
১৩৯৩ বাংলা। চৈত মাস। ভাটির ময়ালে খুব অভাব। গেরস্তকুল তাদের একমাত্র বুরো (*বোরো*) ফসল তোলার অপেক্ষায় দিন গুনছে। ফসলের মাঠে বুরো ধানের সবুজ শিষ এখনও মাথা নোয়ায়নি। শিষের রেণু ঝরছে চৈতালি বায়ে। শাইল-গচি জাতের ধানে কেবল ‘থউর’। জমিনে খুব ভালো ফলন হয়েছে। কৃষক সুখের স্বপ্ন নিয়ে চৈতের অভাব কাটিয়ে উঠতেছে বুরো ফসল তোলার অপেক্ষায়। আদুরীর মায়ের পরনের ছেড়া কাপড়টার পরমায়ুও যেন চৈতের অভাবের সমান। ফসল উঠলেই নয়া শাড়ি-লুঙ্গি-গামছা কিনে শুরু হবে অভাব জয়ের আনন্দ। এ-আনন্দ লাভের আশায় অভাব সয়ে সয়ে আদুরীর মায়ের দিন কাটে ফসল-দেবতার আরাধনায় উপবাস করে-করে। উপবাসের তাড়নায় মাঝে মাঝে মনোকষ্টে আদুরীর মা বলে ওঠে—’পক্কি অইলেই ভালা আছিন! ইচ্ছাতম ঠুক্কিয়া ঠুক্কিয়া খাইতাম, গাছের ডাল-অ ঘুমাইতাম।’
স্বর্গপ্রাপ্তি নয়; খাদ্যপ্রাপ্তির জন্য দেবদেবীর উপবাস করতে-করতে আদুরীর মা এখন ‘সূতিকার’ রোগী। কঙ্কালসার দেহ! মাথার তালুর চুল কেটে কবিরাজি ‘ভরণ’ দিয়ে মরণ জয় করতেছে ফসল তোলা পর্যন্ত। আদুরীর বাবাও জানে তাদের অভাব পাকা ধানের শিষের সমান। তাই জমির আইল ঘুরে আঙুলে দাগ গুনতে-গুনতে বলছে :
শিষে বিশ, নুয়াইলে বারো,
শাইল-গচি-বুরো কাটতে পারো।
হঠাৎ একদিন বিকাল বেলা আসমানের আইড়াকোণায় কালো মেঘ জমেছে। শিলাবৃষ্টির আভাস। ফসলের দেবতা নিরুদ্দেশ! আদুরীর মা বড়ো অসহায়। বাড়ির উঠোনে শিল-পাটা রেখে হিরালের দোহাই দিয়েও কাজের-কাজ হচ্ছে না। ঝিলকি মেরে আসমান থেকে মুহূর্তে বিকট শব্দে শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। শিলা জমে সাদা হয়ে যায় বাড়ির উঠোন। উঠোনের পাশে লাউ গাছের থেতলে যাওয়া ডুগা পাতা দেখে আদুরীর মায়ের মন খারাপ। তার পরনের ছেঁড়া শাড়ির পরমায়ু বেড়ে যায়। আসমানের শিলে তছনছ হয়ে যায় জমিনে গর্ভবতী ধানের ‘থউর’, ধানের শিষ। মাটিতে মিশে যায় সুনামগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চলের শাইল-বুরো ফসল। আদুরীর বাবা জমিনে দাঁড়িয়ে থেতলে যাওয়া ধানের শিষ হাতে নিয়া আসমানের দিকে তাকাইয়া কয়—’হগল বরষণ এমনে দিয়াই ঢাল্লিয়া দিলা? গরুর খেড়ডাও রাখলা না?’ ধান-দূর্বা দিয়ে জামাই আশীর্বাদ করার মত একমুঠো ধানও কেউ সংগ্রহ করতে পারেনি।
আকাশের বাহাদুরি যেন আর থামে না। দেখতে দেখতে ঢলে-ঢলে তলিয়ে যায় মাঠ-ঘাট-জমি। হারিয়ে যায় ফসলের চিন। জমি শুদ্ধু গিলে খায় জলেশ্বর! ভাসাপানিতে আদুরীর বাবা নাওয়ের গলুইয়ে বসে হাল ধরে ভাটিয়ালি গেয়ে আাবারও জানান দেয় নতুন করে যুদ্ধ জয়ের। থেমে থাকেনি ভাটির চিরাচরিত বর্ষাকালীন জনজীবন। থেমে থাকেনি অলসবেলার গান। অভাবের সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু হয় গানে-গানে তাদের দুঃখের বয়ান। কেননা, গান যতটুকু না সুখের সাথী, তার চেয়ে অধিক দুঃখের সাথী। জীবনঘনিষ্ঠ সুখ-দুঃখের অনুভূতিগুলো কথা হয়ে সুরে সুরে গান হয়। যেখানে বিরহের গান সর্বাগ্রে। তাই ফসলহারা মানুষের বেঁচে থাকার আর্তনাদ প্রকাশ পায় গানে-গানে। বিশেষ করে বাড়ির উঠোনে মেয়েদের ধামাইল গান ভাটি ময়ালের সুখদুঃখের জনদলিল।
ভাটি বাংলার আঞ্চলিক শব্দ ‘ধামা’ যার অর্থ ভাব বা আবেশ। আর এই ভাব বা আবেশ ভক্তি ও প্রেমে মজে যে-গান পরিবেশিত হয়, তার নাম ধামাইল। তাছাড়া ধামা শব্দের অর্থ উঠোন বা মাটির আসর। ভাটির গেরস্ত বাড়ির বড়ো উঠোনে বা মাটির আসরে ধামাইল দলগতভাবে পরিবেশিত হয় বলে এই গানকে উঠোন বা মাটির আসরের গানও বলা হয়। আবার অনেকেই মনে করেন, অবসরে গল্পগুজবের মুহূর্ত ‘ধুম্বইল’ আসর কালক্রমে গল্প থেকে গানে-গানে ধামাইল আসরে পরিণত হয়। যা সাধারণত ভাটি গায়ের লাজুক গেরস্ত বধূগণ দলগতভাবে চক্রাকারে ঘুরে-ঘুরে নেচে-নেচে হাতে তালি দিয়ে পরিবেশন করে থাকে। ধামাইল গানে জীবনঘনিষ্ঠ ভাব প্রকাশ হয়। তাই আদুরীর মা ধামাইল আসরে গেয়ে ওঠেন :
প্রাণ সই সখি গো প্রাণ বাঁচে না অভাবের জ্বালায়।
১৩৯৩ সালে চৈত্র মাসে নিলো শিলে, এগো কত হাওর নিলো শিলে, লোকে করে হায়রে হায়।… ঐ
৪০০ টাকা চাউলেরই মন, কি করে বাঁচিবে লোকজন, ছেলেমেয়ে ক্রন্দন করে পিতা-মাতার কাছে যায়।… ঐ
আদুরীর মা কান্দিয়া বলে, আমার ইহজনম গেল বিফলে, দারুণও অভাবের দায়।… ঐ ((দীনবন্ধু, ১৯৮৬)
ভাটি ময়ালে ধামাইল গানের আসরে আমার (দীনবন্ধু) এই গানটি নানাভাবে আরও কিছু কথা ও ভণিতাজুড়ে দিয়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রাধা-কানু, রাই-শ্যাম সংগীত কিংবা মহাজনদের বান্ধা দরদী গানও তখন এ-গানের বাস্তবতার কাছে হার মানে। শুধু কি তাই! আরও-যে কত এমন সমকালীন বাস্তবতা নিয়ে গানের জন্ম হয় অভাবি ভাটি মায়ের কোলে, তার হিসাব নগরে ক’জন রাখে?
চরম অভাবেও তাদের সুরেলা স্বভাবে এতটুকু চির ধরেনি। অভাবি বধূগণ তখন হাসিস্বভাবী হয়ে সংসারের অশান্তি তাড়ায়। তাই-তো গাঁয়ের বধূগণ তাদের সংসার আগলিয়ে রাখতে, স্বামীর মনে শক্তি যোগাতে ধামাইল আসরে আবারও গেয়ে ওঠেন :
সাধের প্রানপতি গো কাজ নাই আমার নতুন শাড়ি, সুতা আইনা দেও।
ছিঁড়া শাড়ি শিলাই করি দিতে হবে বছর পারি, চলব আমি সইয়া রইয়া জানবে না তো কেউ।…ঐ
পুলায় কান্দে পুরি গো কান্দে ভাতের লাগিয়া, ভাতের সাথে আলু দিয়া রান্দি ভাতের লেউ।…ঐ
আদুরীর মা’র কপাল পুড়া ভাঙছে সুঁইয়ের আগা, শাড়ি সিলাই হইলো না তার জানলো না তো কেউ।…ঐ (দীনবন্ধু ২০১৭)
আদুরীর মাকে উৎসর্গ করে সমকালীন বাস্তবতা নিয়ে ২০১৭ সালে ফসলহানীর পর এই গানটি আমি (দীনবন্ধু) রচনা করি। এখানে গানের ভনিতায় আদুরীর মা ভাব প্রকাশের মাধ্যম মাত্র। ধামাইল গানে একজন গায়ক নিজের ভাব প্রকাশ করে বা জীবনঘনিষ্ঠ গান মনে করে গায় বলেই দরদ বেশি প্রকাশ পায়। ধামাইল গানে ভণিতায় গীতিকারের নিয়ম ভাঙার প্রচলন শুরু থেকেই। তবে সেটা কারো গান দখল করে বা গীতিকারকে আড়াল করে নিজের জন্য নয়। ধামাইল গায়ক কখনো স্বেচ্ছায় নিজের নাম ভণিতায় জুড়ে দেন না। বরং ভালোবেসে নিজের লেখা গান অন্য ভণিতায় উৎসর্গ করেন। গীতিকার নিজের পরিচয় গোপন করে সকলের জন্য গান উৎসর্গ করেন, এমন নজির ধামাইল গানে ভাটি গাঁয়ের বধূসমাজে অনেক। তাই পছন্দের গানে পছন্দের গীতিকার এর পরিচয় খুঁজে না পাওয়ার বেদনাও আছে অনেক।
. . .
. . .

হাওরপারের সন্তান সজল কান্তি সরকারের অস্তিত্বে মিশে আছে হাওর জনপদের জীবন ও সংস্কৃতির বিচিত্র সব রং। কবিতা, গান, চিত্রকলা, আর মাঠ-পর্যায়ের গবেষণায় রংগুলো তিনি ধারণ করে চলেছেন নিরলস। হাওর জনপদে প্রচলিত ও অবলুপ্ত গানের ধারা নিয়ে প্রবল অনুসন্ধিৎসা তাঁকে দিয়ে এ-পর্যন্ত সতেরোটি বই লিখিয়ে নিয়েছে। হাওর জনপদের জীবন-মানচিত্রের ছাপ প্রকাশিত বইগুলোয় নিবিড়।
উপন্যাসের আঙ্গিক ধার করে রচিত ক্ষেও, ঢেউ ভাঙ্গা ঢেউ-এ উঠে এসেছে হাওরজীবনের দুঃখসুখের সঙ্গে তাল দিয়ে বহমান সংস্কৃতির উৎসারণ। দুই খণ্ডে প্রকাশিত হাওরের কথকতা ও আইলাম্বর-এ সংকলিত প্রবন্ধগুলোয় হাওরের বিচিত্র দিক ধরতে সচেষ্ট থেকেছেন সজল। যেখানে, গবেষকের অনুসন্ধিৎসার সঙ্গে মিশেছে হাওর-যাপনের অভিজ্ঞতা।
বাউন্ডুলে কবি, বুরো ধানের গন্ধ, দড়ং নামে তিনটি কবিতাবই, আর আলগঘর শিরোনামে মলাটবন্দি গল্পসংকলনে হাওর জনপদের ভূগোল ও জলবায়ুর প্রতিধ্বনি পেতে পাঠকের অসুবিধে হয় না। এছাড়াও ভাট কবিতা : হাওর কাহন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ। হাওর অঞ্চলে মুখে-মুখে রচিত ও গান-আঙ্গিকে পরিবেশিত ভাট কবিতা অদ্য লুপ্ত প্রায়। সজল কান্তি সরকার এর উৎস ও বিবর্তনরেখাকে ধারণ করেছেন গবেষকের অনুসন্ধিৎসায়।

এছাড়াও, ওরাল ট্রাডিশনের স্মারক মুখ্যাদ্যিয়া গান, ধামাইল, বাউল মহাজনদের গানকে ঘিরে নিজের অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধানে নাগরিক পাঠকজনকে আলোকিত করতে ধামাইল অঙ্গে রচিত রাইকিশোরী নাট্যপালার পরিবেশনা অনেকের মন কেড়েছিল। দীন শরতের মানবমঙ্গল সম্পাদনা তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
সজল কান্তি সরকার ছবি আঁকেন, ভাস্কর্যও করেন মাঝেমধ্যে। গ্রামীণ জীবনধারার নানা অনুষঙ্গ সেখানেও ফুটে বের হয়। যামিনী রায় ও কামরুল হাসানের হাতের তুলিতে ছবি আঁকার যে-ধারা মান্যতা পেয়েছিল, সজল কান্তি সরকার পুনরায় সেই ধারাকে নিজের মতো সময়-উপযোগী চারিত্র্য দিয়ে চলেছেন।
. . .




One comment on “হাওরজীবন-১ : চেনা গান অচেনা গীতিকার — সজল কান্তি সরকার”