মাতন বড়ো সংক্রামক একখান জিনিস! একবার শুরু হইলে তার সংক্রাম হইতে নিস্তার মিলে না। হাসিনাপতনের পর থেকে দেশে ফ্যাসিস্ট, ফ্যাসিবাদ নিয়া ব্যাপক মাতন দেখতেছি। ফরহাদ মজহারের মতো টেটনরা শব্দ দুইখানকে এমনভাবে জাতিসমুখে ঘনঘন দাখিল করতেছেন, দেশবাসীর গায়ে যার আঁচ দ্রুতই বিস্তার লাভ করছে। কথায়-কথায় একজন আরেকজনের পিঠে ফ্যাসিস্ট ছাপ্পা বসানোর চল এই সুবাদে গেল চার মাসে তীব্র হইছে। এর পেছনে শেখ হাসিনার দায় আছে বিলক্ষণ।
পনেরো বছর জাতিকে ফাটা বাঁশের চিপায় রাখছিলেন হাসিনা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থেকে আরম্ভ করে আমজনতার ডান-বামে কাইত হওয়ার পরিসর সংকুচিত করে আনছিলেন তিনি। মন খুলে ক্রিটিক করার স্বাধিকার নিয়া যে-কারণে আলোচনা-সমালোচনা ব্যাপক ছিল। একপক্ষ অলওয়েজ ভাবছেন,- তাদেরকে কথা বলতে সরকার বাধা দিতেছেন। অন্যপক্ষ আবার সেইটা ডিফেন্ড করছেন এই বইলা,- কথা বলার স্বাধীনতা যদি না থাকত তাহলে টিভি চ্যানেলের ডেলি টকশো আর সমাজমাধ্যমে সরকারকে ধবল ধোলাই তারা দিতেছেন কেম্বা?
স্বাধিকার কতটা কী ছিল সে-আলোচনায় আপাতত না যাই। মোটা দাগে বুঝে নেওয়া যাইতে পারে,- শেখ হাসিনার দীর্ঘমেয়াদি শাসনে দুই প্রকার ক্রিটিক আমরা দেশে সচল থাকতে দেখছি। প্রথম ক্রিটিকের দলে যারা অবস্থান করতেন, তারা মূলত ঘি-মাখন খাওয়া লোকজন। হাসিনার সমুদয় অ্যাকশনকে বৈধ ও যৌক্তিক প্রতিপন্ন করতে আদাজল খেয়ে যুক্তির গোড়ায় শান দিতেন। বাকপটু তেলবাজ রূপে সর্বত্র হাজির থাকতেন এই ঘি-চাটার দল। দেশের সর্বময় ক্ষমতার মালকিন শেখ হাসিনার তরফ হইতে সেই সুবাদে পরিতোষক বাগাইয়া নিতেন তারা।
নতুন কিছু না। এই ধারার লোকজন বিশ্বের সর্বত্র ছিল এবং সবসময় থাকবে। হাসিনাপতনের কারণে ঘিমাখনখোর তেলবাজরা অদ্য মাইনকার চিপায় আছেন। তাদের মধ্যে যারা বিলা ইউনূসের লাঠিয়াল বাহিনির হাতে ধরা খাইছেন তাদের অবস্থা বেশ সঙ্গীন মানতে হইতেছে। ইউনূস সরকার প্রযোজিত ভাতের হোটেলে ফ্যাসিস্ট রানীমার দালাল তকমা মাথায় নিয়া ডলা খাইতেছেন বোঝা যায়।
বিগত পনেরা বছর যারা দ্বিতীয় দলে বিলং করছেন, তাদেরকে সিলেক্টটিভ ক্রিটিক বলা যাইতে পারে। হাসিনা আয়োজিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কোপ থেকে বাঁচতে ভাষা ও শব্দে বিচিত্র প্যাঁচ দিয়া রেজিমকে ঝাড়তেন তারা। প্রথম ও দ্বিতীয় দলের মধ্যখানের সুড়ং দিয়ে আরো কিছু লোক তখন একজিস্ট করতেন। Intruder বা ছুপা রুস্তম নামে তাদেরকে আমরা সম্ভাষণ যাইতে পারি। আম্রিকায় একসময় কু ক্লাক্স ক্লান নামে উগ্রপন্থী একখান গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল। ধলা আদমি ছাড়া যত আদমসন্তান আম্রিকায় বসবাস করতেন, তাদেরকে দেশছাড়া করা এই গুপ্ত সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল। যেখানে-সেখানে আচমকা হামলায় লোকজনের জান কবচ করত তারা।
বলা কওয়া নাই হুটহাট বাহিরে এসে হামলা করতে পটু এরকম কিছু কু ক্লাক্স ক্লানদের পনেরো বছর মেয়াদী শাসনে ভালোভাবে টাইট দিতে পারেন নাই শেখ হাসিনা। রেজিমকে আচ্ছামতো ধোলাই ও পচানোর স্পেস আজব কারণে দিয়া রাখছিলেন। মাগনা-মাগনি রাখেন নাই অবশ্য! এর ভিত্রে গভীর রাজনীতি নিহিত ছিল। মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী হোয়াইটম্যানদের ম্যানেজ করতে পিনাকী ও ইলিয়াস টাইপ গুপ্তঘাতককে যেমন ইচ্ছা তাঁকে ঝাড়ার স্বাধিকার অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুজিবকন্যা দিতে বাধ্য হইছিলেন।
আখেরে অবশ্য লাভ হয় নাই। তাঁর পতনকে ত্বরিত করতে কু ক্লাক্স ক্লানরা ব্যাপক অবদান রাখছে। তাদের পরিবেশিত তথ্য ও বক্তব্যে সম্মোহিত জনগণ হাসিনাকে অবিশ্বাস ও ঘৃণার বৃত্ত হইতে পরে আর বাহির হইতে পারে নাই। ভালোমন্দ যত কাজ তিনি করছেন তার কোনোটাই আমলে নেওয়ার অবস্থায় তারা থাকেনি। অন্যদিকে হোয়াইটম্যানরা শেখ হাসিনার এই রাজনীতিকে তলে-তলে মেনে নিতে অসম্মত ছিল। তারা হইতেছে সেয়ানা ঘুঘু! ভালোই বুঝতেছিল,- কী হেন কারণে তাঁর উপ্রে ছোড়া শব্দবোমা উনি ডেলি সহ্য করতেছেন।
শেখ হাসিনার পনেরো বছরে যারপরনাই মন খুলে কথা বলার স্বাধীনতা দৃশ্যত ছিল না, আবার ছিলও। ভজকট এই পরিস্থিতিকে বোধহয় আংরেজিতে অ্যাপারেন্টলি ট্রান্সপারেন্ট বাট ডার্ক বইলা চিহ্নিত করা হয়। এরকম পরিবেশে সবচেয়ে তীব্র ছিল সার্কাজম। আংরেজি ভাষায় সার্কাজম বলতে আমরা যত কিছু বুঝি তার সবগুলাকে সোজাসরল বাংলা কটাক্ষ দিয়া বোঝানো কঠিন। আংরেজি সার্কাজম হইতেছে এমন জিনিস যাকে হাতিয়ার করে আপনে অশ্লীল হইতে পারতেছেন। যাকে ঝাড়তে মন চায় তারে নিয়া রঙ্গ-তামাশা-মজাক-পরিহাসের সবটা করতে পারবেন। এমনভাবে পচাইতে পারবেন যে ওই লোকটা তার জীবনকে হাবিয়া দোজখ গণ্য করতে বাধ্য হবে।
হাসিনাকে এমতো সার্কাজমে পচানো ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তাঁকে যুক্তিরহিত ক্রিটিক করায় রিস্ক ছিল বিস্তর। যুক্তি দিয়া ক্রিটিক করলে পার পাইবেন তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। হাসিনা বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কটাক্ষ করা মানে পুলিশের দৌড়ানি। হাউন আঙ্কেলের ভাতের হোটেলে ভিজিট ইত্যাদি। বাকস্বাধীনতার নামে অশ্লীল একখানা পরিবেশ দেশে নীরব বিদ্যমান থেকেছে প্রায় দশ বছর।
সার্কাজমটাকে হ্যান্ডেল করতে বাইপ্রোডাক্ট বা উপজাতের দরকার ছিল, কারণ দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী বা সোজা কথায় মিডল ক্লাসে অবস্থান নেওয়া জনগণ হাসিনার উপ্রে অসন্তুষ্ট হইলেও কারোই তখন খাড়াইতেছে না তেমন! শিশ্নপিপাসায় ভুগতেছিলেন তারা। মোক্ষম অস্ত্র দরকার ছিল, যেইটা কিনা শিশ্নের উত্থান ঘটাইতে কাজে দিবে। এখন সেইটা যোগান দিতে অচিরে সেফুদা, হিরো আলম, রাজ ও পরীমণি, ডিগবাজি জায়েদ, শাহরিয়ার নাজিম জয়, মামুন-অপু… হাজারে-বিজারে প্রোডাক্ট দেখা দিতে থাকলেন। দেশের সচেতন কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী থেকে আরম্ভ করে ম্যাঙ্গোপিপলের নিকট তারা কার্যকর একে-47 বইলা গণ্য হইতেছিলেন তখন।
স্বমৈথুন ছাড়াও সরাসরি গুলি ঠোকার রসদ পাইলেন জাতি বা জনগণ। হাসিনা এখানেও ব্লান্ডার করে বসছিলেন। অস্ত্রগুলাকে ব্যাপকভাবে প্রমোট করতে উনার বাচ্চা সাকরেদ পলককে সিগন্যাল দিয়া রাখছিলেন তিনি। পলকও সমাজমাধ্যমে মালগুলাকে আনসেন্সরড যাওয়া-আসায় রাখছিলেন। জনগণকে বিরাজনীতিকরণে গুম রাখার খেলাটি সফল ছিল বইলা অনেকে ধরে নিলেও সর্বনাশের বীজ সেখানে পুঁতছিলেন হাসিনা।
ম্যাঙ্গোপিপল বাদ, সচেতন কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীরা সেফুদা থেকে ডিগবাজি জায়েদ খানে ব্যাপক কামহিশরন বোধ করছেন গেল আট-দশ বচ্ছর। দৃশ্যত মজাকের নামে হাসিনা রেজিমকে এভাবে শিশ্ন দিয়া প্রহারের বাসনা সেখানে সুপ্ত ছিল। সেফুদার ‘কীরে গরিবের দল, ক্যামন আছিস তোরা?’; তাহেরি হুজুরের ‘ঢেলে দিইকে’ পিক করে প্রত্যয় হিরনের ধুন্ধুমার ডিজে; রাজ-পরীর বিয়া আর বাচ্চা নিয়া খেলাধুলা; জায়েদ খানের ডিগবাজি; শাহরিয়ার নাজিম জয়ের টিজমার্কা আজাইরা প্যাঁচাল; আর হিরো আলমের বহুমুখী প্রতিভার বিচ্ছুরণ… ইত্যাদি মিলেঝুলে একখানা অসুস্থ-অবদমিত যৌনপিপাসায় কাতর বাংলাদেশের ছবি সারা বিশ্বে প্রমোট করতেছিলেন হাসিনার আইটি সৈনিক জনাব জুনায়েদ আহমেদ পলক।
হাসিনা গংকে দেশছাড়া করতে কু ক্লাক্স ক্লান-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ পিনাকী-ইলিয়াস গং, তাদের থেকে এক ড্রিগ্রি উপ্রে বিলং করতে থাকা ফাহাম আবদুস সালাম গং, এবং শিখরে বিরাজিত ফরহাদ মজহার-সলিমুল্লাহ খান গং…, উনারা সক্কলেই পলক আয়োজিত সার্কাজমকে নিজস্ব অভিপ্রায় বাস্তবায়নে ব্যবহার যাইতে দিরং করেননি। বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতাকে বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় মোকাবিলার দিক থেকে ফকির-মিসকিনে পরিণত আওয়ামী লীগ এর সর্বনাশ আঁচ করতে পারেনি। জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমি এভাবে রচিত হইছিল দেশে।
যে-সার্কাজমকে অবাধে জারি রাখাটা হাসিনা বেনিফিট ধরে নিছিলেন, আখেরে এই সার্কাজমত তাঁকে গদি থেকে নামতে বাধ্য করল। সরকারের নাকের ডগায় বইসা ঢাবি ক্যাম্পাসে ‘গুরুবারের আড্ডা’ আর ফরহাদ মজহারের ‘পাঠচক্র’-এ যাওয়া-আসা করতে থাকা জাতির সক্রেটিস মাহফুজ আবদুল্লাহরা উনার ট্রিকস ঠিকই ধরতে পারছিল। বিরাজনীতিকরণ প্রতিরোধের রাজনীতির দিকে যে-কারণে তারা দ্রুত সংহত হইতে পারছে।
. . .
পনেরো বছরে শেখ হাসিনা দেশকে লুটেরা পুজিবাদের প্রথম স্তরে নিয়ে আসতে কামিয়াব হইছিলেন। এর সুফল ছিল না বলা যাবে না। দেশে রাতারাতি একখান লুটেরা ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠছে তাতে। ধনিক শ্রেণির বিকাশে দেশের বাদবাকি অংশ কোনো-না-কোনোভাবে সুবিধাভোগী হন নাই এমনটা হলফ করে বলা যাইতেছে না। করাপ্ট হইতে থাকা সিস্টেমে সকলেই অংশীজন ছিলেন। দফায়-দফায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর নানা মাত্রার সিন্ডিকেটবাজি সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি পুরোদস্তুর সচল ছিল তখন। সেখান থেকে উত্তরণ বা দ্বিতীয় ধাপে গমনের পরিকল্পনা শেখ হাসিনার ছিল। ২০২১ থেকে ২০৪১-এর রূপকল্প উনি খামোখা তৈরি করে নাই। এতদিন তো আর বেঁচে থাকতেন না তিনি। এই মেয়াদের পরে হয়তো ইস্তফা দিতেন বা নিজ পরিবারের কারো হাতে দায়িত্ব অর্পণ করে নেপথ্যে যাইত উনি।
উদ্দেশ্য ছিল, দেশে এমন একখানা রেজিম কায়েম রাখা যা কিনা আস্তেধীরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রের আদলে আওয়ামীদের চিরকাল ক্ষমতায় রাখবে। নিরবিচ্ছিন্ন আওয়ামী ছায়ায় জনগণকে শান্ত রাখার জন্য যা দরকারি সেগুলা ওই রাজতন্ত্র নিশ্চিত করবে। সবই করবে তারা কিন্তু রাজতান্ত্রিক একচ্ছত্রবাদ নিয়া প্রশ্ন তোলার পরিসর সেখানে থাকবে না। সোজা কথায় Development under ultimate legitimacy-র পরিবেশ নিশ্চিত করার মতলবে সক্রিয় ছিলেন হাসিনা।
উনার এসব প্যাঁচপয়জার নিয়া জিজ্ঞাসু হওয়ার সুযোগ পনেরো বছরে ছিল না। হাসিনা সরকার প্রযোজিত আলটিমেট লেজিটিমেসির কোপানলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতিচর্চার হালত যাকে বলে কোমায় চলে গিয়েছিল। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করলেও শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে নিজের উন্নয়ন পরিকল্পনায় ভালোভাবে সমন্বিত করতে পারেনি হাসিনা সরকার। এইটা গুরুতর ক্ষতি, যার পরোক্ষ চাপে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইছিল দেশে উৎপাদিত জাতীয় সাহিত্য। কবিলেখকরা পনেরো বছর মেয়াদী রেজিমে আত্মমৈথুন আর শিশ্নপরায়ণ জীব রূপে সর্বত্র বিচরণ করছেন।
হাসিনাপতনে দেশের অগ্রগণ্য কবিলেখকদের অবদান নগণ্য ছিল। ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রকে এক্সপ্লোর ও এক্সপোজড করতে পারে এমন সাহিত্য জন্ম দিতে ষোলআনা ব্যর্থ ছিলেন তারা। পনেরো বছরের ভালোমন্দ ঠার করতে পূর্ববতী কালপর্বগুলায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখার কাজেও কামিয়াবি দেখাইতে পারেন নাই। সমাজমাধ্যমে আগাগোড়া সরব থাকলেও সেখানে যে-ভাষা চর্চিত হইতেছিল, ওই ভাষাকে গল্প-কবিতা-আখ্যানে সবাক করে তুলতে পারছেন কি? হাসিনা রেজিমের পনেরো বছরে প্রবলভাবে মুসলমান হইতে চাওয়ার অবদমিত বাসনাঘন ভাষা বাদ দিলে কবিলেখকরা ম্যান্দামারা ভাষায় মহান সাহিত্য মারাইছেন! এর একাংশ মুজিব বন্দনায় নিঃস্ব ছিল আর বাকিটা বিগত দশকগুলায় পয়দা হওয়া সাহিত্য নিয়া তর্ক-বিতর্কের নামে সেগুলার অক্ষম চর্বিতচর্বন ছাড়া কিছু পয়দা করতে পারেনি।
গত পনেরো বছর সাহিত্য মারানোর নামে যত কাগজ খর্চা হইছে তার পুরাটাই ছিল অপচয়। ফি বচ্ছর একুশের বারোয়ারি বইমেলায় উৎপাদিত টন-টন কিতাবের সিংহভাগকে গার্বেজ হিসেবে ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা যাইতে পারে। এসবের মধ্যে নির্জীব কচকচানি ছাড়া দেশকাল ও স্থনিকতার লক্ষণ দূরবীন দিয়া খুঁজলে দুই-একটা মিলতে পারে। পুরোটা সময় জুড়ে ভাষাকে আক্রমণ করতে কবিলেখকরা ভীষণ ভয় পাইছেন। যে-কোনো কারণে হোক, তারা ভাবছেন, ভাষাকে আক্রমণ করলে যা বাহির হবে সেইটা এখন বইয়ে অথবা অনলাইনে বলা যাবে না। যদি বলি তাহলে হাউন আঙ্কেল তার ভাতে হোটেলে নিয়া ডলা দেবে। শঙ্কা অমূলক ছিল এমন না, তবে কবিলেখকরা যতটা আতঙ্কিত ছিলেন, বাস্তবতা মনে হইতেছে না অতখানি ভীতিকর ছিল।
উনারা ফরহাদ মজহার, শহীদুল আলম প্রমুখদের হেনস্থা হইতে দেখে ভীত ছিলেন। এখন মজহার বা শহীদুল আলমের হেনস্থার হওয়ার যৌক্তিক নানা কারণ কিন্তু ছিল। ওই সময় যে-উদ্দেশ্য নিয়া তাঁরা মুভ করছেন নানা সময়, সেগুলাকে প্রশ্নাতীতভাবে বিতর্কমুক্ত ছিল না। কাজেই পিনাকী গংরা এসবকে ইস্যু করে লাগাতার ভীতি ছড়াইতে কোনো কার্পণ্য করেনি। তাদের ছড়ানো হুজুগের কতখানি সত্য আর কতখানি অপপ্রচার… এই দিকটা ঠাণ্ডা মাথায় বিচার-বিবেচনা করা বা তলিয়ে দেখার সক্ষমতায় দেশের জাতীয় পর্যায়ে সক্রিয় কবিলেখক ও সংস্কৃতিকর্মীরা পুরাই ব্যর্থ ছিলেন। দেশের আমজনতার সঙ্গে তারাও হুজুগে ফাল পাড়ছেন প্রায়শ। সময়ের সঙ্গে ড. ইউনূসের সঙ্গে শহীদুল আলমদের চেহারা সকলে প্রকাশ্য দেখতে পাইতেছি। আওয়ামীদের হয়ে গওহর রিজভী আল জাজিরার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সরকারকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করলেও একতরফা নির্বাচন, বিরোধী দলকে দমন, এবং তার সঙ্গে জেন-জি প্রজন্মকে বুঝতে না পারার দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ আসলে ছিল না। যার মাশুল এখন নির্মমভাবে তাদেরকে দিতে হইতেছে।
অথচ সরকারকে যৌক্তিক আক্রমণে ফালাফালা করার মতো বীজ যথেষ্ট জন্ম নিছে গত পনেরো বছর। লেখাপত্রে যার সামান্যই তারা তুলে আনতে পারছেন। মোক্ষম ক্রিটিক তো পরের বিষয়। নিজেদের লেখা বইপত্রে অথবা অনলাইনে এই নির্যাসটুকুও নামাইতে গাছবলদা ছিলেন তারা, যার উপ্রে ভর দিয়া দেশে নতুন সাহিত্যের জাগরণ ঘটবে। ফলে এই যে এখন উনারা ফ্যাসিস্ট, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি নিয়া ভীষণ সোচ্চার আছেন, সেখানে উনাদের স্বকীয় কণ্ঠস্বর জাতি টের পাইতেছেন না। ফ্যাসিস্ট, ফ্যাসিবাদ নিয়া যা-কিছু আওরাইতেছেন তারা, এর ষোলআনার পনেরো আনা ফরহাদ মজহারদের প্রজন্মে পয়দা হওয়া সংজ্ঞায় এখনো ঘুরপাক খাইতেছে;- যেখানে উনাদের নিজস্ব বীক্ষণ অনুপস্থিত।
সোজা কথায় অনুকরণ হইতেছে, স্বীকরণ নয়। গত ত্রিশ বছরে দেশের সাহিত্যমহলে দেখা দেওয়া কবিলেখকরা সরাসরি সত্তর দশকের কালসীমায় বসে রফিক আজাদের মতো ভাত দে হারামজাদা বা হুমায়ুন আজাদের মতো সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে বলার হ্যাডম রাখেন না। ইনডিরেক্ট কিন্তু আরো ভালোভাবে বিগত ও সমকালকে নিদেনপক্ষে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শহীদুল জহিরের মতো অনুধ্যানে নিতেও তাদের ব্যর্থতা খালি চোখে দৃশ্যমান বটে!
এখন তাহলে থাকতেছে কী? থাকতেছে অতিকায় দেখতে এক উত্তেজনা। উত্তেজনার আবেশে ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিস্ট আদতে কী জিনিস… ইত্যাদি গভীরচোখে বীক্ষণের পরিবর্তে বেহুদা লম্পজম্প সার হইতেছে কেবল। থাকতেছে গেলো পনেরো বছরে নেতিয়ে যাওয়া শিশ্নকে খাড়া করার কসরত। জীবনের প্রতি পরতে তৈরি হইতে থাকা রংগুলাকে ডিফাইন করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে, সমকালীন ও সাম্প্রতিককে বাজপাখির চোখে নিরিখ করার ক্ষমতা রহিত হওয়ার কারণে, ভাষাকে আক্রমণ করতে বিমুখ বোধ করার কারণে নব্বইয়ের সময় থেকে অদ্য যারা লেখক-বুদ্ধিজীবী… উনারা সকলে একযোগে নপুসংক। অতিকায় শিশ্ন হাতে হস্তমৈথুন ছাড়া দ্বিতীয় কোনো যোগ্যতা এসব উন্নত সাহিত্য মারানিদের নেই। হাসিনা আমলে যেমন তাদের ভূমিকা শিশ্নপরায়ণ ছিল, ইউনূস আমলেও তাই। যারপরনাই ওই ড. ইউনূসকে নিয়া রোদ্দুর রায়ের খিস্তিভরা সার্কাজমে উগড়ে দেওয়া সংক্ষোভটাই প্রকট হইতে থাকে। যেইটা প্রকারান্তরে আমাদের কবিলেখকদের গালে চপেটাঘাতই বটে।
তাঁরা বুঝতে অক্ষম, সত্যিকার মহান সাহিত্য রচয়িতাদের পুরোধা বইলা যারে অনেকে নমস্য গণ্য করেন সেই ফিওদর দস্তেয়ভস্কি কী-কারণে রুশ দেশে বাকবাকুম বুদ্ধিজীবীতার খপ্পরে যারা পড়তেন,- তাদেরকে ঘৃণা করতেন। আর কেনই-বা সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত দাগী আসামির হৃদয়ে আবিষ্কার করছিলেন পাপী সন্তদের, যেইটা ছাড়া উন্নত, মহান সাহিত্য কভু হওয়ার নয়।
. . .