কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর টাইম ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত লেখাগুলো পর্যায়ক্রমে বাংলাভাষী পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার একটা উদ্যোগ কিছুদিন আগে দৈনিক প্রথম আলো ঘোষণা করছেন। উনাদের এই ঘোষণা প্রশংসার দাবি রাখে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে টাইম ম্যাগাজিন এই প্রথম বিশেষ সংখ্যা করলেন এমন নয়। এর আগেও গুচ্ছের লেখা তারা প্রকাশ করছেন। চ্যাটজিপিটির রূপকার স্যাম অল্টম্যানের যে-আলাপচারিতা বাংলাভাষী পাঠকের পাতে গেল নভেম্বর মাসে প্রথম আলো পরিবেশন করছিলেন, টাইম কর্তপক্ষ ইতোমধ্যে সেখানে নতুন লেখা সংযুক্ত করছেন। ম্যাগাজিনের অনলাইন সাইটে এরকম বেশ কিছু প্রতিবেদন চোখে পড়তেছে।
স্যাম অল্টম্যানকে নিয়া থারিন পিল্লাইয়ের প্রতিবেদনটি তার মধ্যে একদম টাটকা। নিজের ব্লগে স্যাম অল্টম্যান সুপারইন্টেলিজেন্স নিয়া কিছুদিন আগে আলাপ তুলছিলেন। থারিন পিল্লাই এখন সে-আলাপের নির্যাস উনার প্রতিবেদনে তুলে ধরছেন। সুপারইন্টেলিজেন্সের মোক্ষম বাংলা কী হইতে পারে সেইটা ভাবতেছি। উপযুক্ত কোনো পরিভাষা আপাতত মাথায় আসতেছে না। তবে এটুকু না বোঝার কিছু নাই,- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে স্যাম অল্টম্যানের মতো ঝানু ব্যবসাদার ও বিবিধ কার্যদোষে বিতর্কিত লোক এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, যেখানে তার পক্ষে সর্বোচ্চ মাত্রার বুদ্ধিমত্তা জাহিরের সুযোগ অবারিত হইতে থাকবে। সে হবে প্রযুক্তি দুনিয়ার উবারম্যানশ বা অতিমানব।
থারিন পিল্লাই সংগতকারণে তাঁর প্রতিবেদনে নিক বোস্ট্রমের নাম ইয়াদ করছেন। প্রায় দশক আগে টেড টকে এই ভাবুক সুপারইন্টেলিজেন্সের আলাপ নিয়া হাজির হইছিলেন। তাঁর বক্তব্য নিয়া হইচই পড়ছিল তখন। স্মরণ আছে এখনো,- ইউটিউবে নিকে বোস্ট্রমের স্পিচটি নিয়া মন্তব্যের ঝড় উঠছিল। আসন্ন আগামীতে মানব প্রজাতির ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করার ঘটনায় কম্পিউটার প্রযুক্তির ভূমিকা নিয়া নিক যা বলছিলেন,- স্যাম অল্টম্যানের কণ্ঠে এখন তার প্রতিধ্বনি শুনতেছি আমরা। মেশিন ইন্টেলিজেন্সে ভর দিয়া বুদ্ধিমত্তার পরম পর্যায়ে মানব সভ্যতার উপনীত হওয়ার দিনক্ষণ সন্নিকট বইলা নিদান হাঁকতে আরম্ভ করছেন স্যাম। তাঁর ধারণা,- বেশি হলে হাজার রজনি অর্থাৎ বছর তিনের মধ্যে এআই প্রযুক্তিকে ওই পর্যায়ে আমরা সক্রিয় হইতে দেখব। বাঁচামরা, সামাজিকতা ও সংস্কৃতির যেসব বুনিয়াদ মানব প্রজাতিকে বুঝতে সাহায্য করে, সেখানে প্রবল ঝড় ধেয়ে আসার ব্যাপোরে কাজেই দ্বিধা না রাখা সমীচীন মনে হইতেছে। যাই হোক, থারিন পিল্লাইয়ের প্রতিবেদন সবেমাত্র সাইটে তুলছেন টাইম ম্যাগাজিন। মাগনা পড়তে পারা যাচ্ছে। আগ্রহীরা মন চাইলে ক্লিকাইতে পারেন।
টাইম ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যায় সংকলিত লেখাগুলো অবশ্য মাগনা পড়ার সুযোগ নাই। প্রথম আলোর উদ্যোগ তাই গুরুত্ব রাখে। বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নির্ভর অ্যাপসের ব্যবহার বাড়লেও এর সুদূরপ্রসারী অভিঘাত সম্পর্কে ধারণা স্বচ্ছ না অদ্যাবধি। স্যাম অল্টম্যানের সঙ্গে এডওয়ার্ড ফেলসেনথাল ও বিলি পেরিগোর যৌথালাপ এখানে এসে গুরুত্ব তৈরি করতেছে। প্রশ্নের চাপান-উতোরে অনেক কথা বলছিলেন ঝানু প্রযুক্তিবিদ। তার মধ্যে নিচের কথাগুলা আমলে নেওয়া জরুরি মনে হইতেছে। স্যাম অল্টম্যান সেখানে জানাইতেছেন …
একটা বিষয়ে মানুষ স্পষ্টতই ভুল–বোঝাবুঝির মধ্যে আছে—এআই কি আমাদের একটা নিত্যদিনের ব্যবহারের টুল বা প্রযুক্তি না কি আমাদের মতনই একটা প্রাণী। এমনকি যাঁরা নিশ্চিতভাবেই জানেন যে এটা কেবলমাত্র একটা টুল, তাঁরাও অবচেতনে কখনো কখনো এআইকে মানবরূপ দিয়ে ফেলছেন এবং সেই মতো আচরণ করছেন। [প্রথম আলো ২২ নভেম্বর ২০২৪]
এই-যে বিভ্রান্তির আলাপ উনি তুললেন সেইটা গুরুত্বপূর্ণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বহুমুখী উপযোগ হইতে মুখ ফিরানোর সুযোগ কারো নাই। তথ্য বা ডেটা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এআই প্রথম তরঙ্গ পার করতেছে। এখনো তারে চাহিদা মেতাবেক তথ্য দিতে হয়। সঠিক বিশ্লেষণ যেন করতে পারে তার জন্য নেপথ্যে হাজার-হাজার লোক খাটনি দিয়া যাচ্ছেন। কোন তথ্যটা অফেন্সিভ আর কোনটা এলাউ করলে অসুবিধা নাই,- তথ্যের প্রকৃতি চিনতে অবিরত ট্রেনিংয়ের মধ্যে রাখতে হইতেছে তাকে। দ্বিতীয় তরঙ্গে সে নিজে বিচিত্র উৎস হইতে কেবল তথ্য সংগ্রহ করে বসে থাকবে না, তথ্যকে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও সংবেদন দিয়া বিশ্লেষণও করবে। তৃতীয় তরঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সেই জায়গায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা থাকতেছে, যেখানে তাকে মানব প্রজাতির মতোই পুরোদস্তুর সংবেদনশীল সত্তা বইলা আমরা ভাবতে বাধ্য হবো। সুপারইন্টেলিজেন্স হইতেছে উক্ত ধাপে পা রাখার সিঁড়ি। নিক বোস্ট্রম যার ব্যাপারে ধারণা দিতে গিয়া হইচই ফেলে দিছিলেন।
সংবেদনশীল সত্তায় উপনীত হওয়ার পর এআইকে কীভাবে জাজ করব আমরা? একটা টুল? নাকি বুদ্ধিমত্তায় প্রখর অনুভূতিশীল জীব? এই জায়গাটি ভীষণ মারাত্মক হবে তখন। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক হইতে শুধু নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তখন একাধারে রাজনৈতিক সত্তা রূপে ব্যবহৃত হইতে থাকবে। ধর্মীয় মূল্যবোধসহ অন্যান্য বিষয় পৌঁছাবে অবিশ্বাস্য জটিলতায়। বরবাদ মজহার ও মাহফুজ গং প্রণীত এবং মাওলানা ভাসানী আবিষ্কৃত পালনবাদ দিয়া যার নিরাকরণ সহজ থাকবে না। পালন যদি রবের সৃষ্ট দুনিয়ার প্রতি আমাদের দায়িত্ব হয়, আমাদের হাতে সৃষ্ট সত্তাধারী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কীভাবে পালন করব, নাকি সে আমাদের পালনের ঠিকা নিয়া নেবে… একথা ভেবে মাথা ঘুরতেছে।
. . .
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যতম বড়ো কারিগর কম্পিউটার বিজ্ঞানী মার্ভিন মিনস্কি এর তাৎপর্য নিয়া একাধিক কিতাব লিখে গেছেন। তার মধ্যে The Society of Mind পাঠ করতে বসে বেশ উপাদেয় ঠেকছিল তখন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়া যেসব আশঙ্কা তার অনেকখানি মিনস্কি সাহিত্য হইতে নানা উদাহরণ ও উদ্ধৃতি সহকারে ঝরঝরে ভাষায় খণ্ডন করছিলেন। সময় বিশেষ রূঢ়ভাবে করছেন, তবে তাঁর বই পাঠ যাওয়ার পর পাঠক প্রভাবিত হইতে বাধ্য বোধ করে। মার্ভিন মিনস্কি নিয়া আরো বিস্তারিত আলাপ সামনে তোলা দরকার হইতেও পারে। আপাতত খুচরো কিছু বিষয় অত্র টুকে রাখি আমরা। পরে কাজে দিবে।
The Society of Mind বইয়ে মার্ভিন মিনস্কি মনকে মনহীন ধরে লজিক সাজাইছিলেন। মন আসলে কী? মিনস্কির মতে,- সে হইতেছে একগুচ্ছ এজেন্টের সমাবেশ। রাগ, অনুরাগ, ক্রোধ, সংযম, আগ্রহ, অনাগ্রহ… এরকম অসংখ্য যত অনুভূতি দিয়া মনকে আমরা বুঝি, এখন সেগুলাকে পৃথক করে দেখলে তারা কোনো মূল্য রাখে না। মেশিনের এক-একটা পার্টস বা টুকরা। টুকরা থাকা অবস্থায় মন বইলা কিছু ধরার উপায় নাই। টুকরাগুলা একত্রে জুড়লে তারা তখন এজেন্ট। মন নামক গায়েবি বস্তুকে সক্রিয় ও বাস্তব করে তুলতে যাদের ভূমিকা বইলা বোঝানোর নয়। কাজেই মন হইতেছে মনহীন উপাদানে গঠিত ধারণা। মস্তিষ্কের মাধ্যমে যার এজেন্টগুলা সক্রিয় হইতেছে। এই সুবাদে আমাদের দেহও মনের নাগাল ধরা যায় এরকম সব অভিব্যক্তির মাধ্যমে সক্রিয় হইতে থাকে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যার কোনো মন নাই বইলা আমরা বুঝতেছি এবং গাধার মতো খাটানো যাইতেছে ভেবে খুশি আছি,- মার্ভিন মিনস্কি তাতে জল ঢেলে নিদান হাঁকছেন,- মনহীন উপাদান যদি মানবমস্তিষ্কে মনকে সক্রিয় করতে পারে, তাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে অনুরূপ আইডিয়ার সাহায্যে মন উপহার দেওয়া সম্ভব। তার মধ্যে মন পয়দা করা কঠিন কাজ না। মিনস্কি আসলে হবহু এভাবে বলেন নাই, আমি পড়তে গিয়া ইন্টারপ্রেট করে নিচ্ছি।
আমার বিবেচনায়, মার্ভিন মিনস্কি বিরচিত কিতাবের সারবস্তু চিনতে বড়ো ভুল করি নাই। কিতাবখানা কারো পড়া থাকলে চেক করতে পারেন। ভুল কিছু থাকলে শুধরাতে শরম থাকবে না। মানুষ মাত্রই ভুল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অবশ্য এখনো যথেষ্ট নির্ভুল। আগামীতে এই ছবিখানা থাকবে না। আমাদের মতো ফট করে বলে বসবে : টু এরর ইজ এআই ম্যান। ভুল তোমার হয়, আমিও করছি নাহয়। এর জন্য চেতো ক্যান। খামোশ থাকো। কারেক্ট করতেছি নিজেকে।
মিনস্কির কিতাব পাঠ করতে বসে Infinite monkey theorem ইয়াদ হইতেছিল। গণিতে এই প্যারাডক্সটা আছে,- একটা বান্দরকে আমরা যদি টাইপরাইটার বা কিবোর্ডের সামনে বসাই এবং যদি সময়ের পরোয়া না করে টাইপরাইটার বা কিবোর্ড টিপতে থাকে,- একটা সময় এসে দেখা যাবে বোধগম্য একখান রচনা সে নামিয়ে ফেলছে। এখন সেইটা গরুর রচনা হইতে পারে আবার শেক্সপিয়ার উনার জীবনে যত নাটক বা কবিতা লিখছেন, তার সবটাই দেখা যাবে বান্দর বাবাজি নামিয়ে ফেলছেন।
এখানে লজিক হইতেছে, টাইপরাইটার বা কিবোর্ডকে আমরা যেসব অক্ষর ও গাণিতিক সংখ্যা আর চিহ্ন দিয়া সাজাই, সেগুলা ফিনিট বা নির্দিষ্ট। কিন্তু বান্দর এগুলা অনির্দিষ্ট সময় ধরে টিপতে থাকার কারণে অবশেষে ওই ফিনিট বা নির্দিষ্ট শব্দবিন্যাসে ফেরত যাবে। প্রস্তাবনাটি মূলত মহাবিশ্ব সসীম নাকি অসীম এই ভাবনার জের হইতে সৃষ্টি হয়। এর পক্ষে-বিপক্ষে মতের অন্ত নাই। আগ্রহীরা নেটে খুঁজলে প্রচুর পাবেন। কাজেই কথা আর না বাড়াই।
কম্পিউটার এখন যে-র্পযায়ে আছে, সেখান থেকে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে যাওয়ার ভাবনা এভাবে আসছে। গুগল এখন এই বিষয়টি নিয়া কাজ করতেছেন। কম্পিউটারের মস্তিষ্ক বা প্রসেসরের সিগন্যাল বিশ্লেষণের সক্ষমতা ধারণাতীত দ্রুত করতে তারা সক্রিয়। বলা হইতেছে, পৃথিবীর অর্থনীতি তখন প্রতীকী অর্থে লাইটস্পিড ইকোনমিতে পা দিবে। সেখানে মানব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পারস্পরিক সম্পর্ক হবে বহুরৈখিক। এখন সেইটা ভালো না মন্দ তার ব্যাপারে মীমাংসায় পৌঁছানো সম্ভব না। সব মিলিয়ে এই যুগটায় পৌঁছাইতে অনধিক ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছর লাগতে পারে। আমরা হয়তো দ্বিতীয় তরঙ্গ দেখে যাইতে পারি, তৃতীয় তরঙ্গ আয়ুতে ধরবে না।
তো এসব বিবেচনায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যারা এখনো মানুষের সক্ষমতাকে অতিক্রম করতে পারবে না বইলা ভাবতেছেন, তাদের ধারণাকে বেঠিক বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। এআইয়ের পক্ষে বেথোভেনোর নবম সিম্ফনি, পিকাসোর গোয়ের্নিকা অথবা জয়েসের ইউলিসিস রচনা সহজ হবে না। তারকোভস্কি বা বেলা টারের মতো সিনেমায় কবিতা লেখা কঠিনই থাকবে তার জন্য। কারণ, মানুষের মগজের সক্ষমতা সমানতালে বাড়বে। কিন্তু মিনস্কির পথ ধরে যদি আমরা তারে মনসৃষ্টির এজেন্টগুলা দিয়া দিতে সক্ষম হই,- নতুন এক বাস্তবতা জন্ম নিবে সেখানে।
এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি বেথোভেনের সুরজাল অথবা জীবনানন্দের মতো কবিতা লিখে বসে… অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না! এর সঙ্গে মানুষ কীভাবে সম্পর্কিত হইতেছেন, সেইটা হবে দেখার বিষয়। উদ্বেগের কিনা জানি না, তবে ওই সময়ের শেক্সপিয়ারকে পুনরায় বলতে হইতেও পারে : To be, or not to be: that is the question!
. . .
. . .