
. . .
চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। কে যেন চলে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি নিয়ে লিখেছিল—‘আমাকেও মনে রেখো।’ জীবনের মধুর ভুলগুলোও ভুলে যাবে—কী মধুর যাতনায় ভুলগুলো হয়েছিল! ভাঙা আয়না দেখে দেখে পথ চলেছি। কিছুই দেখা হয়নি মনমতো। তাকিয়েছি কারো কারো দিকে ফুল তুলতে গিয়ে, কিন্তু মালা গাঁথার সময় কাউকেই ভালো করে দেখার আগ্রহ জাগেনি।
একদিন হিমালয়ে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গেলে, হঠাৎ হাফিজ মাহমুদ এসে বলে, জীবনানন্দের নামে একটা নির্জন চাঁদ উঠেছে আকাশে দেখবি নাকি?
এরকম, মক্কায় কালো পাথরে চুমু দেওয়ার সময় হাফিজকে সাথে নিয়ে গেছি—সে হঠাৎ বলে, চারদিক থেকে মুতের গন্ধ আসছে কেন বল তো?
ঠিকঠাক কোথাও যাওয়া হয়নি, আনমনা মনের বন্ধু হয়েছি বলে।
কিশোর বেলায় ফজরের নামাজ ফাঁকি দিয়ে কেন বকুল ফুল কুড়াতে যেতাম বহুদূর—সেই রহস্য আজো মীমাংসা হয়নি…ঘর বলতে সারাজীবন উঠোন বুঝেছি—তা না হলে কারাগার!
জীবনানন্দ কি শেষের দিকে একটু জায়গা কিনতে চেয়েছিলেন, একটুকরো রোদে পূর্ণ উঠোনের জন্য?
কোনো একসময় স্বাভাবিক স্বাধীনতাটুকুও পাইনি বলে চারপাশের সকলের ওপর, সবকিছুর ওপর খুব রাগ হতো—এখন চল্লিশ পেরিয়ে মনে হয় স্বাধীনতা আকাশের মতো আকর্ষণীয় একধরনের মরীচিকা—সুন্দর, অভাবনীয় স্বপ্নের মতো…

. . .
আর দেখা হবে না। সময় নেই। উঠোনের রোদ ক্রমশ ম্রিয়মাণ… সূর্যের কথা বলছি না—সে তার নিজের নিয়মের কথা বলুক,—বালকবেলায় ঘুমায় যারা সারা জীবন। আমি অন্য নিয়মের প্রাণ… সকল নক্ষত্রের ফিসফিসানি টের পাই ফড়িঙের উড়ে যাওয়ার ধ্বনিতে।
ভোরে, রোদমাখা উঠোনে বসে যাদেরকে বলেছিলাম আবার দেখা হবে—তারা সব এক-একটা পাখির ডানা হয়ে গেছে অনেক আগেই। নতুন আঙিনা নেই, কথা দেওয়াও আর হবে না…
গুনগুন করে মানুষের প্লেটে সাজিয়ে দেই সালমন মাছের স্বাদ—অনেকেই টের পায় দূর দেশের কারো গুনগুনানি মিশে আছে প্লেটের আনাচকানাচে…। ভেবেছিলাম অন্ধসুন্দরী কোনো জীবনসঙ্গিনী পাবো রাতের তারাদের দিকে চেয়ে থাকার বেলায়—পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু গুনগুনিয়ে নিজেই নিজেকে শুনাতাম যে গান—তা থেমে গেছে কোনো অলৌকিক ইশারা ছাড়াই… জীবনে চমকে উঠেছিলাম যখন,—তখন মানুষ কাকে বলে জানতাম না, আর যখন মায়াবী পর্দা দুলে উঠল, তখন দরোজার ওপাশের সকল চমক মায়ের সমাধির মতো হয়ে গেল অচেনা…
হাওরে যতবার গিয়েছি, তা সূর্যাস্তের বেলায়। রাখাল ফিরে আসছে ঘরে। আমি একা অথই জলের হাওরে বসে আছি। দেখেও সে দেখছে না—সে জানে, উঠোনে অন্ধকার নেমে আসার আগে সবাইকে কোথাও না কোথাও ফিরতে হবে…
মনে রাখার মতো সত্যিই এখানে কিছু নেই—তবু যারা বলে—তারা শুধু জন্মমুহূর্ত থেকে সাথী হওয়া ভাঙা আয়নার কথাই বলে…

. . .
জীবন ঘঁষে বিপ্লবী হতে না চাইলেও এখানে সময় দিতে হয়েছে বন্ধু ফয়সাল হাবিবকে। সময় দিতে হয়েছে বাধ্য হয়ে অনবদমিত কামে, প্রেমে, মোহে…যখন বিখ্যাত ব্যাংকার হওয়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেলো, তখন একরাতে অজস্র মহিষ স্বপ্নে দেখে চমকে উঠল সে। মনে হলো, তার দাদার আমলের মহিষ এসব। তারা তাকে সে-রাতে কিছু একটা বলেছে।
তারপর থেকে অবিরত নিজের সাথে কথা বলে আনমনে—সব মহিষ বিষয়ক কথা। দেশে-বিদেশে যত আত্মীয় ছিলেন, সবাইকে বলেকয়ে একটা মহিষের খামার দিলো একদিন বন্ধু ফয়সাল হাবীব। সে আমাকেও সাথে নিয়ে যায় মাঝেমধ্যে, কাউয়াদিঘীর হাওরে তার খামারে মহিষদের আত্মীয় হতে।
আমি চুপচাপ চেয়ে থাকি নিষ্পলক মহিষদের চোখের দিকে—তারাও আমাকে দেখে পরম মমতায়। গভীর রাত। চারদিকে জলের নীরবতার পাশে বসে হঠাৎ বাঁশি হাতে নেয় ব্যাংকার ফয়সাল হাবিব। আমি চমকে উঠে দেখি আমাদেরকে ঘিরে আছে হাজার হাজার মহিষ… ভয়ে, বিস্ময়ে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। বন্ধুরে জিগাই—এতো মহিষ এখানে আসল কীভাবে! সে বাঁশি বাজানো থামিয়ে বলে—ওরা আশেপাশের বাথানেই থাকে। মাঝেমধ্যে আমাকে দেখতে আসে। বাঁশির সুর ওদের খুব পছন্দ।
আমি অনুভব করি কোথাও কিছু একটা বেড়াছেরা তৈরি হয়েছে বন্ধুর সত্তায়… সে আরো বিড়বিড় করে বলে—মার্ক্স, মুহাম্মদ, গৌতম বুদ্ধরা কী একসাথে হাজার হাজার মহিষ দেখেছেন জলে পূর্ণ কোনো দ্বীপে? তাদের নিষ্পলক, নির্মোহ চোখের দিকে কি কখনো গহীন অরণ্যের মতো ধ্যানমগ্নতা নিয়ে তাকিয়েছেন? তাকালে তাদের জীবনের গল্প নিশ্চিতভাবেই ভিন্ন হতো…
অন্ধকার রাত। ঠিক এই রাতের রংয়ের মতো অজস্র মহিষেরা আমাদেরকে ঘিরে আছে স্বচ্ছ জলের মতো মমতায়…

. . .
আগাছা কাটার জন্য যার হাতেই তুলে দিয়েছি তলোয়ার, সেই প্রথমে আমাকে আঘাত করেছে। জিদ করে যখন ভেঙে ফেলেছি তলোয়ার—তখনই তুমি এমন ভাব করলে, যেন তুমি আমাকে কোনোদিন কোথাও দেখোনি। আঘাত করার প্রয়োজনে তুমি জন্ম দাও আমায়—আমি তা অমান্য করে ফিরিয়ে দেই সহস্র কাঁটার মুকুট…
তীর ভাঙালেই আবার গড়ে তুলি অরণ্য—তুমি এসে ফেলে দাও বিষাক্ত রূপসীর বীজ। জল দেওয়ার নাম করে শুষে নাও অমরত্বের শিকড়-বাকড়।
এইসব দেখে দীর্ঘশ্বাস এলে, ঠোঁটের তিলে এঁকে দাও অযাচিত হাওয়া—আমার সবকিছুতেই তোমার শ্বাসরুদ্ধকর আসা যাওয়া…
তোমাকে খুঁজবো বলে হারাই বারে বারে—এই খেলা তুমিও জানো, তাই লুকিয়ে থাকো অনন্তের আড়ালে।
. . .

ইতালির মিলান শহরে কবি আহমেদ বেলালের ঘরামি এখন। আরবমরুর দেশে থেকেছেন অনেকদিন। মৌলভীবাজারে জন্ম ও সেখানকার জলমাটিহাওয়া শুষে কেটেছে যৌবন। কর্মসূত্রে প্রবাসী হলেও দেশের সঙ্গে অনুভব করেন নাড়ির যোগ। এখনো কোনো কবিতার বই প্রকাশিত হয়নি, তবে ফানার ভিন্নমাত্রিক কবিতারা যন্ত্রস্থ হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছে। প্রশ্ন করতে ও ভাবতে ভালোবাসেন। ভালোবাসেন কাফকা ও জীবনানন্দ। তাঁদের মতোই অন্তর্মগ্ন নির্জনতায় নিজের সত্তা ও অস্তিত্বের সারার্থটি ধরতে চান কবিতায় ও যাপনে।
. . .



