টেক বুলেটিন

প্রযুক্তি-সামন্তবাদ – বিশ্ব কি মধ্যযুগে ফেরত যাচ্ছে পুনরায়?

Reading time 7 minute
5
(3)

গ্রিক অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারোফাকিস আর ওদিকে নৈরাজ্যবাদী দর্শনের আকর্ষণীয় চরিত্র হেগেলভক্ত স্লাভয় জিজেক হামেশা আওরান বটে,—পুঁজিবাদের মরণ সুনিশ্চিত হলেও বিকল্প হিসেবে সামনে যা আসতে চলেছে সেটি তারচেয়েও ভয়ানক হতে যাচ্ছে। আসন্ন বিশ্বব্যবস্থা কেবল পুঁজিবাদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে বসে থাকবে না, সেইসঙ্গে গণতন্ত্রের বিলুপ্তিকে অনিবার্য করে তুলবে। বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থীদের প্রবল উত্থানের যুগে পুঁজিবাদ তার সর্বশেষ মেরুকরণের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে বলে দুজনেই মনে করেন। গণতন্ত্র নিশ্চিত করা নিয়ে বিচিত্র সব পন্থাও সেইসঙ্গে অকার্যকার প্রতিপন্ন হতে চলেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র, যারা এখনো পুঁজিবাদের পরিণত স্তরে পা রাখতে পারেনি, এবং যারা গণতন্ত্রের জন্য হাপিত্যেশ করে মরছে,—তাদের কী হবে? প্রশ্নের উত্তর সময় নিশ্চয় বলে দেবে, তবে একথা সত্য,—পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও তার মধ্য দিয়ে বিকশিত গণতন্ত্র বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থার প্রবল উত্থানচাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন ন্যাটোর মাধ্যমে ইউরোপকে সামরিক সুরক্ষা দানের অঙ্গীকার থেকে সম্প্রতি পল্টি নিলেন।

মিউনিকে অনুষ্ঠিত ইউরোপ মহাদেশের জাতিরাষ্ট্রের সুরক্ষা বিষয়ক সামিটে সমাপনী বক্তব্যে সামিট সভাপতি নিজেকে সামলাতে না পেরে শেষপর্যন্ত কেঁদেই ফেললেন! বিশ্ব দৃশ্যটি দেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম ইউরোপকে এতটা ভীতসন্ত্রস্ত ও অসহায় দেখল বিশ্ব। তাদের পেটের মধ্যে রাশিয়া নামে অতিকায় দানবের অবস্থান। দেশটি সরাসরি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত নয়। ইইউ-র সঙ্গে তার সম্পর্ক সেখানে বড়োভাইসুলভ। যে-চুক্তির ভিত্তিতে ইউরোপের কোনো রাষ্ট্র ইউনিয়নের সদস্য হয়ে থাকে, গোড়া থেকে রাশিয়া তাতে সই করতে গররাজি থেকেছে। দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার মাধ্যমে ইউনিয়নে সঙ্গে তার বাণিজ্যিক ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা চালিয়ে এসেছে এতদিন। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের পল্টিবাজি ও রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত মিত্রতা ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোকে মনস্তাত্ত্বিক চাপে নিক্ষেপ করেছে।

The chairman of the Munich Security Conference broke down in tears; Source – WION YTC

মিউনিক সামিটে জেডি ভান্সের বক্তব্যের পর সামিট সভাপতির কান্নাভরা সমাপনী ভাষণে নিজেকে এতিম ও বিপন্ন ভাবার চাপ বেদনুবিধুর ছিল। এখান থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন সমীকরণে গমন করবে সেটি নিশ্চিত। এছাড়া উপায় নেই। ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ ও তিক্ত বিবাদের পরপরই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক মৈত্রীতে গমনকে যার প্রাথমিক ধাপ বলা যেতে পারে।

ট্রাম্প দুদিক থেকে ইউরোপকে বিপদে ফেলেছেন। প্রথমত, ভারী শিল্প যেমন স্টিলজাত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে জার্মানির মতো দেশকে এখন বাড়তি শুল্ক গুনতে হবে। বাড়তি শুল্কের বোঝা সংগতকারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি করবে। সেইসঙ্গে ডলারের মূল্যমানে রিজার্ভ ধরে রাখার খেলায় ইউরোপ তার স্থানীয় মুদ্রাকে যে-ভারসাম্যে রেখেছে এতদিন, এখন থেকে সেটি ব্যাহত হবে। কীভাবে হবে তার ব্যাখ্যা সম্প্রতি মুক্ত সাংবাদকিতায় বিশ্বাসী লেবানিজ ইউটিউবার রানিয়া খালেকের পডকাস্টে ভারোফাকিস দিয়েছেন বটে।

বিভিন্ন দেশের ওপর ট্রাম্পের ট্যারিফ বা বাণিজ্যশুল্ক বৃদ্ধিকে যারা নির্বুদ্ধিতা বলছেন, তাঁদের কথার যৌক্তিকতা স্বীকার করলেও ভারোফাকিস এই ব্যাপারে ভিন্ন ধারণা পোষণ করেন। তাঁর মতে, দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব কাণ্ড করছেন তার সবটাই পরিষ্কার মাস্টার প্ল্যানের অংশ। যুক্তরাষ্ট্রে যেসব দেশ পণ্য রপ্তানি করে তাদের কাছ থেকে বাণিজ্যযুদ্ধের পয়লা কিস্তিতে বাড়তি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে ট্রাম্প সরকার। দেশটির ফেডারেল রিজার্ভকে এই অর্থ শক্তিশালী করবে। বাড়তি উৎপাদন ব্যয় মিটানোর কারণে নিজেদের রিজার্ভকে আগের মতো ডলারের বিপরীতে সংহত রাখাটা রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য এভাবে কঠিন করে তুলছেন ট্রাম্প। নিজের মুদ্রাকে ভারসাম্যে রাখাটাও কঠিন হবে তাদের জন্য।

অন্যদিকে আমেরিকান ভোক্তার ওপর শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বাড়তি মূল্যের চাপ, ট্রাম্প প্রশাসনে নিযুক্ত অর্থনীতিবিদদের হিসাব মোতাবেক এতটা বেশি নয় যে লোকজন খেপে যাবে। উপরন্তু ট্রাম্প নিজ দেশে ভারী শিল্প উৎপাদনের দিকে যাবেন। এর ফলে অন্য দেশ থেকে আমদানির চাপ কমবে। ইউরোপের দেশগুলোকে এভাবে দুর্বল করার খেলায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বয়ং তাঁর উৎপাদিত পণ্য তাদেরকে ক্রয় করতে মজবুর করতে পারেন। এর পাশাপাশি উৎপাদন খর্চা মিটাতে ঋণচক্রে ইউরোপের দেশগুলোকে বন্দি করার মতলব তো থাকছেই। ইউরোপ যদি বিকল্প বাজারের সন্ধানে নামে তাহলে এই ট্রাম্পঝড় তারা হয়তো সামলে উঠতে পারবে।

ট্রাম্পের এই নীতিকে ভারোফাকিস ইভিল প্ল্যান বলেই ভাবেন। রাজনৈতিক সংকট তৈরিতে যা ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মেনে নিচ্ছেন। বড়ো কথা, ট্রাম্পচালে মার্কিন অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও আমজনতার ভাগে লাভের গুড় কিছুই জুটবে না। রিজার্ভের সবটাই অবকাঠামোগত উন্নয়নের বাহানায় ধনিক গোষ্ঠীর পকেট আরো ভারী করবে। জনগণ সেই উন্নয়নে কামলা হিসেবে কাজবাজ পাবে। বেকারত্বের চাপ তাতে কিছুটা কমবে মাত্র। লাভ বলতে এটুকু।

Slavoj Žižek meets Yanis Varoufakis; Source – How To Academy YTC

মোদ্দা কথা, বিশ্ব নতুন এক অর্থনৈতিক মেরুকরণের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, যেখানে ইউরোপের আরো বেশি ঋণচক্রে বাঁধা পড়ার সম্ভাবনা থাকছে। ইউরোপের আশু বিপর্যয় নিয়ে ভারোফাকিস ও জিজেক অনেকদিন ধরে বলে আসছিলেন। রাজনৈতিক মহলে দুই বুদ্ধিজীবীর গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক হলেও তাঁদের কথাকে আমলে নেওয়ার অবস্থায় কেউ ছিলেন না। সে যাকগে, ভারোফাকিস ও জিজেক এখান থেকে আরো বৃহৎ পরিসরে পুঁজিবাদের কফিনে পেরেক ঠুকতে নতুন বিকল্পের উত্থান ঘটার আলাপ তুলছেন। কী সেই বিকল্প? ভারোফাকিস এই বিকল্পকে টেকনো ফিউডালিজম বা প্রযুক্তি -সামন্তবাদ নামে কয়েনাইজড করেছেন। Techno-Feudalism: What Killed Capitalism-এ ব্যাখ্যা করেই বলছেন,—পুঁজিবাদ তার ঐতিহ্যবাহী চরিত্র হারিয়ে নতুন অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থায় রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। সামন্তবাদী কাঠামোর মতো হবে তার সুরত।

প্রচলিত পুঁজিবাদ এখন পর্যন্ত সম্পদ সঞ্চয় ও পুঁজি বিনিয়োগ, মজুরি ভিত্তিক শ্রম, প্রতিযোগিতমূলক বাজারে পণ্য বিপণন ও মুনাফা, এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বাজার পরিচালনা করে থাকে। এর ভিত্তিতে ধনিক বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ সারা বিশ্বে নানান মাত্রায় আজো ঘটছে। যেখানে বাকিরা ব্যক্তি মালিকানাধীন পণ্য উৎপাদনের ছকে একইসঙ্গে শ্রমিক ও ভোক্তা রূপে সামাজিক স্তরে বিচরণ করেন। ছকটি ভেঙে দিতে টেকেনো ফিউডালিজমের বিকাশ ঘটবে সামনে। ব্যক্তি মালিকানধীন প্রতিষ্ঠান এখানে কিছু উৎপাদন করবে না। সে যা করবে তাকে মাছের তেলে মাছ ভেজে নেওয়া বলা যেতে পারে। যেমন, বিশ্ব জুড়ে দাপটের সঙ্গে সক্রিয় মেটা, আমাজন, গুগল-এর মতো টেক জায়ান্টরা rentier capitalism বা ভাড়াভিত্তিক পুঁজিবাদের সূচনা ইতোমধ্যে ঘটিয়ে বসেছে। প্রচলিত পুঁজিবাদে বুর্জোয়ারা পণ্য উৎপাদন করে এবং মুনাফার জন্য বাজারে বিক্রি করে। প্রযুক্তি-সামন্তবাদে কর্পোরেট লর্ডরা কিছু উৎপাদন করে না। আমরা স্বয়ং তাদের হয়ে তথ্য উৎপাদন করি, আর এর জন্য তারা যেসব ডিজিটাল পরিষেবা চালু করেছে, সেগুলো ব্যবহারের জন্য ভাড়াও দিয়ে থাকি।

বিভিন্ন আ্যপস বা কৃত্রিম বুদ্ধমত্তার মতো প্রযুক্তি তৈরিতে টেক কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করছে। যেখানে এসব অ্যাপস ও প্রযুক্তিকে অ্যালগরিদমের মাধ্যমে পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করে তারা। এখন এই অ্যালগরিদম এমন এক প্লাটফর্মে কাজ করে যার কোনো বাস্তবিক অবয়ব নেই। তার অস্তিত্বটি এখানে গায়েবি বা ভার্চুয়াল। বিশ্বব্যাপী ছড়ানো ইন্টারেন্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে প্লাটফর্মটি তারা তৈরি করেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষ তাদের পরিষেবা ব্যবহার করছেন। ব্যবহার করতে গিয়ে নিজের সমুদয় তথ্য বা ডেটা তারা সেখানে দিতে বাধ্য। এর মধ্য দিয়ে অ্যাপসগুলো মানুষের মনোসঃযোগ, তথ্য ও ডিজিটাল শ্রম বিনাখর্চায় কিনে নিচ্ছে। মানুষকে আবার সেই তথ্য ভাড়ায় বিক্রি করছে তারা।

Technofeudalism: What Killed Capitalism by Yanis Varoufakis; Image Source – Google Image

আমরা গুগলে সার্চ করি, আমাদের তথ্য সংগৃহীত হয়, তারপর গুগল আমাদের সেই তথ্যের ভিত্তিতে কাস্টমাইজড বিজ্ঞাপন সামনে আনে ও মুনাফা করে। আমরা সমাজমাধ্যম ব্যবহার করি। ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের মতো শক্তিশালী তথ্য সংগ্রহাকের কাছে আমাদের সকল তথ্য অবিরত তুলে দিতে থাকি। তারা সেগুলো সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে। আমাদের ইচ্ছা ও আগ্রহকে অ্যালগরিদমের ছকে ফেলে পুরোপুরি বিশ্লেষণ করে তারা। রকমারি পণ্যের প্রতি আমাদের মনোভাবকে এভাবে সহজেই যাচাই করে নিতে পারছে তারা। পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অতঃপর তথ্যের বিপুল এক সম্ভার নিয়ে হাজির হচ্ছে, যার মালিকানা এখন পুরোটাই তাদের হাতে কুক্ষিগত। আমাদের সম্মতির তোয়াক্কা না করে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তারা সেগুলো বিক্রি করে। আমরা চ্যাটজিপিটি বা অন্যান্য এআই টুল ব্যবহার করে সেগুলোকে অবিরত উন্নত হতে সাহায্য করছি, এবং ভবিষ্যতে এই উন্নত সংস্করণটি ব্যবহার করতে টাকা গুনতে হচ্ছে।

সেবা পেতে হলে আমাদেরকে ইন্টারেনেটে ঢুকতেই হবে। সেটি কিন্তু ফ্রি নয়। মানুষ একটি সেবায় অভ্যস্ত হওয়ার সুবাদে সেবাটি তার জন্য প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে যায়। সেবার সবটুকু সুবিধা পেতে হলে তাকে টাকা খর্চা করতে হচ্ছে। মেটা বা গুগলের মতো টেকজায়ান্ট টাকা আয়ের যে-সুযোগ মানুষকে করে দিচ্ছে, সেটিও প্রকৃত অর্থে ফ্রি নয়। যেমন ইউটিউবের মাধ্যমে যিনি অর্থ উপার্জন করছেন, এর জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যবহারকারী তাকে তৈরি করে নিতে হচ্ছে। ব্যবহারকারীর সকল তথ্য গুগল তার অ্যালগরিদমের সাহায্যে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে আয় করছে। মার্কস কথিত উদ্বৃত্ত শ্রমের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের নতুন চক্রে বিশ্ব ইতোমধ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। টেকজায়ান্টদের হাতে মানুষের মন-মগজের সবটাই যেখানে জিম্মি বলা চলে।

অ্যালগরিদম কেমন বা সেটি কীভাবে কাজ করে তার কুছ পাতা ভোক্তার নেই। যার ফলে প্রচলিত পুঁজিবাদ থেকে এর চরিত্র ভিন্ন। পুঁজিবাদ আমাদের শ্রমের বিনিময়ে বেতন দিত এবং আমরা পণ্য ক্রয় করতাম। প্রযুক্তি- সামন্তবাদে আমরা নিজে হচ্ছি তথ্যশ্রমিক,যদিও পুঁজিবাদের মতো স্পষ্ট কোনো বাজারমূল্য ও বিনিময় সেখানে অনুপস্থিত! আমাদের মনোসঃযোগ ও তথ্যকে কেবল ভাড়া নিচ্ছে তারা। এর ফলে ডিজিটাল কোম্পানিগুলো খোদ ভোক্তা পর্যায়ে শুধু নয়, রাষ্ট্রকেও নিয়ন্ত্রণ করছে প্রতিনিয়ত।

গুগল, মেটা, মাইক্রোসফট, আমাজন, আলীবাবা, টিকটক, স্টারলিংক-এর মতো প্রতিষ্ঠান Corporate State-এ নিজেকে রূপান্তরিত করেছে। তাদের হাতে যে-পরিমাণ তথ্য মজুদ রয়েছে, তার দশভাগের একভাগ রাষ্ট্রের ভাঁড়ারে নেই। অর্থনীতিকে যে-কারণে তারা নিয়ন্ত্রণ করে এখন। নীতিনির্ধারণে প্রভাব রাখে বিস্তর। রাষ্ট্র স্বয়ং এসব টেককোম্পানির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। করোনা অতিমারির সময় দেখা গেল রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রযুক্তি দানবরা সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। সরকারের তথ্য ব্যবস্থাপনাও অসরকারি প্রযুক্তি কোম্পানির হাতে সংরক্ষিত, যেমন, গুগলের ক্লাউড ইনফ্রাস্ট্রাকচার সরকারের জন্য সংবেদনশীল সকল তথ্য সংরক্ষণ করে থাকে। এর ফলে এসব টেক কোম্পানির মালিকরা মিলে একটি সংহত গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। মধ্যযুগের মতো সামন্তবাদী চরিত্র যেখানে ক্রিয়াশীল।

Technofeudalism by Yanis Varoufakis; Source – Yanis Varoufakis YTC

প্রযুক্তি-সামন্তবাদ ওরফে টেকনো ফিউডালিজম এভাবে রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে অকার্যকর করে দিচ্ছে। মধ্যযুগে রাজারা সামন্তবাদী ভূস্বামী ও বণিকদের ওপর নির্ভরশীল ছিল! ডিজিটাল সামন্তবাদের পুরোহিতচক্রকে অনেকটা সেরকম দেখতে! ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, স্যাম অল্টম্যান, বিল গেটসের মতো ব্যক্তিরা সেখানে চালক।। মধ্যযুগে বিরাজিত খ্রিস্টান চার্চের মতো সমস্ত ক্ষমতা তাঁরা কুক্ষিগত রেখেছেন, এবং রাষ্ট্রকে তাদের অভিলাষ মোতাবেক পরিচালিত হতে বাধ্যও করছেন ব্যাপক। ট্রাম্প প্রশাসনে ইলন মাস্কের প্রভাব এক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ গণ্য হতে পারে। সামন্তবাদটি, ভোরাফাকসের ব্যাখ্যা মোতাবেক কয়েকটি লেয়ারে কাজ করে :

এক-একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মালিক হচ্ছেন তথ্য ও অ্যালগরিদমের নিয়ন্ত্রক। ডিজিটাল সার্ফার হলেন ভোক্তা। তারা আসলে তথ্যশ্রমিক। বিনামূল্যে কামলা দিচ্ছেন সেখানে। গিগ ওয়ার্কারস হচ্ছেন চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক শ্রেণি। নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ডিজিটাল সার্ভিস থেকে আয় করেন, যেমন উবার চালক। ভোক্তা এখানে স্বেচ্ছায় শ্রম দিচ্ছেন বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। প্রযুক্তি কোম্পানি সুকৌশলে এই জালে তাদেরকে বন্দি করছে। নিজের সকল মনোসংযোগ তারা সেখানে বিনিয়োগ করেন। তথ্য পেতে কোম্পানিগুলোকে সহায়তা করেন অবিরত। মনোসংযোগ ও ডেটা মাগনা তুলে দেন তাদের হাতে। পরবর্তীতে যেগুলো পণ্যমূল্যে পরিণত হয় এবং তাদের জন্য ফেরত অনে তথ্যবিক্রেতা কোম্পানি।

ধ্রুপদি পুঁজিবাদে উদ্বৃত্ত শ্রমের পরিসর তৈরির মাধ্যমে অর্জিত মুনাফাছক বায়বীয় বা অদৃশ্য শ্রমের মধ্য দিয়ে মুনাফায় রূপান্তরিত হছে অনায়াস। এসব কারণে ভারোফাকিস বলছেন, আমরা এমন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছি যেখানে কর্পোরেট ডিজিটাল লর্ডদের অধীনে আমাদের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। রাষ্ট্র এখন দুর্বল, এবং গণতন্ত্র হুমকির মুখে। আমরা একটি নতুন ডিজিটাল সার্ফডমএর দিকে ধাবিত হচ্ছি।

এখন এই কর্পোরেটচক্র ভেঙে দেওয়ার মতো রাজনীত, যার কথা জিজেক বলছেন, যদি নিশ্চিত করা না যায় তাহলে সভ্যতা অন্যভাবে মধ্যযুগীয় সামন্তবাদে ফেরত যাবে। যেখানে ইলন মাস্করা হচ্ছে চার্চ আর রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছেন চার্চের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একক, যার পক্ষে জনগণের স্বাধিকার বজায় রাখা আর সম্ভব নয়। ঘটনাটি এক অর্থে পুঁজিবাদের পশ্চাদপসরণ। সে ফেরত যাচ্ছে পেছনে,—মধ্যযুগে। অ্যলগরিদমকে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রাখার শিকলটি ভাঙতে না পারলে সামনের পৃথিবী পরিষ্কার অলিগার্কির অধীনস্থ হবে, যেখানে আমরা সকলে নিছক শ্রমিক, এবং আমাদের স্বাধিকার বা গণতান্ত্রিক বিষয়গুলো ইলন মাস্ক ও জেফ বেজোসরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করবে।
. . .

Billionaire warlords: Why the future is medieval – Sean McFate; Source – Big Think YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 3

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *