কবির দায় ও পাঠকের চাওয়া
আবুল হাসনাত

. . .
কবিরা সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা;—আমার এভাবে ভাবতে ভালো লাগে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অনুভূতি, যাপন ও সংগ্রামকে তারা কবিতায় ভাষা দিয়ে থাকেন। আমরা ছাপোষা মানুষ। আমাদের এই প্রতিভা নেই যে তার মতো করে কবিতায় মনের কথা বলব। সুতরাং আমরা মনে-মনে চাই,—কবি সেই দায় মিটাবেন। তিনি যখন এই চেষ্টা করেন,—আমাদের কাছে তার আলাদা মূল্য তৈরি হয়।
তিনি অবশ্যই তার মতো করে বলবেন। চারপাশকে যেমন দেখছেন, যেমন করে বলাটা তার কাছে সঠিক মনে হচ্ছে,—সেভাবে বলবেন। কবিতার ভাষায় নিজের কথা বলতে যেয়ে আমাদের কথাকেও জায়গা দেবেন কবি। আমাদের কাছে অনেকসময় তার এই বলার ভাষা কঠিন মনে হতে পারে। বুঝেও বুঝলাম না, এরকম অনুভূতি মনে কাজ করতে পারে। তবু আমরা চাই,—তিনি আমাদের যাপনকে কবিতায় ধরতে নিজেকে ব্যয় করুক। পড়তে গিয়ে মনে হবে,—নতুন এক ভাষা এইমাত্র জন্ম নিলো! যা আমরা ভাবিনি, কল্পনা করিনি কখনে, অথবা ভাবলেও বলতে পারিনি,—কবি এখন আমাদের হয়ে না-বলা অনুভূতিকে হাজির করছেন কবিতায়। অজানাকে উন্মোচিত করছেন আমাদের চোখের সামনে। এটুকু মুগ্ধতা কি তার কাছে আমরা চাইতে পারি না? বোধহয় পারি।
কবিতা পাঠ করতে গিয়ে অনেকসময় বিস্ময় ও ধাঁধা মনে জন্ম নেয়। আমাদের চেনা ভাষায় কবি কথা বলেন, কিন্তু কবিতায় তাকে অচেনা ও নতুন লাগে। ভাষাকে এভাবে নতুন রূপ দিতে পারেন বলে কবিকে আমি পৃথক প্রজাতির মানুষ বলে ভাবি। কেবল কবিতা লেখার কারণে তিনি পৃথক। আমাদের মতো সামাজিক প্রাণী হয়েও সমাজকে দেখার আলাদা চোখ তার রয়েছে। এটি, আমার ধারণা, কবিতায় পৃথক সত্যকে জন্ম দেয়। কেবল এই সত্যকে ভাষায় তুলে ধরার কারণে তাকে আলাদা ভাবতে আমি শতবার রাজি।
আমাদের সঙ্গে তুলনায় তার দেখার ভিন্নতা তাকে কবি করেছে। তার আবেগ প্রকাশের ধরন ও সংবেদনশীল অনুভূতিতে আমরা তীব্রতা টের পাই। মানব-হৃদয়ের তলদেশে তিনি গমন করছেন বলে মনে হতে থাকে। তার লেখা কবিতা পাঠ করতে গিয়ে আমরা এভাবে মানব-অনুভূতির নতুন দিগন্তের দেখা পাই। কিন্তু একই কবি যদি আমাদের মতো তুচ্ছতায় নিজেকে ক্ষয় করতে থাকেন, বিচিত্র বাহানায় সুবিধালোভী হয়ে ওঠেন, তখন তার কবিতায় এর ছাপ পাঠক টের পায়। আমার ধারণা, জাগতিক সুযোগ-সুবিধার প্রতি কবির লোভ তার কবিসত্তায় শায়িত শক্তিকে খাটো করে। তিনি হয়তো তখনো চমৎকার কবিতা লিখছেন, কিন্তু তা কবিতার চেয়ে বেশি কিছু আমাদের দিতে পারে না। সুবিধাবাদ কবির শিল্পসত্তাকে দুর্বল করে দেয়।
আমরা সাধারণের কাছে কবির মূল্য কমতে থাকে। তিনি শব্দের ফেরিওয়ালা;—এর বেশি ভাবতে ইচ্ছে করে না। অন্যরকম মানুষ ভাবার রোমাঞ্চ মনে কাজ করে না। কবিতার প্রতি যতখানি বিশ্বস্ত, নিজের প্রেরণাশক্তির কাছেও বোধহয় ততটাই বিশ্বস্ত থাকা তার জন্য জরুরি। এছাড়া যে-সমাজে তিনি বিচরণ করছেন ও এর খুঁটিনাটি নিয়ে ভাবেন, তার মূল্য আগের মতো দৃঢ় থাকে না। সত্য ও স্ববিরোধিতার মধ্যে তার যাত্রা, সেখানে তখন ছলচাতুরি বড়ো হয়ে ওঠে। কবিতার ভাষায় ভান চেপে রাখা কঠিন হয়। আপসকামি কবির পক্ষে কি একই অনুভূতি নিয়ে কবিতা লেখা সম্ভব?

কবিকে ভালো মানুষ হতে হবে, সেকথা আমি এখানে বলছি না। জীবনের প্রয়োজনে তাকেও শত আপস করতে হতে পারে। মিথ্যাকে সত্য করা লাগতে পারে। এখন সেগুলো তিনি কবিতায় বলতে পারছেন কি? কীভাবে বলছেন? কপটতা করে বলছেন? নাকি অকপট ভাষায় সকল প্রবঞ্চনাকে তুলে আনছেন কবিতায়? আমরা সাধারণ পাঠককে কবি এসব প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে তখন বাধ্য করেন।
ভান ও কপটতা পাঠকরা কিন্তু ধরতে পারে। কবিকে যে-দ্রষ্টা বলা হয়, সেটি এজন্য যে, তিনি ভানসর্বস্ব নয়। স্ববিরোধ তার থাকতে পারে, কিন্তু তিনি তা গোপন করেন না। অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহস তার মধ্যে এখনো জীবিত। সমাজে সংকট দেখা দিলে আমরা সেখানে কবির সক্রিয়তা কামনা করি। আমরা মনে করি,—তিনি আমাদের হয়ে না-বলা কঠিন সত্যকে ভাষা দিতে জানেন। দায়িত্বটি আমরা তার ঘাড়ে জোর করে হলেও চাপাতে চাই তখন। কারণ আমরা একথা ভাবি,—কবি এখানে আমাদের প্রতিনিধি। যা আমরা বলতে পারছি না তিনি সেটি বলার সাহস রাখেন। কারণ, তিনি জানেন,—কেবল সুবিধাবাদ ও আপসকামিতায় নিজেকে বিলীন করা কবির কাজ নয়।
. . .
. . .