স্বচ্ছতার সংস্কৃতি ও দগ্ধ সমাজ
বুয়িং-চুল হান-এর (Byung-Chul Han) ভাববিশ্ব : চতুর্থ পর্ব-১

দগ্ধ সমাজে বুয়িং-চুল হানের ভাবুকসত্তার বিচরণকে বিগত তিন পর্ব ধরে আমরা অনুসরণ করছি। আজকের পর্বে প্রযুক্তিশাসিত বিশ্বে নব্যউদারতাবদ ও পুঁজিবাদকে তিনি কীভাবে দেখেছেন, তা জানার চেষ্টা করব। Psychopolitics বা মনোরাজনীতিকে এখানে এসে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন হান। এবং সেখান থেকে মানুষকে মরণবাসনার দিকে ঠেলে দেওয়া পুঁজিবাদের নতুন স্বরূপকে নজরে নিয়েছেন এই ভাবুক।
মনোরাজনীতির স্বরূপ উন্মোচনে হানের Psychopolitics: Neoliberalism and Technologies of Power বইটির পৃথক গুরুত্ব রয়েছে। প্রায় এক দশক আগে লেখা হলেও এর প্রাসঙ্গিকতা এখনো অমলিন। প্রযুক্তিশাসিত বিশ্বে নব্যউদারতাবাদকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করা হয়, তার প্রাঞ্জল আলোচনা আমরা এখানে পাচ্ছি। এই বইটিকে অবশ্য হানের ভাবুকসত্তার কেন্দ্রবিন্দু বিবেচিত The Burnout Society ও The Transparency Society বইয়ে আলোচিত বিষয়বস্তুর গভীর সম্প্রসারণ হিসেবে অনেকে ভেবে থাকেন। মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক শাসন-কাঠামোর ভিতকে প্রখর দৃষ্টিতে এখানে পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যা করেছেন হান।
হানের বিবেচনায় নব্যউদারতাবাদ এখন আর কেবল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিসীমায় আবদ্ধ নেই। সময়ের পালাবদলে নতুন মোড় নিয়েছে, এবং তাকে আমরা আত্মিক ও নৈতিক চরিত্র ধারণ করতে দেখছি। মানুষ যেখানে তার নিজেকে স্বেচ্ছায় নিয়ন্ত্রিত হতে দিচ্ছে। মুক্তি ও স্বাধীনতার চিরাচরিত আকাঙ্ক্ষা ও এসব নিয়ে মনের ভিতরে সক্রিয় দ্বন্দ্ব তাকে অতীতের মতো অতটা উতলা করে না। সে বরং সচতেনভাবে স্বেচ্ছাবন্দিত্বে নিজেকে সুরক্ষিত ভাবছে এখন!
বইয়ে সংগতকারণে মিশেল ফুকোকে প্রাসঙ্গিক করেছেন হান। ক্ষমতা কীভাবে শৃঙ্খলা বা ডিসিপ্লিন তৈরির বাহানায় মানুষকে শৃঙ্খলিত ক্রীতদাসে পরিণত করে, এর বিস্তারিত বিবরণ আমরা ফুকোর গবেষণা ও ভাবুকতায় প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হতে দেখেছি। বুয়িং-চুল হানকেও তিনি প্রভাবিত করেছেন। কেবল তাই নয়,—স্বাধীনতা, ক্ষমতা-কাঠামো, জর্জ অরওয়েলের বিগ ব্রাদার, আজকের জীবনধারায় মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করতে থাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, রাষ্ট্র ও সরকার আরোপিত স্বেচ্ছা-নজরদারি ছাড়াও বৃহৎ তথ্য-ব্যবস্থাপনার গতি-প্রকৃতি নিয়ে সবিস্তারে ভেবেছেন হান। সেইসঙ্গে আত্ম-শোষণমূলক পুঁজিবাদ বিষয়ে নিজের ভাবনাকে আরো সুসংহত করতে দেখছি তাঁকে।
মনোরাজনীতির খোলনলচে তুলে ধরার উদ্দেশ্য থেকে রচিত বইয়ে কিছু-কিছু ক্ষেত্রে হানের বক্তব্যে পুনরাবৃত্তি পাঠকের বিরক্তির কারণ হতে পারে। তবে, মনে রাখা প্রয়োজন,—বুয়িং-চুল হানের লেখা সবগুলো বই একটি অন্যটির পরিপূরক। সুতরাং, তাঁর ভাবনার খেই পেতে হলে পরিপূরক করে লেখা বইগুলোকে বাদ দিয়ে অগ্রসর হওয়ার উপায় নেই।
Psychopolitics: Neoliberalism and Technologies of Power বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো Beyond the Subject ও Idiotism-কে নতুন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করেছেন হান। প্রতিরোধী শক্তির জয়গান সেখানে পাঠক পাবেন। দস্তয়েভস্কির আখ্যানে অমর চরিত্রর প্রিন্স মিশকিনকে প্রতিরোধের আয়ুধ হিসেবে বেছে নিয়েছেন ভাবুক। তাঁর কাছে মিশকিনের ইডিয়টিজম নিছক সোজাসরল বা বোকাবোকা ঘটনা নয় সীমাবদ্ধ। সে হচ্ছে এমন এক চরিত্র, যে তার সত্তাকে স্বেচ্ছায় অন্য কারো সাবজেক্ট হতে দিতে সম্মত হয়নি।
বাজার-পছন্দ চরিত্র হয়ে ওঠার চাপ এড়াতে এই ইডিয়ট তার বোকামি বা সরলতাকে বরং চতুরভাবে কাজে লাগিয়েছে। নিজের ভিতরে সে গড়ে তুলেছে শক্ত প্রতিরোধ। প্রতিরোধটি এখানে সম্পর্কের গুরুত্ব ও গভীরতার পরিচর্যায় তাকে শক্তি দিচ্ছে। সম্পর্ককে সুরক্ষিত রাখার পন্থা যেখানে নীরব প্রতিরোধের মন্ত্রে সবল। এই ইডিয়টের মধ্যে হান তাই নতুন মানুষের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন। তাঁর মতে,—এরকম মানুষরাই কেবল নতুন যুগের স্বাধীনসত্তা হওয়ার শক্তি রাখবে,—অন্যরা নয়।

এখান থেকে আমরা ডুব দিতে পারি পুঁজিবাদ ও মৃত্যুবাসনা নিয়ে বুয়িং-চুল হানের গভীর ভাবুকতায়। Capitalism and the Death Drive বইয়ে হান পুঁজিবাদকে কেবল একটি অর্থনৈতিক কাঠামো হিসেবে দেখতে নারাজ বোধ করেছেন। একে তিনি দেখছেন মানসিক, সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া হিসেবে;—মৃত্যুকে অস্বীকার করা যেখানে তাকে দিয়েছে যুগান্তকারী ভিন্নতা।
হানের মতে, আমরা আজকাল যাকে ‘উন্নয়ন’ বলি, বাস্তবে তা ক্যান্সার ছাড়া কিছু নয়। উন্মত্ত এক উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধির যুগে সকলে বসবাস করছি;—গভীরভাবে ভেবে দেখলে এই উন্মত্ততা হচ্ছে মৃত্যুর উন্মত্ততা। উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির প্রাণবন্ত অভিনয় করছি সকলে মিলে;—যার আড়ালে লেলিহান রূপ নিচ্ছে সর্বনাশা মরণ! উৎপাদন যেখানে ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করছে দ্রুত। মানুষের আত্ম-বিচ্ছিন্নতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে সে নিজের এই ধ্বংসকে পরম নান্দনিক ভাবতে ও তাকে আলিঙ্গন করতে দ্বিধা করছে না। ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন যে-কথা বলেছিলেন,—পুঁজিবাদের ক্ষেত্রেও তা সমান কার্যকর বলে মনে করেন হান।
ওয়াল্টার বেঞ্জামিন তাঁর বিখ্যাত নিবন্ধ The Work of Art in the Age of Mechanical Reproduction-এ বলেছিলেন,—ফ্যাসিবাদ মানুষকে এমন অবস্থায় নিয়ে যায়, যেখানে তারা নিজের ধ্বংস, যুদ্ধ, নিপীড়ন ও আত্মঘাতী উন্মাদনাকে নান্দনিক শৈল্পিকতা ভেবে পরিতুষ্ট বোধ করতে মরিয়া হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, নিজের এই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মধ্যে ‘ধারাবাহিকতা’ ও ‘উপভোগ্যতা’ খুঁজে নেওয়ার বাতিক তাদের সত্তায় প্রবল হয়ে ওঠে।
পুঁজিবাদও অনুরূপ পন্থায় সক্রিয় বলে রায় দিচ্ছেন বুয়িং-চুল হান। মানুষের সর্বনাশ সেখানে ‘নান্দনিক’ ও ‘স্বাভাবিক’ ঘটনায় রূপ নিয়েছে। আত্মশোষণকে বলা হচ্ছে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বা Self-Improvement. নিঃসঙ্গতাকে মুক্তি বা Freedom নামে মহিমান্বিত করছে এই পুঁজিবাদ। ক্লান্তির ভারকে নমনীয় করতে একে Achievement নাম দিয়ে মানুষের সামনে হাজির করছে অবিরাম। আর, হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে বিধ্বস্ত মানুষকে Commitment-এ অটল বলে বাহবা দেওয়ার পাঁয়তারা তো থাকছেই! মানুষ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির ছকে ধ্বংসকে উপভোগ্য অর্জন ভাবতে মানুষকে ক্রমশ অভ্যস্ত করে তোলা হচ্ছে।
হানের মতে, মানুষ এখন মরণতুল্য অন্ধতায় আক্রান্ত। অন্ধতা এখানে নিছক দৃষ্টিহীনতার কোনো উপমা নয়! এটি হচ্ছে দর্শন ও অনুধাবনের অক্ষমতা। মানুষ নিজের সময়, নিজের ধ্বংস, এমনকি অস্তিত্ব নিয়ে ভাবার ক্ষমতা হারিয়ে ফতুর হতে বসেছে! উপযোগ, প্রযুক্তি, শরীর ও পরিমাপযোগ্য ব্যাপার ছাড়া কোনোদিকে সে মনোযোগী নয়। সৌন্দর্য, নৈতিকতা, আত্মজিজ্ঞাসার মতো উচ্চতর অর্জন তার দৃষ্টিসীমার বাইরে পড়ে থাকছে !
পুঁজিবাদ নিয়ে হানের এই দৃষ্টিভঙ্গি মূলত সিগমুন্ড ফ্রয়েডের Death Drive বা মরণবাসনা তত্ত্বের আধুনিক পাঠ-বিনির্মাণ। ফ্রয়েড তাঁর বিখ্যাত বই Civilization and Its Discontents (1930)-এ বলেন,—মানুষের ভেতর ‘আগ্রাসনের প্রবৃত্তি’ (instinct of aggression) অত্যন্ত শক্তিশালী। সভ্যতা এই প্রবৃত্তিকে দমিয়ে রাখলেও পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারে না।
যুক্তিবোধের মাধ্যমে মানবিক উৎকর্ষের ‘উচ্চতর স্তরগুলো’ অনুধাবনের কথা ফ্রয়েড বলেছেন; কিন্তু তাঁর মতে মানুষের ওপর তাড়না ও প্রবৃত্তির চাপ অধিকতর প্রবল। মৃত্যুবাসনা যেখানে তার ভিতরে সক্রিয় আক্রমণাত্মক প্রবণতার মূল উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। হান এই আগ্রাসনকে পুঁজিবাদী কাঠামোয় সংযুক্ত করেছেন। বলছেন,—পুঁজিবাদ বর্তমানে মানুষের ভিতরে কাজ করে চলা হিংস্র মনোবৃত্তি, প্রতিযোগিতা পরায়ণ উন্মত্ততা ও ভোগবাসনায় মরিয়া সত্তাকে টেনে বের করার উপযোগী মঞ্চ তৈরি করেছে।
মানুষ এখন একে অন্যকে পরাজিত-পরাস্ত করার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়। নিজের সাফল্য জাঁক করে বলে বেড়ায় সকলকে। অন্যকে ব্যর্থ হতে দেখলে মনে-মনে তৃপ্তি বোধ করে। এগুলো অর্জনের তাড়নায় নির্দয়ভাবে নিজের আত্মশক্তিকে সে দোহন করে চলে! নিজেকে এভাবে দোহন করতে ভালো লাগে তার। ভোগবাসনাকে পুঁজিবাদ এভাবে সামাজিক সত্য রূপে প্রতিষ্ঠা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাজার, ব্র্যান্ড, পারফরম্যান্স, চাকরি, ফিটনেস ইত্যাদি ন্যারেটিভকে মানুষ এখন সামাজিক মর্যাদা ও উপযুক্ততার প্রতীক ভাবে। মানুষের সত্তা ও স্বকীয়তার ওপর পুঁজিবাদ সৃষ্ট এসব ন্যারেটিভের ধ্বংসাত্মক প্রভাবকে বিবেচনায় নিয়েছেন বুয়িং-চুল হান। যে-কারণে ফ্রয়েডের মৃত্যুবাসনার সঙ্গে পুঁজিবাদকে সংযুক্ত করা তাঁর কাছে যুক্তিসংগত মনে হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে ফরাসি অর্থনীতিবিদ বার্নার্ড হেনরি মারিস-এর (যিনি ২০১৫ সালে Charlie Hebdo নামক সংবাদপত্রের কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন ) ভাবনাকে গুরুত্বের সঙ্গে বইয়ে তুলে ধরেছেন তিনি। মারিস তাঁর বই Capitalisme et pulsion de mort বা পুঁজিবাদ ও মৃত্যুবাসনা-য় যুক্তি দিয়েছেন : The great cunning of capitalism lies in the way it channels, it diverts, the forces of annihilation, the death drive, toward growth. অর্থাৎ পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় ধূর্ততা হলো,—ধ্বংসাত্মক প্রবণতাকে সে প্রবৃদ্ধিতে রূপান্তরিত করে। মারিস বলছেন,—মানুষের মধ্যে আত্মধ্বংসের যে-প্রবৃত্তি বিদ্যমান, ফ্রয়েড যাকে Death Drive বলে ব্যাখ্যা দিলেন,—পুঁজিবাদ এখন অনুরূপ অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষকে আত্মশোষণে নিমজ্জিত রেখেছে। তাকে ক্লান্তি ও আত্মনির্মাণের অসীম চক্রে বন্দি করছে সফলভাবে। মানুষকে অবিরত এই মন্ত্রণা দিচ্ছে সেখানে :
আরো উপার্জন করো। নিজেকে গড়ে তোলো। আরো বেশি পারফর্ম করো। যতবেশি তৎপর থাকবে, ততবেশি সাফল্য আসবে জীবনে। আর সাফল্য তোমাকে ইচ্ছা ও স্বাধীনতা উপভোগের পথ প্রশস্ত করে দেবে। প্রবৃদ্ধির এহেন তাড়না ও মোহ মানুষের জীবনশক্তিকে শেষপর্যন্ত গ্রাস করে ফেলছে। ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি যেখানে উন্নয়নের নামে মৃত্যুকে অমোঘ করে তুলছে প্রতিদিন। মানবিক সুচেতনা ও সম্পর্কের অলিগলি থেকে আরম্ভ করে প্রকৃতির মধ্যেও মানুষ এভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে মরণবিষ।
বার্নার্ড মারিস দেখিয়েছেন,—পুঁজিবাদ কেবল টিকে থাকার নামে নয়, বরং একধরনের ধ্বংসপ্রবাহ রূপে সমাজে নিজেকে সক্রিয় রাখে। তাঁর এই ভাবনাকে বুয়িং-চুল হান আরো বিস্তারে নিয়ে গেছেন। দেখাচ্ছেন,—মানব সভ্যতা এখন নিজের মৃত্যুকে জীবনের উৎসার বলে চিহ্নিত করছে;—এর বন্দনা করছে বিরামহীন। আর তাই ফ্রয়েডের মৃত্যুবাসনা, মারিসের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও হানের দার্শনিক ব্যাখ্যা একত্রে মিলে ভয়াবহ এই সত্যকে নগ্ন করছে,—পুঁজিবাদ জীবনকে ধ্বংস করে, কিন্তু এমনভাবে করে,—মানুষ একে ধ্বংস রূপে শনাক্ত করার পরিবর্তে জীবনের প্রেরণা ভাবতে বাধ্য হয়!
বার্নার্ড মারিসের ব্যাখ্যায় পুঁজিবাদ মৃত্যুবাসনাকে প্রবৃদ্ধিতে পরিণত করে। কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা বলে না,—পুঁজিবাদ কেন উন্মাদভাবে জমা করতে চায়! উৎপাদন ও সঞ্চয় করে! কেনই-বা অস্থির প্রবৃদ্ধির বেগে মানুষকে রাখে দৌড়ের ওপর। অন্ধ এই Growth Compulsion—এর উৎস কী? হান বলছেন,—প্রবৃদ্ধির এই অন্ধপ্রেরণা আসে গভীর Ontological ভয় থেকে। আর তা হলো মরণের ভয়। পুঁজিবাদে মানুষ ধ্বংস হতে চায় না। ক্ষয়প্রাপ্ত হতে চায় না। হারিয়ে যেতে চায় না। অস্তিত্বকে সে তাই সঞ্চয়, উন্নয়ন ও অর্জনের মতো ন্যারেটিভে অবিনাশী রাখতে মরিয়া হয়। Capital is accumulated as a defence against death, against absolute loss.—পুঁজির মধ্যে মানুষ নিরাপত্তা খোঁজে; সে খোঁজে অমরত্ব! এটি তাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করবে;—এই বিশ্বাসে অধীর দেখায় তাকে।
হানের মতে মারিস এই মৃত্যু-বাস্তবতার দিকে মনোযোগ দেননি। এমনকি ফ্রয়েড মৃত্যুকে গুরুতর রূপে বিবেচনা করেননি। মৃত্যুবাসনা বলতে তিনি একটি ইচ্ছেকে কেবল হিসাবে নিয়েছিলেন;—মরণভীতিকে যেটি আড়াল করছে সেখানে। ফ্রয়েড এভাবে মৌলিক একটি দিক উপেক্ষা করেছেন, আর সেটি হচ্ছে,—প্রত্যেক জীবিত সত্তা মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তিনি উলটো বলে বসেন, বেশ অদ্ভুতভাবেই বলেন :—মৃত্যুবাসনার ধারণাটি গ্রহণ করলে আমাদেরকে আর জীবনের রহস্যময় সংকল্প, যেটি সকল প্রতিকূলতায় নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে চায়,—তা নিয়ে ভাবতে হয় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা মোটেও অযৌক্তিক নয়,—ফ্রয়েডের মৃত্যুবাসনা মূলত এক ধরনের অসচেতন কৌশল, যার মাধ্যমে মৃত্যুর বাস্তবতাকে তিনি চাপা দিয়েছিলেন।

হান তাই বলেন,—মানুষ কর্তৃক সংঘটিত আগ্রাসন ও সহিংসতা মৃত্যু-সম্পর্কিত সচেতনার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত;—আর এই সচেতনতা একান্ত মানুষিক গুণের বহিঃপ্রকাশ। সহিংসতার অর্থনীতি চলে সঞ্চয়ের যুক্তিতে। মানুষ যত বেশি সহিংসতা প্রয়োগ করবে, তত বেশি নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করবে সে। হত্যা করার শক্তি হচ্ছে এক ধরনের প্রবৃদ্ধি। মানুষকে এটি অজেয় অমরত্বের অনুভূতি দান করে। মানুষ পাশবিক সহিংসতায় যে-নার্সিসিস্ট আনন্দ পায়, সেটি এই ক্ষমতা-সঞ্চয়ের অনুভূতির সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে জড়িত।
হত্যা সুতরাং মৃত্যু-প্রতিরোধী প্রতিরক্ষা। হত্যা করার মাধ্যমে মানুষ মৃত্যুকে সাময়িক থামিয়ে রাখে। হত্যা করার শক্তি যত বাড়বে, মৃত্যু তত কম হবে। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা এই পুঁজিবাদী সহিংসতার প্রতিচ্ছবি। হত্যা করার শক্তি জমা রাখার মধ্য দিয়ে যেখানে বেঁচে থাকার শক্তিকে জমা করার উপায়ে রূপান্তরিত করে মানুষ।
হান বলেন,—Money শব্দটির উৎপত্তিগত ইতিহাস নির্দেশ করে এর সঙ্গে রয়েছে বলিপ্রথা ও সাংস্কৃতিক আচারগুলোর সংযোগ। প্রাচীনকালে অর্থ ছিল এমন একটি বিনিময়-মাধ্যম, যার দ্বারা বলির পশু ক্রয় করা হতো। যাদের কাছে প্রচুর অর্থ ছিল, তারা পেত ঈশ্বর সদৃশ হত্যাশক্তি। বলিপ্রথার প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে অর্থ হলো জমাট বলির রক্ত। টাকা ছড়ানো, তার প্রবাহ, এবং সেই প্রবাহে অবগাহনের অভিজ্ঞতা,—এর সবটাই যেন যুদ্ধক্ষেত্র বা বলির বেদীতে রক্তপাতের মতো উত্তেজক।
এই জমাকৃত অর্থ ধনীর মধ্যে সৃষ্টি করে শিকারি। এটি তাকে মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রদান করে। গভীর মনস্তাত্ত্বিক স্তরে এই আদিম বিশ্বাসটি আজো সক্রিয়,—জমা রাখা হত্যাশক্তি ও সঞ্চয়কৃত পুঁজি মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে। একালে পুঁজি সঞ্চয়ের যুক্তি বলিপ্রথায় নিহিত আদিম সহিংসতা ও অর্থনৈতিক উপয়োগের সঙ্গে তাই মিলে যায়। পুঁজির আচরণ সেখানে মানা-র (mana) আধুনিক রূপ। Mana হচ্ছে পলিনেশিয়া ও অন্যান্য আদিম সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত ধারণা। মৃত্যু ঘটানোর মাধ্যমে অর্জিত আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে যেটি বিশিষ্ট করে তোলে।
হান তাই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন,—পুঁজিসঞ্চয় অনুরূপ আবেগ উৎপন্ন করে। যেমন করে মানা-র (mana) সঞ্চয়। পুঁজি যত বাড়ে, ক্ষমতাও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পায়। পুঁজি যত বাড়বে,—মৃত্যুকে অস্বীকারের প্রবণতাও বাড়বে। পুঁজির সঞ্চয় ঘটানো হয় মৃত্যু থেকে পালানোর মতলবে। পুঁজিকে যে-কারণে জমাট সময় বলে ভাবা যেতে পারে। অসীম পুঁজি-সঞ্চয় সৃষ্টি করে অসীম সময়ের বিভ্রম। সময় মানে টাকা। সীমিত সময়ে বাঁধা জীবনের মুখোমুখি আমরা তখন ওই সময়কে পুঁজি হিসেবে জমা করে থাকি।
এই প্রেক্ষাপটে হান বলছেন,—পুঁজি আসলে মৃত্যুভীতি ও একে প্রতিরোধের বাসনা থেকে জন্ম নিয়েছিল। আমরা যতই ধনী হই, স্বাস্থ্যবান হই, ফিটনেস সচেতন হই,—আমাদের ভিতরে গোপন আকুতি কাজ করে, আর সেটি হলো,—মরতে না চাওয়ার আকুতি। মৃতদেরকে আমরা তাই ভুলে থাকতে ভিতরে-ভিতরে মরিয়া হই। অসুস্থ লোকজনকে আড়াল করতে চাই। মৃত্যু নিয়ে কথা বলা স্বস্তিকর মনে করি না। বিকল্প পথ ধরে অগ্রসর হই। স্থায়ী, কার্যক্ষম ও দেহনির্ভর চাহিদা পূরণে ডুবে থেকে মৃত্যুকে প্রবলভাবে অস্বীকার ও প্রতিরোধের চেষ্টা করি। মৃত্যু-প্রতিরোধে মরিয়া এই জীবনকে বুয়িং-চুল হান Performance-Zombie বা Fit-but-dead জীবনধারার প্রতীক বলে ভাবছেন! কারণটি পরবর্তী পর্বে আমরা আলোচনা করতে পারব আশা রাখি।
. . .
. . .



