গানালেখ্য - পোস্ট শোকেস

গানালেখ্য : মেলাবেন তিনি, মেলাবেন

Reading time 5 minute
5
(15)

মেলাবেন তিনি মেলাবেন
[অমিয় চক্রবর্তী ও শহীদ কাদরীর ‘সংগতি’ / ’সঙ্গতি’ কবিতার সাংগীতিক সংস্করণ]

Amiya Chakravarty; Image Source – Collected; Wikipedia

সংগতি
অমিয় চক্রবর্তী

Ganalekhkho : Songgoti by Amiya Chakravarty; Musical Version – Created by Ahmed Minhaj in collaboration with AI; @thirdlanespace.com

মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর
পোড়ো বাড়িটার
ঐ ভাঙ্গা দরজাটা।
মেলাবেন।

পাগল দাপটে দেবে না গায়েতে কাঁটা।
আকাশে আগুনে তৃষ্ণার মাঠ ফাটা
মারী-কুকুরের জিভ দিয়ে খেত চাটা,—
বন্যার জল, তবু ঝরে জল,
প্রলয় কাঁদনে ভাসে ধরাতল—
মেলাবেন।

তোমার আমার নানা সংগ্রাম,
দেশের দশের সাধনা, সুনাম,
ক্ষুধা ও ক্ষুধার যত পরিণাম
মেলাবেন।

জীবন, জীবন-মোহ,
ভাষাহারা বুকে স্বপ্নের বিদ্রোহ—
মেলাবেন, তিনি মেলাবেন।

দুপুর ছায়ায় ঢাকা,
সঙ্গীহারানো পাখি উড়ায়েছে পাখা,
পাখায় কেন যে নানা রঙ্ তার আঁকা।
প্রাণ নেই, তবু জীবনেতে বেঁচে থাকা
—মেলাবেন।

তোমার সৃষ্টি, আমার সৃষ্টি, তাঁর সৃষ্টির মাঝে
যত কিছু সুর, যা-কিছু বেসুরো বাজে
মেলাবেন।

মোটর গাড়ির চাকায় ওড়ায় ধুলো,
যারা সরে যায় তারা শুধু — লোকগুলো;
কঠিন, কাতর, উদ্ধ্বত, অসহায়,
যারা পায়, যারা সবই থেকে নাহি পায়,
কেন কিছু আছে বোঝানো, বোঝা না যায়—
মেলাবেন।
দেবতা তবুও ধরেছে মলিন ঝাঁটা,
স্পর্শ বাঁচায়ে পুণ্যের পথে হাঁটা,
সমাজধর্মে আছি বর্মেতে আঁটা,
ঝোড়ো হাওয়া আর ঐ পোড়ো দরজাটা
মেলাবেন তিনি, মেলাবেন।।
. . .

Shahid Quadri; Image Source – Collected; Credit – O Aaa Kho Khoo

সঙ্গতি
শহীদ কাদরী

Ganalekhkho : Songgoti by Shahid Quadri; Musical Version – Created by Ahmed Minhaj in collaboration with AI; @thirdlanespace.com

বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…
একাকী পথিক ফিরে যাবে তার ঘরে
শূন্য হাঁড়ির গহ্বরে অবিরত
শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুঞ্জের মতো,
পুরোনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরবে তোমার স্বরে
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…
ব্যারাকে-ব্যারাকে থামবে কুচকাওয়াজ
ক্ষুধার্ত বাঘ পেয়ে যাবে নীলগাই,
গ্রামান্তরের বাতাস আনবে স্বাদু আওয়াজ
মেয়েলি গানের- তোমরা দু’জন একঘরে পাবে ঠাঁই
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…
. . .

Amiya Chakravarty & Shahid Quadri; Image Source – Collected; Graphics : @thirdlanespace.com

সংযুক্তি

অমিয় চক্রবর্তীর ‘সংগতি’ কবিতাটি আমরা পাচ্ছি সেই সময়টায়, যবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে;—ট্রমা অবশ্য সতেজ থেকেছে পুরোমাত্রায়। আরো সতেজ ছিল সদ্য দেশভাগ হওয়ার দগদগে ক্ষত ও পরিণাম। কবির শরীর ভালো যাচ্ছিল না। দেহমনে পীড়িত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ দেহ রাখার এক দশক ততদিনে ছুঁইছুঁই করছে প্রায়। সভ্যতার সংকট অভিভাষণে ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ বলে নিদান হেঁকেছিলেন রবি ঠাকুর;—যেখানে বিশ্বাস হারানোর পীড়া ও বিষাদ মর্মান্তিকভাবে প্রচ্ছন্ন থেকেছে।

মানে দাঁড়াল,—পঞ্চাশে পা রাখার আগেই অমিয় চক্রবর্তী দেখে ফেলেছেন মানব-প্রবৃত্তির মর্মন্তুদ তামাশা! দেখে ফেলেছেন, নিজেকে ও আবিশ্ব বহমান প্রকৃতিকে সে কীভাবে ধ্বংসবিষাণ হানতে পারে অবলীলায়! যখন কি-না জীবনানন্দ দাশ অবিরত-অবিরত নিজেকে মমি করছিলেন প্রত্নতত্ত্বে বিলীন মহাপৃথিবী মাঝারে! জীবনের এইসব রণরক্ত সফলতার কল্লোল যেখানে স্তিমিত হয়ে এসেছিল। স্বপ্নগ্রস্ত খোঁয়ারিতে গুম এক পৃথিবী ধ্বনিত হচ্ছিল কবিকণ্ঠে। প্রত্নতাত্ত্বিক সময়গর্ভে গুম হওয়ার কারণে যে-এখন সকল কলরোলের বাইরে শান্ত-সুধীর নিরাময়ের বেদনা জাগাচ্ছে মনে।

অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের মিলের জায়গা ক্ষীণকায়। ভিন্ন মেজাজের মানুষ দুজনে। মর্মপীড়ায় তাঁরা যদিও সমানভাবে আক্রান্ত তখন। এর মধ্যে অমিয় চক্রবর্তীর হাত দিয়ে বেরিয়ে এলো ‘সংগতি’। সব ভেঙে পড়েছে জেনেও মেলানোর আরাধনায় একাগ্র হয়ে কবিতাটি লিখলেন কবি!

কেমন হতো যদি ওইসময় গানের কবি বব ডিলানের মতো আচমকা খসখসে রকবাজ চিৎকারে গেয়ে উঠতেন গড়িয়ে পড়ার গান? ডিলান যেটি তাঁর গায়ে ছাপ্পার মতো বসে যাওয়া ফোক সিংগারের লেবেল ঝেড়ে ফেলতে আচমকা গেয়ে উঠেছিলেন সত্তরের দোড়গোড়ায়! বিশ্ব শুনেছিল খ্যানখ্যানে চিৎকার! যার মধ্যে পরিহাস ও আর্তনাদ যুগপৎ থেকেছে সক্রিয় :

How does it feel, how does it feel?
To be without a home
Like a complete unknown, like a rolling stone

না, অমিয় চক্রবর্তী চাইলেও তা পারতেন না। যেহেতু, তাঁর মর্মে রবিপ্রভা তখনো সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করছিল। নিরাশায় অবিরত আশার আলোকবর্তিকা খুঁজে বেড়ানোর রবি-সান্ত্বনাই তো কবিকে নোঙর খোঁজার প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে তখনো। অমিয় চক্রবর্তীর পক্ষে কাজেই বব ডিলানের মতো রকিকণ্ঠে ‘সংগতি’কে পরিহাস করা মানাতো না একচুল।

থিওডর অ্যাডর্নো প্রশ্নটি তুলেছিলেন,—ইহুদি গণহত্যার পরে কবিতা লেখা কি কারো পক্ষে আদৌ সম্ভব? অমিয় যেন-বা তা মিথ্যা প্রমাণ করতে ‘সংগতি’ কবিতাটি লিখলেন, যেখানে মেলানোর দেবতার প্রতি তাঁর মিনতি ভারাতুর আবেদন রবি ঠাকুরের ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’-এর মতো বিষাদে আর্ত ছিল। আশাবাদকে যেখানে নিটশীয় নৈরাজ্যের মতো অনিকেত লাগছিল দেখে।

এমতাবস্থায় একটি ঘোষণা, বব ডিলানের ওই হাউ ডাজ ইট ফিল-এর আক্রোশভরা হাহাকারে প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা জরুরি হয়ে উঠছিল ক্রমশ! শহীদ কাদরী তাঁর ‘সঙ্গতি’ কবিতায় সে-কাজটি সারলেন অবশেষে। কবিতার সঠিক সন-তারিখ আমার অজানা, তবে অমিয় চক্রবর্তীকে উৎসর্গিত পঙক্তিচরণ অধিক হলে ষাট থেকে সত্তর দশকের সীমায় বসে কবি লিখেছেন;—এটুকু অনুমান আশা করি ভুল নয় এখানে।

অমিয় চক্রবর্তীর ‘সংগতি’র একখানা সারমর্ম আমরা পেলাম এখন। শহীদ কাদরী অ্যানকাউন্টার টানলেন,—মেলানোর আশা সহজ প্রাকৃতিক হলেও কোনো অঙ্কই অদ্য আর মিলবে না। নাতিদীর্ঘও নয় কবিতাটি;—যদি অমিয় চক্রবর্তীর পাশাপাশি তাকে রাখি। তার মধ্যেই ধরা পড়েছে মানব-ইতিহাসের লক্ষ বছরের আবর্তন। ধরা পড়েছে তার অবিরত গড়িয়ে পড়ার হাস্যকর পরিহাস। দুটি কবিতা আতএব বাংলা ভাষাকে নতুন বোধি ও গরিমায় ফলবান করে তুলেছিল। এবং, দুটিই সমানে আবৃত্ত ও পঠিত হয়ে চলেছে আজো। সংগীত রূপে গীত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। হতেও পারে। আমাদের নিজস্ব দুষ্কালে ইচ্ছে করছে কবিতায় নয়, বরং গানের সুরকাঠামোয় শ্রবণের।

এআইকে দিয়ে নিজের লেখা ও কবিবন্ধু বিরচিত কবিতা/ গীতকলির সাংগীতিক সংস্করণ থার্ড লেন স্পেস-এর ছোট্ট পরিসরে নতুন ঘটনা নেই আর! মনোচাপ থেকে রেহাই নিতে গ্রুপের মেম্বাররা গদ্য, কবিতা ও গানটান লিখছেন বেশ। অপুট হস্তে যন্ত্রের শরাণাপন্ন হয়ে সেগুলোর সংগীত আয়োজনের মহড়া ও নিরীক্ষা চলছে নিয়মিত। কেন এসব এআই-গান (?), তার কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে কয়েক দফায়। থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এই-তো কিছুদিন আগে কবি হেলাল চৌধুরীর জীবনানন্দ দাশের কবিতাবিশ্বে জার্নির সূত্র ধরে লেখা একটি কবিতার সংগীত আয়োজনের উদ্দেশ্য নিয়ে আলাপ করতে বসে কারণগুলো ভেঙে লিখেছি সবিস্তারে। থার্ড লেন স্পেস-এর সাইটে এই আলাপ হয়তো অচিরে উঠবে। পুনরাবৃত্তিতে সুতরাং নাই-বা গেলাম এখন।

দুই কবির লেখা ‘সংগতি’ / ‘সঙ্গতি’-র সংগীত আয়োজন শ্রবণের দিকে বরং থাকুক মনোযোগ। ভিন্ন আঙ্গিকের সুর-যোজনায় তিনটি সংস্করণ তৈরি করেছিলাম, তার থেকে একটি করে দিচ্ছি এখানে। চেষ্টা করেছি কবিতায় সঞ্চারিত পটভূমির সময়-প্রাসঙ্গিক ভাবার্থ গানে ফুটিয়ে তুলতে। আমার কাছে দুটি কবিতার রংরস অদ্য যেমন প্রতিভাত হচ্ছে,—তাকে বিবেচনায় নিয়ে গানের কম্পোজিশন সাজানোর চেষ্টা করেছি।

ফোক-রক ও স্লোকোর-রক ধাঁচে গান দুটি করা। বাদ্যযন্ত্র ও গায়কি বাছাইয়ে এদিকটায় ছিল মনোযোগ। অমিয় চক্রবর্তীর ‘সংগতি’-র মৌলসুরে হাউ ডাজ ইট ফিল-এর উচ্চনাদ আমার কাছে সময়ানুগ বোধ হয়েছে। নিখাদ রক-অঙ্গে যাইনি, তবে এর অনুরণন রেখেছি গানে;—যেহেতু, সকল আধ্যাত্মিক সান্ত্বনা এখন আধ্যাত্মিক আক্রোশের বিষাদে লীন লাগে আমার কাছে। বাছাইটি হয়তো ভুল, তবে স্বাধীনতা নেওয়ার হক কি আমরা রাখি না? যে-কারণে সফট ভার্সন তৈরি করেও বাদ দিয়েছি। শহীদ কাদরীর ‘সঙ্গতি’ কবিতার গীত-আয়োজনে বিশেষ সংযোজন বলতে বেথোভেনের মুনলাইট সোনাটার ফার্স্ট মুভমেন্ট। বাদবাকি বাদ্যযন্ত্র ও গায়কি সেই অনুপাতে নিতে চেষ্টায় ত্রুটি রাখিনি।

দুটি গানের কম্পোজিশনে সুরস্বীকৃত উচ্চারণ ও গায়কিতে খামতি অবশ্যই ঘটেছে। এআই মহাশয়কে দিয়ে গান করানোয় এই সীমাবদ্ধতা আপাতত মেনে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। খসড়া হিসেবে যে-কারণে সাইটে তুলে রাখছি। ইচ্ছে আছে, পরে সময়-সুযোগ বুঝে নিখাদ সুর ও স্বরসংগতির দিকপানে গমনের। কেমন হয়েছে বা আদৌ কিছু দাঁড়াল কি-না,—এই বিবেচনার ভার যারা শুনতে আগ্রহ বোধ করবেন, তাদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। ভুলত্রুটির সকল দায় অধমের একলার। আমি হয়তো এআইকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারিনি।
. . .
—আহমদ মিনহাজ : অবদায়ক : থার্ড লেন স্পেস.কম

. . .

বিশেষ দ্রষ্টব্য : ‘মরীচিকা শহর’-এ শিরোনামবন্দি সিরিজ-গানের আওতায় গানালেখ্য বিভাগে খসড়া রূপে প্রকাশিত। 

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 15

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *