগৎ ও তার ভবিষ্যৎ এদিক থেকে ভেবে দেখলে মনে হচ্ছে অন্ধকার! ছাপার অক্ষরে বাউল কি এখনো কেবল স্মৃতিকাতর রোমান্টিক জীবনবেদে অবিরত পঠিত হতে থাকবেন? কেউ কি ভাববেন না তার দুখবেদনভরা উচ্চারণ :
কী লাভ হবে করে সাধের পিরিতি, মনে মন না মিলিলে বড় অশান্তি।
প্রেমিক মিলে দলে দলে মিলে না জাতি।।
‘জাতি’ কেবল ওই অজানা পরমের সঙ্গে মিলনের বাসনায় পঠিত হওয়ার বিষয় হয়ে নেই এখন। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে জাতির অর্থ বড়ো নিগূঢ় হতে চলেছে। সমছুলকে প্রেমবিভোর রসে দিওয়ানা রাখবে, তাঁকে সুরক্ষা দেবে যে-জাতি, সেটি কেবল গানের শ্রোতা নয়, নয় শিল্পী শিষ্যকুল;—তারা একটি কমিউনিটি একটি পরম্পরা একটি সিলসিলা। বাউলদের দুর্ভাগ্য, আরো দুর্ভাগ্য সিলেট অঞ্চলে ছড়ানো বাউলদের,—তাঁদের জন্য এরকম কিছু কখনোই ছিল না।
. . .
. . .



