
. . .

গ্রামীণ মানুষ বলে মনে পড়লো অনেক কিছুই এই লেখা পড়ে…
. . .

ইন্টারেস্টিং, তবে স্কটের এই দেখাটাও খণ্ডিত এবং রোমান্টিক বেলাল ভাই। ফসল উৎপাদনে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ছড়াছড়ি ‘সামাজিক বুনন’কে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে;—তাঁর এই পর্যবেক্ষণ খুবই সঠিক। ফসল ফলানো ও ফসল তোলাকে কেন্দ্র করে বিকশিত বর্ণিল উৎসবগুলো পৃথিবীজুড়ে এখন অস্তমিত। আমাদের এখানে আগে নবান্ন যে-আবেদন রাখত, সেটি এখন আর নেই। স্কটের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে এখানে কারো দ্বিমত থাকছে না।
অন্যদিকে, ভূস্বামী, জোতদার প্রমুখদের সঙ্গে খেতকামলাদের সম্পর্ক, দর কষাকষি ও তারা ইচ্ছে করে যেসব পেটি ক্রাইম তখন করেছে, স্কট যেগুলোকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের নীরব প্রতিরোধ বলে মানছেন;—এখানে তাঁর পর্যবেক্ষণ ও মতামত শুনতে ভালো, কিন্তু তাতে গ্রামীণ সমাজের বড়ো একটা উপকার হয়েছে বা হতো, এমন কিন্তু নয়।
ভূস্বামী ও জোতদাররা যেসব দর কষাকষি ও বিনিময়মূল্য স্থির করে জমি আবাদ করাত ও খেতকামলা নিয়োগ করত ফসল বোনা ও কাটার সময়, সেখানে এসব পেটি ক্রাইম হিসাবে রেখেই নেমেছে তারা। জমি যে-কৃষক বর্গা নিয়েছে আর ওদিকে খেতকামলা… উভয় শ্রেণি সেখানে ভয়ানক গরিবি, ক্ষুধা, অপুষ্টি ও অপরিসীম অজ্ঞতায় চমৎকারভাবে পচত জীবনভোর। একে প্রেইজ করার কী আছে তা আমার মাথায় ঢোকে না! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই দিকটি খুব ভালো ধরতে পেরেছিলেন বলেই গ্রামীণ জীবনের কদর্য, কুৎসিত চেহারাও তুলে এনেছেন লেখায়।
আরণ্যিক, শিকারি ও যাবাবর জীবনকালে মানুষ সুখী ও আক্ষরিক অর্থে প্রকৃতির সন্তান ছিল। সম্পত্তির ধারণা যেহেতু প্রবল ছিল না,—খাদ্য সংগ্রহ ও বণ্টনে থেকেছে সহজ সমতা। ধনী ও গরিবের মধ্যে আন্তঃসংঘাতের প্রয়োজন পড়েনি। মঙ্গোলিয়ার নোম্যাডরা যেমন একুশ শতকেও এটি ধরে রেখেছে। বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে ঘোড়া ও গরু-ছাগল চড়িয়ে বেড়ায় আজো। তাঁবুতে থাকে। টিভি থেকে শুরু করে আধুনিক উপকরণ সেখানে সুলভ, কিন্তু সেগুলোকে জীবনের মাপকাঠি হিসেবে তারা ভাবে না। ঘোড়ার দুধ ওই জলের মতো পান করে সারাদিন, আর জায়গা বদলায় কিছুদিন পরপর। এখানে গরিবি ও বৈষম্য ঢোকার সুযোগ সীমিত বা নেই বললেও চলে।

কৃষিকেন্দ্রিক জীবনধারায় গমন ছিল প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের প্রথম বিচ্ছেদ ও নিজের হাতে সভ্যতাকে গড়েপিটে নেওয়ার কাল। যেখানে সম্পত্তি এসেছে, এর জের ধরে এসেছে মালিকানা ও শ্রেণি-বিভাজন। ইউভাল নোয়া হারারি দেখুন। তিনি তো খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এই সত্যটি,—শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে-পরিমাণ প্রাণবৈচিত্র্য পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল, তার ডাবল বিলুপ্ত হয়েছে কৃষি ভিত্তিক গ্রামীণ সভ্যতার বিকাশপর্বে। বনজঙ্গল, পাহাড়-টিলা, নদী-বিল এসব সফাসুতরো না করে আবাদ করবেন কী করে! গ্রাম গড়বেন ক্যামনে! সুতরাং ওসব ট্রাক্টর-ফ্রাক্টর আর কীটনাশক ও উচ্চফলনশীল আসার আগেই বিচিত্র প্রাণ-প্রজাতির গণবিলুুপ্তি ঘটে গিয়েছিল।
মার্কস হয়তো এ-কারণে কৃষককে পেটি বুর্জোয়ার প্রতীক রূপে দেখেছেন। কৃষি সভ্যতার গোড়ায় তাকে শোষণ ও বঞ্চনা করেছে জমির মালিক বনে যাওয়া পক্ষগুলো। এখন তাকে ছিবড়ে বানায় মালিক ও বহুজাতিক কোম্পানির যৌনমিলন থেকে সৃষ্ট নতুন ধনিক শ্রেণি। রাষ্ট্রও তাকে শোষণ করে সমান। অতীতে তার ওসব পেটি ক্রাইমে সক্রিয় নীরব প্রতিরোধকে গ্লোরিফাই করার কিছু নেই আসলে। এটি বরং ছিল আরো হীনতর অবনমন। ছ্যাচড়ামি। মানুষকে যা আরো নিচে নামিয়ে দেয়। বুঝিয়ে দেয়, তার জন্ম হয়েছে পরের জমির লাউটা-মুলোটা চুরি করার জন্য। স্কট সায়েব একে যতই গ্লোরিফাই করে দেখান, আদতে এটি মানুষের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও হীনতর অবস্থার প্রতীক।
কানাডা-জার্মানির মতো দেশে অনেকে শখের বশে ফলের গাছ লাগায় বাড়ির সামনে। ফল যখন ধরে, খুব একটা পেড়ে খায় না। বাজারেও বেচে না তারা। ফলগুলো মাটিতে পচে নষ্ট হয়। খাওয়ার ইচ্ছে হলে একই ফল দোকান থেকে কিনে আনে অনেকে। যুক্তি হলো,—আমি চাইলে কিনতে পারছি, এগুলো পশু-পাখির জন্য থাকুক। তারা তো আর কিনে খাবে না। সমাজ যখন বেঁচে থাকার নূন্যতম চাহিদাগুলো মানুষ অর্জন করে ফেলে, তখন নীরব প্রতিরোধের নামে কাজে আলসেমি ও ফাঁকিবাজি কিংবা মালিকের জমি থেকে কিছু চুরির দরকার পড়ে না। স্কট সায়েব এদিকটা ভেবে দেখেননি।
উচ্চফলনশীল ফসলের ভালোমন্দ অবশ্যই রয়েছে। কীটনাশক ও নিত্যনতুন প্রযুক্তির সবটা উপকারী নয়। প্রদীপের নিচে যেমন অন্ধকার থাকে, সভ্যতার নিচে, বিশেষ করে কৃষিকেন্দ্রিক খাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের নিচে অন্ধকারের সীমা-পরিসীমা নেই। একে মোকাবিলা কীভাবে করবেন, সেটি এখানে সমস্যা। অনেকভাবে অনেকে ভেবেছেন, কাজের কাজ কিছু হয়নি। এখন আর সেই অবস্থায় আমরা নেই, মন চাইলে আরণ্যিক সভ্যতায় ফেরত যাবো পুনরায় অথবা যাযাবর হয়ে কাটিয়ে দেবো জীবন। গ্রাম চাইলেও শতভাগ আদিম গ্রাম থাকবে না। একটি রাস্তা হওয়া মাত্র সেখানে শহর ঢুকবে। শহর ঢুকলে গরিবির চরিত্র বদলাবে দ্রুত; এবং, দুঃসহ স্থবিরতার চেয়ে তা একদিক দিয়ে উপকারী।
মানুষ কৃষিতে যদি না যেত, জন্মহার ঊর্ধ্বগতি লাভের চান্স কমে আসত। যেহেতু, আরণ্যিক জীবনে জন্মহার বৃদ্ধির গতি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার কারণে মন্থর। মানুষ সেখানে থাকেনি। তরক্কি করেছে নিজের মগজ খাটিয়ে,—বৈষম্য যেখানে অবধারিতই ছিল। স্কট যে-গ্রামীণ কৃষিজীবনকে প্রেইজ করছেন, সেটি বরং বাইরে থেকে দেখতে শান্ত-সুস্থির ও ঘন-সামাজিক। ভিতরে তাকালে অতিব কুৎসিত। গরিবির মধ্যে কোনো গর্ব নেই। দীনতা ও বঞ্চনা মানুষকে তুচ্ছ করে ফেলে। সেখানে একমাত্র আকর্ষণীয় এই-যে,—খেতে কামলা দেওয়ার পরে হাতে অবসর থাকে, যেটি তারা সামাজিক সঙ্গ ও বিনোদনে পূরণ করেছে। ফসল তোলা ও বিলি-বণ্টনে বিরাট বৈষম্য থাকলেও তাদেরকে তা মেনে নিতে হয়েছে।
উচ্চফলনশীল ফসল ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আসার পর শস্য উৎপাদন, এর মালিকানা, বিপনন সবটাই আমূল বদলে গেছে। শোষণ ও বৈষম্য থাকলেও তার মাত্রা ও আকৃতি আলাদা। কৃষিতে কাজের পরিসর কমে যাওয়ায় মানুষজন নিত্যনতুন সব পেশায় শিফট করেছে দ্রুত। সোজাকথায়, গ্রামের মধ্যে শহর যখন প্রবেশ করতে থাকে, তখন সামাজিক বুনন বদলাবে। আজকে যে-কৃষক খেতে কামলা দেয়, সে লাঙ্গল নির্ভর সময়কার কৃষকের চেয়ে কম গরিবি সহ্য করে। তার পরিবারের সকল সদস্য কৃষিতে কাজ করে, বিষয়টি তাও নয়। সিএনজি চালায়, রেস্টুরেন্ট বা কোনো কারখানায় কাজ করে; বিকাশের মতো দোকান চালায়। এসব জীবিকা গ্রামীণ অর্থনীতিকে একটি মিশ্র চরিত্র দান করেছে।
বিষয়টি খুব ভালো বোঝা সম্ভব, যখন আমরা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এসথার দ্যুফলে রচিত পুওর ইকোনমিক্স বইটি পাঠ করি। যেখানে তাঁদের স্টাডি বলছে, মানুষ এখন ভোগ করতে চায়। অপ্রয়োজনে খরচ করতে মন চায় তার। যেখানে, ইন্দোনেশিয়ার একটি গরিব পরিবারকে যদি সরকার, কথার কথা, বিশ কেজি চাল কেনার জন্য সাহায্য বা ভতুর্কি দেয়, সে দশ কেজি কিনবে। বাকি টাকা দিয়ে হয়তো মাংস কিনবে সে। কিছু যদি বেঁচে যায়, সিনেমার টিকিট কাটবে তখন। কারণ, তারও সিনমো দেখার শখ আছে বৈকি। সংস্কৃতির এই নতুন চরিত্রও বাস্তবতা এখন। যে-কারণে সে অবিরত নতুন কাজের ধান্ধা করে।
এটিও যুগবাস্তবতা, এবং নতুন সংস্কৃতির রসদ। একে স্কিপ করার চেয়ে এর ভালো-মন্দ, সুন্দর ও কদর্য… উভয় দিককে মেনে নেওয়া ভালো। হ্যাঁ, জীবনানন্দের মতো আমরাও খড়কে বিষণ্ন হয়ে ইস্পাতের কলে ঝড়ে পড়তে দেখার হাহাকারে তথাপি বিপন্ন হবো। কিন্তু তাতে রিয়েলিটি বদলাবে না। যেমন বদলাবে না, একে বদলাতে দেখার স্বপ্ন বুকে নিজেকে কার্যত ধ্বংস করতে থাকা ব্যর্থ বিপ্লবের স্বপ্নও।
. . .

. . .



