বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের ভাষা নাচের মুদ্রায় ফুটিয়ে তোলা ডান্স কোরিওগ্রাফি দেশ-এর সুবাদে আকরাম খানের নাম প্রথম জানতে পারি। জন্ম ও বেড়ে ওঠার চক্করে তিনি ব্রিটেনের বাসিন্দা। বাবা-মা যদিও অভিবাসী ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে সম্ভবত লন্ডনে পাড়ি জমান তাঁরা। নাচের ভাষায় পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য সংস্কৃতির মিলন মোহনা রচনায় সাবলীল আকরাম খানের বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভের ঘটনা নতুন নেই আর। আধুনিক নৃত্যঘরানায় অন্যতম পথিকৃতের বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য তাঁকে লম্বা সময় অপেক্ষাও করতে হয়নি।

ভারতীয় নৃত্যশৈলীর মধ্যে কত্থককে তাঁর বনেদ বিবেচনা করা হলেও, পাশ্চাত্য ঘরানায়ও সমান স্বচ্ছন্দ এই গুণী। তাঁর পরিবেশনায় ভারতীয় নৃত্যকলার প্রাধান্য থাকে বটে, তবে এ-পর্যন্ত করা কাজগুলোকে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে ফেলে গড় করা কঠিন। কত্থক, ব্যালে, ডিস্কো, ব্র্যাক ডান্স থেকে আরম্ভ করে বিচিত্র মুদ্রার সংমিশ্রণে এক-একটি পরিবেশনার বয়নকৌশল গড়ে ওঠে।
আকরাম খানের বিষয়-ভাবনায় থাকে নুতনত্ব ও সমকালীনতা। ব্রিটেনের প্রখ্যাত ব্যালে নাচের দল ইংলিশ ন্যাশনাল ব্যালের হয়ে গিসলে করেছিলেন তিনি। ব্যালের ধ্রুপদি শৈলীর মধ্যে সময়-সমকালকে এমনভাবে মিশিয়েছেন সেখানে,—এর আবেদন মনে নিজ থেকে সম্মোহন জাগায়। গিসলেকে সায়েব-মেমরা তাঁর মাস্টারপিস ভাবতে ভালোবাসেন। অনলাইনে অবশ্য এর ট্রেলার ও রিভিউ ছাড়া বাকিটা সুলভ নয়।
আকরাম খানের বৈচিত্র্যমুখী পরিবেশনার মধ্যে আনটিল দ্য লায়নস অন্যতম। মহাভারতের প্রতিধ্বনি নাচে তুলে আনতে অম্বাকে বেছে নিয়েছিলেন সেখানে। কুরক্ষেত্রের মহারণে অম্বাকে আমরা ভীষ্মবধের কাণ্ডারি শিখণ্ডী রূপে পাই। কুরু-পাণ্ডবকুলের পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। অবিবাহিত থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভীষ্ম তাকে প্রত্যাখ্যান করেন।। নিজের কুমারীত্বকে এভাবে অপমান করায় ক্ষুব্ধ অম্বা শপথ নেন প্রতিশোধের। আনটিল দ্য লায়নস-এর পরিবেশনায় মহাভারতের নাটকীয় এই কাহিনিকে অন্যমাত্রা দান করেছেন শিল্পী।
স্মরণ রাখা চাই, রাজবংশ রক্ষার দায়ে পড়ে অবিবাহিত থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভীষ্ম স্বয়ম্বর সভায় কাশীরাজের তিন কন্যাকে অপহরণ করেন। মনে-মনে ভেবেছিলেন,—সৎভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে অম্বার বিয়ে দিয়ে বংশরক্ষা করাবেন। অম্বা বলে দিলেন,—শাল্বরাজকে তিনি পতি হিসেবে ভাবেন। বিচিত্রবীর্য বিমুখ হলেন তা শুনে। নীতিনিষ্ঠ ভীষ্ম অগত্যা শাল্বের কাছে অম্বাকে পাঠালেন। এখন, স্বয়ম্বর সভায় শাল্ব তো অম্বাকে অপহরণ করে জয় করতে পারেনি;—ভীষ্ম তাকে জিতে এনেছেন। শাল্বের কাছে অম্বাকে গ্রহণ করা মানে পৌরুষের অপমান। তাকে তিনি ফিরিয়ে দিলেন সত্বর!
নিরুপায় অম্বা তখন ভীষ্মের দীক্ষাগুরু পরশুরামকে এর একটি বিহিত করতে অনুরোধ করেন। ভীষ্মকে তথাপি টলানো যায়নি! তাঁকে রাজি করাতে স্বয়ং লড়াইয়ের নামেন পরশুরাম। লড়াইয়ে গুরু-শিষ্য দুজনেই থাকলেন অজেয়। হারজিতের কিছু সুরাহা হলো না তাতে। মহাদেব শিব মাঝখানে পরে যুদ্ধ থামিয়ে অম্বাকে বর দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তখন। আকরাম খানের কোরিওগ্রাফি এই ক্লাইম্যাক্সকে মাথায় নিয়ে মঞ্চে মুগ্ধতা ছড়াতে ত্রুটি রাখেনি।
শিবের তপস্যায় অম্বা বর পেলেন,—পরজন্মে তিনি ক্লীব হয়ে দ্রৌপদ রাজার ঘরে জন্ম নেবেন। কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধে ভীষ্মের পতন তার হাতেই ঘনাবে। পরজন্ম সূত্রে দ্রৌপদ রাজার ছোট মেয়ে দ্রৌপদীর বড়ো বোন হয়ে জন্ম নিলেন নপুংসক শিখণ্ডী। আগের জন্মে নারীত্বের সুখ পাননি। এই জন্মে না-নারী না-পুরুষ রূপে তাকে জন্ম নিতে হলো! অম্বাজন্মের এই জটিলতা ও নেপথ্যে সক্রিয় সংক্ষোভকে আকরাম খানের পরিবেশনা নিপুণভাবে গেঁথেছে মঞ্চে।
মহাভারতের অগণিত অভাবনীয় চরিত্রের মিছিলে শিখণ্ডীর অপূর্বতা বলে বোঝানোর নয়। আকরাম খানের পরিবেশনা সেটি আঁচ করতে ভীষণ সাহায্য করে। ম্যাগনিফিসেন্ট পিস অব ডান্সিং। ইংরেজি এই পরিবেশনায় ক্যাথরিন হান্টারের কণ্ঠস্বর সংযোজন ছিল আরেক বিস্ময়! শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে!
ভার্টিক্যাল রোড, জিরো ডিগ্রি, কাশ, জেনোস, জাঙ্গল বুক, আনটিল দ্য লায়নস-এর ডান্স কোরিওগ্রাফিতে আমরা বৈচিত্র্যময় এক নৃত্যশিল্পীকে পাই। পুব-পশ্চিম যেখানে পরস্পরের মধ্যে লীন হয়ে তৈরি করছে সারার্থ। বড়ো ব্যাপার হলো,—শিকড় সন্ধানের প্রশ্নে আকরাম খান অনুসন্ধিৎসু ও মরমি। দেশ-এর পরিবেশনায় যেটি ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। দেশ-এর খুদে সংস্করণ (Miniscule Version) ছোট দেশও এদিক দিয়ে চমৎকার।
বাংলাদেশকে আকরাম খান চিনেছেন বাবা-মা আর যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশী সমাজকে নজরে আনার মধ্য দিয়ে। ভারত উপমাদেশের সঙ্গে নিবিড় এই শিল্পী কত্থক, কথাকলি, ভারতনাট্যম থেকে আরম্ভ করে লোকনাচের ফর্মগুলো নিয়ে উৎসুক থাকায় তাঁর পরিবেশনা হয়ে ওঠে জীবন্ত ও ভিশনারি।
আকরাম খান কোম্পানির হয়ে সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়ানো শিল্পীর কাজ নিয়ে ডাইনোসর গণমাধ্যমরা হামেশা খবর ছাপে। এর বড়ো কারণ সম্ভবত তাঁর নতুনত্ব ও আন্তর্জাতিকতা। দ্য গার্ডিয়ান-এর তাঁকে নিয়ে করা গাদা-গাদা প্রতিবেদনের মধ্যে একটির শিরোনাম এখানে আমরা ইয়াদ করতে পারি। আধুনিক ডান্স কোরিওগ্রাফিতে আকরাম খানের গুরুত্ব ও বিশেষত্ব শিরোনামটি পরিষ্কার তোলে ধরে। দ্য গার্ডিয়ান সেখানে তাঁকে the master mover who redefined dance হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। ভারতীয় নৃত্যশৈলীকে উদয়শঙ্করের পর আর কেউ এতটা বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন বলে আমার জানা নেই।
আকরাম খানের কাজের পরিধি ব্যাপক। নিতিন সাহনির মতো নামকরা সংগীতকারের সঙ্গে তাঁর কোলাবোরেশন অনেকদিনের। হলিউড-বলিউডও তাঁকে হায়ার করে। গিগিনস-এর পরিবেশনায় যেমন ভারতীয় নৃত্যশৈলীকে নিয়ে গেছেন পৃথক উচ্চতায়। সব মিলিয়ে অ্যা ভার্সাটাইল আর্টিস্ট। জিনিয়াস তো বটেই!
শিকড় ও শিকড়াতীত বিশ্বতরঙ্গে পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব আকরাম খানের সৃষ্টিযাত্রা সর্বশেষ পরিবেশনা জেনোস দিয়ে বিরতি টেনেছে। মঞ্চে তিনি যে-মাত্রায় পারফর্ম করেন, সেখানে অ্যানার্জি অনেক বড়ো ফ্যাক্টর। সংগতকারণে দেশে-দেশে লাগাতার পেশাদার পরিবেশনায় বিরতি টেনেছেন শিল্পী। নির্দেশনা ও অন্যান্য কাজে নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন সম্ভবত। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সংযোগকে আমরা অবশ্য আজ পর্যন্ত কাজে লাগাতে ব্যর্থ। দেশে তাঁকে অনেকে চেনেন, তাঁকে নিয়ে খবর ও প্রতিবেদন চোখে পড়েনি এমন নয়, কিন্তু তাঁর থেকে শেখা ও তাঁকে ব্যবহারের ঘটনা আমার জানা নেই।
আমাদের কাছে আকরাম খান বিশিষ্ট মূলত দেশ-এর কোরিওগ্রাফির জন্য। প্রায় সাত-আট বছর আগে এই পরিবেশনায় আমরা এমন এক শিল্পীকে পাচ্ছি,—বাংলাদেশের সংক্ষুব্ধ যাতনা ও লড়াইয়ে যিনি মিশিয়ে দিচ্ছেন শিকড়ের প্রতি দরদ ও টান। অনেকদিন পর দেশ দেখতে বসে মনে হলো,—প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে দেশকে স্বেচ্ছায় তুলে দিতে থাকা আমাদের মতো মেরুদণ্ডহীন হতভাগার জন্য আকরাম খানের এই পরিবেশনা এখন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক।
. . .
. . .



