নেটালাপ - পোস্ট শোকেস

কণাআখ্যানে বৃহতের বিস্তার

Reading time 7 minute
5
(58)
@thirdlanespace.com

. . .

ঘুম ভেঙে জেগে দেখি—
এখনও রাত পোহায়নি

দুলাইনে নিহিত বার্তাটি দূরপ্রসারী। কণাকবিতায় ফ্ল্যাশ ফিকশন বা কণাআখ্যানের আভাস অবশ্য নতুন ঘটনা নয়। বাংলা ভাষায় ছোটগল্প বলতে আমরা যা বুঝে থাকি, তার সঙ্গে (আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায়) এর পার্থক্য রয়েছে। ছোটগল্পের অতি ক্ষুদ্র পরিসরকে আমরা সাধারণত অনুগল্প/ অণুগল্প বলে বুঝে নেই। কণাআখ্যান সেরকম বস্তু নয়। এক-দুই লাইনে লেখেন অথবা অনুচ্ছেদ জুড়ে দিয়ে লেখেন,—আখ্যানে বিস্তারিত হওয়ার আভাস, ঘনঘটা ও পরিসর যদি সেখানে পাওয়া যায়, তাহলে একে ফ্ল্যাশ ফিকশন বা কণাআখ্যান ভাবা যায় বলে আমি ধারণা করি। আপনার দুচরণের পঙক্তিরের মধ্যে সেই রসাভাস মিলছে বেশ!

কণাআখ্যান বলতে কী বোঝাচ্ছি সেটি ধরিয়ে দিতে একখানা উদাহরণ টানি বরং। গুগল মামাকে টোকা দিলে দেখবেন,—ভুবনবিখ্যাত কথাশিল্পী আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একলাইনের একটি বাক্য তিনি হাজির করছেন ঝটপট। For sale: baby shoes, never worn.হেমিংওয়ের এই বাক্যটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে খুদে গল্প ভাবা হয়। বিজ্ঞাপনের আদলে লেখা বাক্যে লেখক বাচ্চাদের জুতো বিক্রি হওয়ার খবর দিচ্ছেন;—যেটি কিনা এখনো কারো পায়ে ওঠেনি!

খুদে বাক্যটির আড়ালে হাসি-ক্রন্দন ও পরিহাসে ভারাতুর অনেকানেক কাহিনি আন্দাজ করা সম্ভব; যেখান থেকে আবার ছোটগল্প কিংবা আস্ত আখ্যান রচনা করে ওঠা নয় সুকঠিন। এখন, ছোটগল্প কেমন হতে পারে তার ধারণা সোনার তরী কবিতায় রবি ঠাকুর দিয়েছিলেন। ঠাকুর সেখানে বলছেন :

ইচ্ছা করে অবিরত   আপনার মনোমত
গল্প লিখি একেকটি করে’।
ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা
নিতান্তই সহজ সরল;
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দুচারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি র’বে সাঙ্গ করি’ মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।

রবি ঠাকুরের সংজ্ঞার ভিতরে কণাআখ্যানের সারবস্তু কিছু ধরা আছে। তাঁর দেওয়া সংজ্ঞার জগতে বসে এন্তার গল্প লেখা হয়েছে একসময়; আবার সংজ্ঞার বাইরে সৃষ্ট গল্পের নেই অভাব। আখ্যানের সঙ্গে পার্থক্য বোঝানোর খাতিরে ঠাকুরের কাব্য করে বলা সংজ্ঞাকে অনেকে তাই এখনো আমলে নিয়ে থাকেন।

Flash Fiction by Ernest Hemingway; Image Source – Pinterest

কণাআখ্যানের চরিত্র বুঝতে রবি ঠাকুরের সংজ্ঞা নেহায়েত নয় মন্দ। একচিলতে খুদে বাক্যের মধ্যে বিচিত্র আয়তন ও পরিসরের কাহিনি গড়ে ওঠার আভাস দিতে পারাকে কণাআখ্যান তার সার্থকতা ধরে নেয়। অর্থাৎ, এক-দুই লাইন বা নাতিদীর্ঘ অনুচ্ছেদে মর্মরিত বার্তায় গল্প ও উপন্যাস ফাঁদার সম্ভাবনা জাগিয়ে সে থেমে পড়ে, আর আগায় না তার চাকা।

For sale: baby shoes, never worn. বাক্যটির সারবস্তু ব্যবহার করে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কি দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি, ফেয়ারওয়েল টু আর্মস কিংবা অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়ের্স্টান ফ্রন্ট লিখতে পারতেন না? পারতেন জরুর; কিন্তু লেখেননি। দরকার নেই ভেবে লেখেননি।

তিনি হয়তো ভেবেছেন,—বাক্যটি এমন এক কাহিনির আভাস এখানে জাগিয়ে তুলেছে, তাকে এখন পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলে ক্ষতি নেই। জুতোর দোকানে ঝোলানো বিক্রির অপেক্ষায় থাকা বাচ্চাদের জুতো বিষয়ক বিজ্ঞাপন দেখার অভিজ্ঞতা সকলের কমবেশি রয়েছে। সুতরাং এখান থেকে প্রত্যেকে নিজের মতো করে গল্প বানিয়ে নিতে পারছে। তিনি না-হয় নাই বললেন তাঁর গল্পখানা। এই-যে লিংক ধরিয়ে দিয়ে সরে পড়া,—ফ্ল্যাশ ফিকশন বা কণাআখ্যান তার বেশি কিছু হতে চায় না কখনো।

ফ্ল্যাশ ফিকশনের এটি হলো একমাত্র কাজ। জাপানি হাইকু কবিতার মতো আভাস ও বার্তা সে রেখে যায় কেবল;—তার অধিক অগ্রসর হয় না কখনো। মানুষের কল্পনা ও সৃজনশক্তিকে উসকে দেওয়ার বাইরে আর কোনো দায় সে মিটাতে রাজি নয়।

হেমিংওয়ের একলাইনের কণাগল্প থেকে বিচিত্র অর্থ ও শিল্প নিষ্কাশন আসলে কোনো ব্যাপার না! তার একখান নমুনা আফোনসো হেনরিক নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে ধরা পড়ছে। ছবিতে ওইসব মায়ের গল্প বলার চেষ্টা করেছেন নির্মাতা, যাঁরা গর্ভ ধারণের পর মৃত শিশু সন্তান প্রসব করেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় স্টিলবার্থ বেবি বলে যাদেরেক গণ্য করা হয়। গর্ভে ঘুরতে থাকা অবস্থায় শিশুটি মারা যেতে পারে। প্রসব জটিলতার কারণে মারা যায়। মায়ের গর্ভে থাকার সময় মল গিলে ফেলার জটিলতা থেকেও মারা যেতে পারে। স্টিল বার্থের এরকম আরো কারণ রয়েছে বটে!

গর্ভে আসার পর তাকে নিয়ে কত স্বপ্ন বুনতে থাকেন মা। তার জন্য কাপড় কেনেন। মায়ের গর্ভজলে উচ্চ তাপমাত্রায় মোড়ানো পরিবেশে সে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে। ভ্রূণ থেকে ক্রমশ পূর্ণাঙ্গ প্রাণে রূপ নিতে থাকে। সময় যত ঘনিয়ে আসে ধরায় নামার,—মায়ের পেটে লাথি ছুড়ে জানান দিতে থাকে,—আই অ্যাম কামিং। গড়ে আট-দশবার করে লাথি ছুড়ে তখন। ইংরেজিতে বলে বেবি’জ কিক। এটি লক্ষণ, তার সুস্থ-সবল থাকার। লাথি না ছুড়লে গতিক নয় ভালো।

মায়ের গর্ভ তার সুরক্ষাখানা। রোগবালাই থেকে থাকে সুরক্ষিত। ধরায় আসার পর যে-তাপমাত্রার সংস্পর্শে তাকে আসতে হবে, সেটি তার জন্য অতিশয় হিম। সুতরাং মা কাঁথা বানিয়ে রাখেন। পশমি ওলের সোয়েটার ও টুপি; তার সঙ্গে জুতোও থাকে! Baby Shoes!

সব বৃথা করে মায়ের গর্ভে তার জন্ম ও মরণ ঘটেছে। কবি আবুল হাসানের ইচ্ছা সার্থক করতে ধরায় নামেনি আর! জুতো এখন মা কাকে পরাবেন? এই জিজ্ঞাসার আড়ালে লুকিয়ে থাকছে বেদনায় ভারাতুর কাহিনি। শিল্প এভাবে জন্ম নেয়। হেমিংওয়ে একলাইনে যা বলে গেলেন, তাকে এখন অন্যলাইনে গমন করে পাঠ করছেন ছবিনির্মাতা।

Dinosaur: Augusto Monterroso’s Flash Fiction; Image Source – Collage from Google Iamge

আরেকখানা উদাহরণ গুগল, চ্যাট জিপিটি বা পারপ্লেক্সিটিকে পুছতাছ করলে বেরিয়ে আসে। এনারা আমাদের কাছে প্রায় অপরিচিত এক লাতিন লেখকের নাম নেবেন সেখানে। গুয়াতেমালায় বেড়ে ওঠা লেখকের নাম ছিল অগাস্তো মন্টেরোসো। আমাদের এখানে পরিচিত বলে মনে হয় না, তবে সমগ্র লাতিনবিশ্বের লেখক-পাঠকরা তাঁকে ভালোই চেনেন। জনাব অগাস্তো মন্টেরোসো ডাইনোসরকে শিরোনামবিন্দ করে বিরচিত কণাগল্প সমগ্রে সংকলিত একখান কণাগল্পে মাত্র একলাইন খর্চায় একটি বাক্য লিখেছিলেন : When he awoke, the dinosaur was still there.

কোনো এক বান্দার আলাপ লেখক সেখানে তুলছেন। ঘুম থেকে জেগে ওঠে সেই বেচারা দেখে,—ডাইনোসর মহাশয় দিব্যি বিরাজ করছেন এখনো! তিনি কী-কারণে ও কীভাবে বিরাজ করছেন, তার কোনো যোগসূত্র বা আভাস বাক্যে নেই। জাস্ট একজন মানু আর ডাইনোসরকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে মামলা ফিনিশ করেছেন স্প্যানিশভাষী এই লেখক।

এখন, ডাইনোসর ও মানুষের টাইমলাইন এক হওয়ার কথা নয়। সরীসৃপ দানবরা যে-সময় পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখন মনুষ্য দূরে থাক, কীটস্য কীটগণ মাথা তোলার সাহস পায়নি। জীববিবর্তন যেন থমকেছিল কোটি-কোটি বছর! যে মাথা তুলতে গেছে—তাকে লহমায় সাবাড় করেছেন তেনারা। এরকম ভয়ানক প্রাণকে এখন মানব ভিড়ে সয়লাব ধরায় কী-কারণে লেখক জীবিত ভাবছেন,—তার হদিশ পাওয়ার নেই উপায়!

ফ্ল্যাশ ফিকশন এদিক থেকে এনকোডেড সিগন্যাল। সংকেত দিয়ে খালাস। সংকেতের রহস্যভেদ বাকিরা সেখানে এক-একজন শার্লক হোমস হওয়া ছাড়া গতি নেই। নিজের অনুমান ও কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে অগ্রসর হতে হয় পাঠককে। সুতরাং এর থেকে সৃষ্টি হতে পারে নতুন কবিতা, গল্প, এমনকি আস্ত কোনো আখ্যান।

একলাইনের এই বাক্যটি যে-কারণে অনেকের প্রিয় লেখক উমবার্তো একোকে চমকে দিয়েছিল! মন্টেরোসোর কলমের নিব দিয়ে বেরিয়ে আসা কণা সমতুল বাক্যটিকে জগৎবিখ্যাত গল্প-আখ্যানের রচিয়তা একো উপন্যাসের মর্যাদা দিতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। তাঁর মতে,—একটি মাত্র লাইনে সময়ের বৃহৎ পরিসরকে লেখক ধরিয়ে দিচ্ছেন;—যেখান থেকে ঢাউস উপন্যাস অনায়াসে নামানো সম্ভব।

এক-দুই লাইন থেকে কয়েক প্যারায় সীমিত এরকম সব রচনা একত্রে গেঁথে আস্ত একখানা কিতাব মন্টেরোসো রেখে গেছেন আমাদের জন্য। ডাইনোসরের রেফারেন্সটি এখানে সিগনিফিকেন্ট বৈকি! বিচিত্র কল্পনা সে মনে আভাসিত করে যায়। এগুলোকে সম্বল করে আস্ত গল্প বা থান ইটের মতো ভারী আখ্যান লিখে ফেলা তাই অবান্তর কিছু নয়।

Umberto Eco; Image Source – Google Image

ফ্ল্যাশ ফিকশনকে আমি যে-কারণে কণাআখ্যান ভাবতে পছন্দ করি। মাঝখানে কিছুদিন এর ভূত মাথায় চেপেছিল বেজায়। মন্টেরোসোর ডাইনোসর মাথায় ঘুরঘুর করে দেখে ঝটপট লিখেছিলাম একখানা কণাগল্প। জায়েদ আলী সম্পাদিত জিন্দাবাজার-এ সম্ভবত এটি ছেপে বের হয়েছিল। এখানে কোট করি তবু :

জানালা দিয়ে চমৎকার রোদ আসছিল! ঘুম থেকে জেগে দেখি, ডাইনোসর তার লম্বা গলা বাড়িয়ে আমায় দেখছে। রফিকও এভাবে সানজিদার দিকে তাকিয়ে থাকত। সানজিদা আমার পাশে শুয়ে… । হালকা নাক ডাকার আওয়াজ কানে আসছে। আমি তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে আনি : ‘এই, শুনছো? রফিক ফিরে এসেছে!’

কণাগল্পটির আড়ালে প্রেম, পরকীয়া, খুনোখুনি ও বিবিধ দৃষ্টিভ্রম বা মতিভ্রমের আভাস পাঠক ইচ্ছে করলে কল্পনা করতে পারছেন। সবগুলো একত্রে গেঁথে নিতে পারলে গল্প ও আখ্যান দাঁড় করানো নয় কঠিন। ডাইনোসরকে মেটাফোর রূপে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটি এখানে যিনি কাহিনিটি ভাবছেন,—তার ওপর নির্ভর করছে। রিয়েলেস্টিক না ম্যাজিক রিয়েলিস্টিক পন্থায় আগাবেন,—সেটি তাকেই ঠিক করে নিতে হবে। আরেকটি লিখেছিলাম এরকম :

দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা মহল্লাবাসী বুঝতে পারে,—জেগে ওঠার কোনো দরকার ছিল না তাদের;—দুঃস্বপ্ন এখানে এখনো চলছে।

পেছনে নিহিত বার্তা এই কণাগল্পে মোটের ওপর পরিষ্কার। স্থানকাল ও ঘটনাপ্রবাহের নিরিখে একে গল্প বা আখ্যানে বিস্তারিত করা যেতে পারে। বাংলাদেশকে পটভূমি করে নিলে কণাআখ্যানের বিস্তার হবে একরকম;—পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তকে ভেবে নিলে তা ভিন্ন চেহারা নিতে পারে। আপনার দুলাইনের কাব্যচরণও তাই। কণাগল্প কিংবা কণাআখ্যানে রূপদানের মতো কল্পনার রসদ দুলাইনে দবদব করছে। 

ফ্ল্যাশ ফিকশন ওরফে কণাআখ্যান এ-সমস্ত কারণে বেশ মজাদার এক খেলা। আমাদের এখানে উচ্চাঙ্গ সাহিত্যমারানি কবিলেখকের দল যদিও খেলাটেলা দুইচোখে দেখতে পারেন না। জগতের তামাম বিষয়ে তাঁরা ভীষণ সিরিয়াস থাকেন সবসময়। রামগড়ুরের ছানা এক-একজন! যারা এসব গল্পটল্প লিখতে চেষ্টা করে, কিংবা ধরুন, আলোকচিত্র বা চলচ্চিত্রের কোনো দৃশ্য থেকে গল্প টেনে বের করতে কল্পনাশক্তি খাটায়,—এখন সেগুলো এঁনাদের পছন্দ নয়। ফটোস্টোরি, কণাগল্প, কণাআখ্যান ইত্যাদি শুনলে নাখোশ বোধ করেন তাঁরা! এসব তাঁদের কাছে অতিশয় নাপাক জিনিস!

Sample of Flash Fiction; Image Source – Google Image

ব্যাখ্যায় যুক্তি থাকলেও ফটোস্টোরি বা ফ্ল্যাশ ফিকশনের ফিলোসফি তাঁরা একবর্ণও বোঝেন বলে মনে হয় না! নাকচ করার এহেন খাসলত একটি বাজে প্রথা ও সংস্কার ছাড়া কিছু নয়। সাহিত্যে বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার মানে এই নয়,—একটার সঙ্গে অন্যটাকে তুলনা করতে হবে। যে-লোক কণাগল্প বা কণাআখ্যানে মজেছে, সে এখানে গল্প-উপন্যাস রচনার স্বীকৃত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে কাজটি সারার চেষ্টা করে।

এসব সাহিত্যমারানির দলকে বোঝানো মুশকিল,—গল্প-উপন্যাস রচনার ধ্রুপদি শর্ত ও তরিকাকে অনুসরণের দায় কণাআখ্যানের নেই। বিষয়বস্তু, পটভূমি, কাহিনি ও চরিত্র চিত্রণকে সার্থক করতে সৃষ্ট ভাষা-বিবরণের দাস হওয়াটা কণাআখ্যান লিখতে থাকা ব্যক্তির মিশনে পড়ে না। তার উদ্দেশ্য ভিন্ন। কণা সমতুল বাক্যের আড়ালে সত্যিকার গল্প-আখ্যানের সম্ভাবনা জেগে ওঠার রেখা এঁকে দায়িত্ব খতম ভাবছে সে। কাজটি যদি ঠিকঠাক করতে পারে, সেখান থেকে পরে আস্ত গল্প বা আখ্যানের গাছ নামানোয় আটকাচ্ছে না কোথাও! সুতরাং, একে গল্প-আখ্যানের প্রতিপক্ষ ভাবার কিছু নেই।

গল্প-আখ্যান যদি নামানো সম্ভব না হয় পরে, তাতেও ক্ষতির কারণ দেখি না। পৃথক একটি প্রকরণ হিসেবে এর মূল্য ও আবেদন তাতে খারিজ হয়ে যাচ্ছে না। হাইকু পড়ে দেখেন। জাপানে এটি জেনসাধনার অঙ্গ হিসেবে কবিরা চর্চা করেছেন একসময়। সকলেই জেনসাধক ছিলেন মূলত। যেরকম, আমাদের এখানকার চর্যাপদের কবিগণকে বৌদ্ধসাধনপন্থী সন্ন্যাসী বলে আমরা জেনেছি ক্রমশ। হাইকু ও চর্যা এদিক থেকে মেডিটেশন বা অনুধ্যানের অংশ, এবং অন্যদিক থেকে একটি জনপদের প্রকৃতি ও জলবায়ুসহ সামাজিক জীবনধারার ইতিহাস।

তুচ্ছ দৈনন্দিন ঘটনা ও পরিপার্শ্বে হাইকু কবি জীবনচক্রের জন্ম-বৃদ্ধি-জরা থেকে আরম্ভ করে অনন্ত নিরাকারে বিলীন ও প্রত্যাবর্তনের ছবি দেখতে পাচ্ছেন। হাইকুতে কথাগুলো এমনভাবে বলা হয়, পড়তে কি আসলেও দারুণ লাগে? মামুলি শব্দ ও ছবি পাচ্ছি সেখানে। মামুলিটা দারুণ হয়ে ওঠে,যখন আপনি আটপৌরে চরণে সাজানো ছবি বা চিত্রকল্পকে নিজে কল্পনায় ধরার চেষ্টা করবেন। যেখান থেকে আপনার মনে এর মাহাত্ম্য আভাসিত হতে থাকে। তার আগে কিন্তু নয়।

ফ্ল্যাশ ফিকশনও তাই। বৃহৎকে সে এখানে বিবরণে না যেয়ে কণাবাক্যে ধারণ করছে। বিবরণে গেলে তা হয়ে উঠবে গল্প, আখ্যান, চলচ্চিত্র বা শিল্পের আরো যত স্বীকৃত শাখা-প্রশাখার রয়েছে, তার যে-কোনোটি। বড়ো কথা, এই ধাঁচে লেখকরা ওই খেলা করার আনন্দ থেকে সচরাচর লেখেন। এবং, কাজটি অতিশয় কঠিন বলে কারো পক্ষে এর পেছনে লাগাতার লেগে থাকা নয় সম্ভব।

ছোট্ট এই বিষয়টি বুঝে নিলে কণাআখ্যানকে সাদরে বরণ করতে গাড্ডায় পড়তে হয় না। আমরা নিজেকে খুব চালাক-চতুর-সেয়ানা বলে ভাবি;—বাস্তবে বসবাস করি সংস্কারন্ধ এক গুহায়। আজকের বাংলাদেশ তার প্রমাণ। এই দেশের কবিলেখকরা এর সংক্রাম এড়াবেন কী করে! সুতরাং ঘুম থেকে জেগে ওঠে রজনি ফুরাতে না দেখা অথবা দুঃস্বপ্ন চলতে থাকার কাহিনিকে হ্রস্ব ও দীর্ঘ উভয় আকৃতিতে লেখা সমীচীন। তাতে যদি সংস্কার কিছুটা কাটে, তবে তা সকলের জন্য হতে পারে সতিশয় উত্তম।
. . .

The Collector’s Head, Based on “The Shrunken Head” by Augusto Monterroso; Source – Calliope’s Quill YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 58

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *