
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে অভিনেতা স্বাধীন খসরুর ক্যাপশনটি সময় প্রাসঙ্গিক। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবালকে আমরা কখনো ক্রিটিকাল হতে দেখিনি। একাত্তর সবসময় তাঁর কাছে বেঞ্চমার্ক ছিল। এর সাহায্যে শত্রু-মিত্র বুঝে নিতেও দেখেছি তাঁকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রসব বেদনায় যারা বিরোধিতা করে থেমে থাকেনি, নারকীয় নিপীড়নে ভূমিকা রেখেছে প্রত্যক্ষ,—জাফর ইকবালের কাছে তারা প্রতিপক্ষ থেকেছে সবসময়। একবার এক অনুষ্ঠানে তাঁকে বলতে শুনেছিলাম,—আমার কাছে শত্রু-মিত্র চেনার মাপকাঠি হলো একাত্তর। একটি লোক যখন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের ঘটনাকে অযথা বিতর্কিত করে, সে আমার প্রতিপক্ষ, এবং ওই লোকটি রাজাকার।
সোজাসাপটা এই ফয়সালা নিয়ে একশো তর্ক করা যাবে হয়তো, কিন্তু দিনশেষে দেশের পরিস্থিতি তাঁর প্যারামিটারকে ন্যায্য প্রমাণ করছে। স্বাধীনতার তুঙ্গ মুহূর্তেও ত্রিশ শতাংশ বা কাছাকাছি সংখ্যা আমরা অনুমান করতে পারি,—পাকিস্তান ভেঙে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে যারা ইমান রাখেনি। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়ে সৃষ্ট দ্বিজাতি তত্ত্ব, ভারত-পাকিস্তান বিরোধ, সাম্প্রদায়িক অভিমান ইত্যাদি এই মানসিক অবরোধের পেছনে বড়ো ভূমিকা রেখেছে।
দেশভাগের জের ধরে কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট পাকিস্তানে বাংলাদেশের টিকে থাকা এমনিতেও অবান্তর ছিল। কোনো একভাবে ভাঙন আজ-নয়-কাল ঘটতই। ভারতের মতো বৃহৎ ভৌগলিক অঞ্চল অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হচ্ছে পাকিস্তানের। মোটের ওপর আড়াই হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব কেবল ভৌগলিক প্রতিবন্ধকতা নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও এর অভিঘাত ব্যাপক। পশ্চিম পাকিস্তানিরা সেকালের পূর্ব বাংলায় পড়ে থাকা বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বোঝার কোনো চেষ্টাই করেনি। তাচ্ছিল্য আর শোষণ সব ছাপিয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল।
পাঞ্জাব প্রদেশকে প্রাধান্য দিয়ে গঠিত পাকিস্তানের মাথামোটা শাসকশ্রেণি ভারত পরিবেষ্টিত অঞ্চলটিকে শাসন করতে নেমে গোড়া থেকে ব্যর্থতার নজির রেখেছে। বৈষম্যের ওপর দাঁড়ানো ফলস স্টেটের যে-পরিণাম সচরাচর অবধারিত হয়, জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তান সেখানে পা দিয়ে রেখেছিল। পূর্ব বাংলা ও বেলুচিস্তানের সঙ্গে সংঘাত যে-কারণে ঠেকানো যায়নি। বর্তমানে বেলুচিস্তান তো বটেই, সিন্ধ ও খাইবার পাখতুনের সঙ্গেও পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির দূরত্ব তীব্র হতে দেখছি আমরা। ভারতের অখণ্ডতা বিনষ্টকে নিজের মিশনে পরিণত করার কুফল দেশটিকে মার্কিন ও চীনের তাঁবেদার করে তুলেছে, যেখানে তার স্বকীয়তা পরিষ্কার নয়।
এরকম একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রকে স্বাধীন বাংলাদেশে জনগোষ্ঠীর একটি অংশ কিবলা মানছেন এখনো! পারলে পুনরায় এর অংশ হতেও তারা রাজি! তাদের এই মোহের পেছনে ইসলামের সুরক্ষা ও ভারত বিরোধিতা হচ্ছে তুরুপের তাস। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কার্ডটি খেলা হচ্ছে এখানে। যারা এতে নিজের ইমান জিম্মা করলেন,—এখন এর সত্যমিথ্যা গভীর গিয়ে যাচাইয়ের তাড়না তাদের মধ্যে দেখা যায় না। সমস্যাটিকে আওয়ামী লীগ ভালো ডিল করতে পারেনি কখনো। সেকুলার স্টেট প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব মোক্ষম পন্থা অনুসরণ করা প্রয়োজন, তার একটিও তারা সফলভাবে ব্যবহার করতে পারেনি।
মুসলমানিত্ব আর ভারতবিরোধিতার পাঁচন মিলিয়ে তৈরি বয়ান মোকাবিলা করতে নেমে আপত্তিকর আপস, এমনকি আওয়ামী লীগকেও করতে হয়েছে ক্ষেত্রবিশেষ। দলটির বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা খুব-যে ইম্প্রেসিভ এমন নয়। বিচিত্র স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ ও চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সর্পিল পথে তারাও পা বাড়িয়েছে অনেকসময়। ড. জাফর ইকবালের সোজাসাপটা শত্রু-মিত্র শনাক্ত করার পন্থা এর কিছু জানে না বা বোঝে না,—এরকম ভাবা সরলীকরণ হয়ে যাবে। সব জেনেবুঝে তিনি আওয়ামী লীগকে ছাড় দিয়েছেন। দলটিকে সেখানে মন্দের ভালো হিসেবে তাঁকে বেছে নিতে হয়েছিল।
বিকল্প তো দেশে কখনো ছিল না। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, এবং ঐতিহাসিকভাবে আগাপাশতলা বিভ্রান্ত বেকুব বামকে বিকল্প ভাবা আর আত্মহত্যা সমান কথা। শেখ হাসিনার পতনে বিষয়টি আরো ভালোভাবে প্রমাণিত হচ্ছে প্রতিদিন। অনেকে অবশ্য তা এখনো মানতে নারাজ। সেদিন মানবেন, যেদিন ইরান স্টাইলে ইসলামি শাসন কায়েম হবে দেশে। এবং তখন, মেঘমল্লার থেকে মেঘমোল্লায় রূপান্তরিত বামগুলোকে আগে ফাঁসিতে ঝুলাবে তারা;—নিষ্ক্রিয় করবে চিরতরে।
যাইহোক, আমার কথায় অনেকে আপত্তি ও তর্ক তুলতে পারেন, তাতে কিছু বাকবিতণ্ডা সার হবে মাত্র। রিয়েলিটি ভিন্ন কথা বলেছে ও বলবে সবসময়। একশোটা ভুল ও অন্যায় করলেও দেশের সার্বভৌম সুরক্ষাসহ যেটুকু অর্জন, তার ষোলআনার পনেরো আনা আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঘটতে দেখেছি আমরা। বাকিরা এই কাজে ডাব্বা মেরেছেন বারবার।
শেখ হাসিনা ষোল বছর মেয়াদী শাসনে উগ্রপন্থার উত্থান ঘটলেও দেশ একটি গন্তব্যের দিকে মোড় নিচ্ছে বলে হিসাব কষেছেন ড. জাফর ইকবাল। কাজে লাগানোর নামে হাসিনা সরকার যেখানে তাঁকে অনেকসময় বাজেভাবে ব্যবহারও করেছে। মান-সম্মান খুইয়ে তিনি নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়েছেন। তথাপি, এই বিশ্বাস তাঁর মনে কাজ করেছে,—ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে অনেক, তবে আওয়ামী লীগের হাতে দেশের সার্বভৌম স্বকীয়তা ও অগ্রগতি বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি নেই। শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কারের কাজটিও সরকারকে দিয়ে করানোর সুযোগ থাকছে।
কাজটি শুরু করার কিছুদিনের মাথায় হাসিনাকে পড়ে যেতে হলো। জাফর ইকবালকে প্রধান করে প্রণীত সর্বশেষ শিক্ষা কার্যক্রম সংস্কার নিয়ে বিতর্কের ফেনা তৈরি করাটা ছিল সরকার পতনের মহাসূক্ষ্ম পরিকল্পনার অংশ। যেখানে মোল্লারাসহ সলিমুল্লাহ খানদের মতো কোটেশনবাজরা নিজের ভূমিকা প্রচণ্ড ভালোভাবে নিভিয়েছে তখন।
হাইব্রিডে ভরপুর আওয়ামী লীগ লুটপাট আর বিরোধী রাজনীতিকে দমনের ছল কষতে নেমে জনবিচ্ছিন্ন ততদিনে। জাফর ইকবালকে সুরক্ষা দানের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি করার এলেম তাদের ছিল না। বেচারাকে উলটো সামনে ঠেলে দিয়ে নিজেরা সরে গেছে অনেকসময়। এই হঠকারিতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে ড. জাফর ইকবাল মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছেন। ক্ষমতা-রাজনীতির জটিলতা বোঝার ধীশক্তি তাঁর মধ্যে যথেষ্ট মাত্রায় ছিল না;—সত্যটি এইবেলা মেনে নিতে হবে।
ড. জাফর ইকবালের মধ্যে যেটি সবসময় ছিল ও আজোবধি রয়েছে, সেটি ওই বহুচর্চিত বাক্যটি মনে করায় : ল্যাঞ্জা ইজ ডিফিকাল্ট টু হাইড। হাসিনা পতনের তুঙ্গ মুহূর্তে যে-কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি অচেনা বলে সাব্যস্ত করেছিলেন। যেহেতু, তাঁর হিসাব অনেক আগে থেকে জানাচ্ছিল,— বিশ্ববিদ্যালয়টি রাজাকারপন্থীতে ভরে গেছে।
আবেগের ফেনায় নিজের কাপড় খুইয়ে বসা দেশের শিক্ষিত সমাজ তাঁর ওপর খেপে উঠলেও, জাফর ইকবাল নিজের সোজাসাপটা রায় থেকে একচুল সরে আসেননি। এই হ্যাডম খোদ হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে দেখাতে পারতেন বলে মনে হয় না। তাঁর মধ্যে ইনকনসিসটেন্সি ভর করছিল শেষের দিকটায়। ড. জাফর ইকবাল এই জায়গায় সকল গালিগালাজ সহ্য করে অবিচল থেকেছেন।
বাংলাদেশকে যদি বাঁচাতে হয়, বলতে বাধ্য হচ্ছি,—জনাব জাফর ইকবালের ওই সোজাসাপটা ফয়সালা আপাতত একমাত্র আয়ুধ। বাদবাকি বয়ান আর পালটা বয়ানে কোনো কাজ হবে না। কেবল আঁতলামির পারদ তাতে একডিগ্রি বাড়বে। আর, ফাঁকতালে দেশটি চলে যাবে গোরখাদকের দখলে।
. . .
. . .



