মানুষ হইতেছে স্ট্যানিস্লো লেম বিরচিত কল্পবিজ্ঞান One Human Minute বা অনুপলমানবের সমতুল কিছু! ওয়ান ফাইন মর্নিংয়ে আমাদের এই অনপুলমানব ঘুম হইতে জাগে। দুষ্প্রাপ্য বইয়ে ঠাসা গ্রন্থাগারে গিয়া ঢোকে সে। পছন্দের বই হাতে নেয় আর বোবা বিস্ময়ে দেখে গাণিতিক সংখ্যা ১ দিয়া বইয়ের পাতাগুলা বোঝাই হয়ে আছে! বাকি যত অক্ষর ছিল তার একটাও সেখানে নাই। বেবাক অক্ষর যেন মন্ত্রবলে বই থেকে মুছে গেছে! অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে বইগুলা লেখা হইছিল। এখন ১ ছাড়া বাকি অক্ষরগুলা মুছে যাওয়ার ফলে কোনো মিনিং বা অর্থ বইয়ের পাতায় জীবিত নাই। আমাদের পড়ুয়া লোকটি এতদিন এসব অর্থের মধ্যে দিন গুজরান করছে;- তার এখন কী হবে? মিনিংয়ের তালাশে কার কাছে হাত পাতবে সে? নিজেই-বা কেমন করে পয়দা করবে নতুন অর্থ! এরকম পরিস্থিতি বাস্তবজীবনে কল্পনা করাও কঠিন!
ওয়ান হিউম্যান মিনিট-এর মতো বই লেখার ভাবনা স্ট্যানিস্লো লেমের মাথায় কীভাবে আসছিল ভেবে তব্দা যাইতেছি! বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি নামে বিদিত বইখানা আসলে তিনটি ভাগে লেখা নিবন্ধ-সমষ্টি। সময়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কিত হওয়ার অভিজ্ঞতাকে বিচিত্র মাত্রায় ভাবার চেষ্টা করছিলেন লেম। আমাদের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সবটাই কেমন একপলকে বদলে যাইতে পারে, তালগোল পাকানো ধাঁধায় নিক্ষিপ্ত হইতে পারি আমরা,- তার নানান মাত্রিক অন্বেষণ হইতেছে এই ওয়ান হিউম্যান মিনিট। লেমের বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান সোলারিসকে অনেক পাঠক জটিল বইলা মত দিয়া থাকেন। তারকোভস্কি অবশ্য এটিকে সিনেমায় রূপান্তরিত করছিলেন। মুভিখোর পাবলিক আজো ছবিখানা নয়নভরে দেখে। রুশ সিনেমাকারের নির্মাণকুশতায় মুগ্ধ হয়। প্রশংসা করতে কৃপণতা করে না। কথাখান যদিও ধ্রুব সত্য,- সিনেমার ফিতায় ধারণকৃত সোলারিস ধরা-অধরার রহস্যে ঢাকাই থাকে শেষতক! দুর্বোধ্য সুন্দর দেখার তৃষ্ণা মিটাতে দর্শক এই ছবিটার কাছে বারবার ফেরত যায়।
ওয়ান হিউম্যান মিনিটও তদ্রুপ দুর্বোধ্য সুন্দর একখানা কিতাব। ইংরেজ চলচ্চিত্রকার প্যাটার স্প্যারো এই সুবাদে লেমের ভাবনাকে সিনেপর্দায় নিয়া আসলেন। লেম কি মিনিংয়ের অবলুপ্তি ঘোষণা করতে এক মিনিটের আয়ুষ্কালে বইয়ের ছক সাজাইছিলেন? অন্য কোনো মতলব কি তাঁর মনে সক্রিয় ছিল তখন? উত্তর তালাশ করতে নেমে প্যাটার স্প্যারো বইয়ের দুনিয়ায় ঘটতে থাকা যেসব বাস্তবতায় আমরা বিচরণ করি তার সবটা ১ সংখ্যা দিয়া বিলোপের ভাবনা নিয়া সিনেপর্দায় হাজিরা দিলেন। দৃশ্যচিত্রের দিক হইতে ছবিখানা চমকপ্রদ, যদিও আজব এই থট এক্সপেরিমেন্টের কুছ পাতা ছবি দেখে মালুম হয় না! আমার ধারণা, মিনিং পয়দার খেলা শেষ করতে স্ট্যানিস্লো লেম ওয়ান হিউম্যান মিনিটে কী ঘটতে পারে সেই কল্পনায় মগ্ন হইছিলেন। আর এখন প্যাটার স্প্যারোর ছবির ভাষা একপলের মধ্যে আমরা কতভাবে বিপন্ন হইতে পারি তার বয়ান তুলে ধরতেছে পর্দায়।
যে-বিশ্বে আমরা বসবাস করি সেখানে বই অথবা আরো যত প্রকাশমাধ্যম আছে সেগুলা অবিরত মিনিং বা অর্থ তৈরিতে নিয়োজিত থাকে। তার সবগুলাকে স্ট্যানিস্লো লেমের তরিকা মোতাবেক গায়েব করা কঠিন। তবে হ্যাঁ, ধুন্ধুমার একখানা পারমাণবিক যুদ্ধ যদি বাঁধানো যায় তাহলে কিন্তু কাজটি কঠিন থাকবে না তখন। পরমাণু যুদ্ধ হইতেছে এমন এক বাস্তবতা যেটি কিনা মানব প্রজাতি ছাড়াও আরো বহুকিছু একনিমিষে গায়েব করতে সক্ষম। মন্দ কপালের দোষে যদি এরকম ডিস্টোপিয়ান বা দুঃস্বপ্নলোক বইলা বিদিত বিশ্বে আমাদের বসবাস করতে হয় তাইলে খবর আছে! পৃথিবী তখনো জীবিত থাকবে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফেরত যাইতে বাধ্য আমরাও অল্পাধিক থাকব সেখানে। মেমোরিলেস, কানেকশনলেস সত্তার প্রতীক হয়ে দামড়া দেহ নিয়া বিচরণ করব এক গজবঠাসা দুনিয়ায়! কোনো মিনিংয়ের তালাশ না করে কেবল পেটের জান্তব ক্ষুধা নিবারণে ঘুরপাক খাইতে থাকব চারিধার। পরমাণু যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে মহাকাশবিজ্ঞানে চর্চিত সৃষ্টিতত্ত্বের ভাষা ধার করে সিঙ্গুলারিটি নামে ডাকা যাইতে পারে।
অনন্য এক দিগন্তরেখায় আমরা তখন পতিত হইতেছি। অতীতের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটায় বর্তমানকে নতুন আর অভিনব ঠেকবে সেখানে। পরমাণু যুদ্ধের বলি প্রকৃতির দিকে সকলে ফেরত যাবো। বৃক্ষসহ বাকিরা সেই প্রকৃতিমধ্যে এতদিন ছিল। তাদের জন্য অভিজ্ঞতাটি নতুন নয়। খাপ খাওয়ানোর মামলা মাত্র। আমাদের জন্য অতিব কঠিন। কারণ আমরা অনেকদিন যাবত প্রকৃতিমধ্যে নাই বা তাকে নিজ ইচ্ছামাফিক যেমন খুশি ব্যবহার করছি। ব্যবহার করতে গিয়া পরমাণু যুদ্ধের মতো বীভৎস কাণ্ড অবশেষে বাস্তবে ঘটিয়ে বসছি। নতুন পরিস্থিতি এখন আমাদেরকে যেমন খুশি ব্যবহার করতে থাকা সেই প্রকৃতিমধ্যে যাইতে বাধ্য করবে। প্রকৃতির কাছে ফেরত যাওয়ার কারণে অর্থ পয়দা নিয়া বিচলিত হইতে হবে না। আমরা এখন প্রাগৈতিহাসিক। আদিম ও প্রাকৃত। বৃক্ষ বা বাদবাকিরা যেমন,- আমরাও সেরকম, সুতরাং অর্থ বা মিনিং নিয়া পেরেশান হওয়ার প্রয়োজন বিগত।
আমাদের এই জীবনটা তখন হবে গাছের জীবন। অর্থ পয়দার ফুরসত গাছের নাই। সে কখনো জানতে চায় না কী কারণে ধরায় তারে আসতে হইতেছে বা কে পাঠাইছে ইত্যাদি। গাছ তার ফুল-ফল-শাখা-প্রশাখা আন্দোলিত করে একটাই উত্তর করে সদা,- ওসব জেনে কি লাভ! আমি আছি। আমারে তোরা পারলে কাজে লাগা। কদিন পরে মাটিতে মিশে যাবো। এই তো জীবন! কেন এখানে আসছি, কে আমারে পাঠাইছে এখানে… কোন দুঃখে এসব নিয়া ভাবতে যাবো আমি! এই-যে মিনিং ছাড়া মিনিংফুল বেঁচে থাকা, পরমাণু যুদ্ধ আমাদেরকে সেই স্বাদ উপহার দিলেও দিতে পারে। পরিবেশবিজ্ঞানী জেমস লাভলক যদিও নিদান হেঁকে বিদায় নিছেন কিছুদিন আগে। রাজ্যির কিতাব লিখে বইলা গেছেন,- পরমাণু যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রকৃতি মায়ের সময় বেশি লাগবে না। দ্রুত রিকভারি করবে সে। নতুন করে তার বুকে পল্লবিত হবে জীবন, কিন্তু সেই জীবনের রূপরস দেখতে একটা মানু তখন বেঁচে থাকবে না।
গৌতম বুদ্ধ, ধারণা করি, নিজদেহে ট্রানজিশনটা তখন ফিল করছিলেন। তাঁর মধ্যে বৃক্ষস্বভাব প্রকট ছিল। সিদ্ধি লাভের পরে জীবনে যত কাজ করছেন সেখানে বৃক্ষস্বভাব ছাড়া দ্বিতীয় কিছু অবশিষ্ট থাকেনি। যে-লোক স্বভাবখানা রপ্ত করে নিছে, এখন তার সঙ্গে একটা গাছের তফাত হ্রাস পাইতে থাকে। গাছের মতো ওই মানুষটাও মাটি আর আলো-বাতাস হইতে রস শোষণ করে বালেগ হয়। ফুলফলে সে ভরে ওঠে। তার দেহকোষ যখন পরিপুষ্ট হওয়ার শক্তি হারায়, মরণ এসে তারে তখন আলিঙ্গন করে। জীবনকে টা টা দিয়া নিরন্তর সক্রিয়তায় লোকটি প্রবেশ যায়। বেদের ভাষায় ‘পরব্রহ্ম’-এ বিলীন হয় সে। কোরান বলে, আল্লাহর নিঃসীম একত্বের সম্মুখীন হইতে থাকে। উনার দিকে তার উত্থান ঘটবে এখন। বিজ্ঞান মুচকি হেসে জানায়,- লোকটি অদ্য কিনারাহীন মহাকাশে বহমান শক্তিস্রোতের ভূতুড়ে তরঙ্গে সমাহিত হইতেছে। জায়মান কোনো নক্ষত্র গঠনে শরিক হইলেও হইতে পারে। যদি না হয় তাহলে গ্যাসের ঘূর্ণিতে পাক খাইতেছে এখনো। নিরাকার এই অবস্থা হলো চেতনসত্তার অভেদ অদ্বৈত রূপ। কায়াহীন অস্তিত্ব যেখানে জান্তব স্রোতের মতো নিখিল নাস্তিসম ধারণাতীত জগতে প্রবাহিত….!
চেতনসত্তা শান্তস্রোতে পরিণত হইলে কী ঘটে তার আভাস চাইনিজ মার্শাল আর্টের মহান শিল্পী ব্রুস লি তাঁর তাওবাদসিক্ত বচনে রেখে গেছেন। চাইনিজ কুংফু অর্থাৎ তায়কান্দো তো আত্মরক্ষার একখান কৌশল শুধু নয়, এর মধ্যে তাওবাদের মূলসত্য চোরাস্রোতের মতো বহমান। ব্রুস লি জীবদ্দশায় তায়কান্দো নিয়া বই লিখছিলেন। এর কলাকৌশল নিয়া সবিস্তারে আলোচনা করছেন সেখানে। বইয়ে যে-কথা যুত করে বলতে পারেন নাই, টিভি অনুষ্ঠানে সেইটা বলছিলেন তখন। মার্কিনদেশি সায়েব তাঁকে প্রশ্ন করছিলেন,- কুংফু মাস্টার হিসেবে তাঁর এই ক্ষিপ্র গতি ও অতুল মুভমেন্টের রহস্য কি? ব্রুস লি এন্টার দ্যা ড্রাগন সিনেমার সংলাপ ইয়াদ করছিলেন তখন। সায়েবকে বলছিল উনি :
Empty your mind, be formless, shapeless-like water. Now you put water in a cup, it becomes the cup; You put water into a bottle it becomes the bottle; You put it in a teapot it becomes the teapot. Now water can flow or it can crash. Be water, my friend.
ব্রুস লি-র কথার মধ্যে তাওবাদ নীরব বহমান। কুংফু মাস্টার যখন তাও-এর ভিতর দিয়া প্রবাহিত হইতে থাকে, তখন নিজেকে খাঁটি স্বর্ণে পরিণত করে সে। কুংফু-র ফিলোসফি হইতেছে, দেহকে জলের মতো ভাবতে না পারলে কৌশল কাজে দিবে না। কুংফু রপ্ত করার সময় সচেতনভাবে লোকে টেকনিক শিখে। আসল খেলা হইতেছে দেহকে সহজাত নমনীয়তার মধ্যে নিয়া যাওয়া। দেহ হইতেছে জল। স্রোতে ভাসা কাঠের টুকরা। চকিতে শরীরে বিষ ঢুকাইতে পারে এমন পতঙ্গ বা সরীসৃপ। মোদ্দা কথা যে-দেহ কুংফুর খেল দিয়া শত্রুনাশ করে, এখন সেই দেহটারে পরিস্থিতিমধ্যে সেটল করাটাই আসল। কাজটি যে-আদম করতে পারে তার দেহ ‘শূন্য’ মন নিয়া জলের মতো সহজ ছন্দে পরিস্থিতির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে বসে।
চেতনসত্তা তাই জল। সহজ ও সহজাতের উপমা। নিসর্গদত্ত মহারাজের ভাষায় পরব্রহ্ম বা পরাব্রহ্ম। বাউলের ভাষায় ‘অধর মানুষ’, যারে নাগাল ধরতে তার এত দিগদারি! অধর মানুষ আর ব্রুস লি-র Be like water হওয়ার সাধনা মূলত এক জিনিস। দুইয়ের মধ্যে ভিন্নতা নাই। মানুষ কসরত করে ওইটা রপ্ত করে আর বৃক্ষ বা নদীস্রোতে সে আপনা হইতে প্রতিভাত হয়।
সহজাত এই ক্ষিপ্রতার তালাশে ব্রুস লি কুংফু-র ভাও রপ্ত করছিলেন। বাউল একতারা হাতে পথেঘাটে ঘোরে এখনো। রবি ঠাকুর ওদিকে একলা ধ্যানে মগ্ন থাকার মধ্য দিয়া তারে ধরতে আকুল থাকেন। মাওলানা রুমি আবার শামস তিব্রিজে এর তালাশ করলেন জনমভোর। আমির খসরু আবার নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মধ্যে অধর মানুষের সাক্ষাৎ পাইছেন ভেবে মদহুঁশ ও নাঙ্গা ভাবলেন নিজেকে। কাওয়াল হাঁকছেন সংগীতের ওস্তাদ : ছাপ তিলক সব ছিনি রে মুসে নয়না মিলায়কে/ প্রেম ভাটিকা মদওয়া পিলায়কে/ মাতওয়ালি কর লেনি রে মুসে নয়না মিলায়কে। নয়নে নয়ন মিলানোর ভাবটাই সিদ্ধি। কেউ যদি সেখানে একবার পৌঁছায় তখন তার জীবন ওই স্ট্যানিস্লো লেমের ওয়ান হিউম্যান মিনিট-এ রঙিন হইতে থাকে। এই লোকের জন্য আর কোনো কিতাব দরকার নাই, কারণ সে নিজেই এখন কিতাব।
. . .
. . .