পোস্ট শোকেস - সাহিত্যবাসর

আমাদের মনের দরজায় নিরন্তর যে ডোরবেল বাজে — তৈমুর খান

Reading time 5 minute
5
(21)

অবেলায় ডোরবেল
সুমন বনিক

মাঝরাতে ডোরবেল বেজে ওঠে সশব্দে
ঘুম ভেঙে যায়
হালকা কাঁথার খোলস ছেড়ে
বের হতে মন চায় না, সায় দেয় না
দরজা খুললেই একরাশ আঁধার হামলে পড়বে ঘরে
লণ্ডভণ্ড করে দিবে সাজানো পরিপাটি ঘরদোর
তাই জোছনা মাখা ঘরটা নষ্ট করতে চাই না।

এই-যে ডাইনিং টেবিল, সোফা, আলমারি, কিং সাইজ খাট
সবকিছুতেই জ্যোৎস্না মাখা
ভালোবাসা জমা রাখা
বাথরুমের শাওয়ার,
বিশাল মিরর রোজ সকালে কথা বলে,
কী যে বলে বলেই চলে

জীবন মানেই গতিময়তা
হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছি
পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে উল্টো প্রান্তে।
জীবনানন্দকে সশ্রদ্ধায় তুলে আনি
ট্রামের চাকা থেকে
শুশ্রূষার প্রলেপ মেখে দেই দেহজুড়ে
যত্নে রাখি রিডিং টেবিলে।
মহাস্থানগড়ের পালির টোলে ঘুরে ঘুরে
সভ্যতার গন্ধ শুঁকে শুঁকে
বনলতা সেনকে খুঁজে ফিরি নাটোরে—বিশ্বময়।

ভালোবাসার আতর মাখা রুমাল
বুকের গভীরে ঠেসে জ্যোৎস্নায় স্নান করি রোজ রাতে
কিং সাইজ খাটে ফুটে থাকে বসরার হাজারো গোলাপ
প্রেমের অযুত আলাপ
আদিম চাহিদার স্মৃতিচিহ্ন চুষে নিয়ে
সুগন্ধি ছড়ায় বিছানার চাদর।

এই বেগানা বিছানা ছেড়ে কীভাবে উঠবো বলো
ডোরবেল বাজে—বাজুক, এখন দরজা খুলবো না
একটু পরেই আলোয় হাসবে পৃথিবী
সাগর আছড়ে পড়বে
প্রাণে প্রাণে
স্থানে স্থানে
জীবন উদযাপনে।

. . .

Untimely Doorbell by Suman Banik; Poetry Book; Image Source – Collected; @thirdlanespace.com

আমেরিকার কবি জ্যান অ্যালিসন (১৯৬৩-২০২৫) The doorbell rang নামক কবিতায় লিখেছেন :

I wonder if you will have a recognizable face;
or, will you wear a mask to hide your identity?

অর্থাৎ,

আমি ভাবছি তোমার কি চেনা মুখ থাকবে;
নাকি, তুমি কি তোমার পরিচয় লুকানোর জন্য মুখোশ পরবে?

দরজা খোলার আগে যখন এ-কথা ভাবতে হয় তখন কিছুটা সংশয় মনের মধ্যে জমে। এরকমই ভাবনার মধ্যে ডুবে যাই সুমন বনিকের অবেলার ডোরবেল পড়তে-পড়তে। মাঝরাতে ডোরবেল সশব্দে বেজে উঠলেই ঘুম ভেঙে যায়। হালকা কাঁথার খোলস ছেড়ে বের হতে মন চায় না। দরজা খুললেই একরাশ আঁধার হামলে পড়বে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন :

ডোরবেল বাজে বাজুক, এখন দরজা খুলবো না
একটু পরেই আলোয় হাসবে পৃথিবী
সাগর আছড়ে পড়বে
প্রাণে প্রাণে
স্থানে স্থানে
জীবন উদযাপনে।

যে-অনিশ্চয়তা, যে-অন্ধকারচ্ছন্নতা, যে-সংশয় কবিকে ডোরবেল বাজাকে উপেক্ষা করতে বলেছে তা একটা অবরুদ্ধ সময়েরই বিমূঢ় প্রবাহ। আর এই অবরুদ্ধ সময়টি ‘করোনাকাল’। যে সময় লকডাউনে গৃহবন্দী জীবনে মৃত্যুর অপেক্ষাই করছিলেন সমস্ত মানুষ। কিংবা হয়তো জীবনের অপেক্ষাও। তাই নতুন সকালের এবং জীবন উদযাপনের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল।

সুমন বনিক ২০২১-এ ৩৯ টি কবিতা নিয়ে অবেলার ডোরবেল কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন। সব কবিতাগুলির মধ্যেই আছে এক প্রত্যয়ের জাগরণবার্তা। ‘জীবন মানেই গতিময়তা’, তাই মৃত্যু বা মারি তাকে রুদ্ধ করতে পারে না। বনলতার অন্বেষণ যেমন হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিয়েছে, তেমনি ট্রামের চাকায় কবিকে নিঃশেষ করতে পারেনি। সুতরাং প্রেমের এই অনিবার্য রূপ, এই জন্মান্তর, জীবনান্তর মুহূর্ত দান করেছে। সংশপ্তক হয়েও যুদ্ধ করা শিখিয়েছে। বর্বর পরিবেশ থেকে বাঁচার আকুতি মুক্তির বার্তা প্রেরণ করেছে।

টেলিস্কোপ দিয়ে এখন
চাঁদ দেখি না
খুঁজি-না নক্ষত্রকুঞ্জ
কিংবা মহাকাশের অলি-গলি
এখন শুধুই মানুষ খুঁজি
আলোয় ধোয়া—রোদে স্নান করা মানুষ।
মানুষ নাকি ডায়নোসারের মতো
লুপ্তজাতি হয়ে যাচ্ছে!
সন্দেহ ঘুরপাক খায় ইথারে-ইথারে
উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে
মানবতার মহাকাব্য লেখা হচ্ছে দেদারসে।

টেলিস্কোপে চোখ সেঁটে
কেবলই মানুষ খুঁজি, অথচ
পৃথিবীময় চষে বেড়ায়
মানুষের সাদৃশ্য প্রাণী।

রূপান্তর : সুমন বনিক

জীবনের এই সংকট মুহূর্তকেই কবিতার আয়না দেখিয়েছেন কবি। ডোরবেলের শব্দে সাড়া দিয়েছেন। ‘মনের গহীন গাঙে উথলা ঢেউ অনাবিল হর্ষকে’ মুক্তি দিতে চেয়েছেন। সেখানে কত গুণী মানুষেরও আশ্চর্য ছায়াকে অনুসরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে বঙ্গবন্ধু, ডক্টর আবুল ফতেহ ফাত্তাহ থেকে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা পর্যন্ত। আর তখনই লিখতে পেরেছেন :

অশুভ সময়কে তুড়ি মেরে
ছুটে চলে এক সিন্দাবাদের নাও।

অর্থাৎ সর্বজয়ী অলৌকিক সেই শক্তির সমারোহকেই কবি আলিঙ্গন করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই কবির মধ্যেও আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞার উদয় হয়েছে। নারীর আঁচলে স্বপ্নের পুঁটুলি বেঁধে সন্ত কবি সুনীল সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছেন। সেখানেও ‘দিব্যজ্যোতি বিপুল’। আবার দেশের জন্য লড়াই করতেও হয়েছে, সেই রক্তমাখা শার্ট কবির প্রেরণা হয়ে এখনো বার্তা দিচ্ছে :

বিজয়ের ছোপ ছোপ রক্ত
লেপ্টে আছে এই শার্টে
সূর্যের দ্যুতি ছড়ায়;
অনন্ত মহাকালে।

সুতরাং চন্দ্রভুক বিষাদের মেঘ যতই দানা বাঁধুক ‘স্বপ্নগুলো ডানা ঝাপটায় অনন্ত উচ্ছ্বাসে’, এ-কথা অস্বীকার করা যায় না। লকডাউন চলাকালীন মানুষে মানুষে স্পর্শ করা যাবে না। এই কোয়ারেন্টাইন বা সঙ্গনিরোধ জারি হলে নিজের হাতকেও ‘নাপাক’ বলে মনে হয়েছে। ভালোবাসা যেখানে পরিশুদ্ধ করে, সেখানে একাকিত্ব নির্বাসন এক ঘৃণিত জীবনের জন্ম দেয়। তাই এর থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। রক্তচোষা সাম্রাজ্যবাদী জোঁকের মুখে ছিটিয়ে দিতে চেয়েছেন ঘৃণার নুন। অর্থাৎ লকডাউনকেও এক চক্রান্ত বলে মনে হয়েছে।

সভ্যতার স্বয়ংক্রিয় অভিযাপনকে মানুষের স্বার্থপরতা, লোভ, হিংস্রতা কীভাবে ধ্বংস করে চলেছে তা অনুভব করেছেন। তাই কবিতায় বলেছেন ‘মারি ও মড়ক গিলে খাবে তিলে তিলে।’ প্রকৃতির কাছে যে-সৌন্দর্য, যে-পূর্ণতা, যে-অনন্ত দাক্ষিণ্য কবি পেয়েছেন তাকে সঞ্জীবিত করতে পারেননি। ‘তাই কথা রাখিনি আমি’ বলে এই সত্যবোধের স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন।

ঝকঝকে এক পৌরুষদৃপ্ত স্মার্ট উচ্চারণ তাঁর প্রতিটি শব্দেই প্রাণের অফুরন্ত মহিমাকে বেজে উঠতে দেখি। যে- দৃঢ়তায় ও ব্যক্তিত্বে তিনি সপ্রতিভ মার্জিত সুবিন্যস্ত প্রজ্ঞায় দীপ্ত হন তা বোধের তীব্র স্পন্দনকেই অনিবার্য করে তোলে। যুক্তি ও সত্যনিষ্ঠার পরম্পরা থেকেই তিনি কাব্যপ্রকরণের পর্যাপ্ত আলো আহরণ করেছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই বলতে পেরেছেন ‘সূর্যের সন্তান’ ‘বিজ্ঞানের দাস’। আমাদের প্রত্যেকের মনের দরজায় নিরন্তর এই ডোরবেল বাজতেই থাকবে।
. . .

অবেলায় ডোরবেল : সুমন বনিক
প্রথম প্রকাশ :
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১, ফাল্গুন ১৪২৭
প্রকাশক : গ্রন্থিক প্রকাশন-এর পক্ষে: তানিয়া আক্তার, ১১০ আলিজা টাওয়ার (৪র্থ তলা), ফকিরাপুল, ঢাকা-১০০০, বাংলাদেশ +৮৮ ০২ ৭১৯১৭৪৭, ০১৬৭৬ ৩১ ৩৯ ৫৭
প্রচ্ছদ : অবিনাশ আচার্য
মূল্য : ১৭০ ট.
. . .

কবি ও গদ্যকার তৈমুর খান বীরভূমের সন্তান। পেশায় শিক্ষক কবির প্রথম কবিতাবই কোথায় পা রাখি প্রকাশিত হয় মধ্য নয়ের দশকে। নির্বাচিত কবিতা ও কবিতা সমগ্র ছাড়াও একে-একে বেরিয়েছে বৃষ্টিতরু, খা শূন্য আমাকে খা, আয়নার ভেতরে তু যন্ত্রণা, বিষাদের লেখা কবিতা, একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ, জ্বরের তাঁবুর নিচে বসন্তের ডাকঘর, প্রত্নচরিত, জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরাসহ আরো কবিতাবই।

তাঁর কবিতায় দেশ-মাটি-মানচিত্র যেমন উপজীব্য হয়, এর পাশাপাশি ধারণ করেন অন্তর্মগ্ন কণ্ঠস্বরে গাঁথা জীবনসংবেদ। সহজ ভাষায় লেখেন, কিন্তু সেখানে থাকে কবিতার দ্যুতিগর্ভ উচ্চারণ : ‘ফোস্কা ওঠা হাত, আধপোড়া বাঁশি/ মৃত অনুভূতিগুলি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি/ যদিও কিছুটা মানুষ, কিছুটা গাছ/ কিছুটা ঐশ্বরিক, কিছুটা বিশ্বাস..।’ কিছুটা মানুষ, কিছুটা গাছ কবিতায় এই উচ্চারণ তৈমুর খানের কবিতায় সহজাত স্রোতের মতো প্রবহমান।

নিভৃতচারী কবি দৌড় সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও একাধিক স্বীকৃতি পেয়েছেন এ-পর্যন্ত। রয়েছে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ওপর গবেষণা অভিসন্দর্ভ, যেটি তখন পিএইচডির জন্য বেছে নিয়েছিলেন। দুই বাংলার সাহিত্যমহলে পরিচিতমুখ এই কবিকে নিয়ে জলভূমিসহ একাধিক ছোটকাগজ ও অনলাইন সাহিত্য মুখপত্রে লিখেছেন অনেকেই।
. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 21

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *