মানুষ আসলে কে?

বাংলাদেশের পাবনায় এক নারী
আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে পুকুরে ডুবিয়ে মেরেছেন।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে
রাস্তায় ফেলে রাখা এক নবজাতক মানুষশিশুকে
কয়েকটি দেশি কুকুর রাতভর পাহারা দিয়ে শেয়াল থেকে বাঁচিয়েছে।
ভোরে লোকজন এসে শিশুটিকে উদ্ধার করেছে।
দুটি ঘটনা পাশাপাশি দাঁড় করালে—
এ প্রশ্নটাই ফিরে আসে, নৈতিকতার মালিকানা কে রাখে, কীভাবে রাখে?
মানুষ হত্যা করল অবুঝ কুকুরছানাদের।
কুকুর প্রাণ বাঁচাল অবুঝ মানুষশিশুকে।
তাহলে মানুষ কি শুধু জন্মসূত্রে মানুষ হয়? না কি আচরণে?
যে নারী ছানাগুলোকে ডুবিয়েছে, তার মনে হত্যা ছিল ‘বিরক্তি দূর করা’—এটাই সমাজবোধের নির্মমতম ব্যর্থতা।
আর যে কুকুরগুলো নবজাতকটিকে ঘিরে রেখে রাতভর পাহারা দিয়েছে—তারা যেন স্বভাবগতভাবেই জানত, দুর্বলকে রক্ষা করতে হয়।
আমরা কোন সভ্যতায় দাঁড়িয়ে আছি?
বিল্ডিং, ব্যাংকব্যালেন্স, উৎসব, পদ-পদবি—কোনওটাই সভ্যতা নয়।
কারও জীবন বাঁচাতে হাত বাড়ানোর ক্ষমতাটাই সভ্যতা।
যেখানে কুকুর পাহারা দেয়—সেখানেই মানবতা বেঁচে থাকে।
যেখানে মানুষ ছানাদের ডুবায়—
সেখানে মানবতা ডুবে যায়।
—অবদায়ক : ফজলুররহমান বাবুল

পারিয়া
মানবতা নিয়ে নাকিকান্না,
দেখে হাসি পায় হে মানুষ!
কুকুরের কাছে হেরেছো,
তবু মানতে চাও না পরাজয়।
কুকুরে চাপাও মানবতার তাজ—
হাসি পায় কাণ্ড দেখে!
তোমরা করুণ হে মানুষ!
কুকুর থেকেছে জঙ্গলে বন্য
তোমরা তাকে পোষ মানালে
খেলনা বানালে নিজের—
অনুগত ও বিশ্বস্ত খেলনা
দম-দেওয়া ঘড়ির মতো নির্ভুল—
তার সাথে রঙিলা পিরিত, তবু,
পারলে কি তাকে পড়তে সঠিক?
কুকুরকে যতই পোষ মানাও
শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাও
বানাও তাকে আদুরে বিড়ালছানা
হেলায় ‘পারিয়া’ হতে দাও তাকে—
কুকুর কুকুরই থাকে হে মানুষ,
সরলাঙ্কটি তোমরা বোঝোনি এখনো!
পথ-কুকুরকে পারিয়া ডেকেছিলে,
যবে সিন্ধু ও দ্রাবিড় ছিলে তুমি।
কুকুর রাস্তায় ঘুরছে তখন থেকে—
এঁটোকাঁটার খোঁজে এখনো রাস্তায়
পারিয়ারা হাঁটে মানুষের পায়ে-পায়—
আর, তারা বন্য ও দুর্বোধ্য ছিল,
এখনো তাই—যেমন চিরদিন …
কুকুরের ডাক কান পেতে শোনো—
তার ঘেউ ঘেউ চিৎকারে ভান নেই
আর, যখন সে চিতার মতো ছুটে,
মাংসপেশীতে খেলে বনের হওয়া
দাঁতে জমে ওঠে শক্তির পুঞ্জ—
তাকে বনদেবতার উপহার।
তোমাদের নরোম চামড়া ভেদ করে,
এই শক্তি ফুটো করে দিতে পারে দর্প।
তার সাথে পাল্লা দিতে যেয়ো না—
তুমি হেরে যাবে প্রতিবার …
তার জিভ দেখো ঝুলে থাকে—
সেখানে বিষাক্ত লালার লালিমা,
এবং সেখানে লুকিয়ে থাকে আদর
কুকুর স্ববশ কুকুরে—
তোমাদের মতো বহুরূপী নয় …
কুকুর রেগে ওঠে গর্জনে—
শান্ত হয় নিমেষে, যখন সে জানে,
তার এখন শান্ত হওয়া উচিত
কুকুরের পশমি ত্বকে দেখো বর্ম
আর পায়ের নখরে বুনো বিদ্যুৎ—
তাকে মানবতায় বন্দি করো না
কুকুর হতে পারে পারিয়া অথবা বুনো—
তার ত্বকের নিচে বনেলা হাওয়ার আদর,
তোমাদের ত্বক তা টের পায় না এখন!
কুকুর আগলে রাখে ছানা,
গন্ধ শুঁকে বের করে আনে পাপ—
তোমাদের যত অপরাধ!
কুকুর শিশু বোঝে,
তোমরা কি শিশু বোঝো হে মানুষ?

কুকুরের গলার স্বর দেখো আলাদা—
দুধের বাঁট আর মখমল-কেশর
হারিয়ে ফেলেনি বনেলা চমক
তার অলস চোখে খেলে বিদ্যুৎ
বুনো ঝড় বয়ে যায় পশমি নখরে—
তার তখন মনে পড়ে,
কুকুর রূপে সে কতটা মহান!
কুকুরের হিংস্রতায় পাপ নেই,
নম্রতায় পাবে না মিছে ছলনা
যৌনতায় সহজিয়া বড়ো—
যেমন সহজ জলের জীবন!
জলকে যে-পাত্রে রাখো,
সে থাকে গৌতম
কুকুর বোধিবৃক্ষে গৌতম—
সিদ্ধি লাভ করেছিল বনে
তার কানে বনের ফিসফিস—
বন তাকে টুঁটি চেপে ধরতে বলে,
যে-তার টুঁটি চেপে ধরেছে।
তাকে আগলে রাখতে বলে আদর—
যে-তাকে জড়ায় আদরে।
কুকুর বনেলা গৌতম হে মানুষ—
তোমরা ভাবো সে অনুগত তোমাদের!
তাকে সাজাও মানবতার ফুল দিয়ে—
দেখে করুণা হয় …
কুকুরের মাংসপেশীতে নাচে বন—
তোমরা কি জানো বন কি বোঝায়?
যখন প্রথম মানুষ বন ছাড়বে বলে
সড়কে উঠেছিল — তার অর্থ জানো তুমি?
কুকুর জানে, তাই সে কুকুর …
কুকুরকে থাকতে দিও তার মতো—
সে থাকুক পারিয়া হয়ে রাস্তায়,
তোমাদেরকে পাহারায় রাখুক—
বিশ্বস্ত প্রহরীর মতো
সে থাকুক সুনীলের কুকুর—
যে-তোমাদের ভেতরে থাকে,
তাকে তোমরা পাশব বলে জানো
আর অপেক্ষায় থাকো—
সে বেরিয়ে আসবে আচমকা
চিতার মতো ঝাঁপ দেবে বিদ্যুৎ,
যেন তোমরা তাকে মানবিক বলতে না পারো
মানবতা পোশাকি হে মানুষ,
তোমরা পরে থাকো—
পাশবতা ঢাকতে…
. . .



