নেটালাপ

একপ্রস্থ হুমায়ূননামা

শর্ট ইন্ট্রো : থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে আলাপটি বিগত বছরের ১৩ থেকে ১৫ নভেম্বর অবধি জারি ছিল। হাসিনা সরকারের পতন পরবর্তী টালমাটাল বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিবসকে ঘিরে গণমাধ্যম ও সমাজমাধ্যম অন্য বছরগুলোর মতো অতটা সরব ছিলেন না। সরকারি আনুষ্ঠানিকতার বাইরে মোটের ওপর নিভৃত-নিরালায় দিবসটি পালিত হয়। বদলে যাওয়া পরিস্থিতির মধ্যে বসে হুমায়ূন স্মরণের অভিঘাত ও তাৎপর্য আলাপচারিতায় কিছুটা উঠে এসেছিল। 

থার্ড লেন ব্লগ তখনো প্রস্তুতিকালের ভিতর দিয়ে যাওয়ার কারণে আলাপটি টাটকা ব্লগে তোলা সম্ভব হয়নি। প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় এখন তুলছি। দুটি ভাগে হুমায়ূন আহমেদ ব্লগে উঠছেন। প্রথম ভাগ তাঁকে নিয়ে আমাদের তাৎক্ষণিক নেটালাপ। দ্বিতীয় ভাগ মিমের জগৎ : স্মৃতির বিলোপ ও হুমায়ূন-স্মরণ শিরোনামে পৃথক রচনা হিসেব দেখা-শোনা-পাঠ বিভাগে অচিরে তুলতে পারব আশা করি। হুমায়ূন নিয়ে আলাচারিতায় পাঠকের সক্রিয়তা একান্ত কাম্য। আশা করি তারা সংযুক্ত হবেন।

জয়তু হে বাদশাহ নামদার

আজ ১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ছিল। বাংলাদেশে হাতে গোনা যে-কজন কবি-লেখকের জনমবার, মরণবার কমবেশি ঘটা করে জাতিকে ইয়াদ বিলানো হয়, হুমায়ূন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। হাসিনা জামানায় গণমাধ্যম হইতে সমাজমাধ্যমকে ঘুরেফিরে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আর হুমায়ূনকে জন্ম ও মৃত্যুদিবসে স্মরণ করতে দেখছি। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক এবং আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদকে নিয়া সমাজমাধ্যমে নিয়মমাফিক স্মৃতিবন্দনা চোখে পড়ত। ব্যাস… এটুকুই ছিল আমাদের বরণীয়বন্দনা! তার বাইরে কাউকে বিশেষ ইয়াদ করতে দেখছি বইলা মনে পড়ে না।

জুলাই বিপ্লবের ধাক্কায় স্মরণচর্চা বেশ ধাক্কা খাইছে। গণমাধ্যমে এই প্রথম হুমায়ূনকে নিয়া বড়ো আকারে তৎপরতা চোখে পড়তেছে না। নুহাশ পল্লীতে শাওনসহ হুমায়ূনভক্তরা হয়তো সমবেত হইছেন। যাওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু প্রতিকূলতায় যাইতে পারেন নাই, এরকম ঘটতে পারে এই বছর। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সুমহান পৃষ্ঠপোষক চ্যানেল আই অন্ততপক্ষে হুমায়ূন নিয়া কিছু একটা করবেন বইলা ভাবছিলাম। ফি-বছর তো করেন উনারা। এবার (হইতে পারে আমার চোখে পড়ে নাই) সেরকম কিছু দেখি নাই। ফরিদুর রেজা সাগর কি বেঁচে আছেন, নাকি মরহুম! বাংলা একাডেমির মোহাম্মদ আজম হয়তো উদ্যোগ নিছেন নিয়ম মাফিক, তবে অন্য বছরের মতো তার কোনো চটজলদি খবর গণমাধ্যমে নাই দেখতেছি। সব মিলিয়ে গুমোট একখান পরিস্থিতির মধ্যে যাপিত হইতেছে হুমায়ূনবন্দনা।

দেশটাকে ভালোবাসতেন হুমায়ূন। এমন সব চরিত্রদের কাহিনি লেখায় নিয়া আসতেন, মনে হইত এসব চরিত্র যতদিন আছে, বাংলাদেশ কোনো একটা পথে নিজেকে শেষ করবে না। প্রচণ্ড ইতিবাচক আর জীবনসংবেদী ছিলেন। রসিক ও বিচিত্র তো অবশ্যই, তথাপি হে কথাকার, বাংলাদেশে আপনার বেইল নাই আপাতত! কেন নাই সেইটা বোধহয় আন্দাজ করা কঠিন না কারো পক্ষে।

Nuashpalli – stone mermaid; Source – Wikipedia

গণমাধ্যম ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের কথা বাদ দিলাম। হূমায়ূন আহমেদ দেহ রাখার পর থেকে এমন কোনো বচ্ছর নাই কবিলেখকদের মধ্যে উনাকে নিয়া মাতম দেখি নাই। হুমায়ূনকে উপলক্ষ্য করে তারা পোস্ট দিতেন। এবার নীরব কেন আপনারা? ডর খাইছেন মনে হয়? নাকি বিপ্লবের গুলি খেয়ে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে সবচেয়ে বড়ো ব্রান্ড ভ্যালু যিনি ক্যারি করেন, যাঁরে নিয়া আপনাদের গদগদ স্ট্যাটাস দেখতাম, উনাকে এখন বেমালুম ছাটাই করে দিলেন লিস্ট থেকে! হালত দেখে বোঝা যাইতেছে হুমায়ূনের প্রয়োজন ফুরাইছে। লিস্টে ফররুখ আহমদ অলরেডি ঢুকছেন। আর কারা-কারা ঢুকবেন সেইটা দেখার আপেক্ষায় আছি।

কবিলেখকসহ বরণীয় ব্যক্তিদের যে-পন্থায় আমরা ইয়াদ করি সেইটা এম্নিতেও আমার পছন্দ না। প্রতি বছর একজনকে ইয়াদ কেনই-বা করতে হবে? বাইরে এভাবে করে না বইলা জানি। বরণীয় ব্যক্তিকে সেখানে যখন স্মরণ করা হয় তখন তারা মাস হইতে বছর জুড়ে ইভেন্ট সাজায়। নানামাত্রায় ধরার চেষ্টা করে। প্রচুর ভালো বইপত্র বের হয়। অনুষ্ঠানও হয় সেই মানের। আমাদের এখানে এসবের চল নাই। বিগত সরকারের আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইকেল মধূসূদন দত্তের দ্বিশত জন্মবার্ষিক উদযাপনের অংশ হিসেবে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি বেশ চমৎকার ছিল মনে পড়ে। এখন মনে হইতেছে অনুষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো কারণবশত আয়োজন করছিলেন, যার পেছনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা হয়তো ছিল না।

মাইকেল হচ্ছে প্রাচীন সৌধের মতো যেখানে আমরা বসবাস করি না! – অধ্যাপক সৌভিক রেজা; Source – MSI Kahn YTC

যাই হোক, হুমায়ূন আহমেদের লেখার বড়ো ভক্ত আমি কোনোকালেই ছিলাম না। এইটা কেবল বুঝি,- আমাদের দেশের সাহিত্যে অনেক হুমায়ূন আহমেদের প্রয়োজন আছে। উনি নিজমাপে অনন্য এক জগৎ সৃষ্টি করছিলেন। এমন এক জগৎ যেটি এই জনপদকে অন্য পরিসরে ধারণ করছে সবসময়। আমাদের চির মেরুদণ্ডহীন তৈলবাজ জাতীয় কবিলেখকরা আপনাকে ইয়াদ করে নাই তো কী হইছে, এই-যে আমার মতো নগণ্য এক পাঠক ইয়াদ করতেছি এখন। আরো অনেকে করতেছে;- নীরব…!

আপনাকে এভাবে কখনো স্মরণ করতে হবে ভাবি নাই। আপনার জনমবার, মরণবার আসছে-গেছে… গা করি নাই, কিন্তু এখন করতে হইতেছে। আপনি যে-বাংলাদেশ রেখে বিদায় নিলেন, সেইটা যে ভালো নাই হুমায়ূন! নিশ্চিত থাকেন, দেশ তার নিজ গতিতে না ফেরা পর্যন্ত এভাবে আপনাকে ইয়াদ করতে থাকব। হুমায়ূন আহমেদকে আমরা কখনো এই দেশে মৃত হইতে দিবো না। জয়তু মিসির আলী ও হিমুস্রষ্টা হুমায়ূন। জয়তু হে বাদশাহ নামদার।
. . .

আশা করি এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত লেখা পাবো মিনহাজ ভাই..
. . .

অপশক্তির হাতে সংস্কৃতির বিলোপ ও প্রতিস্থাপনের মানে হচ্ছে আপনি পেদ্রো পারামোর জাদুবাস্তবতাঘন প্রহেলিকা থেকে বেশি দূরে নেই
. . .
বিস্তারিত আর কী লিখব বেলাল ভাই! মন প্রচণ্ড খারাপ! হুমায়ূন আহমেদকে এভাবে গৌণ হতে দেখব বাংলাদেশে… এইটা কখনো ভাবি নাই! মাত্র দেখলাম, নুহাশ পল্লীতে উনার স্মরণে কিছু লোক জড়ো হয়েছিলেন। টুকিটাকি স্মৃতিচারণ ও স্মরণবন্দনা বোধহয় শেষ পর্যন্ত হয়েছে। অন্য বছরের তুলনায় কিছুই না সেটি। তো এই-যে হুমায়ূনকে প্রায় তাৎপর্যহীন হতে দেখছি, এর অভিঘাত বোঝার ক্ষমতা মনে হয় আমাদের লোপ পেয়েছে।

রবি ঠাকুরকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বিলোপ করার হেন চেষ্টা নেই তারা করেনি! এর পেছনে আমাদের প্রগতিশীলদের নানা ব্যর্থতা আছে। সে-আলাপে আপাতত না যাই। রবি ঠাকুর এতটাই বিরাট ঘটনা আমাদের জন্য, উনাকে শেষপর্যন্ত আপনি বিলোপ করতে পারবেন না, সম্ভব নয়। ফিনিক্স পাখির মতো রবি জেগে উঠবেন বারবার। যে-কারণে ঠাকুরের ওপর বিরামহীন অ্যাটাক দেখেও গা করিনি।

হুমায়ূনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। উনি সরাসির আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজকে কেন্দ্র করে আবর্তিত জীবনলিপির রূপকার। গল্প বলেন, নাটক বলেন, উপন্যাস বলেন, রসরচনা থেকে চলচ্চিত্র… বিচিত্র আয়তনে একটি রসঘন পরিহাসদীপ্ত বাঙালি জীবন ধারণ করতেন লেখায়। প্রচণ্ড ইতিবাচক আর খোয়াবঘন ভাষায় লিখতেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনকথা। সংগ্রাম ও পীড়নকে নিজের মাস্টারি দিয়ে লঘু করতেন হুমায়ূন। ভরসা দিতে চাইতেন,- ভেবো না, মানুষ শেষপর্যন্ত ইতিবাচক। মন্দ মানুষটির ভিতরেও লুকিয়ে থাকে কোমল মানবিক সত্তা। দেখবে, মন্দ লোকটিও এমন কোনো পাগলামি করে বসবে, যার কারণে তুমি তাকে ঘৃণা করতে পারবে না। হুমায়ূনের কাছে মানুষ তাই সবসময় সহজ মানুষ। রংয়ের মানুষ।

Tui Rajakar – Bohubrihi – Humayun ahmed Drama; Source – BTV YTC

উনি সাহিত্যের বিচারে কতটা বড়ো তাতে কিছু যায় আসে না। এইটা যায় আসে,- বাংলাদেশকে তিনি অনুভব করতে সাহায্য করেন। মিসির আলী কিংবা হিমু আমাদের ভিতরে নাই… কথাটা কী করে বলি? প্রত্যেকের ভিতরে এরকম একটি করে মিসির আলী অথবা হিমু হয়তো আছে;- আমরা টের পাই না। এসব জায়গা থেকে হুমায়ূন আমাদের জন্য আশীর্বাদ। আবার উনি অভিশাপও বটে। গানপার-এ এসব নিয়ে কোনো একদিন তাৎক্ষণিক লিখেছিলাম। আগের পোস্টে লিংক বোধহয় আছে। ছোট্ট রচনা। পড়ে দেখতে পারেন যদি মন চায়।

যাই হোক, আমরা আছি হাসিনা আবার ফেরত আসবে কি আসবে না সেই উত্তেজনায়। সরকারের নানা তামাশা নিয়ে মেগা উত্তেজনায় আছি। তার ফাঁক গলে ওরা জাতির সবচেয়ে বড়ো সর্বনাশটি করছে;- একদম পরিকল্পনা করে করছে; আর সেটি হলো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বলতে আমরা যা বুঝি, তাকে একটু-একটু করে নয়া বয়ানের সাহায্যে ধুয়েমুছে সাফ করে দেওয়া।

গায়ক মাকসুদ মূল্যবান একটি কথা কিছুদিন আগে বলেছিলেন,- অর্থনীতির ক্ষতি আপনি একসময় কাটিয়ে উঠতে পারবেন। আরো নানা ক্ষয়ক্ষতির সবটাই আস্তে-আস্তে সেরে যাবে, কিন্তু সংস্কৃতির পতন একবার ঘটলে সেটি আর উদ্ধার করা যায় না। মাকসুদের চেয়েও মারাত্মক কথা বলেছিলেন মিলান কুন্ডেরা। উনি বলেছিলেন, অপশক্তি যদি গেড়ে বসে তাহলে একটি জাতি যেসব স্মৃতির ধারাবাহিকতায় বেড়ে উঠেছে তার সবটা বিলোপ করে দেওয়া সম্ভব। অপশক্তির নিজস্ব ছাঁচে তৈরি নতুন স্মৃতিকে প্রতিষ্ঠা করা তখন কোনো ব্যাপার না। দেশে এখন সেটি ঘটছে। ঘটানো হচ্ছে। আমরা নিরুদ্বেগ।

আমাদের কবিলেখক যারা আছেন, একজনকেও এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন দেখি না। উনারা বিলোপের সংস্কৃতিতে খাপ খাওয়ানোর ধান্ধায় আছেন। হুমায়ূনের অপরাধ তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিস্তর লিখেছেন। গল্প লিখেছেন। উপন্যাস লিখেছেন। ছবি বানিয়েছেন। দেশে যখন রাজাকার নাম উচ্চারণের পরিবেশ ছিল না, তখন নাটকে পাখির মুখ দিয়ে তুই রাজাকার বুলিকে জনপ্রিয় করেছিলেন উনি।

পরবর্তীতে তাঁর চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু চেঞ্জ এসেছিল। শেখ মুজিব নিয়ে যে-আখ্যান সেখানে উনি ভুল তথ্যপাঠের শিকার হয়েছিলেন। কিছুটা ভিন্নখাতে ভাবতেও চাইছিলেন হয়তো। জানি না, বেঁচে থাকলে বদলে যেতেন কিনা! হয়তো যেতেন, হয়তো না। মানুষের ব্যাপারে উনার যে-দৃষ্টিভঙ্গি তার কারণেও বটে, হুমায়ূনের কাছে মন্দ মানুষ বলে কিছু নেই আসলে। চরম খারাপ মানুষের মধ্যেও উনি জীবনরস খুঁজতেন। আজব মনে হলেও এটি তাঁকে দখলে রাখত। মিসির আলী কিংবা হিমু এসব কারণেই সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। কাল্পনিক চরিত্র, কিন্তু তাঁর কাছে একান্ত বাস্তব।

রাজাকারি করছে যে-লোকটা, নানারকম শয়তানি মতলব আঁটছে, তাকেও আখ্যানে বা নাটকে ধরার সময় খোদার সৃষ্ট আজব রংবাজ ইনসান হিসেবে ধরে নিতেন। এইটা উনার মাথায় ভর করত। যে-কারণে তাঁর পক্ষে কখনোই দস্তয়েভ্স্কি বা তলস্তয়ের ধাঁচে লেখা সম্ভব ছিল না। না লিখতে চেয়েছেন তারাশঙ্কর-মানিক কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো করে। উনি উনার মাপে লিখতেন;- ভাবতেন, এবং মজা করতেন। আরেক হুমায়ূন, মানে অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদীর মতো বিচিত্র ও আকর্ষণীয় মানুষ ছিলেন;- শাওন মূলত এই মানুষটির প্রেমে পড়েছিলেন তখন।

তো সেই হুমায়ূনকে যদি মুছে দিতে পারে, ধরে নিন, বাংলাদেশের অত্যন্ত শক্তিশালী একটি প্রতীককে তারা সফলভাবে ইরেজ করতে পারবে, এবং সেটি সম্ভব। সাহিত্যিক আবেদনের জায়গা থেকে হুমায়ূন আহমেদ যদি নিষ্প্রভ হতেন, আমার কোনো সমস্যা ছিল না। উনাকে রাজনীতির জায়গা থেকে নিষ্প্রভ করার মতলবটি আপত্তিজনক। আমাদের কবিলেখকের ওসব নিয়ে ভাবার টাইম নেই। উনারা হুজুগ আর গুজব নিয়ে ব্যস্ত। নিজের পাছার কাপড় যে নাই হয়ে যাচ্ছে, ল্যাংটাবাবা বানিয়ে দিচ্ছে,- সেদিকে হুঁশ নেই। বাংলাদেশের সাহিত্য নব্বই থেকে অবক্ষয় ও ধসের শিকার। উদ্ধারের অবস্থায় নেই। সব ওই পেদ্রো পারামোয় পড়া মৃত গ্রামে জীবিত প্রেত হয়ে ঘুরছেন।

Pedro Páramo by Juan Rulfo; Official Trailer; Source – Netflix YTC

. . .

মিনহাজ ভাই, হুমায়ূনকে নিয়ে আপনার আলাপ আরো গহীনে যেতে পারত মনে হয়। হ্যাঁ, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরো একটি লেখা পড়েছি আপনার। লেখাটি আমার মতে অসম্পূর্ণ ছিল। বর্তমান অস্থিরতা দূর হলে বহুমাত্রিক আলাপ হয়তো পাবো আপনার থেকে। হুমায়ূন সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে এতো দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে গেছেন, আমরা এখন কোনটা রেখে কোনটা নেবো,- সেটি স্থির করে উঠতে পারি না। হুমায়ূনের ব্যক্তিজীবনও ঘটনাবহুল। এক্ষেত্রে তাঁর নিজের জীবন ও সৃষ্টিশীল জগৎকে মিলিয়ে প্রয়োজনীয় আলাপে আমরা হয়তো যেতে পারি।

আপনি তো জানেন, গহীন স্তরের পাঠকরা একসময় হুমায়ূনকে অনেকটা এড়িয়ে চলতেন। তার কারণ অনেকে ব্যাখ্যাও করেছেন। অনেকে তাঁকে একালের শরৎচন্দ্র বলে ভাবতেন। মানে ওই জনপ্রিয়তার জায়গা থেকে তুলনা টানতেন তারা। আমি নিজে তাঁর লেখায় বুঁদ ছিলাম অনেকদিন। বাস্তব-অবাস্তবের সীমারেখা তাঁকে পড়তে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেছি বহুবার।

কথা হচ্ছে, আমরা আমজনতা তাঁকে নিয়ে কী বলছি সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। হুমায়ুন আজাদ ও আহমদ ছফা যখন তাঁর লেখালেখি নিয়ে তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন, তখন তার একটি অর্থ নিশ্চয় থেকে যায় সেখানে। এই দিকটি আলাপে আসা প্রয়োজন। তাঁর নাটক ও গল্পগুলোকে কাজের কাজ হয়েছে বলে অনেককে মত প্রকাশ করতে শুনেছি। আপনিও কি তাই ভাবেন? শরৎচন্দ্রকে তো আমরা এখন সেভাবে স্মরণ করি না। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিবস মনে থাকে না কারো! অনেকে বলেন,- হুমায়ূন আহমেদ হচ্ছেন শরৎচন্দ্রের মতো চানাচুরমার্কা লেখক। তাদের ভাবনা ও মন্তব্য আজব লাগে আমার কাছে! কেন তারা এসব ভাবেন? যুক্তির জায়গা কি সেখানে আছে?

তুই রাজাকার, হিমুর রূপালি রাতদিনের হাস্যরস, রহস্যময় ও খানিকটা আধ্যাত্মিক সমাচার নিয়ে হাজির মিসির আলীর প্রতি আকর্ষণ কি তবে তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে? চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও টেলিনাটককে এই সময়ে দাঁড়িয়ে কীভাবে দেখছি আমরা? জানার আগ্রহ থাকল। আরো অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হালার প্রবাস জীবন এমনভাবে দৌড়ের ওপর রাখে,- হাজার চেষ্টা করেও আপনাদের সঙ্গে আজকের এই যৌথ-যাতনায় একাকার হতে পারছি না।
. . .

তুলনামূলক সাহিত্য বিচার একটি বাজে তরিকা

হুমায়ূনের সাহিত্য নিয়া আলাপের চাইতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাঁর যে-আবেদন, সেই বিষয়ে আলাপ এখন অনেকবেশি জরুরি বেলাল ভাই। সাহিত্যে উনি কী আবাদ করছেন, কতটা গুরুত্ব রাখে এই চাষাবাদ, আদৌ মহৎ লেখক নাকি সস্তা… এসব ছোটকাগজমার্কা আলাপ একসময় আমার কাছে প্রাসঙ্গিক ছিল, এখন আর নাই। দেশ-বিদেশে যত লেখককে কমবেশি জানার সুযোগ ঘটছে তাঁরা সকলে পরম প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের কথা যদি বলি, হুমায়ূন আহমেদ গুরুত্ব বহন করেন। কাশেম বিন আবু বকরও গুরুত্ব রাখেন। আবার শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির মানের লেখকরাও সমান প্রাসঙ্গিক। লেখক হিসেবে প্রত্যেকের বেড়ে ওঠার পরিধি আলাদা। সেই অনুসারে তাঁদের লেখার বিষয়বস্তু, ভাষা, শৈলী ছাড়াও যতকিছু দিয়া আমরা লেখার মাপ নেই… সেগুলা আলাদা;- পাঠকবৃত্ত পৃথক। এসব দিক বিবেচনায় নিয়া প্রত্যেকের মেরিট ও কন্ট্রিবিউশন বিচার করা উচিত মনে হয়।

আহমদ ছফা এখন হমায়ূনকে কীভাবে জাজ করলেন, হুমায়ুন আজাদ কোন চোখে মাপ নিলেন ইত্যাদি একান্ত উনাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করতেছে। একসময় শুনছি, এখন তাতে কান দেওয়ার আগ্রহ জীবিত নাই। কোনো পাঠক কোনো লেখকের বিচারক নয়, কোনো লেখক কোনো পাঠকের রুচির ঠিকাদারি নেন নাই। এতদিনে বিষয়টি আমাদের ক্লিয়ার হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। সোহেল হাসান গালিবদের যেমন দেখি,- হুমায়ূন আহমেদকে প্রমোট করতে নেমে হাসান আজিজুল হককে তাচ্ছিল্য করেন। হাসান আর হুমায়ূনকে উনারা যেসব প্যারামিটার দিয়া মিলায়, সেটি আমার মাথায় ঢোকে না। দুজনের লেখার ধাঁচ ও জীবনবীক্ষণ সম্পূর্ণ আলাদা। হুমায়ূন একমেরুতে বসে দেখেন ও ভাবেন, হাসান ৩৬০ ডিগ্রি বিপরীতে কলম চালান। তাঁদের মধ্যে কাজেই তুলনা হইতে পারে না।

গালিবদের চেয়ে বরং কাজী আনোয়ার হোসেনকে আমার বিবেচক মনে হইছে এক্ষেত্রে। ব্রাত্য রাইসু উনার একখানা সাক্ষাৎকার নিছিলেন। সেখানে হুমায়ূন ও হাসানের প্রসঙ্গ উঠছিল। কাজী আনোয়ার হোসেন, যদি ভুল না করি, হাসানের শকুন গল্পটার প্রশংসা করছিলেন। গল্পটা পড়তে দারুণ লাগছিল তাঁর, এবং হাসান নিঃসন্দেহে বড়ো লেখক। তারপর বলছিলেন,- হুমায়ূনের লেখায় আমি ধক করে মাটির গন্ধ পাই। খুব কাছের… নিজের লাগে। হাসানে ওই গন্ধটা সেভাবে নাই। কাজী আনোয়ার হোসেন কিন্তু তুলনায় না গিয়াও নিজের ভালোলাগার মাত্রা ক্লিয়ার বলে দিতেছেন। গালিবরা এই জায়গায় স্বচ্ছ না একদম। এইটা আসলে উনাদের পলিটিক্স। ভারতবিদ্বেষের জায়গা থেকে হাসানকে উনারা পচাইতে ভালোবাসেন। তাঁকে বাংলাদেশী বইলা মানতে চান না। বাংলাদেশে এগুলাই চলে ভাই। ছফা, আজাদের মতো গুণী মানুষও এই সংক্রামের বাইরে যাইতে পারেন নাই।

‘ইতিহাস বলে কিছু নেই’ – A conversation with Hasan Azizul Haque; Source – Magic Lanthon YTC

হাসান আজিজুল হকের লেখার আমি নিজে গুণমুগ্ধ পাঠক না। সেইটা সম্পূর্ণ পৃথক কারণে। উনি দর্শনের শিক্ষক হইলেও উনার দার্শনিকতার বনেদ বাজে ছিল। যে-কারণে বোর্হেস নিয়া উল্টাপাল্টা বক্তব্য রাখছিলেন একসময়। বোর্হেসের একলাইনও নাকি উনি বুঝে নাই। বুঝবে ক্যামনে, ধ্রুপদি মার্ক্সবাদ নিয়া পড়ে থাকলে বোর্হেস বুঝতে পারবে না উনি। সাক্ষাৎকারটা পড়ে রাগ উঠছিল খুব। পরে চিন্তা করলাম,- এর জন্য উনাকে খামোখা দায়ী করে লাভ নাই। লেখায় তো আর দার্শনিকতা ফলাইতে যায় না উনি। সেগুলার বিষয়, ভাষা, পটভূমি নিয়া আলাপ পৃথক।

শেষ জীবনে এসব বলদামির জন্য তাঁকে মূল্য দিতে হইছিল। মাসরুর আরেফিনের আখ্যান নিয়া ঝামেলায় পড়ছিল উনি। আপনে পড়েন নাই বা বোঝেন নাই, তাতে সমস্যা নাই, কিন্তু তার বইয়ের ভূমিকা লেখার দায়িত্ব নেওয়ার দরকার ছিল না। হেই ব্যাটা বিশ্বসাহিত্যের বাজার থেকে লেখার বিচিত্র শৈলী ধার করে টেক্সট সাজায়। আপনি ভাই ক্লাসিসিস্ট, পুরানা আমল নিয়া পড়ে আছেন, পড়ে থাকেন। মাসরুর আরেফিন যে-আঙ্গিকে লেখেন এবং এর মধ্য দিয়া উনার পুঁজিবাদী এলিট চরিত্রকে জাস্টিফাই করতে থাকে ও ঝাড়ে বিস্তর। ট্রিকসটা যদি ধরতে না পারেন তার লেখা হাতে নেওয়া আপনার উচিত না। সে তো আপনাকে টেস্ট করতেছে। আপনি শালা মার্ক্সবাদীকে টাকা দিয়া কিনতে চাইতেছে, দেখতে চাইতেছে আপনি কতটো হ্যাডম রাখেন। আপনার ভাই কী দরকার তার জগতে ঢোকার?

এগুলা আমাদের লেখকদের মজ্জাগত সমস্যা। সকলে পজিশন নেওয়ার পর ভাব মারান এবং পরে কট খান। ছফা ব্যতিক্রম ছিলেন কিন্তু উনি তো আবার পাগলা…! যে-কারণে হুমায়ূনের কাছে আশা করে বসছেন প্রুস্ত! এইটা কিছু হইল? হুমায়ূনকে তাঁর মাপে দেখেন। সেখানেও দেখার আছে বহুত। তুলনামূলক সাহিত্য বুদ্ধদেব বসুরা এখানে আমদানি করছিলেন। একটা বাজে কাজ করছেন উনারা। আমাদের মাথা খাইছেন একসময় এইটা দিয়া। অনেক কষ্টে বাহির হইছি ভাই;- ওই খোড়লে আর ঢুকতে চাই না। তারচেয়ে বলেন, পরীমণি নিয়া লিখতে। মনে হয় না সেইটা খারাপ কিছু হবে।
. . .

Mathay Porechi Sada Cap by Humayun ahmed; Source – Laser Vision Music Station YTC

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 3

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *