আবু জাফর শামসুদ্দীন রচিত উপন্যাস পদ্মা মেঘনা যমুনা জীবনে একবারই পড়েছি। বয়স বিচারে সেই সময়টিকে প্রাগৈতিহাসিক বলা যেতে পারে। উনিশ-কুড়িতে পা রাখার দিনকালে প্রায় হাজার পৃষ্ঠা জুড়ে বিস্তারিত আখ্যানটি পাঠ করা হয়। ওই প্রথম, এবং ওটাই শেষ। ফিরতি পাঠের অবকাশ পরে জোটেনি। হামীম কামরুল হক সম্প্রতি উপন্যাসটি নিয়ে দুকলম লিখেছেন। এমন এক সময় লিখেছেন, যখন কিনা জাতি আরো একবার ক্রান্তিকালের মুখে দাঁড়িয়ে! অস্থিরতা, অরাজকতা ও বিভক্তির বিষাক্ত হাওয়া দেশ জুড়ে বইছে এখন। এমন অবস্থায় পদ্মা মেঘনা যমুনা নিয়ে আলাপ হালে পানি পাওয়ার কথা নয়, আলাপটিকে তথাপি অবান্তর ভেবে বাতিল করা যাচ্ছে না। নিজের প্রাসঙ্গিকতাকে বরং এটি তুলে ধরছে সেখানে। বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যিক আকাঙক্ষা একসময় যেসব লেখক ও বুদ্ধিজীবীর হাতে ভাষা পেয়েছিল, আবু জাফর সামসুদ্দীন তাঁদের অন্যতম। জাতীয় সাহিত্য রচনার মহাকাব্যিক খোয়াব তাঁরা দেখেছিলেন একসময়। বাঙালি মুসলমানের মনোতলে সক্রিয় যেসব ঘটনা তাকে বরাবর জিম্মি রাখে, দ্বন্দ্ব ও স্ববিরোধিতায় পাক খেতে বাধ্য করায়, এখন এসবের কারণ ঠার করতে হলে আবু জাফর সামসুদ্দীনরা প্রাসঙ্গিকতা রাখেন বটে।

গুণী সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিকের ম্যাগনাম ওপাস পাঠের স্মৃতি কাজেই মনে পড়ছে বেশ। স্মৃতিকোষে আখ্যানটির সারনির্যাস এখনো জীবিত দেখতে পাচ্ছি। খুঁটিনাটি সেভাবে মনে নেই তবে বাঙালি মুসলমানের যে-আবর্তনকে হাজার পৃষ্ঠা জুড়ে আবু জাফর সামসুদ্দীন তখন ধরার চেষ্টা করেছিলেন, তার অনেকখানি চোখে ভাসছে। কেন্দ্রীয় চরিত্র ওরফে প্রোটাগনিস্ট মামুনকে দেখতে পাচ্ছি। বাদবাকি চরিত্র ও ঘটনারা স্মৃতিকোষে আচমকা বিজলিচমকে হানা দিচ্ছেন বৈকি। প্রায় হাজার পৃষ্ঠা জুড়ে বাঙালি মুসলমানের মনস্তত্ত্ব তালাশে সক্রিয় আবু জাফর শামসুদ্দীনের বেড়ে ওঠা থেকে দেহান্তর অবধি কালপর্বকে যদি নজরে আনি তাহলে দেখব, তাঁর প্রজন্ম ও পূর্ববর্তী প্রজন্মের সকলে কমবেশি হিন্দু ও মুসলমানে ভাগ হওয়া জনমিতির মধ্যে বিচরণ করেছেন। পুরোদস্তুর মুসলমানি আচার-বিশ্বাস প্রসূত সংস্কৃতির ঘেরাটোপে বালেগ হয়েছেন তাঁরা। অটোমেটিক মক্তবে গিয়েছেন। বিনা প্রশ্নে মাদ্রাসায় দীনী শিক্ষা রপ্ত করেছেন। সায়েবসুবোর বানানো স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে যদি-বা পা রেখেছেন কখনো, সেখানেও মুসলমানি আত্মপরিচয় বাকি সকলকিছু ছাপিয়ে বড়ো হয়েছে বারবার। ভারতবাসী বা হিন্দুস্তানি পরিচয়টি ততদিনে হিন্দু ও মুসলমানে নির্দিষ্ট হয়ে পড়েছিল। মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণের সুবাদে পাকিস্তানের অনিবার্যতাকে আবু জাফর শামসুদ্দীনরা যে-কারণে মেনে নিতে বাধ্য ছিলেন।
হিন্দু জনমিতির সঙ্গে মুসলমানের মিলমিশ ও বিরোধ সবসময় এই ছকের আনুগত্য করেছে। দুটি সম্প্রদায় পাশাপাশি ওঠবস করছেন অথচ যুগবাস্তবতায় নিজেকে ভাগ করে নিতে তাঁরা মরিয়া থাকলেন! মানসিক অবরোধের মাঝখান দিয়ে সমগ্র বিশ্ব তাঁদের মনোজগতে তরঙ্গ তুলছিল। আবু জাফর শামসুদ্দীনের প্রজন্ম কাজেই বাংলা, আরবি, ফার্সির সঙ্গে ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করেন। ইংরেজকে একচোখ দিয়ে তাঁরা অবলোকন করছিলেন, অন্য চোখ দিয়ে সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী বার্তা কেমন করে রুশ দেশ ছাপিয়ে ভারতবর্ষের আনাচ-কানাচে প্রবেশ করছে,—এই খবরে নিস্পৃহ থাকা তাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। জার্মানিতে ওদিকে নয়াবাস্তবতার উত্থান ঘটছে ততদিনে। হিটলারের মধ্য দিয়ে যা সামনে ক্রম-পরিণতি লাভ করবে। আজকের তুর্কে খেলাফত তখন মরহুম হওয়ার পথে আছেন। মুসলমানের সিধে হয়ে দাঁড়াবার মাটি সুতরাং নিখোঁজ ছিল সেইসময়। আবু জাফর শামসুদ্দীন তাঁর আখ্যানে এই উদ্বাস্তু উন্মূল কালপর্বকে ধারণ করবেন পরে, কথাটি এখানে টুকে রাখছি এইবেলা।
কংগ্রেস ও মুসলিমে লীগের রাজনীতি স্থির করে দিচ্ছিল দেশবাসীর ভবিষ্যৎ। এতোকিছুর সঙ্গে জড়াজড়ির অভিজ্ঞতা দেহে টানতে গিয়ে আবু জাফর শামসুদ্দীনের প্রজন্ম ছাড়াও সিনিয়রদের বড়ো অংশ কমবেশি নির্দিষ্ট কোনো একটি দিকে ঝুঁকে পড়তে বিমুখ ছিলেন। অনির্দিষ্টতায় সুখ পাচ্ছিলেন তাঁরা। মুসলমান পরিচয়ের ফ্রেম থেকে তাঁরা বেরিয়ে যাচ্ছেন না, সেটি সম্ভবও নয়, কিন্তু উক্ত পরিচয়ে অবিরত যেসব তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছিল সেগুলোকে পাশ কাটানোর সাধ্য কারো হয়নি। পদ্মা মেঘনা যমুনার বয়ানে যার ছাপচিত্র তরুণ বয়সে পা রাখার ক্ষণে পড়তে দারুণ লেগেছিল। পরস্পরবিরোধী তরঙ্গের প্রভাবে আবু জাফর শামসুদ্দীন ও তাঁর সিনিয়র প্রজন্ম প্রগ্রেসিভ মুসলিম হয়ে উঠতে আরম্ভ করলেন। এই মুসলমান নিজের দীনকে বিসর্জন দিচ্ছে না কিন্তু এর খোঁপে বন্দি থাকায় তার মনের সায় নেই। আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র মামুনের মধ্যে আগাগোড়া সে-কাহিনি লেখক বলার চেষ্টা করেছেন। উনিশ শতকে অচিহ্নিত থাকার পেছনে মুসলমান সমাজের সঙ্গে হিন্দু সমাজের মেরুদূরত্বের ভূমিকা ছিল বেশ গুরুতর। আপাত সম্প্রীতির ভিতরে নীরবে সক্রিয় সূক্ষ্ম-স্থূল সাম্প্রদায়িক অভিমানকে দুপক্ষ কখনোই ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। পদ্মা মেঘনা যমুনার বয়ানে লেখক এই দিকটি তোলে ধরেছেন।

মুসলমান নামে জনগোষ্ঠীর সুলুক পেতে আমাদেরকে অগত্যা মীর মশাররফ হোসেন ও সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীতে বারবার গমন করতে হয়েছে। বঙ্কিমে যে-মুসলমানকে পাচ্ছি তার অবয়ব মোটাদাগে ঐতিহাসিক। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে ইংরেজের কাছে পরাস্ত হতবিহ্বল মুসলমান রাজশক্তিকে প্রতীক ধরে নিজের ন্যারেটিভ বঙ্কিম তৈরি করেছিলেন। ন্যারেটিভের ইতিনেতি নিয়ে তর্ক-বিতর্কে কখনো ছেদ পড়েনি। ইসমাইল হোসেন সিরাজী যখন আনন্দমঠ ও দুর্গেশনন্দিনীর পাল্টা রায়নন্দিনী লিখছেন, সেখানে দু-পক্ষের সাম্প্রদায়িক অভিমানকে আমরা নগ্ন হতে দেখছি। কেন দেখছি বা এর পেছনে ক্রিয়াশীল রাজনীতির আলাপে আপাতত না যাই। কমবেশি সকলে তা জানেন। আমরা বরং আবু জাফর শামসুদ্দীন কোন তাড়নায় পদ্মা মেঘনা যমুনার পটভূমিতে গমন করলেন তার নেপথ্য কারণ আন্দাজের দিকে যেতে পারি।
দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যহারা হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান থেকে ইংরেজ আমলে পা রাখতে যেয়ে নতুন রাজের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন। মুসলমানরা প্রথম একশো বছর ইংরেজকে প্রত্যাখ্যানে জারি থেকেছেন। দ্বিতীয় ভাগে এসে ইংরেজদের বয়ান তারা হাতে নিলেন। না নিয়ে উপায় ছিল না আর! আলীগড় এদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বটে! নওয়াব আব্দুল লতিফরা এখানে এসে বেশ গুরুতর বিবেচিত হবেন। এই ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়ায় আমরা নজরুলকে পেয়েছি পরে। আবুল মনসুর আহমেদ, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বেগম রোকেয়ারা একে-একে দেখা দিলেন। শিখা গোষ্ঠীর ঝাণ্ডা উড়াতে এলেন আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেনসহ আরো অনেক। সকলের একটাই লক্ষ্য সেখানে,—মুসলমান সম্প্রদায়কে যুগানুবর্তী হওয়ার দিকে উৎসাহী করা। প্রতিপক্ষ হিন্দু সমাজের মতো করে মুসলমানের সাম্প্রদায়িক আত্মপরিচয় বিনির্মাণ। জুনিয়র ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, শওকত ওসমান, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ হয়ে এভাবে রশীদ করীমকে আমরা পেতে থাকব।
এখানে যা লক্ষ্যযোগ্য সেটি হলো তারা কমবেশি মুসলমান সমাজের সংকীর্ণতাকে নিরিখ করছেন, তাকে প্রশ্নের আওতায় নিয়ে আসছেন, অন্যদিকে এর থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদে সেকুলার মনোভাবও লালন করছেন মনোতলে। বাংলা সাহিত্যে আবু জাফর শামসুদ্দীনদের আবেদন যদি বিবেচনায় নিতে চাই তাহলে সেখানে কয়েকটি বিষয় ভোলার নয়। তাদের সাহিত্যে মুসলমান সমাজের অন্তঃপুরকে আমরা বেশ নিবিড়ভাবে পাই। হিন্দু সমাজের অন্দর-বাহিরও কমবেশি নজরে নিতে চেষ্টা করছেরন তাঁরা। উভয়ের মধ্যে যে-আন্তঃসংযোগ ও বিরোধ, এর আপাত মীমাংসা করতে না পেরে আবু জাফর শামসুদ্দীনের প্রজন্ম ইউরোসেন্ট্রিক উদারতাবাদে মুক্তির উপায় খুঁজছিলেন।
এখানে আবার দুটি ভাগ দেখতে পাচ্ছি। শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু জাফর শামসুদ্দীন বা রশীদ করীম উইরোসেন্ট্রিক বয়ানের মধ্য দিয়ে নিজেকে মুসলমানের গৎবাঁধা সংজ্ঞা থেকে বের করে আনতে তৎপর ছিলেন। এর বিপরীতে ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুদ্দীন আবুল কালামরা ইউরোসেন্ট্রিক বয়ানে গমন করলেও মোডারেট অথবা সেকুলার মুসলিম হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাদের মনে কস্মিনকালে জন্ম নেয়নি। মুসলমান সমাজকে তাঁরা ধারণ করছেন এবং এর উজ্জীবনের নিশান ইসলামি জাতীয়তাবাদে দেখতে পাচ্ছিলেন বেশ। অদ্য যে-বিষয়টিকে মর্মান্তিক পর্যায়ের প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন গত তিন-চার দশকে দেখা দেওয়া কবিলেখকের দল। এই জায়গা থেকে ভাবলে আবু জাফর শাসুদ্দীনের পদ্মা মেঘনা যমুনার বয়ানবিশ্বকে তাঁরা হয়তো প্রত্যাখ্যান করবেন এখন।

মানে দাঁড়াচ্ছে, দুটি ধারা গোড়ায় জন্ম নিয়েছে। আবু জাফর শামসুদ্দীনরা যে-ধারায় ছিলেন আর ফররুখ আহমদরা যে-ধারাকে সাহিত্যকে ভাষা দিতে তৎপর থেকেছেন, তার মধ্যে পাকিস্তান অনুগত ও পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশে গমনের দ্বন্দ্ব ক্রমাগত তীব্র হয়েছে। রশীদ করিমের আখ্যান যদি লক্ষ্য করি, তিনি দুভাগে মুসলমান নাগরিক সমাজকে সেখানে ধারণ করছেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের কলকাতা কেন্দ্রিক সমাজে মাটি খুঁজতে দেখেছি আমরা। দেশভাগের পর আবার একধরনের নিরালম্ব আয়তনে আত্মপরিচয় খুঁজে ফিরেছে তারা। কোথাও দাঁড়াতে পারেনি। যার ফলে রশীদ করিমের ভাষাবয়ন ও আখ্যান রচনার তরিকা পুরোদস্তুর ইউরোসেন্ট্রিক। মুসলমান সম্প্রদায়ে রিলিজিয়োসিটির মাত্রা ও প্রবণতা নিয়ে ওয়ালীউল্লাহ বড়ো আকারে প্রশ্ন তুলেছেন তখন। ব্যাপকভাবে পশ্চাদপদ এক সমাজ, যার জীবন মোটের ওপর আদিম, এবং যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতি তাকে বের হতে দিচ্ছে না। ওয়ালীউল্লাহর ভাষা ও বয়ান যারপরনাই পশ্চিমা সাহিত্য রচনার নানা ট্রিটমেন্টে ভরপুর।
তাঁদের মাঝখানে আবার শামসুদ্দীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যাকে আমরা উঁকি দিতে দেখব। পাকিস্তান-অনুগত কালাম ফেরত যাচ্ছেন গ্রামবাংলায়, এবং সেখানে ইসলামের লোকাল ফর্মকে আখ্যানে ব্যবহার করছেন তিনি। একালে পোস্ট মর্ডান আখ্যান রচনার তরিকায় যেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কাশবনের কন্যায় যে ন্যারেটিভ কালাম তুলে ধরছেন সেখানে তাঁর মুসলমান রেনেসাঁর খোয়াব তিনি ঠেসে দিতে ভোলেননি। ভাষা ও বয়ান যেখানে ইউরোসেন্ট্রিক তরিকায় আগয়ান হতে ঘোর অনিচ্ছুক। কালামের এই ন্যারেটিভকে পরে আবার শওকত আলী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পাশ কটিয়ে ফেরত যাবেন রুশ বাস্তবতাবদী সাহিত্যের ঘরানায়। চিরন্তন সেই ক্লাসিক্যাল স্কুলিং, যেখানে মানিক থেকে সমরেশ বসু হয়ে দেবেশ রায়… প্রত্যেকে কমবেশি স্বচ্ছন্দ থেকেছেন। কিন্তু শওকত আলী বা ইলিয়াস আর কখনো ফিরতে পারবেন না বা পারতে চাইবেন না আবু জাফর শামসুদ্দীনের নিষ্পাপ ভাষায় বিরচিত ন্যারেটিভের জগতে, যেখানে মুসলমান সম্প্রদায়কে আমরা দীনী বিশ্বাসের সঙ্গে সেকুলার ও ননসেকুলারের আত্মদ্বন্বে টুটাফাটা দেখেছি একসময়।

বিপরীতমুখী গতিস্রোতে শওকত ওসমান বা আবু জাফর শামসুদ্দীন তাহলে কোন স্রোতে পড়ছেন? তাঁরা হেঁটেছেন মধ্যবর্তী রেখায়। মুসলমান সমাজকে ধারণ করেছেন প্রবলভাবে। এর খুঁটিনাটি উঠিয়ে আনতে চেষ্টা করেছেন প্রাণপণ। ক্রিটিক করেছেন সমানে। মুসলমান সমাজে যৌনতার প্রশ্নকে ডিল করতে যেয়ে বড়ো ক্রিটিক পাচ্ছি সেখানে। রশদি করীম করেছেন এক ধাঁচে, বকিরা ধরেছেন অন্য পথ। সমাজটি বহুলভাবে অবদমিত ও যৌনকাতর ছিল। শওকত ওসমানের জননী আর আবু জাফর শামসুদ্দীনের পদ্মা মেঘনা যমুনার মহাকাব্যিক আখ্যান হওয়ার চেষ্টায় যৌনঅবদমন বড়ো বিষয়। যার প্রতিফলন, উনারা ভাবছেন, মুসলমান সমাজ থেকে উঠে আসা রাজনীতি ও তার পারিবারিক মূল্যবোধকে ডমিনেট করছে। মাহবুব-উল-আলমের মোমেনের জবানবন্দীও সেই গোত্রে পড়বে।
পদ্মা মেঘনা যমুনার বয়ান আবু জাফর শামসুদ্দীন প্রায় আট বছর সময় নিয়ে লিখেছেন। বিংশ শতাব্দীর সূচনায় যার প্রারম্ভ, এবং দেশভাগের মহেন্দ্রক্ষণে ইতি টানছেন। যেখানে আবার ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার আভাস পাঠক পেতেও পারেন। আখ্যানটি তার আয়তনের জন্য বিশিষ্ট। প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠার পরিসরে লেখক ধরতে চেয়েছেন এমন এক সম্প্রদায়কে যে কিনা একাধারে মুসলমান থাকতে চায়, কিন্তু ওই পরিচয়ে নির্দিষ্ট হওয়ার যন্ত্রণা তাকে অবদমিত রাখে। এই-যে রুশআখ্যান সুলভ বিরাট পরিসরে বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা… এর নেপথ্যে অনির্দিষ্টতাকে বড়ো কারণ গণ্য করা যেতে পারে। পাকিস্তান জন্ম নিতে চলেছে ঠিক আছে কিন্তু সেখানে নিজের জাতি-পরিচয় ও ধর্মীয় পরিচয়ের মীমাংসা লেখক দেখতে পাচ্ছেন না। ষাটের গোড়ায় তিনি আখ্যানটি লিখতে শুরু করেন। শেষ করছেন আয়ুব শাহীর পতন আর নতুন এক ভূখণ্ডে পাকিস্তান ভেঙে পড়ার প্রাক মুহূর্তে পৌঁছে।
আবু জাফর শামসুদ্দীনের ম্যাগনাম ওপাস আদৌ কতটা সফল, কতটা শিল্পকুশল, কতখানি চরিত্র-বিশ্লেষণে ওস্তাদী দেখাতে পেরেছিল, কতটা বিশ্বজনীন হয়ে ওঠার সুর সেখানে লেগেছে… ইত্যাদি আমার কাছে অবান্তর মনে হয়। আখ্যানটি গুরুত্বপূর্ণ তার এই নির্দিষ্টতার জন্য, যেখানে আখ্যানের প্রোটাগনিস্ট মামুন নির্দিষ্ট কোনো কেন্দ্রে নিজেকে স্থির ভাবতে পারে না। নিজের সাম্প্রদায়িক আত্মপরিচয়ে সে স্থির নয়। এই ট্যাগ মুছে দেওয়ার তাড়না ওদিকে তার মধ্যে অটল করে তুলতে পারে না সে। বামপন্থা তাকে টানে তবু সেখানে ধরা দিতে নাচার থাকে। তাকে পাওয়া কঠিন দক্ষিণপন্থায়। সব মিলিয়ে অবদমিত সময়প্রতীক রূপে উপন্যাসে তাকে বিচরণ করতে দেখে পাঠক। যেমন অবদমিত ছিল গ্রাম থেকে কলকাতার মহানগর অভিমুখে তার যাত্রার ইতিহাস। মামুন কাজেই নিরালম্ব, যে কিনা নিজেকে অবিরত তালাশ করে ফিরছে। আখ্যানের অন্তিমে এসে মামুনকে নির্বেদসুখে ঘনীভূত দেখে পাঠক। সে ও মরিয়ম মিলিত হওয়ার সংরাগে টের পাচ্ছে, সংসার মহারণ্যের জটিলতায় নিজেকে নির্দিষ্ট করা কঠিন। তাদের যাত্রারম্ভ অনির্দিষ্ট এবং আত্মপরিচয় অনিশ্চিত। বাঙালি মুসলমান এখনো তাই বটে!

এটি হচ্ছে তফাত, যা আবু জাফর শামসুদ্দীনের প্রজন্মের সঙ্গে অনতিপরবর্তী প্রজন্মকে পৃথক করে দিয়েছিল। তাঁরা উইরোসেন্ট্রিক মনন ধারণ করায় ছিলেন অনিশ্চিত ও অনিকেত। অনতিপরবর্তী প্রজন্ম, যেমন ধরা যাক আল মাহমুদরা অনির্দিষ্টতার কোপানল থেকে বাঁচতে হয়ে উঠতে চেয়েছেন প্রবলভাবে নিশ্চিত ও নির্ধারিত। এখন তাঁরা এমন এক নির্দিষ্টতায় নিজেকে স্থির করতে মরিয়া হলেন, কাজী আবদুল ওদুদ থেকে আবু জাফর শামসুদ্দীনরা একদা যেটি প্রত্যাখানকে জরুরি বলে রায় ঠুকেছিলেন। যাই হোক, আবু জাফর শামসুদ্দীনের অকপট বয়ানে রচিত আখ্যানটি কেন পাঠ-প্রাসঙ্গিক করা প্রয়োজন সেটি নিয়ে হামিম কামরুল হক বেশ ভালো লিখেছেন। তাঁর পাঠ-মূল্যায়ন আগ্রহীরা ফেসবুকে পড়ে দেখতে পারেন।
. . .
. . .