
আঁখিতারা
কোন তারার কথাই মনে নেই আমার
আঁখিতারা ছাড়া
অবশ্য আকাশের তারা গুনে গুনে
বড়ো হইনি আমি
কোনোদিন আকাশ দেখেছি কি না
সেটাও তো বলতে পারছিনে
শোনা যায় নারিকেল বা দেবদারু গাছের পাতার ফাঁকে
তারা আছে
কেউ কেউ পেয়েছে তাদের
আমার তারা আঁখিতারা
তারও রয়েছে চমৎকার এক কন্যা
আর সেটা সে দিয়েছে
আমাকেই
. . .
রেভ্যুলুশান
দুনিয়ার সব সেতুই একদিন উড়িয়ে দেওয়া হবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে—
এই কথাটা কে বলেছিল জানো
হুম্
আমি জানি না
কিন্তু এটা তো ঠিক যে কেউ একজন বলেছিল
সে তুমিও হতে পারো
আমিও
যা হোক এইসব সেতু তো আমরাই বানিয়েছি
রক্তের সেতু
মায়ামমতার সেতু
অকৃত্রিম নিয়মবদ্ধতায় আবর্তিত সেতু
হ্যাঁ এখন এগুলো ভেঙে ফেলা হবে
উড়িয়ে দেওয়া হবে
অন্তত এটাই করা উচিত
কেন
কেন
এই প্রশ্ন কি তোমাদের সবার মনে জেগেছে
একবারও
. . .

আমাদের সবার জানা দরকার কবিতা কীরকম বাজে জিনিস
কবিতা লেখা ছাড়া আরও কিছু যে আমি পারি
এটা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না
বন্ধু মায়াকোভস্কি ছাড়া
ঠিক আছে
ধরেই নিলাম ওরা বিশ্বাস করতে চায় না মানে বুর্জোয়া বা সর্বহারারা
হ্যাঁ
বিশ্বাস করতে চায় না
বন্ধু মায়াকোভস্কি ছাড়া
হতে পারে খুব সাধারণ বা আপাত গুরুত্বহীন কোনো কাজ
তবু তা যে আমি পারি
লেনিন ভাবেন যেমনটা
এই বিশ্বাস তো ওদের করানো দরকার ওই বুর্জোয়াদের
আর সর্বহারাদের
এখন প্রশ্ন করতে পারো করাবেটা কে
কেন আমি
আমি যে কবিতা লিখি
আর কবিতা কতটা বিশ্রী আর দুর্গন্ধময় আর বিপজ্জনক
লেনিন ভাবেন যেমনটা
এ তো ওদের জানা দরকার
. . .
কবি যা বলেন না
আমার কবিতা পড়ে তোমরা খুশি হতে পারো
রেগে যেতে পারো
তাহলে জেনে রাখো এই কবিতার পেছনে
কাগজ
কালি
চিন্তা
শব্দ
তাজা অথবা শুকনো রক্তের দলা
হ্যাঁ
এরকম আরো অনেকেই ছিল
আছে
. . .

বই
বইয়ের ভেতর কত কিছু যে থাকে
যে পড়ে
সে টের পায় না
সুশ্রী আর নাদুসনুদুস সব বই একসময় পড়তাম আমি
পড়তাম
তারপর ঝিমুনি আসতো
তারপর কখন ঘুমিয়ে যেতাম
বইয়ের ভেতরে কী থাকে এটা জানার জন্য
তোমাকে
ঢুকে যেতে হবে বইয়ের ভেতরে
বইয়ের একেবারে ভেতরে
ধীরেসুস্থে
দৃঢ়তার সঙ্গে বা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো
মনে রেখো বই পড়বার মতো কিছু না
তাকে সাজিয়ে রেখে তৃপ্তি অর্জন প্রদর্শন বা বিক্রি
কোনোটাই না
বইয়ের ভেতরকার আকাঙ্ক্ষা খিদে রক্ত বিষ
যন্ত্রণা
নিজের ভেতর
অনুভব করতে পারাটাই আসল
. . .

জন্মসূত্রে ঝিনাইদহের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য কবি ও গদ্যকার শিশির আজম তাঁর ‘সল্ট পোয়েট্রি’ কবিতায় লিখছেন :
(কবিতায় আমি নুন দিই। কিন্তু তার পরিমাণটা এমন
আর কবিতার অন্যান্য অনুষঙ্গে
তার সংশ্লেষণ এমন
যে পাঠক তাকে আলাদাভাবে শনাক্ত করবার কথা ভাবেন না।)
বক্রোক্তি মেশানো ভঙ্গিতে রচিত কবিতায় নিজের কবিতা লেখার রসদ ও ধরতাইয়ের আভাস কবি দিয়েছেন বটে! এ-পর্যন্ত প্রকাশিত তেরোখানা কবিতাবইয়ে কবিসত্তার জার্নি ধারণ করেছেন শিশির আজম। অনেকদিন ধরে লিখলেও প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছাই ঈসায়ী ২০০৫ সনে প্রকাশ করেন কবি। তারপর একে-একে বাকিগুলো বেরিয়েছি।
২০১৮-য় মারাঠা মুনমুন আগরবাতি বের হওয়ার আগে চার থেকে পাঁচ বছরের বিরতিসীমায় বেরিয়েছে দেয়ালে লেখা কবিতা, রাস্তার জোনাকি, ইবলিস ও চুপ শিরোনামের কাব্যগ্রন্থ। মারাঠা মুনমুন আগরবাতি বাজারে আসার পর থেকে পরবর্তী বইগুলোর প্রকাশ-মেয়াদ বেশ সংক্ষিপ্ত করে এনেছেন কবি। করোনা অতিমারির দুই বছরে বেরিয়েছে মাতাহারি, সরকারি কবিতা, হংকঙের মেয়েরা ইত্যাদি।
টি পোয়েট্রি আন্দোলনের উসকানিদাতা পরিচয়টি তাঁর পছন্দের। টি পোয়েট্রি দেখতে কেমন তার ধারণা পাঠক পায় করোনা অতিমারির বছরে একই শিরোনামে বন্দি কবিতাবইয়ে। বারোখানা কবিতায় সাজানো বইটির পরিচয় তুলে ধরতে শিশির আজম লিখছেন :
আপনি ভালো (!) কবিতা লিখুন
আপনি খারাপ (!) কবিতাও লিখুন।
যা ইচ্ছে যেমন ইচ্ছে
চায়ের টেবিলে বসে লিখুন।
এমনভাবে লিখুন যেন চায়ের টেবিলেই পড়ে ফেলা যায়।
এটাই ‘টি পোয়েট্রি’।
কিন্তু মনে রাখবেন ‘টি পোয়েট্রি’র ঝাঁঝ টি টেবিল ছাড়িয়ে
সংসদ ভবন পর্যন্ত পৌছতে পারে।
আমার এই কথাবার্তাকে Tea Poetry-র ম্যানিফেস্টো মনে করার কারণ নেই।
আমি কেবল চায়ের কাপে প্রথম ফুঁ-টা দিলাম।
আসুন সবাই চায়ের টেবিলে বসি।
নয়ের দশকে কবিবন্ধুদের নিয়ে মঙ্গলসন্ধ্যা শিরোনামে কবিতাকাগজ বের করতেন সরকার আমিন। ‘কবিতা দীর্ঘশ্বাসের মতো আরামদায়ক’;—এই ঘোষণা এসেছিল তখন তাঁদের তরফে। শিশির আজমের টি পোয়েট্রি-র ফিলোসফির সঙ্গে উক্ত ঘোষণার একপ্রকার সান্নিধ্য রয়েছে। তবে, ‘কিন্তু মনে রাখবেন ‘টি পোয়েট্রি’র ঝাঁঝ টি টেবিল ছাড়িয়ে সংসদ ভবন পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।’;—এই উচ্চারণটি আবার সরকার আমিনদের কবিতা ম্যানিফেস্টো থেকে টি পোয়েট্রি-র ফিলোসফিকে পৃথক করায়।
শিশির আজমরা হয়তো সেই কবিতা লিখতে উন্মুখ,—যে-কবিতা পাঠে পাঠকের প্রচলিত অভ্যাস টাল খাবে। কবিতা ভালো না খারাপ, এই আপেক্ষিক বিবেচনার বাইরে গিয়ে, তাকে দীর্ঘশ্বাসের মতো আর্দ্র কুসুম ভাবার পরিবর্তে, তাঁরা পাঠসচেতনায় আঘাত হানতে ইচ্ছুক। যেখানে দালি, গগাঁ, আব্বাস কিয়ারোস্তামি, তারকোভস্কির মতো মহাপ্রাণদের নিজমধ্যে জারণ করেছেন কবি। যে-কারণে হয়তো আগুন কবিতাবইয়ের পরিচয় দিতে লিখেছেন :
‘গগাঁর তাহিতি কোন না কোন ভাবে আমার আমার কবিতার অন্তঃসলিলে বয়ে চলেছে, অস্বীকার করতে পারবো না। আমার এই নতুন কবিতার বইয়ে এর রেশ আছে।’
শিশির আজমের ভাবনার গতিরেখ ও আবর্তন অনেকখানি ধরা পড়ে চলমান বছরে প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ কবির কুয়াশায় সংকলিত রচনায়। কবিতার পাশাপাশি চিত্রকলা ও চলচ্চিত্রের ভুবনে কবি দিয়েছেন ডুব। বাদ যায়নি রাজনীতি ও সমকাল। গদ্য সংকলনটি বিরুদ্ধস্রোতে নিরলস লিখতে থাকা এক কবির অন্তর্মগ্ন শিল্প ও জীবনমুগ্ধতাকে চিনিয়ে যায়। সত্তার কাদামাটি কবিতায় কবি যেমন লিখেছেন :
কেউ কারো জন্য মরে না
যে মরে
নিজের জন্যই মরে
তাহলে সাফল্যহীনতার ভিতরও
পাখি
কেন ওড়ে
কেন অন্ধকারে ঠোঁটে নেয়
বনের রেণু
হয় তো তুমি জানোই না
তোমার
সত্তার কাদামাটি নিয়ে খেলছে শিশু
সহজ কিন্তু অর্থগভীরতা হলো কবিতা;—কবি শিশির আজম মনে হয় সেই মন্ত্রে কাদামাটি ছেনে প্রতিমা গড়ায় এখনো নিমগ্ন।
. . .

. . .



