
ভাটির বহু ধামাইল গানের ভণিতায় ব্যবহৃত ‘ললিতা’ একটি লোক-প্রচলিত লুক্কায়িত জনপ্রিয় গীতিকারের নাম। যদিও ললিতা নামে কোন গীতিকারের সন্ধান আজও কোথাও পাওয়া যায়নি। প্রচলিত জনপ্রিয় অনেক ধামাইল গানের ভণিতায় ললিতা নামটি ব্যবহৃত হলেও অদ্যাবধি কেউই জানতে পারেনি,—কে এই ললিতা! এ-নিয়ে আমিও বিস্তর তালাশ করেছি, কিন্তু কোনো হদিস পাইনি। তবে হদিস না পেলেও গীতিকার ললিতার উদ্দিশ পেয়ে গেছি বলে আমার মনে হচ্ছে। জানি না গবেষক মহলের কাছে ললিতার এই উদ্দিশ পাওয়ার অনুসন্ধান কতটুকু যুক্তিযুক্ত বলে মনে হবে। তবে আমার যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। তাই বিষয়ের বিস্তারিত তুলে ধরলাম।
১৯৮৬ সন থেকে ধামাইলের প্রতি আমার ভালোলাগা শুরু। বিশেষ করে ধামাইলের জলভরা পর্বের একটি গান আমার খুব মনে বিন্দে যায়। গানটি হলো :
আমরা ভইরে আইলাম
শীতল গঙ্গার জল,
ও কালার কলসি ভইরা জল ঢালিয়া
সে যে ঘাট করল পিছল।
সে যে নন্দের ছেলে চিকনকালা
সে যে জানে নানান ছল,
সে যে আঁখিঠারে বারে বারে
আমার মন করলো পাগল।
ও এগো অঙ্গুলী হেলাইয়া কালায়
আমায় দেখায় কদমতল,
ও এগো ভাবিয়া ললিতা বলে
তরা যাইস না কদম তল।
আমরা ভইরে আইলাম
শীতল গঙ্গার জল।
এই গানটি শোনার পরে গীতিকার ললিতার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রবল ইচ্ছা দেখা দেয়। যদিও, তখন আমি ধামাইল কিংবা গীতিকারের মাহাত্ম্য তেমন বুঝি না। তাই আমার মাসির বাড়ির দিকে আত্মীয় ললিতা নামে এক জেঠিমার কাছে যাই। তিনি একজন ভালো ধামাইল গান ও বিয়ের গীতের শিল্পী। আমি সরাসরি তাকে এই গানের গীতিকার ললিতা বলে উপস্থাপন করি। তিনি আপত্তি প্রকাশ করে বলেন—’বাবারে এই কম্মো আমার না! এইতা মেলা পুরানা গান, আমার মা-খুড়িরা এই গান গাইছে। এই ললিতা! কার কিতা, খেলায় কইব?’ ললিতা সম্পর্কে আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল হয়ে গেল; তাই জেঠিমাকে কৌতুহলি হয়ে অন্য প্রসঙ্গে বললাম : তাহলে কি জেঠিমা এই গান অনেক আগের লেখা? জেঠিমা কপালে চিন্তার রেখা এঁকে উত্তর দিলেন :
আগেরেই অইতে পারে, রাধার সখি ললিতার বান্ধা অইতে পারে! অন্নের (*অন্যের*) লেখা এইরম না! ললিতা’ আর লীলাবালি;— ধামাইল আর গীতের শিরোমণি! এই বলে মাসীমা একটি অহংকারী শ্বাস ছাড়লেন। হাসলেন! আমি একটু সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—লীলাবালি কে মাসিমা? মাসীমা মুখের পান সামলিয়ে হেসে উত্তর দিলেন : এই যে গীতে আমরা গাই…
লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী সইগো
কী দিয়া সাজাইমু তরে…।
গীতটি সুরে-সুরে গেয়ে তিনি শোনালেন, এবং ললিতা প্রসঙ্গে নানা অসামঞ্জস্যতার কথাও বললেন। বুঝিয়ে দিলেন যে,—এসব তথ্য সঠিক নাও হতে পারে। আমি পড়ে গেলাম খুউব মুশকিলে। আমার জানার আগ্রহের তালিকায় নতুন করে যোগ হলো—’লীলাবালি’। যাই হোক, ললিতার কথায় আসি। তারপর থেকে যতদিন, যতবার ললিতা ভণিতায় ধামাইল গান শুনেছি, ততবারই ললিতাকে জানার আগ্রহ ভীষণভাবে আমাকে তাড়া করেছে। কিন্তু তা আর নানাকারণে তেমনভাবে খোঁজ নেওয়া হয়ে ওঠেনি দীর্ঘদিন।
১৯৯১ সাল। একমাত্র মামার বিয়ে। নেত্রকোণা জেলার ভাটি অঞ্চল। আমি বিয়ে নিয়ে খুবই ব্যস্ত। আত্মীয়-স্বজন ও নাইওরি অনেক এসেছে মামার বাড়িতে। গীতে-গানে মুখরিত সারা বাড়ি। বিয়ের লোকাচার ও শাস্ত্রাচার সমস্ত কিছু মেনে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হতে চলেছে। বিয়ের প্রতিটি পর্বেই চলছে বিষয়ভিত্তিক গীত ও গান। আমার দিদিমা (মায়ের মা) খুব বেশি ভালো গাইতে পারতেন না, কিন্তু গানে সংগত দেওয়া ও আসর জমানোর কারিগর ছিলেন তিনি। বেশ জানাশোনা ছিল তার। বিশেষ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে লোকাচার পর্বের ধারণা খুব ছিল। বিয়েতে কোন পর্বের কোন বিধি-ব্যাপার হবে, কোন পর্বে কোন গান গাইতে হবে,—এই পরামর্শ তিনি দিতেন। বিয়ের অধিবাসের স্নানে যখন জলভরা ধামাইলে (আমরা ভইরে আইলাম…), ঐ গানটি গাওয়া হয়, আমি তখন দিদিমাকে গানের রচয়িতা ললিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন :
রাধিকার সই ললিতা। রাধা-কৃষ্ণ স্নানে জলখেলি শেষে যখন শ্রী রাধিকা সইসনে বাড়ি ফিরেন, তখন ললিতা এই গানটি গায়। এই থেকেই এই ধামাইল গান শুরু হয় বলেই আমরা মনে করি। এই ললিতাই ধামাইল গানের জননী। মা-খুড়িরা কইতা, রাধা কৃষ্ণের স্নানের ঘাটে জলখেলি পর্ব থেকেই অষ্টসখী সমেত ধামাইল গানের দলীয় পরিবেশনা শুরু হয়। আমরা এইটুকই জানি।

দিদিমার এই কথা শুনে মাথায় ঝিম ধরে যায়। বুঝে উঠতে পারতেছি না ঠিক-বেঠিক। তাই বিষটা সময়ের কাছে ছেড়ে দেই। সুযোগ পেলেই ললিতাকে জানতে চাই। নানাজনের নানাকথা শুনি। যুক্তি মিলে না।
২০১২ সাল। ‘হাওর উৎসব’ উপলক্ষ্যে এলাকায় লোকগান ও লোকশিল্পীদের নিয়ে কাজ করছি। বিশেষ করে উৎসবের বিশেষ অংশজুড়ে ধামাইলগানের প্রাধান্য ছিল। তাই গ্রামে-গ্রামে গানের মহড়া ও দল নির্ণয় নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। পাশাপাশি ধামাইল গান সংগ্রহ, গানের সুর, নৃত্য, তাল, গান পরিবেশনের নিয়ম-কানুন ও শিল্পীদের নাম সংগ্রহ করি। দীর্ঘ এই পথচলায় বেশকিছু গানের ভণিতায় ললিতা নামটি আসে। ফলে আমার অতীত আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। কিন্তু কারো কাছ থেকেই জানা সম্ভব হয়নি কে সেই ললিতা?
একদিন ফিল্ডে কাজ করতে করতে গন্তব্যে ফেরা সম্ভব হয়নি। ভগ্নিপতি ডাঃ অরুণ কুমার সামন্ত দাদার বাড়িতে রাত্রি যাপন করি। তিনি একজন ভালো কীর্তনীয়া। ভালো গানও লিখেন। কবিতা, ছড়াও লিখেছেন অনেক। ভালো সাহিত্যজ্ঞান আছে। আমাকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। কলেজে শিক্ষকতার সুবাদে ‘প্রফেসরবাবু’ ডাকতেন। আমাকে পেয়ে তিনি বেশ আনন্দিত হলেন। শুরু হলো রাত জেগে সাহিত্য আড্ডা;—গল্প। এক পর্যায়ে ধামাইল ও ললিতা প্রসঙ্গ উঠে আসে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন :
শ্রীরাধা-কৃষ্ণ লীলায় শ্রী রাধিকা যমুনার জলে সহচরী সঙ্গে ধামালী দিয়ে স্নান করে, ডুবাইয়ে লাই খেলে, মনোরঙ্গে হাত-পা নেড়েচড়ে যে গান গেয়েছিলেন, তাই জলধামালী গান। জলধামালী গানে ললিতা তাই হবে। ললিতা অন্য কেউ নয়। যমুনার জলে নেমে রাধা-কৃষ্ণের স্নান ধামালী হতে ধামাইল গানের উৎপত্তি। তাই এটি জলধামালী গান। যে গানটিই সখি ললিতা গিয়েছিলেন। এ-জন্য বিয়ে উপলক্ষ্যে বর-কনের স্নান অনুষ্ঠানে জলধামালী গাওয়া হয়। শুনেন প্রফেসর বাবু, আরো বলি,—যে গানে অবরুদ্ধ মনোভাব অতি সহজে প্রকাশ পায় এবং চিত্তকে প্রফুল্লিত করে, তাই ধামাইল গান।
ললিতার বিষয়ে আগ্রহ এখন কমতে শুরু করল। মনে হলো, এর কোন আগামাথা পাওয়া যাবে না! ২০১৪ সাল। সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর হাওর উৎসবের আয়োজন হয়। এ-আয়োজনও হয়েছিল ‘হাওরপারের ধামাইল’ সংগঠনের ব্যানারে। উৎসবে ধামাইলের অনন্য শিল্পী চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি ধামাইল গান গেয়ে শোনান। উৎসব শেষে ধামাইল গান নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। এক পর্যায়ে ললিতার প্রসঙ্গ আসে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
বাবারে, শ্রী রাধিকার সই ললিতা, বিশখা, বৃন্দা এরাই তো জলের ঘাটে রাধা-কৃষ্ণের স্নানে জলখেলিতে জলধামাইল গায়। এই গান তার কিনা বলা মুশকিল! ললিতা নামে কত গান আমরা মা-খুড়ির মুখে শুনি। কিন্তু কে সেই ললিতা কে জানে! এমনও হইতে পারে, গাঁও-গেরাম যে-মহিলারা গোপনে গান লেখে তারাই ললিতা! … অবাক হওয়ার কিছু নাই।
গান লিখলে সাধনা লাগে, লেখাপড়া লাগে। তাই আগে গাঁয়ের সাধারণ মহিলারা গান লেখলেও লজ্জায় প্রকাশ করছেন না। শুনছি তারা নানাজনের নামে গান চালাইয়া দিছে। কি আর করবে বলো? গান তো গাইতে হইবো। নিত্য-নতুন এত গান পাইতো কই? না লিখে উপায় আছে!
. . .

সংযুক্তি : পাঠ-অনুভব
(থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে সংকলিত)

লেখাটি ক্রমশ ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠছে। বৈষ্ণব সূত্রে আমরা ললিতা, বিশাখা প্রমুখদের শ্রী রাধিকার সখী রূপে জেনে অভ্যস্ত। ললিতা, বিশাখা, চম্পকলতা, চিত্রা, তুঙ্গবিদ্যা, ইন্দুলেখা, রঙ্গদেবী এবং সুদেবী… এই আটজন সখীর মধ্যে ললিতা ও বিশাখাকে ঘুরেফিরে গানের পদে পাচ্ছি। রাধারমণের গানে যেমন পাই;—অন্য বাউল মহাজনের পদেও অহরহ পাচ্ছি তাদের। বোঝা যাচ্ছে, তারা বৈষ্ণব সূত্র থেকে রাধা সখীদের নাম ধার নিচ্ছেন।
লোক-প্রচলিত অনেক গান আবার পাচ্ছি, যেখানে ভনিতা স্পষ্ট নয়। স্বয়ং ললিতা বা লীলাবালির নাম দিয়ে হয়তো গানগুলো বাঁধা। সেক্ষেত্রে আপনার কৌতূহল ভাবায় বটে,—এই ললিতারা কারা? তারা কি আমাদের গাঁয়ের সেইসব অনামা গান রচয়িতা, যারা রাধাকৃষ্ণ লীলার ললিতায় ভর দিয়ে ভনিতা দিচ্ছেন? নিজের নাম সেখানে রাখছেন সংগোপন? সেকালের রক্ষণশীল সমাজে মেয়েরা গান বাঁধেননি, এ-কথা বলি কী করে! নিজ নামে ভনিতা দিতে পারবেন না বুঝে ললিতায় ভর করেছেন;—ভাবনাটি সুতরাং অবান্তর নয়।
ধামাইল নামটিই বা এলো কোথা থেকে! প্রতীকী ভাবার্থে কমবেশি সবাই বলেন বটে,—ধামা অর্থাৎ আবেশের সঙ্গে এটি সম্পর্কিত। সেইসঙ্গে সম্পর্কিত বাড়ির উঠানের মতো পরিসরের সঙ্গে,—যেখানে সমবেত গীত ও নাচের মুদ্রায় আবেশের বিস্ফার ঘটছে। ধামাইল-যে সরাসরি সখী পরিবৃত রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা থেকে উদ্ভূত, সেটি আমরা রাধারমণসহ অন্য মহাজনদের গানগুলোয় কান পাতলে ভালোই টের পাই।
আরকুম শাহের বহুল প্রচলিত গানটির কথাই ধরি। নয়ের দশকের মাঝামাঝি তাঁর বাৎসরিক ওরসে দুই-তিনবার গোটা রাত্তির পার করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। জিকির-আজগারের পাশাপাশি গান চলছে, যেরকম হয়ে থাকে সচরাচর। সুবহে সাদিক ঘনিয়ে এলে ভাব-দিওয়ানারা একে অন্যের সঙ্গে মালাবদল করতেন। যেখানে আরকুমের কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে গানটি অবধারিত নিয়মে গাওয়া হতো।
ভাবের আবেশে সকল আবরণ মুছে যাওয়া বা অভেদ হওয়ার সুরটি ধরতে আরকুম শাহ হয়তো গানটি বেঁধেছিলেন তখন। রাধাকুঞ্জে ভ্রমর মানে কৃষ্ণ এসে উড়ে বসেছেন। সেই খুশিতে রাধা ধরেছেন ময়ূর বেশ। বাসর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সখীগণ। রাধাকৃষ্ণ পরস্পরের মধ্যে লীন হচ্ছেন মালা বদলের মধ্য দিয়ে। সখীগণ পুলকিত। গানের অন্তে এসে আরকুম গাইছেন :
কৃষ্ণ প্রেমের প্রেমিক যারা,
নাচে গায় খেলে তারা
কুল ও মানের ভয় রাখে না,
ললিতা আর বিশখা
অর্থাৎ প্রেমের চরম পরিণতির ক্ষণে লাজলজ্জার বলাই ঘুচে যায়। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মিলনে সৃষ্টি অভেদ হয়ে ওঠে। আরকুম শাহ একে সুফিভাবে মিলিয়েছেন।
প্রশ্নটি তবু থেকে যায়,—ধামাইল কি ধামাল-এর অপভ্রংশ? যদিও ধামাই, ধামাল-এর অর্থ নির্দেশ করতে যেয়ে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষে দুরন্তপনা, গণ্ডগোল, উচ্ছৃংখল ইত্যাদির পাশাপাশি দেখি রতিক্রীড়া নির্দেশ করছেন। উদাহরণ টানতে যেয়ে রাধা-কানুর ধামালী উল্লেখ করেছেন হরিচরণ। মানে দাঁড়াল, ললিতাগণ পরিবৃত অবস্থায় কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার রতি-অভিসারের নিষিদ্ধ রোমান্সকে সেকালে ধামাল/ ধামালী পরিচয়ে বুঝে নিয়েছে মানুষ।
আপনার উদ্ধৃত গানেও কিন্তু চিরাচরিত দিকটি প্রকাশ পাচ্ছে। যেখানে ললিতার দোহাই দিয়ে রাধাকে জলের ঘাটে যেতে মানা করছেন গীতিকার। সমাজে নিষিদ্ধ প্রেমকে নিয়ে যে-টাবু, তার আভাস গানে উঁকি দিচ্ছে হয়তো। এই গানটি কিন্তু রাধারমণের জলে যাইও না গো রাই-র মতো ভাবসাধনার তারে সাধা নয়। এখানে বরং সামাজিক বিধিনিষেধ ও পাহারার ছবিটি পাচ্ছি বেশ। সুতরাং সেকালের কোনো নারী গীতিকার ললিতা-ভনিতায় মনের বেদন জানাতে গান বাঁধতেই পারেন।

কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী প্রণীত ক্রিয়াভিত্তিক বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ-এ গমন করলে দেখতে পাচ্ছি,—ধামাকে প্রচলিত অর্থের বাইরে ধাম হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করছেন। ধা ধাতু থেকে ধাম, অর্থাৎ গৃহ, আবাস, তীর্থস্থান, জ্যোতি, বিষ্ণু, তেজ, প্রতাপ, আশ্রয় ইত্যাদি। ইন্টারেস্টিংলি কলিম ও রবি এখানে ধাম বলতে বিষ্ণুর নাম নিচ্ছেন। আর কৃষ্ণ তো বিষ্ণুর মানবধরায় দশমাবতার বা দশটি ভিন্ন রূপে ভিন্ন-ভিন্ন সময়রেখায় আবির্ভূত হওয়ার তালিকায় আছেন বটে!
কলিম ও রবি আরো নির্দেশ করছেন,—মধ্যযুগে বৈষ্ণব সূত্রে ধামা নয় বরং ধাম শব্দটি প্রচলিত ছিল। এখন ধাম মানে হচ্ছে ধারণের আধার যেখানে সীমিত হয়। অর্থাৎ, যেখানে গিয়ে কিছু কেন্দ্রীভূত বা জমা হতে থাকে। কেন্দ্রীভূত হওয়া বলতে এখানে ইংরেজি সেন্টারড কিন্তু বোঝাচ্ছে না। ইংরেজি Center মূলত প্রতীকী শব্দার্থ। জড় বা স্থির কিছু বোঝানোর খাতিরে সেই ভাষায় শব্দটির উদ্ভব।
বাংলায় ধাম সেরকম নয়। এটি ক্রিয়াভিত্তিক। কলিম ও রবির মতে,— ধাম বলতে চারদিক থেকে যা এসে একটি জায়গায় বিরাম নেয় তা বোঝানো হতো। যেমন আনন্দ যেখানে এসে জমা হতে থাকে, তাকে বলা হতো আনন্দধাম। সেকালে ধানক্ষেতে জল নামতে শুরু করলে মাছেরা ক্ষেতের কোণায় গর্ত বা চৌব্বাচার মতো জলপূর্ণ জায়গায় জড়ো হতো, মাছের এই ক্রিয়া থেকে উদয় আনন্দধাম শব্দের। মধ্যযুগে ব্রজবিহারীগণ জমা হতেন ব্রজধামে। তীর্থযাত্রীরা কাশীধামে।
কলিম ও রবির উৎস ব্যাখ্যাকে আমরা এখানে রাধাকৃষ্ণ লীলার মূল মঞ্চ নদীর ঘাট বলে ধরে নিতে পারি। যেখানে রাধা ও গোপীগণ কৃষ্ণধামে অবগাহন করতে জমা হচ্ছেন। বাড়ির উঠানও এখানে ধাম , যেহেতু সমবেত কণ্ঠে নাচ ও গানের ক্রিয়াটি সারতে সকলে সেখানে জড়ো বা জমা হচ্ছেন। সুতরাং, ধা থেকে ধাম, ধাম থেকে ধামা, ধামা থেকে ধামালী হয়ে ধামাইল… এভাবে একটি বিবর্তনরেখা বোধহয় ভাবা সম্ভব।
. . .
আগের পর্ব :
হাওরজীবন-১ : চেনা গান অচেনা গীতিকার — সজল কান্তি সরকার

লেখক পরিচয় : ছবি অথবা এই লিংক চাপুন
. . .



