নেটালাপ - পোস্ট শোকেস

নিরীক্ষা ও বিনির্মাণে জীবনানন্দ দাশের অন্ধকার-৩

Reading time 7 minute
5
(10)
@thirdlanespace.com

. . .

এখানে তোমার হাজার বছর ধরে
হেলাল চৌধুরী

বনলতা সেন চারিদিকে দেখি তোমার
জীবনানন্দে এখনও সমুদ্রের সফেন
পোড়ে তারা পাখির নীড়, শান্তির মতো সুনসান আশ্রয় না-মেলে;
এখনে তোমার হাজার বছর ধরে এখনও
আমি পথ হাঁটিতেছিবিম্বিসার অশোকের সে-ধূসর জগতে…

জীবনানন্দ, আজ চুল তার তোমার বিম্বিসার অন্ধকার
বিদর্ভ নগরে সিংহল
সমুদ্র অতলে নিমজ্জমান হেগ জলে
জোনাকির আলো অরণ্যে নিশীথের দুর্গম অন্ধকারে;
এখানে তোমার হাজার বছর ধরে এখনও
আমি পথ হাঁটিতেছি
বিম্বিসার অশোকের সে-ধূসর জগতে…

আজ পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেছে
পাণ্ডুলিপি পোড়ে হলুদ দারুচিনি দ্বীপে আগুনের লাল দাহে
রৌদ্রের গল্পে কেবলই অন্ধকার পিয়াইনের জলে;
এখানে তোমার হাজার বছর ধরে এখনও
আমি পথ হাঁটিতেছি
বিম্বিসার অশোকের সে-ধূসর জগতে…
. . .

জীবনানন্দ অন্ধকারের কথা বার-বার বলেছেন, সত্য। অন্ধকার থেকে উত্তরণের ব্যাপারেও ভেবেছেন। তাঁর ‘তিমিরহননের গান’-এ সেই ইঙ্গিত আছে। তিনি লিখেছিলেন :

আমরা কি তিমিরবিলাসী?
আমরা তো তিমিরবিনাশী
হতে চাই।
আমরা তো তিমিরবিনাশী।

জীবনানন্দের মতে, প্রেম এই চরাচরব্যাপী অন্ধকারকে হারানোর বড়ো উপায়। ‘সঙ্ঘ নয় শক্তি নয় কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়/ আরো আলো : মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়।’
. . .

জীবনানন্দ জিজ্ঞাসামনস্ক কবি ছিলেন বাবুল ভাই। কবিতায় সংলাপ তৈরি করতেন কবি। নিজের সঙ্গে সংলাপ। সংলাপের ভিতর দিয়ে প্রশ্ন করতেন, উত্তর খুঁজতেন নিজের মতো করে। অনেকক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলে এক্সিটও নিয়েছেন। ‘তিমিরহননের গান’ কবিতা যেখানে শেষ হচ্ছে, অর্থাৎ শেষ স্তবক থেকে আপনি কোট করেছেন। ওই স্তবকের প্রথম দুই লাইন আবার পড়ুন। কবি লিখেছেন :

তিমিরহননে তবু অগ্রসর হ’য়ে
আমরা কি তিমিরবিলাসী?

মামলা এখানে ক্লিয়ার করে দিলেন কবি। অর্থাৎ, শুভচেতনার কথা আমরা বলছি বটে, অন্ধকার জয় করে আলোর যাত্রীও হতে চাই, কিন্তু হওয়ার পন্থারা আমাদেরকে করে তুলছে মেকি। তিমিরহনন পরিণত হচ্ছে তিমির-বিলাসিতায়। যে-কারণে, জীবনানন্দ আমাদের সেই কবি, যিনি নির্দিষ্ট কোনো আইডিওলজির পরিপোষকতা করেননি। সবগুলো তিনি নজরে নিয়েছেন, প্রশ্ন ও যাচাই করেছেন, এবং পরিণামের ইশারা তুলে সরে গেছেন আলগোছে।

Jibanananda Das; Image Source – Collected; Credit: bongodorshon.com

সুরঞ্জনা কবিতা থেকে কোট টেনেছেন তো! সেখানেও জীবনানন্দ তাঁর গভীর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বাস্তবতার বিচ্ছেদ বুঝতে পেরে সরে যাচ্ছেন। সুরঞ্জনা কে? ধরে নিন, এমন একজন, যে-কিনা প্রেমের শাশ্বত সুন্দরকে হৃদয়ে ধারণ করে। পৃথিবীর মতো প্রাচীনা ও প্রাকৃতিক তার অবয়ব। যে-কারণে কবি তাকে ইতিহাস ও প্রাক-ইতিহাসে সমান প্রাসঙ্গিক ভাবছেন। কিন্তু, সুরঞ্জনা কি আছে বাস্তবের পৃথিবীতে? না নেই। দ্বন্দ্ব সংক্ষুব্ধ জগতে তাকে পাওয়ার নয়। কারণ, মানুষ ওই একটি পাখির গানের মতো অথবা সমুদ্রের নীলের মতো সহজ প্রাকৃতিক হতে পারে না;—এই ঈশ্বরত্ব ধরে না হৃদয়ে। যে-কারণে বুদ্ধকেও বলি হতে হয় সঙ্ঘারাম বা প্রাতিষ্ঠানিকতায়। ধর্মাশোকের রেফারেন্স টানছেন তা বোঝানার খাতিরে। কবিতার শেষ দুটি চরণে পৌঁছে কবি বলছেন :

তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল
দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল।

সুরঞ্জনা কাজেই মানুষের ধারণশক্তির চেয়ে ব্যাপক। অনেকটা নিটশের দাজ স্পোক জরাথ্রুস্ট-এর আদলে তাকে আমরা কল্পনা করতে পারি। কবি এক বৃহৎ সচেতনাকে ধারণ করছেন মননে, যেটি প্রকৃতির মতো শাশ্বত ও সহজাত, এবং তা বিবর্তনশীল। মানুষ প্রকৃতির অংশ হলেও তার মধ্যে প্রকৃতির শাশ্বত সহজ বিলুপ্ত হওয়ার কারণে প্রেম প্রকারান্তরে অভিশাপের নামান্তর দাঁড়াচ্ছে এখানে। মানুষের প্রতি মানুষীর হৃদয় কেবল পাওয়া যেতে পারে কল্পনায়। একে এখন আমরা তিমিরবিনাশী শুভ ইতিবাচকতা ভাবতে পারি, কিন্তু এর ভিতরকার সুর নিরাশাঘন প্রত্যাখানের। সাতটি তারার তিমির-এ সবগুলো কবিতায় মোটের ওপর অভিন্ন সুর ধ্বনিত। অন্যত্রও কমবেশি তাই পাবো আমরা। বিভিন্ন কোরাস-টাই আবার না-হয় পাঠ করুন একবার। জবাব পেয়ে যাবেন।

আমাদের জীবনানন্দ পাঠ প্রচণ্ড গতানুগতিক। কবির প্রায় নিটশেসুলভ অনুধ্যানে ডুবে থাকা ধীশক্তিকে আমরা পাঠ করতে শিখিনি। তাঁকে সস্তা রোমান্টিকতা ও মানবিকতার আরকে চুবিয়ে কিম্ভূত করে তুলেছি। বাংলা কবিতায় দুজন প্রশ্নশীল কবি ছিলেন, একজন সুধীন্দ্রনাথ ও অন্যজন জীবনানন্দ। দুজনের কাউকেই আমরা আজো ঠিকঠাক রিড করতে জানিনে।
. . .

তোমার বেড়ালটি
হেলাল চৌধুরী

তোমার বেড়ালটি আজ
বাদামি পাতার ভিড়ে নয়, মিশরে—কাফন পাহাড়ে
রোদের ভিতরে নয়, পিরামিড অন্ধকারে
গাছের ছায়ায় নয়, রামেসাসের দেশে;
তোমার বেড়ালটির সঙ্গে তবু
আজও আমার দেখা হয় ধানসিঁড়ি জলে ঘুরে ফিরে…

এখনও তোমার হেমন্তের সন্ধ্যা নামে
এখনও জাফরান রঙের সূর্য ওঠে
তোমার বেড়ালটিরে দেখি আমি
আজও নিখিলের সাথে যেন খেলা করে;
তোমার বেড়ালটির সঙ্গে তবু
আজও আমার দেখা হয় ধানসিঁড়ি জলে ঘুরে ফিরে…

বিকেলে তোমার সূর্যের নরম শরীর
তোমার বেড়াল তখন আহ্লাদী আলো
সবুজ ঘাসের দেশে অশোকের জগৎ
সিংহল কেবল পর্বত ছুঁয়ে আঙুলে পারমিতা ছুঁলো;
তোমার বেড়ালটির সঙ্গে তবু
আজও আমার দেখা হয় ধানসিঁড়ি জলে ঘুরে ফিরে।
. . .

রিক্ত ঝরা পালক
. . .
আরেকটি বিষয় আগের পোস্টে বলতে ভুলে গেছি বাবুল ভাই, এখানে তা যোগ করছি। জীবনানন্দ দাশ তাঁর রূপসী বাংলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাঠের জন্য দিয়েছিলেন। কবিতাগুলো পাঠ যাওয়ার পর পাঠমন্তব্যে কবিগুরু কী বলেছিলেন, তা আমাদের অজানা নয় এখন। রবীন্দ্রনাথের কাছে চিত্ররূপময় বোধ হয়েছিল। রূপসী বাংলা তাই বটে অনেকখানি। অন্য কবিতাগুলোও মোটাদাগে ইমেজারি নির্ভর। কিন্তু ইমেজের ভিতরে সংহত প্রগাঢ় নৈরাশ্য ও মানব-বিমুখতা রবি ঠাকুর ভালো ধরতে পারেননি। প্রাথমিক পাঠে যেটুকু ধরেছিলেন, তা অবশ্য মিথ্যে হচ্ছে না তাতে।

ওইসময় ক’জন তা পেরেছেন বলুন? সুধীন্দ্রনাথ তাঁকে নিতে পারেননি ভালো করে। বুদ্ধদেব বসুর তাঁর ব্যাপারে আগ্রহ ছিল। কবিতাও ছেপেছেন, কিন্তু তাঁকে সম্যক বোঝার অবস্থায় পৌঁছাতে পারেননি। বাংলা কবিতা রচনার পদ্ধতিতে তিনি তখন এতটাই দুর্বোধ্য গণ্য হচ্ছেন, অনেকে ইমেজে ঠেসে দেওয়া শব্দযোগ ধরতে হয়রান বোধ করতেন। সজনীকান্ত পরে ভুল স্বীকার করলেও নজরুল ও জীবনানন্দের ছিলেন কট্টর সমলোচক। আর, আট বছর আগের একদিন কবিতার ব্যাপারে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সমালোচনা অসহ্য বোধ হওয়ার ক্ষোভ থেকেই তো সমারূঢ় কবিতাটি জন্ম দিলেন কবি। নীরেন্দ্রনাথ ভালো কবি ও ছান্দসিক, কিন্তু সময়ের থেকে অগ্রসর কবিকে তিনি ধরবেন কেমন করে!

সে যাকগে, জীবনানন্দ মূলত বোঝার পরিধিতে আসতে থাকেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকসীমায়। শক্তি, সুনীল থেকে আরম্ভ করে হাংরি জেনারেশনের কাছে আইকন হয়ে উঠলেন তিনি। আমাদের এখানে শামসুর রাহমানরা তাঁকে অপরিহার্য ভাবলেন। একটি মিথ এভাবে তৈরি হলো ক্রমশ। এটি আরো ব্যাপ্তি পায় নব্বই দশকের গোড়ায়, যখন তাঁর বিপুল অপ্রকাশিত রচনা ভূমেন্দ্র গুহ ও দেবেশ রায়ের কল্যাণে আমাদের হাতে আসে। হুমায়ুন আজাদ এই আবিষ্কারকে চর্যাপদ আবিষ্কারের মতোই অভাবনীয় ঘটনা বলে মন্তব্য ঠুকেছিলেন। তাই বটে! অপ্রকাশিত বিপুল কবিতা, কাব্য-উপন্যাস, বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা দিনিলিপ মিলে কবিকে জানাবোঝার সড়ক সুগম হলো এর ফলে।

Jibanananda Das Poem-Quote; Image Source – Collected; Credit: poetrystate.com

সত্যি কি হলো? জীবনানন্দের উপন্যাস তো মূলত কবিতার প্রলম্বন। কবিতার ফরমেটে যেসব কথা তিনি বলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছিলেন, সেগুলো উপন্যাসে খোলাসা করেছেন। কারুবাসনার কবলে পড়ে নিজদোষে সকলের থেকে আলাদা হওয়ার মনোবেদন ও সংক্ষোভ আমরা পাচ্ছি মাল্যবান ও অন্যান্য রচনায়। সাংকেতিক শব্দে বোঝাই ইংরেজি দিনলিপিতে আরো ডার্ক এক সত্তাকে বিচরণশীল দেখছি। বৈষয়িক ব্যর্থতা ও দাম্পত্য সংকট যাঁকে করে তুলেছে হতাশ ও মরিয়া।

তাঁর কবিসত্তার যোগ্য স্বীকৃতি তিনি পাচ্ছেন না! মাঝখান থেকে বুদ্ধদেব বসুরা বেশ করে খাচ্ছে,—এই ক্রোধ দিনলিপিতে বেশ ঝেড়ে দিয়েছেন কবি। অন্যদিকে, তিনি এতটাই অনাড়ি ও অন্তর্মুখী, ত্রিশের ডাকসাইটে সাহিত্য পরিমণ্ডলে ভিড়তে আড়ষ্ট বোধ করেছেন বরাবর। পার্কে বসে থাকা জীবনান্দকে দেখে বুদ্ধদেব বসু সাগ্রহে কুশল জিজ্ঞাসায় এগিয়ে যাচ্ছেন,—জীবনানন্দ অপ্রতিভ ও যথারীতি অপ্রস্তুত। পালাতে পারলে যেন বাঁচেন! সুনীলরা একবার তাঁকে মঞ্চে কবিতা পড়তে দেখেছিলেন। কী পড়ছিলেন, সে তিনি ভালো বলতে পারবেন,—কারণ, শ্রোতাদের সঙ্গে ঘটেনি সংযোগ।

মার্কিনদেশি ক্লিট বুথ সিলি নিঃসন্দেহে জীবনান্দকে নিয়ে সবচেয়ে মনোগ্রাহী বইটি লিখেছেন। সেখানে পাচ্ছি, চাকরিহারা কবির জন্য দিল্লিতে চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন কবি হুমায়ুন কবীর। জীবনানন্দের মধ্যে সে কী টানাপোড়েন! তিনি কী করে যাবেন দিল্লি, এ-কথা ভেবে হয়রান!

সব মিলিয়ে ফার্নান্দো পেসোয়ার যমজ ভাই। পেসোয়া ছোটখাটো কাজ করতেন। নিজের লেখা কবিতাকে কবিতা নয়, বরং গদ্যে লেখা ভাবনার বিচ্ছুরণ বলে যুক্তি সাজাতেন, যেখানে সংগোপন থাকত কবিতা লেখার ব্যাকরণের ওপর এক ধরনের রাগ ও বিতৃষ্ণা। তুচ্ছ দৈনন্দিনকে গ্লোরিফাই করতেন পেসোয়া। টোকানো কাগজে লিখতেন লাগাতার। দুজনেই অন্তর্মুখী ও সংবেদনশীল, এবং দুজনের মধ্যে সমানে বহমান থেকেছে প্রগাঢ় নৈরাশ্য,—যেটি তাঁদেরকে মানব-পৃথিবীতে স্বস্তির সঙ্গে সুবোধ সামাজিক রাখেনি। তাঁরা সুতীব্রভাবে একা ছিলেন।

জীবনানন্দ এর থেকে নিষ্ক্রমণ খুঁজেছেন এমন এক প্রাকৃতিকতায়, যেটি নিজে ক্লিয়ার করে দিচ্ছেন,—পৃথিবীতে এর অস্তিত্ব স্বপ্নের মতো পৌরাণিক। তাঁর রচনায় আমরা একসময় দালি ও অঁদ্রে ব্র‍্যতোঁদের তৈরি পরাবাস্তব ইশতেহারে খুঁজে নিয়েছি। এখন তা অবান্তর লাগে নিজের কাছে। কারণ, জীবনানন্দের মধ্যে পরাবাস্তবতা নয়, বরং সক্রিয় থেকেছে ডিল্যুশন!

প্রাগৈতিহাসিক ও অপরিবর্তনীয় জগৎকে তিনি কবিতায় ফিরে-ফিরে টানছেন, যার সঙ্গে প্রতিতুলনায় তাঁর মনে হতো,—মানব-পৃথিবী কখনো সেখানে স্থির থাকতে পারেনি। এই জগৎটি বাস্তবাতীত ফ্যান্টাসি নয়, কিন্তু ক্রমাগত তাই হতে চলেছে; যার ফলে নিজের কোনো দাঁড়ানোর জায়গা থাকছে না।

Jibanananda Das Poem-Quote; Image Source – Collected; Credit: poetrystate.com

বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। গোধূলি সন্ধির নৃত্য কবিতার ইমেজগুলো যদি পরপর অনুসরণ করি, তাহলে দেখব,—পরিচিত হরিতকি, পিপুলের গাছ অথবা ডালে বসা প্যাঁচাকে দেখছেন এমন এক ইমেজারির বিন্যাসে, যেগুলো প্রাচীন ও অবিকল;—কখনো পালটানোর নয় তারা

চুপে-চুপে ভুলে যায়— জ্যোৎস্নায়।
পিপুলের গাছে ব’সে পেঁচা শুধু একা
চেয়ে দ্যাখে; সোনার বলের মতো সূর্য আর
রুপার ডিবের মতে চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা।

হরিতকি ক্রমশ রূপ নিচ্ছে গভীর প্রাচীন হরিতকি বনে। তার অস্তিত্ব এখানে প্রাগৈতিহাসিক। সে ধারণ করছে শিকারি ও আরণ্যিক প্রকৃতি, যেখানে নারীরা আবার মেধাবিনী! অদ্ভুত ইমেজে এখন তাদেরকে ধরছেন কবি…

সেইখানে যূথচারী কয়েকটি নারী
ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে
মেধাবিনী; দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে।

অর্থাৎ, নারীদের কোনো বিবর্তন ঘটেনি বলে তারা প্রকৃতি, এবং সেজন্য মেধাবিনী। এই-যে ঘোরলাগা ইমেজ, সেটি ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে এ-কথা ভেবে,—মেধাবিনীরা অদ্য যুদ্ধ ও বাণিজ্যের কলরোলে স্বয়ং বিকৃত। আগে যার আভাস দিচ্ছেন জীবনানন্দ :

কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতো:
পুরুষ তাদের: কৃতকর্ম নবীন;
খোঁপার ভিতরে চুলে: নরকের নবজাত মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে হঙকঙের তৃণ।

সেখানে গোপন জল ম্লান হ’য়ে হীরে হয় ফের,
পাতাদের উৎসরণে কোনো শব্দ নাই;
তবু তা’রা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে
বিনষ্ট হতেছে সাংহাই।

নারী তাঁর কাছে ইন্দ্রজাল, যারা কিনা বাস্তবের পৃথিবীতে এখন ব্যবহৃত, এবং সে-কারণে প্রকৃতিচ্যুত। অসাধারণ ইমেজে নারীর খোঁপায় নতুন করে জন্ম নেওয়া নরক দেখছেন তিনি। প্রকৃতি কি তাই? ওই হরিতকি কিংবা প্যাঁচা? কবি তা মনে করেন না। জলের ওই ম্লান থেকে পুনরায় হীরে হয়ে ওঠার মধ্যে তা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। প্রকৃতি যতই নিজেকে রিকভারি করুক, তার ভূমিকা তবু গৌণ থাকছে সেখানে। কারণ, তাকে কামানের বিধ্বংসী রূপ গুনতে হচ্ছে এখন। জেনমৌন ধ্যানে সুস্থির থাকা মানুষের কপালে নেই। সুতরাং, কবির আশার বাতিঘর গেছে নিভে। শেষ স্তবকের প্রচণ্ড শক্তিশালী ইমেজে যে-ঘোষণা আমরা এখানে পাই…

ক্রূর পথ নিয়ে যায় হরিতকী বনে— জ্যোৎস্নায়।
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন
শেষ হ’য়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে বৃশ্চিক—কর্কট—তুলা—মীন।

এক অন্তহীন রাশিচক্রমাঝে নিজের গন্তব্য হারাতে দেখার বেদনা কবিকে, হুমায়ুন আজাদের শব্দ ধার করে বলি,‘শিখরস্পর্শী নিঃসঙ্গতা’য় একলা ও বিবিক্ত করেছিল। সুতরাং, এই কবিকে তথাকথিত রোমান্টিসিজমের আরকে গ্লোরিফাই না করাটাই উত্তম সুবিচার।
. . .

The Film of Disquiet (2010) by João Botelho; Short Trailer; Source – Fauggy Films YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 10

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *