পোস্ট শোকেস - সাম্প্রতিক

কাঞ্চনজঙ্ঘা জুবিন

Reading time 5 minute
5
(62)
Zubeen Garg; Image Source – Collected;

মানুষের পছন্দ ও অপছন্দ দুটোই অমূল্য ধন। সকলের ভাগ্যে জোটে না। আপামর মানুষের হৃদয় হরণ করা কঠিন কাজ। যোগ্যতা লাগে। অনেকসময় যোগ্যতায় কাজ হয় না। পরিস্থিতি, ভাগ্য ইত্যাদি তো আছেই,—আরো অনেক ফ্যাঁকড়া সেখানে বাধ সাধে। অন্যদিকে, অপছন্দের পাত্র হয়ে ঘৃণা কুড়ানোও কঠিন একটি কাজ! যোগ্যতা আর মেহনত সেখানেও লাগছে। একটি মানুষ অপছন্দ ও ঘৃণার কারণে কিংবদন্তির মহিমা লাভ করতে পারে। ইতিহাসে নজিরের অভাব নেই। আর, পছন্দ ও ভালোবাসার জোয়ারে প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি অতীতে অনেকে হয়েছেন;— আজো হয়ে চলেছেন ও আগামীতে হতে থাকবেন। পছন্দ ও অপছন্দের সংমিশ্রণ থেকে আবার কোনো-কোনো মানুষের ওপর ভালোবাসা জন্ম নেয়। অপছন্দ কেন জানি ঘৃণাকে সেখানে তীব্র করতে পারে না;—ভালোবাসা সকল ছাপিয়ে বড়ো হতে থাকে কেবল।

গোলমেলে এসব হিসাব-নিকাশের কোনোটাই জুবিন গর্গের ক্ষেত্রে খাটছে না। আমরা বরং ব্যতিক্রম পাচ্ছি সেখানে। পছন্দ-অপছন্দের ধরাবাঁধা গণ্ডি টপকে মানুষ তাঁকে আবেগের এমন এক জায়গায় ধারণ করছেন, যেটি দুর্লভ! দূর অতীতেও এভাবে কাউকে হৃদয়ে ধারণ করার উদাহরণ গণ্ডায়-গণ্ডায় মিলবে না। একালের তো প্রশ্নই উঠছে না! ব্যতিক্রম এক শেষ বিদায় দেখার সৌভাগ্য হলো জীবনে!

জুবিন গর্গ গানের মানুষ ছিলেন। বিপুল সাধারণকে আনন্দ দিতে টানা গান করে গেছেন। পঞ্চাশের সামান্য ওপরে চলছিল বয়স। এর মধ্যে প্রায় চল্লিশ হাজারের কাছাকাছি গান করা চাট্টিখানি কথা নয়। চল্লিশটি ভাষায় গান করার ক্ষমতা অথবা একদিনে ত্রিশের অধিক গান রেকর্ড… সবটাই চোখ কপালে তোলার মতো শোনায় কানে! ভালোমন্দ মিলিয়ে গান করেছেন জুবিন। মানুষ ভালোর ভাগটাকে মনে রেখেছে। বাকিটার পরোয়া করছে না। আবেগের পারদ অবিশ্বাস্য মাত্রায় পৌঁছালেই কেবল তা সম্ভব।

গানের সুবাদে নামযশ কামিয়েছেন জুবিন গর্গ। আরো অনেকে তা কামিয়েছেন অতীতে, এবং এই মুহূর্তেও কামাচ্ছেন। তফাত কিছু দাঁড়াচ্ছে না তাতে। একজন শিল্পীর অকাল বিদায়কে কেন্দ্র করে মানুষের আবেগের যে-বিস্ফার আমরা দেখছি, এর থেকে বোঝা গেল,—সংগীতশিল্পীর পরিচয় তাঁকে জনপ্রিয়তা ও মান্যতা এনে দিলেও, একে ছাপিয়ে যাবে এমন এক পরিধি মাঝারে অবগাহন করেছিলেন মানুষটি। যেটি তাঁকে শিল্পী পরিচয়ের বাইরেও যুগ-যুগ ধরে জীবিত রাখার ঐশ্বর্যে মহিয়ান।

Sonar Baran Pakhi re tui – Zubeen Garg’s magic on covering folk tune; Source – Wave Music Assam YTC

উপমহাদেশে দূর ও নিকট অতীতে আপামর মানুষের প্রিয় অগণিত শিল্পীর প্রস্থান ঘটেছে। কে এল সায়গল, পঙ্কজকুমার মল্লিক, শচীন দেব বর্মণ, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তালাত মাহমুদ, লতা, সন্ধ্যা অথবা নূর জেহান… সকলে নমস্য সেখানে। জীবদ্দশায় মানুষের ভালোবাসা তাঁরা পেয়েছেন। মরণের পরেও মানুষ তাঁদের মনে রেখেছে। তাঁরা ছিলেন; তাঁরা আছেন; এবং আগামীতেও থাকবেন যথারীতি। জুবিন গর্গ আগামীতে কীভাবে থাকবেন তা বলে দেবে সময়। চোখে চশমা এঁটে আমরা সেই তদন্তে নাই-বা নামলাম আপাতত। দ্রষ্টব্য হলো জুবিন নামের মানুষটি,—গোটা ভারতবর্ষ, আরো নির্দিষ্ট করে বললে আসাম নামক জনপদের আবেগকে একলা দখলে নিয়েছেন। দখলের মাত্রা এতটাই প্রবল,—মাইকেল জ্যাকসন, আফ্রোবিটের জনক ফেলা কুটি আর আরববিশ্বে গানের কোকিল নামে বিদিত উম্মে কুলসুমকে তা মনে করাচ্ছে!

সুশৃঙ্খল জীবন জুবিনের ছিল না। অনিয়ন্ত্রিত ছিল চলাফেরাও। রাজনীতির ধার ধারেননি কখনো। সুবিধা নেওয়ার জন্য কম্প্রোমাইজ তাঁকে করতে হয়নি। ভূপেন হাজারিকার মতো প্রবাদপ্রতিম মানুষ বাম-রাজনীতির স্ট্রেস নিতে না পেরে শেষতক নিরাশায় পতিত হয়েছিলেন। বিজেপিতে নাম লেখানোর এটি হয়তো কারণ ছিল শিল্পীর!

জুবিন গর্গের ক্যারিয়ারগ্রাফে বিজেপি, কংগ্রেস, বাম দল নামধারী কিছুর অস্তিত্ব আমরা পাচ্ছি না। তা পাচ্ছি না ঠিক আছে, কিন্তু দেশের হালচাল বোঝার মতো প্রখর কাণ্ডজ্ঞান সেখানে ঠিকই উঁকি মারতে দেখছি। বিশ্বাস ও আবেগের জায়গা থেকে নিজেকে সংবেদী বাম ঘরানার মানুষ বলে অনেকসময় পরিচয় দিয়েছেন। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেও ভারতবর্ষে হিন্দুত্ববাদের উত্থানকে কড়া ভাষায় ঝাড়তে পিছপা হননি শিল্পী। আসামে হিন্দু-মুসলমান, আর আসামি ও বাঙালির মধ্যে বিভাজনের বিরুদ্ধে হামেশা কথা বলে গেছেন। সংকীর্ণতায় অন্ধকার যুগে কেবল এসব কথা বলার জন্য একদল লোকের গালিগালাজ আর মানুষের অপছন্দের পাত্রে পরিণত হওয়ার কথা তাঁর, বাস্তবে তার কিছুই ঘটেনি। জুবিনের সোজাসাপটা সমালোচনার মধ্যে এমন এক সততা সবসময় ঠিকরে বেরিয়েছে,—একে সম্মান দিতে মানুষ কৃপণতা করেনি কখনো।

ধর্মকে পছন্দ করতেন কি জুবিন? হয়তো না। কোনো ধর্ম তিনি মানেন না;—কথাটি অনেকবার বলেছেন। একটি মানুষ সংকীর্ণতা ও বিভাজনে অন্ধকার মঞ্চে দাঁড়িয়ে অবলীলায় বলে দিচ্ছেন : আমার কোনো জাতি নাই। কোনো ধর্ম নাই। কোনো ভগবান নাই। আমি বহতা পানি;—আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা। মানুষ তা গ্রহণ করছেন। তার মানে, মানুষটির মধ্যে সেই কেমিস্ট্রি সহজাত ছিল, যেটি আপামর সাধারণকে অবলীলায় কাছে টানার ক্ষমতায় গরীয়ান। তা-বলে ধর্মের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে অপছন্দ করতেন, সে-কথা বলার জো নেই। তাঁর কাছে সবটাই ছিল সাংস্কৃতিক উৎসারণ।

The real Zubeen; Image Source – Collected- Google Image

জন্মমাটি আসামকে ভালোবাসতেন। যে-কারণে বলিউডে সেট ক্যারিয়ার গড়ে তোলার হাতছানি হেলায় পায়ে ঠেলে আসাম ও বাংলাকে আপন করেছিলেন জুবিন। সেখানে আবার সংকীর্ণতার নামগন্ধ পাচ্ছি না। আসামি, বাঙালি, সিলেটি… সকল পরিচয়ের মানুষের সঙ্গে তাঁর সংযোগ থেকেছে সহজাত। টাকা ও ক্ষমতায় দাপুটের দলবল নয়,—পাড়ার ছেলের মতো সাধারণের সঙ্গে মিশতেন তিনি। বড়ো তারকার পরিচয় সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি একদম। চা-দোকানি থেকে রাস্তার পাগল,—সকলের কাছে তাঁর একটাই পরিচয়,—তিনি জুবিন, তাদের ঘরের ছেলে। এই জুবিনের বাড়িতে অবাধে প্রবেশ করা যায়। কাজে-অকাজে যখন-তখন ডাকলে সাড়া দেয়। বিপদে পড়লে বল ও ভরসা করতে দুবার ভাবতে হয় না। গৌহাটি, শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি আর শিলংয়ে কোনো তফাত রাখেননি জুবিন। সবটাই তাঁর একলার মাটি, এবং সেখানে তিনি পা রাখছেন স্বচ্ছন্দে।

ভূপেন হাজারিকা, প্রতিমা বড়ুয়া অথবা কালিকাপ্রসাদকে যখন বুকে ধরছেন, নিজেকে আধা বাঙলি ও আধা আসামি বলে চিনিয়ে দিচ্ছেন; বলিউড কপি করে কিন্তু বাংলা ও আসাম কপি করে না বলে অবলীলায় উড়িয়ে দিচ্ছেন বলিউডকে;—এর কোথাও পাচ্ছি না লোকদেখানো ভান কিংবা স্টান্ট। বিশ্বাস ও আন্তরিকতায় বোনা স্থানিকতা সেখানে ছলকে উঠছে ফিরে-ফিরে।

জনহিতকর কাজ সেলিব্রেটিরা এমনিতেও করেন। জুবিনও করেছেন। কোনো এজেন্ডা মাথায় না নিয়ে করেছেন। তাঁর মন চেয়েছে, তাই করেছেন;—মামলা সেখানেই খতম। এখন, এর বেনিফিট হিন্দু না মুসলমান পেল, নাকি আসামি বা বাঙালির তাতে লাভ হলো, এসবে থোড়াই কেয়ার করেছেন।

এমন এক লোকাল হিরো হতে চেয়েছেন জুবিন, যার বিদায়ে মানুষ কাঁদবে। বাস্তবে সেটি দেখছি আমরা। গোটা আসাম বাঁধভাঙা আবেগে ভেঙে পড়েছে। যেখানে ঘরের ছেলের এভাবে চলে যাওয়া মানুষকে ভীষণ পোড়াচ্ছে। মেনে নিতে পারছে না এই অকাল প্রস্থান! সবমিলিয়ে এই-যে একটা ক্যারেক্টার আমরা পাচ্ছি, সেটি তাঁর শিল্পী পরিচয়কে ছাপিয়ে বড়ো হয়ে গিয়েছিল। সংগতকারণে শেষযাত্রায় লোকে লোকারণ্য রাজপথ। পনেরো-বিশ লাখ মানুষ সার দিয়ে মরদেহ নিয়ে যাচ্ছেন শ্মশানে। বয়সের বালাই সেখানে নেই। হিন্দু, মুসলমান, আসামি, বাঙালি, সিলেটির নেই চিন্। শেষযাত্রায় সবাই শামিল। মাদ্রাসার হুজুর ও ছাত্ররা আবেগে টলমল। নিয়মের নজরিবিহীন ব্যতিক্রম ঘটিয়ে মাদ্রাসায় বাজানো হচ্ছে জুবিনের গান। চলছে দোয়া ও স্মরণ। জুবিনের ফটো সামনে রেখে কোরানপাঠে মগ্ন ভক্ত। কান্নায় ভেঙে পড়ছেন আবালবৃদ্ধবণিতা!

Mon moor rossona – Zubeen Garg’s magic on covering folk tune; Source – AbuFx YTC

বাংলাদেশে এই দৃশ্যটি এখন অকল্পনীয়। অতীতেও অকল্পনীয় ছিল অবশ্য! সাবিনা ইয়াসমিনকে দেখলাম, পড়ন্ত বয়সে এসে বলছেন : শিল্পীরা এখানে কোনোদিন সম্মানের পাত্র ছিলেন না। তাই বটে! সন্‌জীদা খাতুন ও ফরিদা পারভীনের বিদায়যাত্রা তো দেখলাম নিজ চোখে। মরেও শান্তি নেই! আইয়ুব বাচ্চু চলে যাওয়ার পর হাহাকার ছিল, সেখানেও বেহেশত দোজখের কত না হিসাব-কিতাব! আসামে, বোঝা গেল সালাফিরা এখনো গেড়ে বসতে পারেনি অতটা। এখনো সেখানে, এমনকি সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজে ‘মানুষটা বড়ো দিলদার আর ভালো আছিলা’,—এই অভিব্যক্তি বড়ো হতে দেখছি। জুবিন তাঁর গানের সীমানা ছাড়িয়ে এখানে এসে ম্যামথে পরিণত হয়েছেন। এই অর্জন অনেক বড়ো গুণীর ভাগেও জোটে না।

মিথ অবিরত তৈরি হয় আমাদের চারপাশে;—জোসেফ ক্যাম্পবেলের কথাটি নির্মম সত্য! জুবিন গর্গকে দেখে তা আবার টের পেলাম আমরা। কামরূপ কামাখ্যার দেশে তিনি একচ্ছত্র জাদুকর! মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে যাওয়ার শক্তি তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল। এই শক্তি আজ আর কোনো পলিটিশিয়ানের নেই। ফিল্মস্টারের নেই। ধর্মগুরুর নেই। কবি-লেখক-বিজ্ঞানী অথবা জায়ান্ট সাইজ ভাবুক বুদ্ধিজীবীর প্রশ্নই আসছে না। অথচ জুবিন কাভি ইলেকশনে দাঁড়ানোর কথা ভাবেননি। আপাদমস্তক সুরে নিমজ্জিত সহজ মানুষ। একালে বিরল! ভীষণ বিরল! চোখে জল আনার মতো, অন্তরের অন্তরস্থল থেকে দ্রবীভূত হওয়ার মতো বিরল!

এই জুবিন জীবদ্দশায় ফকিরির ভাও রপ্ত করেছিলেন। দূর ভবিষ্যতে সকল পরিচয় ছাপিয়ে ওই সন্ত-ফকির-দরবেশ রূপে মানুষ তাঁকে স্মরণ করবে ফিরেফিরে। মিথ এভাবেই তৈরি হয়, এমনকি সংকীর্ণতা ও বিভাজনের অন্ধকূপে নিমজ্জিত একুশ শতকেও!
. . .

The real power of Zubeen; Source – sohail Khan YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 62

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *