ফিলাডেলফিয়ার শিব

এই এক শহর চাঁদ থেকে ঝরে পড়ে ঘণ্টাধ্বনি
আমেরিকার প্রথম চিড়িয়াখানা প্রথম হাজত
সাউথ স্ট্রিটে প্রথম ইটালিয়ান রেস্টোরেন্ট।
প্রথম যে খুচরো পয়সা বেরিয়েছিল ফিলাডেলফিয়ায়
তার ঝনৎকার এখনও বাজে কালো নেইবারহুডের
আকস্মিক জেনট্রিফিকেশনে উপড়ে ফেলা
পুরনো দালানের ঠাঁই বসে পড়ায়।
এখানেই গড়ে উঠেছিলেন নোয়াম চমস্কি
অ্যালেন আইভারসন, কোবি ব্রায়েন্ট, কেভিন হার্ট,
রিচার্ড গিয়ার, র্যাবেনের বীজদানাসহ মূল লেখাগুলো
অ্যালান পো লিখেছিলেন এই শহরের কিনার ঘেঁষে।
এই মোকামে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
এজরা পাউন্ড আর উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের
দোস্তি হয় এখানে এই শহরে। পল রবসন ছিলেন এখানে
বেশ কিছুদিন। এখনও জেলে ব্ল্যাক প্যান্থার
মুমিয়া আবু জামাল—আমরা যার মুক্তির জন্য রাস্তায় নামি।

এখানে আপার ডারবি হাই ইস্কুলে বাচ্চারা ৫২টি
ভাষায় কথা বলে, ভ্যালি ফোর্জ পার্কে জর্জ ওয়াশিংটন
একদম জীবন্ত, মনে হবে এই তো
মার্চপাস্ট করে যাচ্ছেন কিছুটা ঢালুর দিকে।
আমেরিকার সংবিধান লেখা হয়েছিল এখানেই।
ওখান থেকেই উঠে আসেন লুই কাহন
বারবার ঘুরে ঘুরে দেখেন—
ঢাকার শেরে বাংলা নগরে সংসদ ভবনের চারপাশে
জলাশয় হলে, বিলের ঘেরাও হলে কেমন লাগবে—
কেমন দেখাবে ঢাকা নগরের কংক্রিটে
যদি শাপলা ফুটে থাকে, কেমন মানাবে তাহলে,
এই শহর কী দয়ায় ভরে যাবে একদিন,
ভেসে যাবে বানের তোড়ে?
লুই কাহন তার পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া
শিশুটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন—
শিশুটি যে ফিলাডেলফিয়ার
আরেক বিপুল আবিষ্কার বাবলগাম চিবুচ্ছিল।
এডগার অ্যালান পো বাল্টিমোরে কী চোখে দেখতে পাননি?
বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনের আবিষ্কার করা
স্ট্রিটলাইটের আলো তো ছিল অ্যালান পো’র চোখে।
ফিলাডেলফিয়ায় ৩০ স্ট্রিট রেলস্টেশন থেকে
ট্রেনে চেপে সেই যে গেলেন বাল্টিমোর—আর ফিরে এলেন না।

এত আলো আর অভিমানের শহরেই আছে এক
কেনজিংটন পাড়া –এই আলোকিত নক্ষত্র ক্ষয়ের
করপোরেট দুনিয়ায় শতসহস্র শিবঠাকুরের দিনযাপন
নিশিযাপন পাড়া—হেরোইন, ফেন্টালিন আর কোকেইনের
ঘোরে কাঁপে, ঘুমায়, ঘুম ঘুম কাতরায়—
স্বপ্ন আর জাগরণের পুলসিরাত ফিলাডেলফিয়ার কেনজিংটন।
বিদ্যুতের থিকথিকে অমা পান করে তারা
রাস্তার উপর ছেঁড়া কম্বলের নিচে যৌনমিলনে
ধুঁকে ধুঁকে জ্বলে তারা, নুয়ে রয়,
তমসার হিল্লোলে উড়তে থাকে, দুলতে থাকে,
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে থাকে কালের শিবেরা।
তারা খায় নিদারুণ সময়ের কালশিটে ও গন্ধম
ঘুমালে তারা উড়তে থাকে, জাগরণে উড়তে থাকে
আই ৯৫ মহাসড়ক দাবড়ে ছোটে অ্যালান মাস্কের টেসলা
দুনিয়া ঠাণ্ডায় ঘামতে থাকে—গো ফ্লায়ার্স!
এইসব দীঘল ইতিহাসের ছাতিমতলা ডিঙিয়ে ইন্টারস্টেট নাইন্টি ফাইভ দাবড়ে যে-ই হয়তো টেসলা, বা নিসান যায়—আমি বলি : কী বলিবো সোনার চান রে, কী বলিবো আর, এই যে নৌকা ডুবো রে ডুবো, এই নৌকা তোমার রে দয়াল, কী বলিবো আর!
. . .
আমার পাড়া
আমার পাড়াটি গুণগতভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে
সাদা লোক—যাদের আমরা উন্নত সভ্যতার
মানদণ্ড মনে করি—তারা এখন আমার
পাড়ায় নেই বললেই চলে শহরতলি গ্যাছে তারা।
ফলে পাড়াটি দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে;
পারিবারিক বন্ধুরা আমার বাড়ি বেড়াতে এলে
পরিস্কার বুঝতে পারি—তারা মনখারাপ করে।
আমার কিন্তু পরিস্থিতিটা ভীষণ ভালো লাগে
নিজের অজান্তেই মটরশুঁটিদানার মতো হেসে ফেলি—
যৌনতার ব্যাপারটাও খাপেখাপ এমনই—
পশ অ্যারিয়া থেকে কেবল নিচের দিকে নামতে থাকে
. . .
পাঠ-সংযুক্তি
ছোটকাগজ ‘ফিলাডেলফিয়া’ পাঠ-উত্তর তাৎক্ষণিক অনুভব
উৎস : থার্ড লেন স্পেস-এর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে সংকলিত

ফিলাডেলফিয়া-র সংখ্যাটি ভালো হয়েছে সায়েম। মনোজ-এর মতো এখানেও কবিতার সূচিবিন্যাস ভালো লেগেছে দেখে। গদ্য, গল্প ইত্যাদিকে জায়গা দেওয়ার চাপে কবিরা মার খাচ্ছেন খাচ্ছেন,—এরকম মনে হয়নি। কবিতা ও অনুবাদ কবিতা মিলিয়ে সংখ্যাটি হৃষ্টপুষ্ট।
ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, জীবনানন্দ দাশ তাঁর অমোঘতায় পুনরায় প্রভাব বিস্তার করছেন। হেলাল ভাইকে আমরা জানি। জীবনানন্দের টেক্সট দিয়েই একুশ শতকে প্রবল অন্ধকারকে ধরতে নিরীক্ষায় হাত দিয়েছেন। গ্রুপে এ-নিয়ে কয়েকদফা আলাপ হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। সাইটেও সংকলিত হয়েছে সেই আলাপ। ফিলাডেলফিয়ার সূচনা-সংখ্যায় আলফ্রেড আমিনের টানা কবিতায় এর রেশ পেলাম যেন! জীবনানন্দ দাশকে সরাসরি কবিতার স্বরে টানছেন কবি, যদিও তা হেলাল ভাইয়ের তরিকা থেকে ভিন্ন। পড়তে মন্দ লাগেনি। আমার কাছে নতুন কাউসার রোজী, মাধব দীপ ও রওশন হাসান। আগে পড়িনি। কাউসার রোজীর দুটি কবিতা পড়তে বেশ।
বদরুজ্জামান আলমগীরের ছোট্ট সাক্ষাৎকার ও একগুচ্ছ কবিতা নিয়ে ভালো করেছেন। লিখিত না নিয়ে তাঁর সঙ্গে অবশ্য সরাসরি কথা বলতে পারতেন আপনি, তাতে আলাপ আরো জমে উঠত মনে করি। ভদ্রলোক জীবনরসিক। ফিলাডেলফিয়া ও স্বদেশকে কথার মালায় ভালো গেঁথেছেন। পড়ে মজা পেয়েছি। বিশেষ করে আলাপের শেষদিকটায় তাঁর লেখা কবিতা দিয়ে শেষ হওয়াটা চমৎকার ছিল।
বদরুজ্জামান আলমগীরের কবিতাটি চমৎকার এ-কারণে যে,—ফিলাডেলফিয়াকে আমাদের কাছে এটি জীবন্ত ও প্রাণবান করেছে। আমেরিকার ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য ভূখণ্ডকে চিনিয়ে দিতে কবির বয়ান থেকেছে আগাগোড়া সাবলীল। ফিলি-র অতীত ও সাম্প্রতিককে একসুতোয় গেঁথেছে এই কবিতা। সেইসঙ্গে স্থপতি লুই কাহন ও রবি ঠাকুরের উল্লেখ, ফিলি-কে আমাদের অনুভূতিতে আপনার করে অনেকখানি। কবির চোখ দিয়ে এরকম একখানা ভূঅঞ্চল ও শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়ানো পাঠক উপভোগ করবেন এ-কথা নির্দ্বিধায় বলাই যায়।
আমার পাড়া কবিতাটির নাম বিশেষভাবে নিতে চাই। ফিলাডেলফিয়া শহরে কবির লম্বা যাপন ও শহুরে হাওয়ায় পালাবদলের চকিত ঝলক এ-কবিতায় আভাসিত। পাড়ায় হোয়াইট সুপ্রিমেসির স্থানান্তর বুঝিয়ে দিচ্ছে, আম্রিকা এখনো তার বর্ণবাদী এলিট খাসলতে ধারাবাহিক রহিয়াছেন! এবং সেখানে কবির স্টান্টবাজি বেশ উপভোগ্য। রস-পরিহাস মিশিয়ে ঝেড়ে দিয়েছেন আসলি বাত, উদ্ধৃত করছি পুরোটা :
আমার পাড়াটি গুণগতভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে
সাদা লোক—যাদের আমরা উন্নত সভ্যতার
মানদণ্ড মনে করি—তারা এখন আমার
পাড়ায় নেই বললেই চলে শহরতলি গ্যাছে তারা।
ফলে পাড়াটি দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে;
পারিবারিক বন্ধুরা আমার বাড়ি বেড়াতে এলে
পরিস্কার বুঝতে পারি—তারা মনখারাপ করে।
আমার কিন্তু পরিস্থিতিটা ভীষণ ভালো লাগে
নিজের অজান্তেই মটরশুঁটিদানার মতো হেসে ফেলি—
যৌনতার ব্যাপারটাও খাপেখাপ এমনই—
পশ অ্যারিয়া থেকে কেবল নিচের দিকে নামতে থাকে
উপভোগ্য! অন্য কবিরাও তাঁদের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে লিখেছেন। অনুবাদ সেকশনটি গদ্য-পদ্য মিলিয়ে করা হয়েছে। ভালো হওয়া প্রত্যাশিত ছিল, যেহেতু, আল ইমরান সিদ্দিকী, মঈনুস সুলতান, এমদাদ রহমান… সকলেই পুরানা ভাষান্তরী। লুইস গ্লুক এমনিতেও পড়তে আরাম, তাঁর সহজ কিন্তু কৌণিক স্বরভঙ্গির কারণে;—আল ইমরান সেদিকটা বিবেচনায় রেখে বেছে নিয়েছেন অনুবাদযোগ্য কবিতা।
গদ্য ও গল্প সেকশনের পাঠ-অনুভবে আপাতত না যাই। গাল্পিকরা আমাদের পরিচিত লিখিয়ে, এবং তাঁরা গল্পে কী ডেলিভারি দিতে পারেন তা মোটের ওপর অনুমেয়। সেরকমটাই লেগেছে চোখ রাখতে যেয়ে। গান নিয়ে লেখাগুলো আগে পঠিত। জাহেদ আহমদের ভাষাবয়ানে যে-প্রসাদগুণ থাকে, মানে ইমোশনকে আলগোছে উসকে দেওয়া,—তা এখানেও পাচ্ছি যথাবিহিত।
দেশভাগ পর্বের মানুষ সৈয়দ গুলাম মহিউদ্দিন আহমেদ বিন খাইরুদ্দীন আল হুসেইনির (!) দূরদৃষ্টি নিয়ে অতীশ চক্রবর্তীর গদ্যটি এর শিরোনামের কারণে আগ্রহ তৈরি করে মনে। আমি প্রথমে ভেবেছি গল্প হবে বোধহয়। পড়তে গিয়ে বুঝলাম দেশভাগের পাতা থেকে বারো হাত লম্বা নামধারী মানুষটিকে লেখক উঠিয়ে এনেছেন। প্রয়াসখানা মন্দ নয়, তবে ব্রিটিশ তাড়াতে নেমে দেশভাগের ফলাফল আখেরে কী দাঁড়াবে, সেটি নিয়ে আরেক বড়ো মহাজন আল্লামা মাশরেকির নাম লেখক নিলে ভালো করতেন।
মাশরেকি খাকসার মুভমেন্টের অগ্রদূত। তীব্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। কোরানের ভিন্নরকম তফসির প্রণয়নের কারণে নোবেল কমিটি থেকে তাঁকে মনোনীত করা হয়েছিল। নিশ্চিত পেতেন নোবেল। শর্ত ছিল, উর্দুর বাইরে যে-কোনো একটি ভাষায় তফসিরটি অনূদিত হতে হবে। মাশরেকি জানিয়েছিলেন,—যে-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই, তাদের হাত দিয়ে নোবেল নেওয়ার খায়েশ তাঁর নেই। তো এই মাশরেকির সঙ্গে গুলাম মহিউদ্দিনের ভাবনা বেশ মিলছে এখানে।
যাইহোক, ফিলাডেলফিয়া তার প্রথম আত্মপ্রকাশে সিলেট থেকে আমরা যেরকম কাগজ বরাবর বের করে থাকি,—আপনি সেই ধারা ও ঐতিহ্য মেনেই ফিলি-তে একে জন্ম দিয়েছেন। যথারীতি সাজানো-গোছানো। দেখতে ও পড়তে বেশ! তবু, কী যেন নেই মনে হতে থাকে! সেটি বোধহয় ওই তারুণ্যদীপ্ত ভাংচুর! ওই নিরীক্ষা ও দ্রোহ;—যেটি, ছোটকাগজে অনেকদিন থেকেই নিখোঁজ!
. . .
. . .

ভাটিবাংলার ছেলে বদরুজ্জামান আলমগীরের ভালোবাসা নাটকে গাঢ় হলেও তাঁর আগ্রহ ও সক্রিয়তা বহুমাত্রায় মেলেছে ডানা। নাটকের দল গল্প থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। নাটকের পাশাপাশি কবিতা ও অনুবাদে সক্রিয় থেকেছেন সবসময়। নাটকের মুখপত্র নাট্যপত্র সম্পাদনায় জড়িত ছিলেন একসময়। তিন দশকের ওপরে মার্কিনপ্রবাসী লেখকের সঙ্গে ফিলাডেলফিয়ার যোগ অবিচ্ছেদ্য। ভাটিবাংলার মতো মার্কিন এই শহরের অলিগলি হাতের তালুর মতো চেনেন তিনি।
জীবনরসিক বদরুজ্জামান আলমগীরের কবিতা, গল্প, নাটক ও বিচিত্র গদ্যে বাংলাদেশ ও মার্কিন-যাপন প্রায়শ এক-সুরলয়তানে তরঙ্গিত হয়। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আখ্যান নাট্য নননপুরের মেলায় একজন ‘কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে’ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় নয়ের দশকের শেষ দিকটায় এসে। একুনে কুড়ি বছর আগে প্রকাশ পায় ‘পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর’ শিরোনামে কবিতাবই। এছাড়াও একে-একে বেরিয়েছে আখ্যান নাট্য : আবের পাঙখা লৈয়া; প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস; কবিতাবই : নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো ও দূরত্বের সুফিয়ানা। ঘোড়াউত্রা থেকে প্রকাশিত ভাষান্তরিত কবিতাবই ‘ঢেউগুলো যমজ বোন’ তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি কাজ।
দীর্ঘ প্রবাস-যাপনে বদরুজ্জামান আলমগীর এখনো সাগ্রহে সক্রিয় কবিতা ও গদ্যে, সম্পৃক্ত জন্মভূমির সঙ্গে,—যেমন নিবিড় ফিলাডেলফিয়ার বহমান জীবন-মানচিত্রে।
. . .



