বিশ্বব্যবস্থায় নতুন বাঁকবদলে চোখ গেঁথে রাখা অথবা এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর অবস্থায় বাংলাদেশ এখন আর নেই। মহা বিশৃঙ্খলায় পড়ে গেছে দেশ! আজব দেশে গজব নেমেছে খোদার! কোনো সুরত জান নিয়ে বাঁচার ভাবনায় কাবু জনগণ। পোকামাকড়ের জীবন কাটছে প্রতিদিন। ওদিকে বিশ্ব আরেক দফায় যুগান্তকারী পালাবদলের সম্মুখীন হতে চলেছে। ইসলামের মক্কা সৌদি আরব এক যুবরাজ সালমানের পাল্লায় পড়ে বদলাতে শুরু করেছে। আরব দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকার মদদপুষ্ট ইসরায়েলের হাতে বিপর্যস্ত প্যালেস্টাইন আর ওদিকে সিরিয়া, মিশর, ইয়েমেনের মতো গুটিকয় দেশ বাদ দিলে বাকিরা উগ্রতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে বাস্তবমুখী হওয়ার চেষ্টায় কমবেশি আগাচ্ছে দ্রুত। ধর্ম বিশ্বাস ও আচারকে তা-বলে ছটাই করতে হচ্ছে না। দীনের অনুশীলন থাকছে যথারীতি, কিন্তু ইহজাগতিক উন্নতিতে তাকে অনর্থক জুড়ে দিয়ে দেশ-জাতি গড়ে তোলার ভাবনা থেকে আরববিশ্ব সরে এসেছে। বদলে যাওয়ার ইতিবাচক একটি ছবি যে-কারণে সৌদিসহ আরব দেশগুলোয় সম্প্রতি সবাই দেখতে পাচ্ছেন।
ওমানের উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক হবে মনে হচ্ছে। আবাসন সমস্যার মোকাবিলায় তারা যে-পথে আগানোর কথা ভাবছে সেটি যথেষ্ট ব্যতিক্রম। তাজ্জব হওয়ার মতো ঘটনা বললেও অত্যুক্তি হয় না। দেশটির অর্থনীতি বেশ সংহত। আবাসন পরিকল্পনায় মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ সুউচ্চ ভবন নির্মাণে মনোনিবেশ করেছে। ওমান সেখানে উল্টোপথের যাত্রী। সুউচ্চ ভবন নির্মাণে রাশ টেনে আধুনিক ও স্বল্প খরচে আরামদায়ক বাসভবন তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তারা। চিরাচরিত ঐতিহ্য মেনে যেসব ভবন সেখানে নির্মিত হয়ে আসছে যুগ-যুগ ধরে, ওমান এখন সেগুলোর আদলে আবাসন ও বাণিজ্যিক ভবনকে একটি বিন্যাসে নিয়ে আসার নকশা চূড়ান্ত করেছে। এর ফলে ঐতিহ্যে হাত দিতে হচ্ছে না। ভবন নির্মাণের পুরাতন ঐতিহ্যের আদলে নতুন আবাসন গড়ে তোলায় মনোযোগী দেশটির সরকার।
আগামীদিনের বসবাস-উপযোগী স্মার্ট সিটি গড়ে তোলায় ওমানের পদক্ষেপকে বিশেষজ্ঞরা দুবাইজেশনের বিপরীতে ওমানের নিজস্বতা বলে চিহ্নিত করছেন ইদানীং। গত তিন দশকে দুবাইসহ অন্য আরব রাষ্ট্র সুউচ্চ ভবন নির্মাণের সংস্কৃতিতে গমন করেছে। ওমান কিন্তু এর বাণিজ্যিক উপযোগিতা ও প্রলোভনের ব্যাপারে সজাগ। নগরায়নের ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে তৈরি তাদের নকশাটি ব্যর্থ হতে পারে;- তারা সেটি অস্বীকার করছে না। তথাপি ওমান মনে করে বাসভবন নির্মাণের ঐতিহ্যকে নগর-পরিকল্পনায় সমন্বিত করা আগামী দিনগুলোয় অধিক ফলদায়ক প্রমাণিত হবে। মানুষকে স্বল্প খরচে আরামদায়ক আবাসন উপহার দেওয়া ও সেখানে আধুনিক সুবিধাদি সমন্বিত করা উচিত। বসবাসের জন্য যেটি নান্দনিক ও আরামদায়ক হতে পারে। ওমানের এই উল্টোযাত্রার তাৎক্ষণিক ফলাফলকে মন্দ বলা যাচ্ছে না। প্রচুর পর্যটক টানছে দেশটি।
সময়ের পালাবদলকে যে-দেশ ধরতে পারে না, নিজেকে উপযুক্ত করার কথা ভাবে না, পরিকল্পনা থাকে না সামনে… তার মতো দুর্ভাগা কেউ নেই। বাংলাদেশ কেবল সময়ের পালাবদল ধরতে না পারায় বিনষ্ট হতে বসেছে। স্বৈরাচার ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনটা অধিক ভালো এই তর্ক বহুদিনের। তর্ক আগে ছিল। তর্ক এখনো আছে। ভবিষ্যতেও এসব নিয়ে তর্কে যতি পড়বে না। শাসনব্যবস্থা যাই থাকুক, সেখানে যদি রাষ্ট্রগঠনের বীজ অনুপস্থিত থাকে, ভিশন না থাকে, সেক্ষেত্রে আগানো যায় না। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এসথার দ্যুফলে বিরচিত গরিবের অর্থনীতি (Poor Economics) বইটি যে-কারণে সকলের পাঠ করা উচিত। গরিব সুরক্ষায় নরেন্দ্র মোদির নেওয়া কর্মসূচির সঙ্গে শেখ হাসিনার আমলে গৃহীত কর্মসূচীর নানান দিক থেকে সাদৃশ্য ছিল। অভিজিৎ ও এসথার দ্যুফলের বই পাঠে বিষয়টি বেশ উপলব্ধি করে পাঠক। ক্ষুদে উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে অর্থনীতির বিকেন্দ্রীভবন কিন্তু যুগ-বাস্তবতা। বাংলাদেশে বিকাশ, নগদ-এর মতো প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব এখানে এসে প্রবল হয়ে উঠছে। পুওর ইকোনমিক্স-এ যার কার্যকারণ দুই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

সামাজিক সুরক্ষার আওতায় হাসিনা সরকারের আমলে প্রায় ত্রিশ ধরনের ভাতার কার্যকারিতা নিয়ে নানান প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকলেও পুরোদস্তুর মাঠ পর্যায়ের গবেষণা থেকে লেখা পুওর ইকোনমিক্স হাতে নিলে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা পাঠকের না বোঝার কথা নয়। গরিব মানুষদের জীবনে খাদ্য ব্যবস্থাপনা, ঋণ, সঞ্চয়, ভর্তুকি বাবদ পাওয়া অর্থ নিজের শখ মিটানোর জন্য তারা কীভাবে খরচ করেন তার একটি পরিষ্কার ছবি সেখানে আমরা পাচ্ছি। জরুরি চাহিদা মিটানোয় বরাদ্দ ভতুর্কিকে দুস্থরা কী কারণে তাদের জন্য বিলাসিতা হিসেবে গণ্য শখ পূরণে ব্যবহার করে, তার মনস্তত্ত্ব বইটি তুলে ধরতে ত্রুটি করেনি। সামাজিক সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে হাসিনার নেওয়া কর্মসূচীকে এরকম এক মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। হাসিনা আমলে সুশানের ঘাটতি শোচনীয় হলেও পুঁজিবাদী জীবনবিকাশের এই পর্যায়ে এটি নিশ্চিত করা আসলেও কঠিন।
ব্যর্থ বামপন্থার পৃথিবীতে এখনো নিজেকে বামপন্থী ভাবেন অভিজিৎ। সেইসঙ্গে মেনে নিচ্ছেন,- বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে পরিকল্পনা সাজানো জরুরি। রিজিড হওয়া ভালো কোনো লক্ষণ নয় সেখানে। অমর্ত্য সেনের গরিবের জন্য কল্যাণরাষ্ট্রের ভাবনার সঙ্গে তাঁর ভাবনা যে-কারণে অনেকক্ষেত্রে মিলে যায়। হাসিনার শাসনামলে তার কিছু প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠতে শুরু করেছিল। পনেরো বছরের বিতর্কিত শাসন খতম হওয়ার ছয় মাসের মাথায় দেশ কোথায় আছে তার কোনো পরিষ্কার ছবি কি জাতি দেখতে পাচ্ছে এখন? ক্ষমতাসীন সরকার গরিবের অর্থনীতিকে কীভাবে ডিল করছেন? রূপরেখা কেমন সেখানে? কেউ তা জানে বলে মনে হচ্ছে না। অকেজো ও নপুংসক গণমাধ্যম সরকারের হয়ে মিথ্যা গুণগানে ব্যস্ত। নিজের পিঠ বাঁচানোর তালে আছে তারা। হাসিনাপার্টিকে ঠেকানোর বাহানায় মবসন্ত্রাস দেশে একমাত্র বাস্তবতা। রাজনৈতিক সরকার যদি সামনে আসেও, সহসা এই সংকট কাটবে বলে আশা করা যাচ্ছে না। গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা বরং তীব্র হচ্ছে দেশে।
শেখ হাসিনা স্বৈরশাসক ছিলেন। অনেক অপরাধের দায় তাঁকে নিতে হবে। সেইসঙ্গে বিবেচনায় রাখতেই হচ্ছে,- হাজার সমালোচনা সত্ত্বেও পরিষ্কার একটি লক্ষ্য নিয়ে তিনি আগুয়ান ছিলেন। পনেরো বছরে খারাপ কাজের যেমন কমতি ঘটেনি, স্থিতিশীল উন্নয়ন ও অগ্রগতির সড়ক ধরেও দ্রুত আগাচ্ছিল বাংলাদেশ। লুটেরা গোষ্ঠীর পাশাপাশি খেটেখাওয়া মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি গত ছয় মাসের তুলনায় ভালো ও স্থিতিশীল অবস্থায় ছিলেন। কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ আর ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ছিল। কাঁচা টাকার প্রবাহ করোনা অতিমারি ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে দুর্নীতির চাপ সামলে যাচ্ছেতাই অবস্থায় যেন না পৌঁছায় সেই ভাবনা ও পরিকল্পনা সরকারের ছিল। যার ফলে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে জন-অসন্তোষ থাকলেও ব্যয় করার সার্মথ্য তলানিতে ঠেকেনি। হাসিনার ভুলত্রুটি ও ভালোমন্দকে অগত্যা ভালোভাবে অবধান করার প্রয়োজন সামনে আরো প্রকট হতে পারে। দেশকে তিনি কোথায় নিয়ে যেতে চাইছেন সেটি বিশ্ব জুড়ে সম্প্রসারিত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো আঁচ করতে পেরেছিল।
শিক্ষার মান নিম্নগামী হওয়া বা একে সেদিকে যেতে দেওয়া ছিল শেখ হাসিনার বড়ো অপরাধ। মানুষের কাছে দুর্নীতি ফ্যাক্টর হলেও পুঁজিবাদী সমাজবিকাশের প্রাথমিক ধাপে পা রাখার দিনে এসব রোধ করা সত্যি কঠিন। চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস যদি হাতে নেই তাহলে দেখব,- উপনিবেশ বিস্তারের সুবাদে ইংল্যান্ডে শিল্পায়ন ও উন্নয়ন শুরু হলেও রাষ্ট্রের খোলনলচে তখনো সংহত রূপ পায়নি। অ্যানার্কি ব্যাপক ছিল। দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বিপরীতে অর্থনীতির পুরোটাই সমাজের একটি স্তরে পুঞ্জীভূত ছিল। ডিকেন্স তার ছবি আঁকছিলেন কেবল। ইংল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা অবান্তর, তবে একুশ শতকে আমরা সামান্য মাত্রায় হলেও এরকম ট্রানজিশনের ভিতর দিয়ে যেতে আরম্ভ করেছিলাম। একে এখন ধরে রাখতে পারলে ভালোমন্দ মিলিয়ে একটা ফলাফল অবশ্যই আসত। এখন কী আসছে বা আসতে চলেছে তার বিষয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!
. . .
. . .