আমার জানামতে মানবগ্রহে ভুটান হইতেছে একমাত্র দেশ যারা দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা পরিমাপে জিডিপি (Gross Domestic Product) বা জিএনপি’র (Gross National Product) কোনোটাই অনুসরণ করে না। এক মিলিয়নের চেয়ে কম জনসংখ্যার দেশে সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন, সেগুলার প্রভাবে দেশের জনগণ কতটা সুখী ও নিশ্চিন্ত আছেন, তার উপ্রে অর্থনীতির অগ্রগতি তারা পরিমাপ করেন। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের আদলে সৃষ্ট এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থার অধীন দেশটির প্রধান ছিলেন রাজা জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক। ছেলেবেলায় তাঁর নাম বিস্তর শুনছি আমরা। সার্ক সামিটে নিয়মিত হাজির থাকতেন রাজা। চিন্তাশীল ও জনদরদি নৃপতি হিসেবে সুনাম ছিল তাঁর।
জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক হইতেছেন জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুকের উত্তরসূরি। দেশের দায়িত্বভার সামাল দিতেছেন এখন। পেশায় ডাক্তার। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারিবিদ্যার পাঠ নিছেন তরুণ যুবরাজ। তাঁর পিতা জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক সার্ক সামিটের কোনো এক সভায় জিডিপি/ জিএনপির বিকল্প জিএনএইচ (Gross National Happiness) নিয়া হাজির হইছিলেন। জিডিপি/ জিএনপি বাদ দিয়া জিএনএইচ-এ গমনের কারণ ব্যাখ্যায় রাজা জানাইছিলেন,- মোট উৎপাদন ও ক্রয় ক্ষমতা দিয়া একটি দেশে জনগণ আসলে ভালো আছে কিনা তার কোনো মাপ পাওয়া সম্ভব না। তারা কি সুখে আছে? যদি থাকে তাহলে কতটা সুখে আছে? তাদেরকে সহি-সালামত রাখতে সরকার যেসব ব্যবস্থা নিলেন, সেগুলার ব্যাপারে কতটা তুষ্ট ও নিশ্চিন্ত ইত্যাদি টের পাইতে জিডিপি/ জিএনপি কাজে আসে না।
জিডিপি/ জিএনপির মতো অর্থনীতির প্রচলিত প্যারামিটার দিয়া জনগণের সন্তোষ ও সুখের মাত্রা ঠাহর করা কঠিন। পৃথিবী জুড়ে চালু অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদন ও ক্রয় ক্ষমতায় সমবণ্টন বজায় রাখা দুরূহ হওয়ার কারণে উৎপাদনের সুফল সকলে সমান হারে পায় না। বৈষম্য থেকে যায়। বৈষম্য যেহেতু বহাল থাকে,- সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিস্তরে ক্ষোভ ও হতাশা হামেশা তীব্র দেখি আমরা। তার সঙ্গে দেখা দিতে থাকে প্রতিযোগিতার অসুস্থ মনোভাব। আরো বেশি ভোগসুখের জন্য সবাই খালি টাকার পেছনে ছোটে। বেশি করে টাকা কামাইতে চায়। টাকা কামানোর ধান্ধায় লিপ্ত সমাজে ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ঠিক আছে, কিন্তু এর পেছন ধরে আসে চুরি-বাটপারি ও হরিলুটের অসুস্থ প্রবণতা। আসে জবরদখল। শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র। মনের উপ্রে এসবের প্রভাব মারাত্মক। এর ফলে মনে দেখা দেয় অবসাদ। কিছু ভল্লাগতেছে না বা বোরডেমকে তখন আর নিরোধ করা যায় না।
প্রশ্ন হলো,- আমরা কি তাহলে অর্থনৈতিক তরক্কি লাভের বাসনায় এরকম একখান অসুস্থ সমাজ চাইব? নাকি দেশের অর্থনীতিকে এমন চেহারা দিতে ইচ্ছা করব যেটি জনগণের খাওয়া-পরার নিশ্চয়তা প্রদান করবে। পাশাপাশি তাদেরকে মানসিক স্বস্তিতে রাখতে ত্রুটি করবে না। এসব যুক্তি সম্বল করে জিগমে সিংগে ওয়াচুক জিডিপি/ জিএনপির দিকে না গিয়া জিএনএইচ-এর (Gross National Happiness) রূপরেখো পেশ করছিলেন তখন।
নিজ দেশে জিএনএইচ কীভাবে বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী তার ছবিখান তুলে ধরছিলেন ভুটানের চিন্তাশীল রাজন্য। বাকিরা শুনছিলেন, কিন্তু আমলে নেওয়ার দরকার বোধ করেন নাই। তাঁরা না পারুন, ভুটানরাজা নিজ ভাবনায় দৃঢ় থেকেছেন আগাগোড়া। যারপরনাই ভুটান হইতেছে একমাত্র রাষ্ট্র যারা সরকার গৃহীত পদক্ষেপে দেশের জনগণ কতটা নিশ্চিন্ত ও সুখী সেইটা দিয়া অর্থনীতির তরক্কি আজো পরিমাপ করেন। মোট উৎপাদন ও ক্রয় ক্ষমতার প্রবৃদ্ধিকে প্রধান বইলা ভাবেন না। জনগণ যেটুকু পাইতেছে তার প্রভাবকে গোনায় নিয়ে আর্থিক পরিকল্পনা সাজায় ভুটান। মানুষ কি সুখী? সুখী না হলে কতটা অসুখী? ভুটানের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোয় সুখের মাত্রা নির্ধারণ যে-কারণে গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপক। মোট জাতীয় সুখ উৎপাদনকে ভুটানবাসী নিজের অর্থনীতি বইলা বোঝেন।
জিএনএইচ-এর ফিলোসফি যদি আরো পরিষ্কার করতে চাই তাহলে বলতে হয়,- খোদার দুনিয়ায় সমবণ্টন, সমতা, সাম্য সম্ভব নয়। সমাজের সকল স্তরের মধ্যে সহনীয় ভারসাম্য আমরা বড়োজোর নিশ্চিত করতে পারি। এই সমাজ হয়তো সম্ভব, যেখানে কেউ এমন রোজগারি হবে না যার কারণে অন্যরা সাফার করবে। এমন গরিবও থাকবে না, যে কিনা খেতে পায় না। যতটা সম্ভব প্রকৃতিবান্ধব উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে, যেন প্রকৃতিলগ্ন থাকার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সুখ মানুষ বুঝতে পারে। ওইসব মানুষ সেখানে হয়তো আইফোন ক্রয় করতে পারবে না। আরো অনেক ভোগসুখ আছে যেগুলা তারা ইচ্ছা থাকলেও অ্যাফোর্ড করতে পারবে না। অন্যদের দানখয়রাত করে দাতা হওয়ার পরিতোষ বোধ করতে তারা পারবে ন। না, কিছুই পারবে না তারা, কিন্তু সকলে সেখানে এই আরামটা বোধ করবে,- তাদের সমাজে টাকার যথেচ্ছ স্রোতের কারণে কামড়াকামড়ি অন্তত নাই।
জিএনএইচ-এর দার্শনিকতাকে ভিত্তি ধরে ভুটান তার অর্থনীতি ও উৎপাদন পদ্ধতিকে মোটের উপ্রে গড়ে তুলছেন। ফলাফল খুব খারাপ হইছে এমনটি বলা যাইতেছে না। অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিনিয়োগে বড়ো আকারের তরক্কি না ঘটলেও ছোট্ট এই রাজ্যের সিগনিফিকেন্ট কিছু অর্জন নিচে পেশ করা যাইতে পারে :
১. ভুটানের মোট বনজ সম্পদের পরিমাণ পঁচাত্তর শতাংশ। জিগমে সিংগে ওয়াংচুকের সময় থেকে অদ্যাবধি প্রায় ১৫ শতাংশ বনজ সম্পদ তারা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হইছেন। যেখানে বাংলাদেশসহ গোটা দুনিয়ায় বনজ সম্পদের পরিমাণ ক্রমাগত নিম্নমুখী বা বিপজ্জনক গতিতে হ্রাস পাইতেছে। ২. বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশটি স্বনির্ভর। ফল হইতে উৎপন্ন বিবিধ পণ্য বিদেশে তারা নিয়মিত রপ্তানি করে। সেইসঙ্গে তাদের মোট কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন চাহিদা মিটানোর জন্য কাফি। ৩. মাথাপিছু আয় নামক শুভঙ্করের ফাঁকির দিক থেকে ভুটান পিছিয়ে নাই। ভারত এবং বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে আছেন এখানেও। জনসংখ্যা কম থাকার কারণে হয়তো তার মাথাপিছু আয় তিন হাজার ডলার। যদিও বাস্তবে ভারত বা বাংলাদেশের মতো ঝা চকচক ভোগপিপাসা ওই দেশে ব্যাপক নয়। ৪. দেশটির বায়ুমণ্ডল অতিশয় নির্মল। ভুটান হইতেছে পৃথিবীতে এমন একখান দেশ যারা সবচাইতে কম কার্বন নিঃসরণ করে। তাদের দাবি মোতাবেক তারা এখন কার্বন নিউট্রাল স্তরে আছে। অবিশ্বাস্যই বটে।
এতসব তরক্কি সত্ত্বেও ভুটানের জিএনএইচ মডেল নিয়া সমালোচনা ও প্রোপাগান্ডা দুটোই ব্যাপক। অনেকে মনে করেন, জাতীয় সুখ মাপার অথনৈতিক তরিকা দেশটিকে স্থবির করে রাখছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ভুটানিদের জীবনধারায় গতি বা কর্মচাঞ্চল্য নাই। মোটের উপ্রে গরিব দেশ, যেখানে শিক্ষা, চিকিৎসা, আবাসনসহ প্রযোজনীয় চাহিদার ঘাটতি প্রকট। সেইসঙ্গে সরকার নিয়ন্ত্রিত থাকায় জনগণের কথা বলার পরিসর উন্মুক্ত নয়। ভুটানকে তার সরকার যেমন করে দেখায়, বাদবাকি বিশ্ব সেই ছকে তাকে দেখতে বাধ্য হয়। আড়ালের ছবিখানা কখনো প্রকাশ্যে আসে না।
অভিযোগ মিথ্যা এমন নয়। পৃথিবীর যে-কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করলে ভুটানে অবকাঠামোসহ আরো অনেক তরক্কি অর্জিত হয়নি। নগর কেন্দ্রিক অধিবাসীদের মনে স্থবিরতায় বন্দি থাকা নিয়া ক্ষোভ আছে। ফিদেল কাস্ত্রো শাসিত কিউবায় যেমন ওইটা ছিল বা এখনো আছে, ভুটান সেখানে ব্যতিক্রম নয়। মানুষকে সুখী রাখার কথা বইলা এমন একখানা পরিস্থিতি তৈরি করা হইছে, প্রতিবেশী দেশগুলার তুলনায় ভুটানিরা অনেক পেছনে পড়ে আছে। ভুটানের তরুণ প্রজন্ম অন্যদের মতো জীবনকে উপভোগ করতে চায়। তারা টাকা কামাইতে চায়। দেশ-বিদেশ সফর করতে চায়। মৌজ-মাস্তিতে জীবনকে রঙিন করে দেখতে চায় ষোলআনা। এসবের কিছুই জিএনএইচ তাদেরকে যোগান দিতে পারে না। তরুণদের মধ্যে যারপরনাই দেশের প্রতি বিরক্তি ও বহির্গমনের ঝোঁক প্রবল। ভুটানের জন্য এইটা হইতেছে বড়ো মাথাব্যথার কারণ।
মাথাব্যথার তল পাইতে ভুটানের তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা পাও চোয়নিং দর্জি নির্মিত লুনানা অ্যা ইয়াক ইন দ্য ক্লাসরুম ছবিখানার দিকে একবার তাকানো যাইতে পারে। দর্জির এই ছবিখানা অস্কারের শর্টলিস্টে স্থান পাইছিল তখন। নতুন সময় ও পুরোনো মূল্যবোধের টানাপোড়েনে আটক ভুটানের ক্রাইসিস তুলে আনছিলেন পর্দায়। ভুটান দেশে সরকারি চাকরির বাজারে শিক্ষকতা হইতেছে আকর্ষণীয় পেশা। আয়-রোজগার ও মর্যাদার দিক হইতে দামি। ছবির প্রধান চরিত্র ভুটানে থাকতে চায় না। দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিতে সে ইচ্ছুক। পরিবারের চাপে স্কুল শিক্ষক হওয়ার এক্সামে তথাপি বসতে হয় তাকে। মেধা থাকায় চান্সও পায়। ভুটানের রীতি অনুসারে কমপক্ষে দুই বছর দেশের সবচেয়ে দুর্গম জায়গা শিক্ষানবিশ শেষ হলে চাকরি কনফার্ম হবে। সেখান থেকে যে-অভিজ্ঞতা একজন শিক্ষকের ঘটে, তার উপ্রে নির্ভর করতেছে দেশের প্রান্তিক জনগণ ও তাদের যাপন পদ্ধতিতে নিহিত মারিফতের কতটা কী সে ধরতে পারছে ইত্যাদি।
বিরক্তি ও অনিচ্ছা সহকারে ছেলেটি অজপাড়াগাঁয় গমন করে। গ্রামীণ দরিদ্র জীবন, যেটি আবার শতভাগ প্রাকৃতিক, এখন এর সঙ্গে ছেলেটির আন্তঃসংঘাত অমোঘ হইতে থাকে। তার ভিতর দিয়া ছবির কাহিনি আগায়। ছেলেটির এই জার্নি আখেরে তার বোধের জগতে নতুন উপলব্ধি তৈরিতে ভূমিকা রাখে। অস্ট্রেলিয়া গমনের সিদ্ধান্ত সে বদলায় না কিন্তু ভুটানের মরমে-মরমে সক্রিয় অল্পে তুষ্ট সরল জীবনছবি চিরকালের জন্য তার মনে জায়গা করে নেয়। দর্জি যেন এই বার্তা দিতে চান,- হইতে পারে আমরা অন্যদের মতো ভোগসুখে মত্ত না, টাকাপয়সায় গরিব, কিন্তু আমাদের জীবন এখনো সরল আর প্রাকৃতিক।
জাতীয় সুখের পরিমাপ পাইতে জিগমে সিংগে ওয়াংচুক কী কারণে জিএনএইচ নিয়া আসেন তার কারণ বুঝতে দর্জির ছবিখানা বেশ উপাদেয়। জিএনএইচ হয়তো জিডিপি/ জিএনপির বিকল্প হইতে পারবে না কখনো। অর্থনৈতিক সক্ষমতা পরিমাপে প্রসঙ্গিক অনেককিছু তাকে কার্যকর ভাবার অন্তরায় সেখানে। জিএনএইচ কার্যকর হলে একটি দেশে সুখ উপচে পড়বে, ঘটনা এমনও নয়। এর ভিত্রে নিহিত ভাবনাখান হইতেছে দামি। অসম বণ্টন, নারকীয় বৈষম্য আর হাজারো মানসিক চাপে বিধ্বস্ত পৃথিবীর মানুষকে জাতীয় সুখ মাপার তরিকাটি সাদাসিধে জীবনের দিকে ফেরত যাওয়ার প্রয়োজন নিয়া ভাবতে শিখায়। ভুটান দেশের হাওয়া এই ভাবনায় গমনের কারণে এখনো নির্মল। আকাশ স্বচ্ছতোয়া নীল। কার না যাইতে মন চাইবে সেখানে!
. . .
. . .