বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে সত্তর-ঊর্ধ্ব প্রজন্মের গুণিজনরা একে-একে বিদায় নিচ্ছেন। বয়সজনিত কারণে অনেকের নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া ও প্রস্থানের কারণে একটি যুগ চোখের সামনে অস্তমিত হতে দেখছি। সফিউদ্দিন আহমদ অস্তগামী প্রজন্মের অন্যতম একজন। স্যার এখনো বেঁচে আছেন জেনে ভালো লাগছে। চাকরি সূত্রে সিলেটে থেকেছেন দীর্ঘদিন। এমসি কলেজে ছাত্র পড়িয়েছেন বছরের-পর-বছর। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু হওয়ার পর সেখানেও ক্লাস নিয়েছেন কিছুদিন। বাংলার শিক্ষক হিসেবে সিলেট শহরে মনোহর আলী ও সফিউদ্দিন আহমদের পরিচিতি ও মান্যতা ছিল। সফিউদ্দিন স্যারের জনপ্রিয়তা নিছক ছাত্রমহলে সীমিত থাকেনি। লেখক, গবেষক ও অনুবাদক রূপে জাতীয় পর্যায়েও পরিচিত ছিলেন। রবীন্দ্র সাহিত্য আর বাঙালির নবজাগরণ বিষয়ক লেখালেখি এই পরিচিতির পেছনে বড়ো ভূমিকা রেখেছিল।
সিলেটের সুধীমহলে সফিউদ্দিন স্যারকে নিয়ে উচ্ছাস ও মুগ্ধতার কমতি দেখিনি কখনো। শহরে বছরভর যেসব অনুষ্ঠানাদি হতো, সেখানে কবি দিলওয়ার ও সফিউদ্দিন স্যারকে প্রধান অতিথি ও সভাপতির ভূমিকা নিভাতে দেখার ঘটনা কমন ছিল। রবীন্দ্র সাহিত্যে গবেষণায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পর সিলেট বিভাগ জুড়ে সংবর্ধনার হিড়িক পড়েছিল। উটকো এসব চাপ স্যার কতখানি উপভোগ করতেন কে জানে! বাংলাদেশে এই সময়টি বোধহয় আমরা পেরিয়ে এসেছি, যখন এক-একজন শিক্ষককে কেন্দ্র করে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রেজ তৈরি হতো। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আহমদ শরীফ, আনিসুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা বাংলা বা ইংরেজি পড়াতেন। স্যারদের লেকচার শোনার লোভে অন্য বিভাগের ছাত্ররা ক্লাসে ঢুকে পড়ত প্রায়শ।
এমসি কলেজে এই হাইপটি সফিউদ্দিনকে ঘিরে প্রবল ছিল। অনার্স ছাড়াও উচ্চ-মাধ্যমিক ও বিএ ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস নিতেন স্যার। আর্টস গ্যালারি টুইটম্বুর থাকত। পাড়াতুতো বড়ো ভাইদের অনেকে স্যারের লেকচার রেকর্ড করতেন। ঘরে বাজানো হতে পরে। এখন এরকম হয় বলে জানা নেই! জনপ্রিয়তার একখানা চাপ তো থাকেই শেষতক! ক্লাসে বা অনুষ্ঠানের মঞ্চে অনবরত নতুন কথা যোগ করা সহজ নয় একটুও! সফিউদ্দিন স্যারের বক্তিমায় সংগত কারণে পুনরাবৃত্তি থাকত। ক্লাসে বা অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে একাধিকবার শুনে ফেলা কথাগুলো ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে রিপিট করতেন হামেশা। আমাদের এখানে আসলে এটি এড়ানো কঠিন। শ্রোতারা অবশ্য বদার করত না। স্যারের বাচনভঙ্গির মধ্যে নিহিত গরিমা দখলে রাখতো তাদের।

সে যাইহোক, সুবক্তা পরিচয়টি সফিউদ্দিন স্যারকে জনপ্রিয়তা দিলেও,—তাঁকে মূল্যায়নের পরিমাপক তা হতে পারে না। হওয়া উচিত নয়। লম্বা সময় ধরে লিখে গেছেন তিনি। রবীন্দ্র সাহিত্য ও বাংলায় নবজাগরণের কালপর্বটি নিয়ে আলাদা করে ভেবেছেন নিরবচ্ছিন্ন। সমসাময়িক প্রসঙ্গেও ছিল নজর। জাতীয় দৈনিক ও সাহিত্য সংকলনে সেগুলো নিয়ে লিখতেন বেশ। শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক পরিচয়টি তাঁর বেলায় মার্কামারা হয়ে উঠলেও, গুরুত্ব রাখে এরকম সাহিত্যিক অনুবাদকর্মে ছিলেন সক্রিয়।
ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তা ও দর্শনের ভাষান্তরে সরদার ফজলুল করিমকে আমরা স্মরণে রাখতে বাধ্য। প্লেটো, অ্যারিস্টোটল, রুশোর মূল কাজগুলোর উপভোগ্য বাংলা ভাষান্তর ও ব্যাখ্যার জন্য জাতি তাঁর কাছে ঋণী। এবং অবশ্যই ঋণী দর্শনের পরিভাষাকে মাতৃভাষায় চিনিয়ে দিতে রচিত দর্শনকোষ বইটির জন্যও। সফিউদ্দিন আহমদকে এদিক থেকে সরদার ফজলুল করিমের অনুগামী মানতে হচ্ছে। সক্রেটিসের হেমলক পানের ঘটনা নিয়ে প্লেটোর ইয়াদনামা (The last days of socrates) তাঁর অনুবাদে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে তখন।
আর্ত্যুর র্যাঁবো, শার্ল বোদলেয়ার, পাবলো নেরুদা ও টি এস এলিয়টের কবিতার ভাষান্তরও করেছেন তিনি। এসব কাজ এখন মামুলি মনে হবে, কিন্তু সময় ও প্রেক্ষাপট বিচারে তাঁর এই সৃজনশীলতা কিমতি রাখছিল। রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার নবজাগরণ বিষয়ক লেখালেখিতে মূলত কেন্দ্রীভূত সফিউদ্দিন আহমদের উৎসুক মনের পরিচয়টি আমরা পাচ্ছি এখানে। বামপন্থী ভাবাদর্শে ইমান গচ্ছিত রাখার প্রভাব যেখানে কাজ করেছে কমবেশি।
সমাজসঙ্গ করলেও সিলেটে সফিউদ্দিন স্যার কার্যত একলা যাপন করতেন নিজেকে। তাঁর কাজের বিষয়বস্তু ও নানামুখী আগ্রহের জায়গাগুলো বোঝা ও এক্সপ্লোর করার বালাই সিলেটি সুধীমহলে দেখিনি। ওদিকে, টিচার্স কমনরুমে আমাদের স্যার-ম্যাডামরা সচরাচর কী টাইপের খাজুরি আলাপ করে থাকেন, সেটি কারো অজানা নয়! সফিউদ্দিনের লেখালেখি ও গবেষকমন নিয়ে তর্কালাপ সেখানে বড়ো একটা হতো বলে মনে হয় না। তাঁকে অগত্যা হংসমধ্যে বক যথা হয়ে কালাতিপাত করতে হয়েছে। এই বিড়ম্বনার সঙ্গে মানিয়ে চলা আমাদের এখানে যুগ-যুগ ধরে অমোঘ। একজন ব্যক্তির মননশীলতাকে যেটি আসলে খতম করার জন্য যথেষ্ট।

এদিক থেকে দেখলে, সফিউদ্দিন আহমদকেও টিপিক্যাল ভেতো বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিচয়ে শহরে চরে খাওয়ার অভিনয়টি চালিয়ে যেতে হয়েছে;—যিনি কিনা সাতচল্লিশের দেশভাগ ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়া থেকে বাংলাদেশকে জন্ম নিতে দেখেছেন। প্রগতি ও পশ্চাদগতির আন্তঃসংঘাতের ভিতর দিয়ে যেতে হচ্ছিল তাঁকে। সেখানে, তাঁর রাহা বা পথ কোনটি হবে, তা বেছে নিতে হয়েছিল। তিনি, সফিউদ্দিন আহমদ কি হিন্দু ও মুসলমানের চিরাচরিত আন্তঃসংঘাত থেকে জায়মান সাম্প্রদায়িক অভিমানে আবর্তিত রাজনৈতিক বয়ানের মধ্যে নিজেকে নবায়িত করবেন? বেছে নেবেন এমন পথ, যেটি যুক্তি দিতে পারে ভালো, কিন্তু দিনশেষে জাতিসত্তার চিহ্নগুলোকে সংকীর্ণ করে চতুরভাবে? এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন ও আলাপ তোলার সময় কি আসেনি এখনো!
সফিউদ্দিন আহমদের জন্মবারে অনেকে তাঁকে স্মরণ করছেন দেখে ভালো লেগেছে, তবে সেখানে তাঁর লেখালেখির মেরিট নিয়ে যদি আলাপ না ওঠে, তাহলে বুঝতে হবে,—আমাদের জন্য তিনি আসলে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তুলতে পারেননি। খামোখাই লিখে গেছেন এতগুলো বছর!
মার্কসবাদে নিজেকে দীক্ষিত ভাবার আবেগ, একে তখন কীভাবে মোকাবিলা করেছেন সফিউদ্দিন আহমদ? ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে সেখানে কোন তরিকায় সমন্বিত করেছেন? এসব দ্বন্দ্ব যে-যুগলক্ষণকে অনিবার্য করছিল,—তাঁর সাহিত্যিকযাত্রা এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। একজন শিক্ষক ও মসিচালক রূপে ফয়সালা সহজ থাকেনি। মুক্তচিন্তার অনুসারী বলে নিজেকে এই দেশে যে-কেউ জাহির করতে পারে। হামেশা করেও। সপক্ষে যুক্তি দিতে খামতি রাখে না। তাতে করে কি সে হয়ে ওঠে মুক্তচিন্তক? মুক্তচিন্তা তো বিপজ্জনক বস্তু একখান! এটি হলো ফাঁদ,—যেখানে প্রতি পদে কাণ্ডজ্ঞান ধরে রাখতে হচ্ছে। স্বচ্ছ ও পরিশ্রুত থাকার পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয় অবিরাম! ক‘জন পারে নিতে সেই চাপ!
স্থানিক পরিসর থেকে পাওয়া চিহ্ন ও পরিচয়কে যেমন মুক্তচিন্তক বহন করতে বাধ্য,—এর বিপরীতে স্থানিকতা পেরিয়ে বৈশ্বিক পরিসরকে ভিতরে জায়গা দিতে হবে তাকে। দুয়ের রসায়ন আবার এমন হওয়া চাই, যা তাকে যুগপৎ যুক্তিশীল ও মানবিক রাখবে। সে হবে সহিষ্ণু ও বিবেচক। অন্যদিকে, প্রয়োজন পড়লে কঠিন হতে দ্বিধা করবে না। সমাজের বিরুদ্ধে যদি যেতে হয় তো যাবে। ভয়ডর ও আপসের তোয়াক্কা করবে না। সবমিলিয়ে দুরূহ এক পথ! সকলের কাছে প্রীতিকর থাকার সুযোগ সেখানে নেই। সফিউদ্দিন আহমদ এই স্থানে পা দিয়ে জরুরি হয়ে উঠছেন। বলতেই হবে এ-কথা,—তাঁর চেয়ে ডাকসাইটে অনেকের তুলনায় নিজেকে পরিশ্রুত ও স্বচ্ছ রাখতে পেরেছেন আগাগোড়া। ডিগবাজির বান্দরনাচে শামিল না হয়ে বরং থেকেছেন কাণ্ডজ্ঞান ও মূল্যবোধে শাণিত।

তাঁকে দূর থেকে যতটুকু দেখেছি ও জেনেছি সেইসময়, সেখানে তাঁর জীবন-প্রণালীকে আহামরি মনে হয়নি। গতানুগতিক ছিলেন। এই সমাজে একজন শিক্ষক সচরাচর যে-মধ্যবিত্ত ঘেরাটোপে যাপন করেন, তাঁর অবস্থান তাই থেকেছে;—যেখানে আপসকামিতা থাকলেও থাকতে পারে। তবে হ্যাঁ, লেখালেখি ও গবেষণায় সফিউদ্দিন আহমদ ছিলেন পরিশ্রমী ও বিবেচক।
ইচ্ছে করলে বামপন্থী ভাবাদর্শের ফ্রেমে ঢুকিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও নবজাগরণকে যৌক্তিক প্রতিপন্ন করা তাঁর জন্য কঠিন ছিল না। করাটা সবসময় খারাপ হয়, এরকম নয় বটে! বিচিত্র পন্থায় কোনো একটি বিষয়কে দেখার অন্যতম স্বীকৃত পন্থা এটি;—এবং অনেকক্ষেত্রে জরুরিও। শেক্সপিয়ারকে যেমন উৎপল দত্ত মার্কসীয় ছকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর ব্যাখ্যার প্রাসঙ্গিকতাকে খারিজ করা আজো কঠিন। শেক্সপিয়ারকে বরং আমাদের কাছেরজন ভাবতে ভূমিকা নেভায় উৎপল দত্তের ব্যাখ্যা।
সফিউদ্দিন আহমদ, যে-কোনো কারণে হোক, মার্কসবাদী নিক্তিতে ফেলে রবীন্দ্রনাথ ও নবজাগরণকে পুরোটা দেখেননি। তাঁর বইপত্র যুবাকালে অল্পবিস্তর পাঠ করেছি। উদ্ধৃতি কন্টকিত মনে হতো পড়ে। সেটি তাঁর দোষ নয়। গবেষণার মন নিয়ে যিনি লিখছেন, তাঁর বেলায় উদ্ধৃতি ধরে-ধরে যুক্তিবিস্তারের প্রচলিত ছক থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কঠিন। সফিউদ্দিন আহমদের লেখার ভাষা ছিল প্রাঞ্জল; তবে সেখানে গবেষকের মেজাজ এসে পড়ায় কোটেশন ও রেফারেন্সকে তিনি আগে প্রাধান্য দিতেন,—যার নিচে তাঁর নিজস্বতা অনেকসময় খেই হারাচ্ছে মনে হতো।
গবেষকের মেজাজে লেখা মানে উধ্দৃতি কন্টকিত, এমনটি আবার সবক্ষেত্রে সবসময় ঘটে না। ব্যতিক্রম আছে সেখানে। বাঙালির অ্যাকাডেমিক পরিসরেও তার নজির আমরা পাবো। উদ্ধৃতি ছাপিয়ে লেখকের স্বকীয় কণ্ঠস্বরকে যেখানে চিনে নিতে পাঠকের অসুবিধে হয় না। তাৎক্ষণিক উদাহরণ হিসেবে আহমদ শরীফ, আনিসুজ্জামান ও হুমায়ুন আজাদের নাম নেওয়া যেতে পারে। আহমদ শরীফ প্রচণ্ড ইহজাগতিক ও বস্তুবাদী বিশ্বাসে অটল থেকেছেন জীবনে। তাঁর আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু, অর্থাৎ মধ্যযুগের মুসলমানি পুঁথি সাহিত্যের বিচারপদ্ধতিতে বস্তুবাদী জীবন-দর্শনের প্রয়োগ ঘটাতে দ্বিধা করেননি। কোটেশন ও রেফারেন্সও দিয়েছেন সেই মোতাবেক, যেখানে ব্যাখ্যার মুন্সিয়ানা সেগুলোকে কেমন করে জানি মাইনর করে রাখে। হুমায়ুন আজাদও অনেকটা তাই। এরকম আরো নাম নেওয়া যাবে। আপাতত প্রয়োজন নেই। সফিউদ্দিন আহমদের কোটেশন ও রেফারেন্সের ব্যবহার এদিক থেকে গতানুগতিক মানতে হবে। তবে, যে-মতামত বা বক্তব্য তিনি রাখতে চাইছেন, সেটি প্রতিষ্ঠা দিতে আটকায়নি।
তাঁর কিছু বই পড়েছি যুবাকালে। সবটা এখন আর মনেও নেই। স্মৃতি থেকে তথাপি দুটি প্রসঙ্গ টানতে চাই। সফিউদ্দিন আহমদকে যা প্রীতিকর ভাবার পেছনে ভূমিকা রাখে, অন্তত আমার কাছে অবশ্যই…
যেমন, বৃত্তাবদ্ধ রবীন্দ্রনাথকে তিনি মার্কসবাদীর চোখ দিয়েই দেখেছেন, কিন্তু সেখানে মূল কথা যেটি বলতে চেয়েছিলেন, সেটি কিন্তু মার্কসবাদী পন্থা সাধারণত আমলে নিতে আগ্রহ বোধ করে না। সফিউদ্দিন সেখানে এই মত রাখছেন : রবীন্দ্রনাথ হলেন আমাদের সেনাপতি;—যিনি সৌন্দর্য বা এসথেটিক ভ্যালুকে মহিমান্বিত করে গেছেন। জীবনে সুন্দরের অনিবার্যতা তুলে ধরতে কার্পণ্য করেননি ঠাকুর। ব্যথা ও পীড়ন মানুষের জীবনে অবিচ্ছেদ্য। এর বিচিত্র দিক নিজের সৃষ্টিকর্মে ধারণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তথাপি, এসবকে লঘু ভাবতে পারার আত্মশক্তিতে নিহিত যে-জীবনবেদ, যে-প্রাচ্য সংবেদ, যে-শাশ্বত সুন্দর, যেগুলো মানুষকে মানবিকরসে মহান করেছে,— রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে তার পাঠ অসম্পূর্ণ থাকতে বাধ্য।
শুনে মনে হবে, এ-আর নতুন কী! তাই বটে! কিন্তু ভেবে দেখলে, রবীন্দ্রনাথের রচনায় মেহনতি জীবনের ছাপচিত্র কতখানি ধরা পড়েছে, সেগুলোর তালাশ সফিউদ্দিনের জন্য কঠিন ছিল না। সেখানে স্থির থেকে তাঁকে যৌক্তিকতা দান অথবা খারিজ করার কাণ্ড তিনি সহজেই সেরে ফেলতে পারতেন। সমাজের শ্রেণিস্তরভেদে রবীন্দ্রনাথের গমনাগমন ও ভাবনাকে অনুসরণ করেছেনও, এর যৌক্তিকতা ও সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়েছেন, কিন্তু এ-যে মূল সুর নয়, সেই কথাটি ফিরে-ফিরে মনে করিয়ে দিতে ভুলছেন না। এখানে এসে তাঁর রবীন্দ্রচর্চার ধরাবাঁধা প্রবণতার মধ্যে প্রাসঙ্গিক অর্থ দাঁড় করাচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ এমন এক সত্তা, যাঁকে ইচ্ছামতো ছাঁচ ও আকারে ফেলে গ্রহণ ও বাতিল করা ব্যাপার থাকে না। সফিউদ্দিন তাঁর বইয়ে ওদিকপানে আগ্রাসী না হয়ে সৌন্দর্য তথা এসথেটিকের আন্তরমূল্য দিয়ে রবিবিচার সেরেছেন;—একুশ শতকেও যেটি সমান প্রাসঙ্গিকতা রাখে।
আজকে যখন রবীন্দ্রনাথ পুনরায় আক্রান্ত, তখন সফিউদ্দিনের বৃত্তাবদ্ধ রবীন্দ্রনাথকে পাঠের প্রয়োজন আছে মনে করি। তা এজন্য,—নান্দনিকতার পেছনে নিহিত ধারণা মূলত ভাববাদী বিষয় হলেও, এর মূল্য তাতে একটুও কমে না। যেমন, আধ্যাত্মিক তৃষ্ণায় নিহিত মরমি জীবনবেদ ঘুরেফিরে বস্তুবাদী জীবনের চাপে যন্ত্র হওয়ার ক্ষণে মানুষকে তার নিজেকে ফিরে পেতে সাহায্য করে। সফিউদ্দিন আহমদের রবীন্দ্রপাঠে এই দিকটি ছিল, যেমন থেকেছে অন্যত্রও।

তাঁর দ্বিতীয় সুবিবেচনা পাই ডিরোজিও তথা ইয়াং বেঙ্গলদের নিয়ে রচিত বইগুলোয়। অ্যাকাডেমিক পরিসের এটি এখনো পঠিত হয়ে চলেছে। বিশেষ করে ইয়াং বেঙ্গল মুভমেন্টের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বিষয়ক বইটি আদিপাঠে আগ্রহ তৈরি করেছিল মনে। প্রথম যখন পড়েছি, বিনয় ঘোষের প্রভাব প্রবল মনে হয়েছিল। আফটার অল, বাংলার নবজাগরণকে মার্কসপন্থী বিনয় যে-জায়গা থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন, সেটি গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা ধরে। সফিউদ্দিন আহমদ স্বয়ং আন্তরবিশ্বাসে ইহজাগতিক ও মার্কসপন্থী। রবীন্দ্রনাথ হোক অথবা অন্যকিছু, এদিকটা তাঁর বিবেচনায় জারি থেকেছে সবসময়। ধর্মসমস্যার থেকে মুক্তি নিতে রেনেসাঁসের ভূমিকা সংগতকারণে বাদ দিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। বাংলার নবজাগরণও যে-মূলত (যদিও হিন্দুধর্ম) ধর্মসমস্যার বাড়বানলকে প্রশমিত করার ভাবনা থেকে শুরু, সে-নিয়ে বিস্তর বলেছেনও।
বাংলার নবজাগরণকে ইউরোপে সংঘটিত নবজাগরণের নিরিখে পাঠ করেছেন তিনি; আবার আমাদের এখানকার জলবায়ুর নিরিখেও নজরে নিয়েছিলেন। কান্টের আলোকায়ন সম্পর্কিত ব্যাখ্যা খণ্ডন করতে বসে মিশেল ফুকো ইউরোপের আলোকায়নকে যে-জায়গা থেকে পরে আঘাত হানলেন বা এর মধ্যে জমে থাকা অন্ধকারের আভাস দেখালেন,—সফিউদ্দিন আহমদের লেখায় এদিকটা এসেছিল কি-না, তা এখন আর স্মরণ নেই।
বইটি বছর পনেরো আগে পুনরায় প্রকাশ পেয়েছে। মুখবন্ধটি পাঠ করেছিলাম অনলাইনে। উত্তরআধুনিক তত্ত্বপ্রসূত পাঠপদ্ধতিকে সেখানে মেনশন করছেন দেখলাম। আমাদের এখানকার জীবনসংস্কৃতির নিজস্বতা ও স্বকীয়তা বুঝতে কলোনিয়াল মাইন্ডসেট থেকে বেরিয়ে আসা অপরিহার্য;—বিশ্বাসটি যদিও গোড়া থেকে তাঁর মধ্যে প্রবল দেখেছি। মুখবন্ধে তা আরো স্পষ্ট করেছেন মনে হলো। জানিয়ে দিতে ভুলছেন না,—আমাদের হিমালয়ের মতো শক্ত ও স্বকীয় ভিত্তি রয়েছে। ভিত্তিটিকে বোঝা মানে এই নয়,—সাম্প্রদায়িক অভিমান আর সংকীর্ণতার কূপে নিজেকে বলি দিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে বিরোধাভাস। ঔপনিবেশিক মানসিকতা বরং এ-ধরনের কূপমণ্ডকুতার জনয়িতা।
সফিউদ্দিন আহমদ তাঁর লেখালেখির মধ্যে প্রসঙ্গটি বহুবার নানাছলে তুলেছেন। সংক্ষুব্ধ বাংলাদেশ টু নামক কিমাকার সময়ে এরূপ স্বচ্ছতার সঙ্গে, কাণ্ডজ্ঞানে জারি থেকে জানা কথাগুলো পুনরায় স্মরণ করতে বলা লোকজন সংখ্যায় কমতে-কমতে নেই হওয়ার পথে আছেন। জানি না, আশি-ঊর্ধ্ব বয়সে সফিউদ্দিন আহমদ এসব কতটা কী ভাবতে সক্ষম! তবে তাঁর মতো লোক, যাঁদেরকে আমরা একসময় ভক্তি অথবা ভীষণ ক্লিশে ভেবে পাত্তা দিতে নারাজ থেকেছি,— তাঁরা মনে হচ্ছে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ও মানবিক ছিলেন! গতানুগতিক বাঙালি মধ্যবিত্ত হলেও তাঁদের মধ্যে ছিল সিগ্ধতা। ছিলেন সহৃদয় ও সুবিবেচক। বড়ো কথা,—প্রখর ইহজাগতিক বা বস্তুবাদী হলেও মরমিরসের কদর বুঝতেন সমধিক। একটি ভারসাম্য ছিল, যার মধ্যে যাপন করতে তাঁরা ভালোবেসেছেন। এরকম লোকজন হ্রাস পাওয়ার কারণে দেশটি ইতর প্রকৃতির বুদ্ধিজীবী নামধারী অমানুষে সয়লাব হয়ে আছে!
. . .

. . .
. . .



