সাম্প্রতিক

দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে

Reading time 5 minute
তাহলে কী লিখবে সে এই চব্বিশকে নিয়ে আগামী কোনো চব্বিশে?

. . .

এরশাহ শাহীর পতনে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক তৎপরতা বড়ো ভূমিকা নিভিয়েছিল। পতনের ক্ষণ যত ঘনিয়েছে, দেশ জুড়ে সংস্কৃতিকর্মীরা এক মোহনায় মিশে গিয়েছিলেন। প্রতিবাদী গান, নাটক, কবিতা আর চিত্রকলা হয়ে উঠেছিল স্বৈরাচার পতনের নিয়ামক। একাত্তর প্রবলভাবে বিরাজিত ছিল চেতনায়।

পাকি সেনাবাহিনি ও তাের দোসরদের নারকীয় তাণ্ডবে আবিল একাত্তরে পটুয়া কামরুল হাসানের হাতে আঁকা এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে দেয়ালে-দেয়ালে পোস্টারে রূপ নিয়েছিল। এরশাদ পতনের মহেন্দ্রক্ষণে তাঁর হাত দিয়ে পুনরায় বেরিয়ে এসেছিল বারুদ। জাতীয় কবিতা পরিষদের সম্মেলনে শিল্পী দ্রুত হাতে আঁকলেন দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে শিরোনামে স্কেচ। সারা দেশ জুড়ে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল শিল্পীর আঁকা প্রতিবাদী অনল।

The country in the grip of world’s most unashamed today by Artist Kamrul Hasan; Image Source – Google Image

শামসুর রাহমানের উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ কিংবা শহীদ নূর হোসেন স্মরণে বিরচিত বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় ততদিনে প্রতিবাদকে আরো শাণিত করে তুলেছিল। তারো আগে মোহাম্মদ রফিক ‘সব শালা কবি হবে; পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই;/ বন থেকে দাঁতাল শুয়োর রাজাসনে বসবেই।’ লিখে ঝড় তুলেছিলেন। ঢাকার শাহবাগে (তখন সড়কদ্বীপ) সাংস্কৃতিক মঞ্চে প্রতিবাদী গান, কবিতা আর নাটকের বিরাম ছিল না কোনো। সৈয়দ হকের নূরলদীনের সারাজীবন ফিরে-ফিরে মঞ্চায়িত হচ্ছিল সেখানে। আলী যাকেরআসাদুজ্জামান নূরের অদ্ভুত রসায়নে দর্শক সম্মোহিত ছিলেন ব্যাপক।

এরশাদ পতনের দৃশ্যপটে দেশিবিদেশি ষড়যন্ত্রের বালাই ছিল না। ঊনসত্তরে আয়ুব শাহীর পতনের সঙ্গে নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতন নিজেকে অভিন্ন করেছিল। নিখাদ রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের বৃহৎ অংশকে এরশাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে একীভূত করতে সক্ষম হয়েছিল রাজনৈতিক জোটগুলো। সাংস্কৃতিক তৎপরতায় যার প্রবল ছাপ আমরা দেখেছি তখন। সৃষ্টিশীল বহুমাত্রিকতায় অনন্য এক আন্দোলন সেটি। নূরলদীন ততদিনে মহিলা সমিতির গণ্ডি ছাপিয়ে সাধারণের মুখে জায়গা করে নিতে পেরেছিল। সৈয়দ হকের নামটি ওই সুবাদে অমরত্ব পেয়েছিল বৈকি।

কথা সত্য, এরশাদ পতনের ফসল রাজনৈতিক দলগুলো ঘরে তুলতে পারেনি। একাত্তরে অর্জিত স্বাধীনতার স্বপ্নবীজকে যেভাবে ব্যর্থ হতে হলো, মাঝপথে পথ হারাল দেশ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনও ব্যর্থতার চিরায়ত বৃত্ত ছেড়ে বেরুতে পারেনি। তারপর থেকে বাংলাদেশে পথহারা অনিকেত! তথাপি ঊনসত্তরের আসাদ, নব্বইয়ের নূর হোসেন, রাউফুন বসুনিয়া ও ডা. মিলনরা হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিতর দিয়ে অর্জিত প্রগতিমনস্ক ও সম্মুখগামী হতে ইচ্ছুক বাংলাদেশের প্রতীক ছিলেন তাঁরা। আজো তাই বটে!

Photographer Dinu Alam shared his experience on 90s Revolution and Nur Hossen; Source – Channel 24 YTC

সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র থেকে আরম্ভ করে মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকে বাংলাদেশের যেটুকু অর্জন, শিক্ষিত সমাজে এখনো যেটুকু প্রগতিমনস্কতা নিভু নিভু জ্বলছে… তার কিছুই সম্ভব হতো না যদি পাকিস্তান সৃষ্টি না হতো। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হয়ে একাত্তর ও নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের মহিমা তাই অমলিন থেকে যাবে। একটি জাতিসত্তাকে তারা সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠার ভাষা দিয়েছিল।

সৈয়দ হকের নূরলদীনের সারাজীবন তো ইংরেজ আমলে সংঘটিত অগণিত কৃষক বিদ্রোহের একটিকে উপজীব্য করে লেখা। কিন্তু তার নেপথ্যে ক্রিয়াশীল থেকেছে একাত্তর। ছিল এরশাদ শাহীর জামানায় চলতে থাকা কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে দ্রোহের বারুদ। দুইহাজার চব্বিশের স্বৈরাচার পতনে তার কিছু কি নজরে পড়েছে কারো? আমার তো পড়েনি। জানি না বাকিদের হয়তো পড়েছে!

চব্বিশের স্বৈরাচার পতনে নব্বইয়ের অনুরূপ সাংস্কৃতিক জাগরণ কি দেখেছে দেশ? অতীতের সঙ্গে তুলনায় এমন কোনো গান, কবিতা, নাটক অথবা অবিরল সাংস্কৃতিক বিস্ফার কি দেশবাসীর মনের ভিতর ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় তুলতে ব্যবহৃত হয়েছিল? কিছু ব্যতিক্রম তো অবশ্যই জুলাই আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে দেশবাসী দেখেছে। কিন্তু মোটাদাগে নব্বইয়ের তুলনায় সেগুলো নগণ্য। সুতরাং পরিতাপের সঙ্গে ‘না’ শব্দটি ব্যবহার করতে হচ্ছে।

প্রকৃত অর্থে কোনো সাংস্কৃতিক জাগরণ চব্বিশের স্বৈরাচার পতনে ঘটেনি, তবে ক্যারিকেচার ঘটানো হয়েছে বিস্তর। সরকার পতনের শুরুতে একাত্তরের নানান মোটিফ তারা ব্যবহার করেছিল। পরে তাল বুঝে সেগুলো বাদ দেওয়া হয়। তার বাইরে দেখা গেল ষড়যন্ত্র ও সস্তা চমক! মিথ্যাচারে ঠাসা নিম্নমানের বিচিত্র ক্যারিকেচার। দেখা গেল ধর্মীয় সুড়সুড়ি তৈরির ছলচাতুরি আর অকথ্য অশ্লীলতা।

চব্বিশের হাসিনাপতন আন্দোলনে দেশজুড়ে আঁকা দেয়ালচিত্র নিয়ে দেশের কবিলেখক মহলে শুরুর দিকে বেশ উচ্ছাস দেখেছিলাম। দেয়ালচিত্রে আরবি ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার নিয়ে মাতন ছিল ব্যাপক। দ্বিতীয় স্বাধীনতা, বাংলাদেশ টু পয়েন্ট জিরো আর পানি লাগবে পানি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে যেসব রেটোরিক তাৎক্ষণিক জন্ম নিলো, গত আট মাসের তাণ্ডবে এর সবটাই মাটি হতে দেখছি সমানে।

উলটো এখন সমন্বয়কদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়ার বার্তা দিয়ে দেয়ালচিত্র জন্ম নিতে দেখছি বৈকি। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের কাজ বলে মীমাংসা টানা সহজ, কিন্তু এরকম কেন ঘটছে সেটি ভাবলে দেয়ালচিত্রটি যে বা যারাই লিখে থাকুক, তাদেরকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জোর কি মনে প্রবল হয় আগের মতো? আমার তো হচ্ছে না ভাই। কেন হচ্ছে না তার জন্য সমন্বয়কদের গেল আট মাসের কর্মকাণ্ড নজরে আনাটাই কি যথেষ্ট নয়?

দেয়ালচিত্রে বেগম রোকেয়াকে যখন মাগী সম্বোধনে অভিহিত হতে হয়, তখন বোঝার বাকি থাকে না, কারা এই আকামে লিপ্ত ছিল তখন। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পক্ষে বিরামহীন মিথ্যা ও রগরগে অশ্লীলতার অতিরিক্ত কোনো আবেদন পয়দা করা সম্ভব নয়। তার কাছে কামরুল হাসানের বারুদ অথবা সৈয়দ হকের নূরলদীন আশা করা অবান্তর। সুতরাং গালিগালাজের তুবড়ি আর ফাঁপা আবেগ ছাড়া চব্বিশে বালেগ গেঞ্জি প্রজন্ম কিছু পয়দা করতে পারেনি। সত্যটি এখনো যাদের গিলতে খুব কষ্ট হচ্ছে, তারা একদিন সেটি বুঝবেন আশা করি।

Ali Zaker Reciting Nuruldiner Sara Jibon; Source – Batighar Theatre YTC

হাসিনা সরকারের তামাশা খতম করতে বিরোধীরা আরো বড়ো তামাশার জন্ম দিয়েছে কেবল। এর ওপর ভর দিয়ে আগামীতে কোনো হৃদয়দ্রাবী সাহিত্য, গান, চলচ্চিত্র অথবা আবারো কোনো নূরলদীনের উত্থান নাহি সম্ভব। যা সম্ভব হবে বা এখন হয়তো সম্ভব করতে বাংলার কবিলেখক উতলা, সেটি ওই তামাশাভরা মিথ্যা বয়ানে ঢাকা বায়ুদূষণ! নাকিকান্না আর গালিগালাজের তুবড়ি সব ছাপিয়ে যাচ্ছে সেখানে।

মিথ্যা ঢাকা দিতে কষ্টকল্পিত মিথ্যা বয়ান সাজানোর মশকরা দুইহাজার চব্বিশে সংঘটিত স্বৈরাচার পতনের নিট ফলাফল হতে যাচ্ছে সামনে। মাঝখান দিয়ে যেটি হাসিনা সরকারের হাজারটা অনাচারকে মাইলেজ দিতে থাকবে। আবু সাইদ বা মুগ্ধ কখনো আসাদ অথবা নূর হোসেনের সঙ্গে অভিন্ন হতে পারবে না। সরকার পতনের নাটকবাজি ছাপিয়ে বড়ো হয়ে উঠবে বত্রিশ নম্বর আর শেখ মুজিব। সামান্যতম হলেও কাণ্ডজ্ঞান যার থাকবে, তার হৃদয়ে আরো গরিয়ান ও জরুরি হতে থাকবে একাত্তর।

চব্বিশের নাটকবাজির চরিত্রগুলোকে আগামী কোনো সময়ে ভাবতে বসা কবিলেখক কীভাবে বিচার করবে? প্রশ্নের উত্তরে আমার সঙ্গে অনেকের মিলবে না, তবু বলছি,—সে কেবল ওই বরবাদ মজহার, ওই পিনাকী আর শফিকুর গংয়ে সয়লাব লোকগুলোকে সেখানে দেখবে। তার চোখে ভাসবে মবসন্ত্রাস। লুটতরাজের মচ্ছব। নারীর অবমাননা। ধর্মের উদ্ভট জিগির। মোল্লা নামক আজব চিড়িয়ারা তাকে অবিরত প্রহার করবে। সে দেখবে, ইসরায়েলের পণ্য বয়কটের নামে তারা জুতোর দোকান লুট করছে। মার্চ ফর গাজায় সমবেত হওয়ার নামে আম গাছের ডালে চড়ে কাঁচা আম পাড়ার উৎসবে মেতেছে।

Bandhu Tumi Lal Chila by Lutfar Rahman Riton; Source – Ganatantrer Biborton YTC

এসব দৃশ্য সম্বল করে স্বৈরাচার পতনের মহিমা রচনা তার নিজের কাছে হাস্যকর মনে হবে। সে হয়তো ফেরত যেতে চাইবে ৫ আগস্টের পূর্বক্ষণে। সেখানেও ঘাপলা ব্যাপক। তার সামনে চলে আসবে ছাত্র লীগের হেলমেট থেকে বের হওয়া শিবিরি পঙ্গপাল। সামনে চলে আসবে স্নাইপার আর সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু রাইফেল। ইন্টারনেটের তারে ঝুলানো পুলিশের লাশ। ৫ আগস্টের পরের দিনগুলোয় যেতে চাইবে সে;—সেখানেও ঝামেলা! থানা লুট আর ভাংচুর ও ডাকাতির মচ্ছব ছাড়া কিছু কি চোখে ভাসবে অধিক?

না কোনো নেতা, না কোনো বুদ্ধিজীবী, না কোনো ইনফ্লুয়েন্সার অথবা কর্ণধার সমন্বয়ক ও শান্তির নোবেলদূত তাকে স্বস্তি দেবে সেখানে। এগুলোর একটাকেও মহাকাব্যিক চরিত্রে গরিয়ান ঠেকবে না তার কাছে। না মনে হবে,—তারা হচ্ছে বিপ্লবী। তার বদলে সে ভাববে,—ছুঁচোর কেত্তন চলছে সবখানে! ভূত-পেত্নীতে ছেয়ে আছে দেশ। শেওড়া গাছে লটকে থাকা ভূতনামা ছাড়া অধিক কিছু লেখা দুষ্কর। দমফাটা রসিকতা আর বিদ্রুপ বাদ দিয়ে সত্যিকার কিছু লিখে উঠা তার নিজের কাছেই অবান্তর ঠেকবে তখন।

তাহলে কী লিখবে সে? সে লিখবে গাঢ় অন্ধকারে হায়নার চিৎকার! তার কলম ফেটে বের হবে একটি জনপদ ও জনগণের হাবা হওয়ার আজিব তামাশা! তামাশাটি তাকে কষ্ট দেবে। বেদনায় নীল হবে সে। তার হয়তো মনে হবে, জাগো বাহে কোনঠে সবাই লেখার মতো আওয়াজ চব্বিশে নেই। গাঢ় অমাবস্যা ছাড়া কোনো বাক্য লেখা শক্ত।

আগামীর মহৎ রচনা কেবল এই অমাবস্যাকে তুলে আনার মধ্যে হয়তো ঘটানো সম্ভব। চব্বিশকে মহিয়ান করে মোটেও নয়। সেই শক্তি এর নেই। যারা এখনো তা বুঝতে নাচার, তাদের জন্য থাকল একরাশ করুণা, আর নীরেন্দ্রনাথের পঙক্তিবচন : দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে …
. . .

Desh Dekachcho Ondhokare by Nirendra nath Chakraborty; Recitation – Suparna Majumder; Source – Suparna Majumder kobita YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 27

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *