আসুন ভাবি

আমাদের ক্লিকবেট কালচার

দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়া বাংলাদেশ ও কলকাতা থেকে যারা সমাজমাধ্যমে ভিডিও ছাড়ে তার নিরানব্বই ভাগ আসলে ভুয়া। ভিউ কামানোর ধান্ধায় তারা এগুলা ডেলি ছাড়তে থাকে। ইনফরমেশন হাইওয়ের যুগে এই লোকগুলা বসবাস করে, কিন্তু ভিডিওতে যেসব তথ্য নিয়া তারা হাজির হয়, তার সবটাই গার্বেজ। তথ্য কীভাবে ঘাঁটতে হয়, তথ্যের সত্যমিথ্যা যাচাই ও বিশ্লেষণ কেন জরুরি ইত্যাদির পরোয়া করে না। সময় থাকলে তো করবে! তাদের কাজ হইতেছে দেশের সরলপ্রাণ মানুষের মনে বেহুদা হাইপ তৈরি করা। মানুষ সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে গুজব। হুজুগে মেতে উঠতে সকলে কমবেশি ভালোবাসে। মনে-মনে যা চায় সেইটা পুরা করার আশায় নেটিজেনদের বড়ো অংশ এসব ফাউলটক শুনতেছে প্রতিদিন।

শেখ হাসিনার পুনরায় ফেরত আসার সম্ভাবনা আর বর্তমান সরকারের মেয়াদ ইত্যাদি নিয়া সমাজমাধ্যমে সক্রিয় এসব লোক লাগাতার প্রেডিকশন দিয়া যাবে, আর আমরা দমদেওয়া কলের পুতুলের মতো দিমাগের বাত্তি অফ করে তাদের বকুনি শুনতে থাকব। তথ্য এখানে এসে বিপজ্জনক বস্তুতে পরিণত হইতেছে। সূত্রটি যারা ধরে ফেলছে, তারা আসলে বিচিত্র মতলব হাসিল করতে তথ্য নিয়া খেলে। জাতিকে আবাল বানিয়ে তথ্যকে ম্যানিপুলেট করে এই লোকগুলা। আমাদের মনের ভাও বুঝে ম্যাট্রিক্স বানায়। ম্যাট্রিক্সে ঢোকার নেশায় আমরা আবার দিমাগের বাত্তি অফ করে বসে থাকি। ওই-যে অফ করি, পরে কিন্তু বাত্তি আর সহজে জ্বলে না। অধমের আর্জি ইয়াদ রাখেন ভাই,- ম্যানিপুলেশন অব ম্যাট্রিক্সে একবার ঢুকলে বাহির হওয়া কঠিন।

ভিডিওসহ অনলাইন-অফলাইন সোর্স হইতে যত তথ্য আমাদের কাছে পেশ হইতেছে সেগুলার ব্যাপারে প্রশ্ন জারি রাখা যে-কারণে জরুরি। সন্দেহের চোখ দিয়া এগুলাকে যাচাই করা ভালো। মেরিট বুঝে মগজের ইনবক্সে রাখতে পারি। মেরিট না থাকলে ডিলিট মারা চাই সত্বর। এই সচেতনা যদি না থাকে তাহলে বুঝতে হবে তথ্যবিদ্যার বিপদ নিয়ে আমরা একটুও অবগত না। বিচিত্র ম্যাট্রিক্সে সাজানো তথ্যছকে জাস্ট কাঠপুতুলের মতো নড়াচড়া করতেছি।

Symbolic Image – Aynaghar; AI Generated Pic; Source – @thirdlanespace.com

তাৎক্ষণিক একখানা উদাহরণ আমরা এখানে নিতে পারি। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার দিন রাতে আয়নাঘরের খবর নিয়া মূলধারার সকল টিভি চ্যানেল হাজির ছিলেন। সমাজমাধ্যম আয়নাঘরের সংবাদে সয়লাব ছিল। তখনকার যে-পরিস্থিতি সকলে এই খবরকে সত্য ধরে নিছিলেন। আমি নিজে তার বাইরে ছিলাম না। মনে সন্দেহ পয়দা হয় দু-একদিন বাদ। ফরহাদ মজহারের একখানা সাক্ষাৎকার শুনতে বসে খটকা লাগে প্রথম। সেখানে দেখি উনি বলতেছে,- আয়নাঘর নিশ্চয় আছে, কিন্তু কোথায় সেইটা তিনি ঠার করতে পারতেছে না। মিডিয়ার উচিত জাতির সামনে নির্যাতন কক্ষের বিস্তারিত ছবি দ্রুত হাজির করা। মজহারের কথা শুনে দিমাগের বাত্তি অন হয়ে গেল। মনে-মনে ভাবলাম,- ঘটনা কী রে ভাই! আয়নাঘর থেকে পিলপিল করে মানুষ বাহির হওয়ার খবর দিতেছে! ভয়ংকর সেই কুঠুরিতে দিনরাত কাটানোর লোমহর্ষক বিবরণ সেখান থেকে বাহির হয়ে আসা লোকগুলা সমানে দিয়া যাইতেছে, তথাপি জায়গাটা কেউ লোকেট করতে পারতেছে না! এইটা কোনো কথা!

বুঝে গেলাম,- আয়নাঘরের স্ক্রিপ্ট সাজাইতে বসে তারা কাঁচা কাজ করে ফেলছে। আমজনতাকে ম্যাট্রিক্সটা গিলানোর জন্য যে-পরিমাণ তথ্য সমাজমাধ্যমে ছাড়া হইছিল সেগুলার ইমপ্যাক্ট যদিও মারাত্মক। আমার ধারণা, আয়নাঘর দেখাইতে না পারলেও বাংলার আবাল জনগণ এর অস্তিত্ব মেনে নিতো, যদি না গোলাম আজমের পোলা গামছাবাবা রূপে আবির্ভূত না হইতেন! উনার কারণে ম্যাট্রিক্সটা ভেঙে পড়তে সময় লাগেনি। গামছবাবা এখন ফকফকা গামছার বদলে ছেঁড়াফাড়া গামছা হাতে নিয়া সাক্ষাৎকার দিতেন, তাহলে কিন্তু আয়নাঘর জিন্দা থাকত। পাবলিককে ধোঁকা দেওয়া সহজ;- কথাটা মিথ্যা নয়, তবে মাঝেমধ্যে তাদের দিমাগের বাত্তি জ্বলে ওঠে। গামছাবাবার কপাল মন্দ। পাবলিকের দিমাগবাত্তি উনার হাতের গামছা দেখে দপ করে জ্বলে উঠছিল সেদিন। কারো দরকার হয় নাই। কোনো গোলাম মাওলা রনিদের প্রয়োজন পড়ে নাই। পাবলিক নিজে ধরে ফেলল গামছাবাবার জালিয়াতি। বাকিটা ইতিহাস।

আবু সাঈদ ও মুগ্ধসহ ছাত্রহত্যার স্ক্রিপ্ট সময় যত গড়াইছে পাবলিক নিজের দিমাগ ব্যবহার করে আস্তে-আস্তে ধরে ফেলতেছে। যেখানে ওই মাসুদ কামাল, গোলাম মাওলা রনি, খালেদ মুহিউদ্দিনদের কোনো ভূমিকা বা অবদান নাই। উনাদের কাজ হইতেছে যখন যে-ঘটনা সামনে আসে সেইটা নিয়া বকুনি। ঘটনা এখন রিয়েল না ফিকশন, তার মেরিট আছে কি নাই… এসব নিয়া হোমওয়ার্ক করে না। এখন আমরা তাদের কাছে জানতে চাইতে পারি,- ভাইরে, আপনাদের মনে কোনো প্রশ্ন নাই? সন্দেহ নাই? সরকারের পেটের ভিতর থেকে খবর বাহির করার মতো সোর্স যদি না থাকে তাইলে কীসের হাম্বাদিক আপনি? বিভিন্ন সূত্র যা পাওয়া যাইতেছে সেগুলা জোড়া দিয়া সমীকরণ অন্তত মিলাইতে পারেন, সেইটাও তো করতে দেখি না! কিছুই যখন করেন না, পারেন না করতে,- আপনে ভাই কী কামে গজবি ব্যানার সেট করে চব্বিশ ঘণ্টায় চার-পাঁচখান ভিডিও নেটে ছাড়েন?

সমস্যা আসলে গোলাম মাওলা রনিদের নয়। আমরা নিজের মগজ ব্যবহার করি না বিধায় ঝামেলা তৈরি হয়। রনিদের ওপর মগজ খাটানোর ভার আমরা দিয়া দিই। এই সুযোগে তারা দিনে দশটা ভিডিও বানিয়ে নেটে ছাড়ে আর আমরা বলদের মতো সেগুলা গিলতে থাকি। তাদের হাতে স্বেচ্ছায় ধর্ষিত হইতে আপত্তি করি না।

ফরাসি ভাবুক জাঁ বদ্রিলার এসব নিয়া বিস্তর কাজবাজ করে গেছেন একসময়। সিনিয়র ও জুনিয়র বুশ উপসাগরীয় যুদ্ধের ম্যাটিক্স কীভাবে তৈরি করে তার ইতিবৃত্ত নিয়া বদ্রিলারের দুর্দান্ত একখানা লেখা পড়ছিলাম কয়েক বছর আগে। বিবিসি, সিএনএন, এনবিসির মতো প্রভাবশালী গণমাধ্যম আম্রিকার হয়ে উপসাগরে যুদ্ধ জমাইতে নতুন ম্যাট্রিক্স তৈরি করছিল তখন। বদ্রিলারের ভাষায়, বাস্তবে সংঘটিত যুদ্ধের চাইতে মিডিয়াসৃষ্ট ও পরিবেশিত যুদ্ধ অনেকবেশি চিত্তাকর্ষক ছিল। বিপুল মানুষকে তারা সেই চিত্তাকর্ষক ম্যাট্রিক্সে ঢুকতে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে কামিয়াব হয়। দিমাগের বাত্তি অফ করে লোকজন ঢুকছিলেন সেখানে। বাংলাদেশে বসে আমরাও ঢুকছিলাম বৈকি।

The Gulf War Did Not Take Place Jean Baudrillard; Source – Philosopheasy YTC

মিডিয়াসৃষ্ট ম্যাট্রিক্সে বসে আমরা তখন সাদ্দামকে দেখছি। ইরাককে দেখছি। মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি ও গোত্রকোন্দল দেখছি। সবকিছু এমনভাবে দেখানো হইত,- আম্রিকার ব্যাপারে সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও উপসাগরে তার ভূমিকা নিয়া প্রশ্ন তোলার জায়গায় অনড় থাকা কারো পক্ষে সম্ভব হয় নাই। রিয়েলিটির মধ্যে এভাবে আরেকখানা রিয়েলিটি মিডিয়া জন্ম দিয়া বসছিল সেইসময়। বাস্তব পরিস্থিতির চেয়ে মিডিয়া সৃষ্ট বাস্তবতাকে সকলে অধিক বাস্তব ধরে নিছি তখন। বদ্রিলারের থিয়োরি মানলে রিয়েলকে গুম করে হাইপাররিয়েলের জন্ম এভাবে যুগ-যুগ ধরে হয়ে আসতেছে।

এই-যে বিচিত্র সব ইতিহাস আমরা পাঠ যাই, তারাও এভাবে অবিরত বাস্তবতা তৈরি করে। প্রকৃত না অথচ প্রকৃত বইলা ধরতে পারি এরকম বাস্তবতা তারা রচনা করে। দুনিয়াজুড়ে ছবি আঁকিয়েরা হয়তো এ-কারণে হাইপাররিয়েল পেইন্টিংয়ের দিকে মাঝখানে ব্যাপক ঝুঁকে পড়ছিলেন। একজন চিত্রশিল্পী তো আসলে বাস্তবতার ছবি আঁকে না, সে ওই বাস্তবতাকে আঁকে যা আমরা দেখি না, কিন্তু শিল্পী মনে করে সে দেখতেছে। ভ্যান গগকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করছিল,- আসমানের মেঘ তুমি হলুদ করে আঁকছ কেন? উত্তরে উনি বলছিল,- কারণ হইতেছে মেঘের রং হলুদ। এই-যে রিয়েলিটি উনি তাৎক্ষণিক তৈরি করলেন, এইটাকে এখন অতিক্রম করা কঠিন। ভারতীয় দর্শন এখান থেকে মায়াবাদের ভাবনায় গমন করছিল এককালে।

সাদ্দাম টাইরান্ট ছিল একথা সত্য। রিয়েল। কিন্তু মিডিয়া তারে যেভাবে ম্যাট্রিক্সে দেখায়, সে কি ওই মোতাবেক টাইরান্ট ছিল? প্রশ্নটি কিন্তু পরে আমরা উঠাইতে পারি নাই। ততদিনে এই ধারণায় সকলে কমবেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম,- সাদ্দাম ব্যাটা যতই আম্রিকার সঙ্গে ফাইট দিতে থাকুক, সে কিন্তু নিপীড়ক! কুর্দিদের লাইফ হেল করছে সে। খামোখা ইরানের সঙ্গে লম্বা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল দশ বছর। এখন সাদ্দাম নিজ থেকে এসব ঘটায় নাকি তাকে ঘটাইতে বাধ্য করা হয়, এই প্রশ্নটি শক্তিশালী হইতে পারে নাই। আমরা খেয়াল করছি অনেক পরে,- নিজ মতলব হাসিলে মার্কিনিরা প্রথমে সাদ্দামকে একটা ম্যাট্রিক্সে ঢুকতে বাধ্য করে। দিমাগের বাত্তি অফ করে সাদ্দাম সেখানে ঢোকে এবং পরে আর বাহির হইতে পারে নাই।

বদ্রিলার এখানে এসে জানাইতেছেন,- তথ্য দিয়া এমন ম্যাট্রিক্স তৈরি করা সম্ভব, রিয়েলকে অতিক্রম করে সেইটা তখন মোর দ্যান রিয়েল হইতে থাকবে। আমার তো সন্দেহ, সাদ্দাম তার শেষজীবনে নিজেকে টাইরান্ট বইলা বিশ্বাস করতে শুরু করছিল। সূচনায় যদিও এরকম কিছুর কথা উনি হয়তো ভাবে নাই। বাথ পার্টি ও ইরাকি সমরসেনার দক্ষতা বৃদ্ধিতে ছিল মনোযোগ। আর টেনশনে থাকত কখন কে তারে গদি থেকে ফেলে দেয়। ইয়াদ রাখা জরুরি, আইএস-এ সক্রিয় জঙ্গিদের বড়ো অংশ ইরাকি সামরিক বাহিনির লোক। ওয়েল ট্রেইনড অফিসার তারা। সাদ্দাম তাদেরকে নিজ কুরসি ধরে রাখতে তৈরি করলেও আখেরে মার্কিনিদের অনুপ্রবেশ ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তারা ইসলামিক স্টেট তৈরির ম্যাট্রিক্সে গিয়া ঢোকে ও পরে জান খোয়ায়।

 Statue vandalism – Saddam Husain and Sheikh Mujib; Source – Google Image 

আম্রিকা এই-যে সাদ্দামের জন্য প্রথমে একটা ম্যাট্রিক্স তৈরি করে ও তারে সেখানে ঢোকায়, তারপর তারে পচাইতে মিডিয়া দিয়া আরেকখানা ম্যাট্রিক্স পয়দা করে…;- এসব ভকচক্করে আমরা কিন্তু সাদ্দামকে মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির দূত ভাবতে আরম্ভ করি। অন্যদিকে আম্রিকার প্রতি আজন্ম ক্ষোভের কারণে সাদ্দাম হিরো বইলাও গণ্য হইতে থাকে আমাদের কাছে। আমরা তখন নবজাতকের নাম রাখি সাদ্দাম। তার মানে, আমরাও নিজের মতো আরেকটা ম্যাট্রিক্স বানাই সেখানে। সেখানে বসে আম্রিকা ও মিডিয়ার তৈরি ম্যাট্রিক্সকে দেখি। বিশ্বাস করি না তবু দেখি। দেখতে-দেখতে অভ্যস্ত হই এবং আম্রিকাকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ জারি রাখতে এক ধরনের বৈধতা দিতে থাকি।

এতকিছু যে মিডিয়া ঘটায়, তার আড়ালে, বদ্রিলার বলতেছেন,- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কার্যত কোনো যুদ্ধ করেনি সেখানে। তার সৈনিকগুলা হুদাহুদি গালফে যায়। কিছু লোক মারে। নিজেরাও মরে কিছু। মাঝখান দিয়া মধ্যপ্রাচ্যকে লম্বা সময়ের জন্য অশান্ত এক অঞ্চল ও মার্কিন সাহায্য ছাড়া চলতে অক্ষম বইলা তারা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। ইয়াদ রাখেন, মিডিয়াসৃষ্ট এই ম্যাট্রিক্সকে ভাঙতে জুনিয়র বুশের জামানায় এসে কাতারের আল জাজিরার জন্ম হয়। আরববিশ্বের সংবাদ পাইতে লোকজন এখনো আল জাজিরাকে অধিক বিশ্বাসযোগ্য বইলা ভাবেন। যদিও এই আল জাজিরা আবার বাংলাদেশ নিয়া যখন নিউজ করে, সেখানে আওয়ামী পার্টি ও মুক্তিযুদ্ধকে তারা ইচ্ছামতো পচায়।

যাই হোক, টুইন টাওয়ার ধসে পড়ার ঘটনা চেক দিতে ইসলামভীতির ম্যাট্রিক্সও পশ্চিম গোলার্ধের মিডিয়া এভাবে তৈরি করছিল। লাদেনের উত্থানের পেছনে মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়া তৈরি ম্যাট্রিক্সের ভূমিকা প্রবল। তার মতো বিষফোঁড়া হইতেছে আম্রিকার তৈরি ম্যট্রিক্সের সাইড ইফেক্ট। বাংলাদেশেও এখন এইটা চলতেছে। গোলাম মাওলা রনির মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ম্যাট্রিক্স তৈরি করতেছে আর আমি-আপনি সেখান দিমাগের বাত্তি অফ করে সমানে ঢুকতেছি। এভাবে আরো সব ম্যাট্রিক্স পয়দা হইতে থাকায় কোনটা রিয়েল আর কোনটা হাইপাররিয়েল… বোঝা বড়ো কঠিন! বুঝতে যদি পারেন তাইলে একটা ঘটনাকে আপনি একভাবে দেখবেন। না পারলে হুদাহুদি ক্লিকের জন্য বড়শি পেতে থাকা লোকগুলার টোপ আপনাকে গিলতে হবে।

আরো মজার ব্যাপার আছে। আমরা সত্যিকার অর্থে রনি বা এরকম আরো যত দুচনা ইউটিউবার আছে, এগুলার একটাকেও আসলে শ্রবণ করি না। যদি করতাম তাহলে তথ্য বিশ্লেষণের নামে তারা আসলে কীভাবে ত্যানা প্যাঁচায় সেইটা অনায়াসে চোখে পড়ত। একই কথা তার কিছুদিন অন্তর রিপিট করে। রিপিটের জায়গাটি মার্ক করতে পারলে তাদেরকে শোনার রুচি কারো থাকার কথা নয়। গোড়ার কোয়েশ্চনটা সুতরাং আবার উঠাইতে হয়। কেন শুনতেছি তাহলে? আনসার সোজা,- আমরা গোলাম মাওলা রনিকে শুনতে বসি নাই মোটেও;- শেখ হাসিনা আবার আসবে কি আসবে না সেইটা নিয়া রনি চটকদার ব্যানার দিছে দেখে মোবাইল স্ক্রিনে ধা করে আঙুল চেপে বসছি। রনিকে ইগনোর করে তার ভিডিওতে জোড়া চটকদার ব্যানারে আমাদের চোখ পড়ে আছে। উনি যা বলতেছে তার কিছুই আসলে আমাদের কানে ঢুকতেছে না। ব্যানারটা এখানে রিয়েলিটিক ডিফাইন করতেছে;- গোলাম মাওলা রনি জাস্ট আনরিয়েল। বদ্রিলারের সারার্থ ধার করে বলা যাইতে পারে,- ব্যানার আদতে গণিতের ননরিয়েল বা কাল্পনিক সংখ্যা, কিন্তু সেইটা রিয়েল নাম্বারকে স্থানান্তরিত ও বিচ্যুত করে দিতেছে সেখানে। ক্লিকবেট এ-কারণে দুনিয়াজুড়ে বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রি।

Mia Khalifa BBC Hard Talk with Stephen Sackur; Source – BBC News YTC

যেমন, পর্নো ছবিতে আমরা যা দেখি তার সবটা রিয়েল না। ক্যামেরার নানা কারসাজি আছে। আবার যেটুকু রিয়েল সেখানে এমনভাবে দেখানো হয়, যার পেছনের স্টোরিগুলা মর্মান্তিক। বিবিসি হার্ড টক-এ মিয়া খলিফার কনফেশন শুনলে যার খানিক আন্দাজ হয়। সেখানে উনি বলতেছে,- আরব দেশের মেয়ে হয়ে আমি যখন হিজাব পরে সেক্সসিনটা করি তখন আমার ওপর কোনো চাপ ছিল না যে এরকম করতে হবে। পর্নোগ্রাফির সবটাই নিখাদ পেশাদার হিসাব-কিতাবে চলে। তারা ফান করতেছিল আর আমি ছিলাম নার্ভাস ও কনিফিউজড। আমার অ্যাড্রিনাল সম্ভবত ওই বয়সে এমন এক অবস্থায় ছিল, মনে হইছিল আমি টাবু ভাঙতেছি। পরে যদিও এর জন্য আমাকে মূল্য দিতে হইছে। এখন আমি পর্নোমুভি করি না, কিন্তু ওই একলাই আছি, যেমন তখন ছিলাম। পর্নোগ্রাফির মতো ব্যানারও হইতেছে টোপ, আর আমরা মাছ। একবার গিলছেন তো মরছেন। দেশের বৃহৎ অংশকে তারা এভাবে আবাল বানায় প্রতিদিন।

তার মধ্যে যারা ব্যতিক্রম,- নির্ভরযোগ্য তথ্য ও বিশ্লেষণসহ ভিডিও ছাড়েন, আমরা কিন্তু তাদের ভিডিও দেখতে বা শুনতে বিমুখ বোধ করি। কারণ, আমাদের পেশেন্স নাই শোনার। কারণ, আমাদের মনের আশা পূরণ করার মতো আশার বাণী তারা শোনায় না। বড়ো কারণ,- স্ট্রেস রিলিজ করার মতো উত্তেজনার খোরাক সেখানে থাকে না। রিয়েলিটি সেরকম হয় না, হবেও না কখনো। যে-লোক তথ্যকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার নিয়তে ভিডিও ছাড়েন, শুনতে নিরস হলেও দিন শেষে তার উপস্থাপনা কাজে লাগে। বাকিগুলা সব বড়শিতে টোপ দিয়া বসা;- আমরা কখন আবালের মতো টোপটা গিলব সেই আশায় দিররজনি কাটায়।

মানব-সভ্যতার জন্য ইন্টারেন্ট একইসঙ্গে আশীর্বাদ ও অভিশাপ। মাটি থেকে সোনা বা ওই গোল্ড মাইনিংয়ের মতো ঘটনা। সোনা কীভাবে তালাশ করে সেইটা একসময় ন্যাশনাল জিওগ্রাফি আর ডিসকভারিতে নিয়মিত দেখাইত। সাংঘাতিক কঠিন কাজ। রোমাঞ্চ আছে। পরিশ্রম আছে। বানের মতো টাকা যাইতে থাকে। সোনা পায় না সহজে। কখন কতটা পাবে তার ঠিক থাকে না। আবার যখন পায়… ছাপ্পর ফুড়ে পায়। পাওয়ার পরে মেহনতের শেষ নাই। তথ্য হইতেছে গোল্ড মাইনিংয়ের সমতুল ঘটনা। যত খুঁড়ব, তালাশ করব, দিমাগের বাত্তি দেখব অ্যাক্টিভ হয়ে গেছে। যা ভাবি নাই সেইটা তখন আমরা ভাবি। বিচিত্র অ্যাঙ্গেল হইতে একটা ঘটনাকে দেখার অভ্যাস তৈরি হয়। আস্তেধীরে উপসংহারেও পৌঁছাই তখন। মোদ্দা কথায়, আমাদের দরকার দিমাগের বাত্তি অন করতে সাহায্য করবে এরকম তথ্য। অনলাইন, অফলাইনে উপচে ওঠা এসব তথ্যকে প্রশ্ন ও সন্দেহের মন নিয়া যাচাই করা ছাড়া ক্লিকবেটের ফাঁদ থেকে বাহির হওয়া কঠিন।
. . .

How false news can spread – Noah Tavlin; Source – TED-Ad YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 3

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *