দেখা-শোনা-পাঠ

শিয়র ও শিরোস্ত্রাণের কবিকাহন

কবি টি এম কায়সারের কবিতাবই শিয়র ও শিরোস্ত্রাণ নিয়ে একগুচ্ছ রাফসডি পাঠ করতে বসে টি এস এলিয়ট মনে উঁকি দিতেছেন আকস্মিক। কবিতাগুলা পড়তে বসে এলিয়টের ঐতিহ্য ও ব্যক্তিপ্রতিভা নামে বিদিত রচনা ইয়াদ হইতেছে। কবি দাউদ আল হাফিজের ঝরঝরে ভাষান্তরে খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত ছোটকাগজ একবিংশ-এর পাতায় এলিয়ট বিরচিত রচনাটি একসময় পড়ছি বটে। ইংরেজিতে পরে পাঠ করছি বারকয়। সবটা তথাপি স্মরণ নাই এখন। মূল পয়েন্টগুলা যদিও বিলক্ষণ মনে পড়তেছে। এলিয়ট সেখানে বলছিলেন,- বালেগ হওয়ার পথে অতিকায় যেসব ঐতিহ্যকে মানুষ তার দেহমনে বহন করতে থাকে এখন তার সবটাই কবিতায় প্রবাহিত করতে সে বাধ্য। প্রবাহনটা এখন ঐতিহ্যকে যদি নতুন পথে বিনির্মাণ করতে না পারে তাহলে কবিতা লিখে ফায়দা নাই। একইভাবে নিজের একান্ত আবেগ ও স্মৃতিকে কবিরা কবিতায় বহন করে যাবে, কিন্তু প্রকাশ এমনভাবে ঘটানো প্রয়োজন যেন অন্যরা কবির সঙ্গে নিজেকে একীভূত গণ্য করতে পারে। তার যেন মনে হয়,- কবির সংবেদে আমিও অংশীদার।

কবিতার পাঠ ও আলোচনায় এলিয়টপন্থা যারপরনাই অনেকের মনে নীরবে সক্রিয় থাকে। কবি তার ব্যক্তিগত অনুভবকে কবিতার ভাষায় কতখানি নৈর্ব্যক্তিক করতে পারলেন ইত্যাদি নিক্তি হাতে নিয়া কবিতার গুণাগুণ পাঠক মাপেন বটে! তার সঙ্গে ভাষার ওস্তাদিসহ কবিতা বিরচনের বিবিধ সূত্র পাঠকমনে আপনা থেকে সক্রিয় হইতে থাকে। যত চেষ্টাই করি-না-কেন, একধরনের অভ্যাসের মতো কবিতাপাঠের মুহূর্তে এসব মনে উঁকি দিয়া যায়।

যাই হোক, আমাদের মতো সাধারণ পাঠক, যারা অতশত বুঝি না, তাদের জন্য এভাবে কবিতাপাঠ ঝামেলার। আমরা নির্দিষ্ট হইতে চাই দুইখান ঘটনায় : প্রথম, কবিতা পয়লা ধাক্কায় ভিত্রে গিয়া টোকা দিতেছে। পড়তে ভালো লাগতেছে, এবং লাগতেছে। দ্বিতীয়, কবিতার মধ্যে ভাষার জাদু নিহিত আছে। পঙক্তি হইতে পঙক্তিতে যাওয়ার যে-জার্নি, তার মধ্য দিয়া ছবির মতো সবটুকু দৃশ্যমান হওয়ার বোধ জাগতেছে মনে, এবং পরিশেষে মিনিং বা অর্থটাও বেশ ধরতে যাইতেছে বইলা আশ্বস্ত হইতেছে মন। এইটুক যদি পাওয়া যায়, আমাদের মতো আমপাঠকের মগজপূর্তি ষোল আনা ঘটে সেখানে।

Poet T M Ahmed Kaysher – Author the reviewed book

পাঠক হিসেবে কবি কায়সারের কবিতাবইয়ে কি সেগুলা পাওয়া যাইতেছে? প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়,- হ্যাঁ জনাব, আমি পাঠক পাইছি। আপনাদের কথা তো বলতে পারব না, তবে মনে হয় পাবেন। ইমোশন বা আবেগ ছাড়া কবিতার হাতেখড়ি হয় না সম্ভবত। শিয়র ও শিরোস্ত্রাণকে একত্রে গেঁথে বিরচিত কবিতামালায় আবেগদীপ্ত উচ্চারণ মিলতেছে বিলক্ষণ। আবেগের আতিশয্য আবার অনেকসময় কবিকে ভাবালুতায় জিম্মি করে। কবিতার জন্য ভাবালুতা খারাপ কিছু না। তবে হ্যাঁ, পরিমিত মাত্রার চেয়ে বেশি হলে মগজে এর চাপ নেওয়া কঠিন মনে হইতে থাকে পাঠকের। কবিতার আন্তরমূল্য বোধহয় ক্ষুন্ন হয় তখন।

টি এম কায়সারকে এইবেলা তার নিজস্ব তরিকায় হিসাবী ঠেকছে আমার। ভাবালুতা আছে, কিন্তু সিংহভাগ জুড়ে সংযমের মাত্রা কবি বজায় রাখছেন ভালোই। এমন না যে যুবকালের এই জানি দোস্ত হিসাব-কিতাব করে লিখছে। কবিতাপাঠের অভিজ্ঞতা তাকে আপনা থেকে গাইড করছে সেখানে। ভাবালুতার সুরা যারপরনাই মাঝেমধ্যে কোনো-কোনো কবিতায় চড়া ঠেকলেও মোটের ওপর সংযম আগাগোড়া বজায় রাখছেন কবিবর। আবেগকে ততটাই নিঃসরণ করছেন কায়সার, যতটা হলে কানে খট করে বাজে না। পড়তে আরাম লাগে বেশ, আর এই সুবাদে পঙক্তিচরণ দুলকিচালে মনের ভিত্রে জায়গাও নিতে থাকে।

শিয়র ও শিরোস্ত্রাণের মধ্যে জমা করা এসব কবিতা পাঠের সুবাদে কিছু কি বোঝা গেল? অনেকে বলেন যদিও,- অর্থ বা মিনিং বোঝাটা কবিতার ক্ষেত্রে জরুরি নয়। আমার কাছে ডাহা মিথ্যা মনে হয় কথাটা। হইতে পারে, কবি যা প্রকাশ করছেন সেখান থেকে দ্বিরাভাস জাগ্রত করে এমনসব মিনিংয়ের চক্করে পাঠক খাবি খাইতে থাকে। বুঝেও কিছু বোঝা গেল না, কিন্তু পড়তে দারুণ ইত্যাদি মনে হয় তার। এর মানে তো এমন না মিনিং নাই সেখানে। কবিতা প্রকারান্তরে মস্তিষ্কের জটিল সব সুড়ং হইতে বাহির হয়। ওহিবাহক কোনো জিব্রিল ফেরেশতার মাধ্যমে কেউ সেগুলা কবির কাছে পাঠায় না। কবিতা আদিতে জীবনারণ্যে বালেগ হইতে থাকা কবির অনুভব, ভাবুকতা ও সংবেদের ভাষাপ্রকাশ,- তার বেশি কোনো রহস্য সেখানে নাই। সুতরাং কবিতাকে মিনিং বাদ দিয়া পাঠ যাওয়ার চেষ্টাও এক ধরনের কলাকৈবল্যবাদী বিকারের নামান্তর লাগে আমার কাছে। শিয়র ও শিরোস্ত্রাণে সংকলিত কবিতাসমষ্টি বড়ো আকারের দ্বিরাভাস ও দ্ব্যর্থক দ্যোতনায় ধনী না হলেও মিনিংয়ের দিক থেকে সলিড।

অর্থ পয়দার নিরিখে টি এম কায়সার স্বচ্ছতোয়া নদী। আধুনিক বাংলা কবিতা বিরচনের ধারা মোতাবেক সবগুলা কবিতাই অর্থবোধক। ভালো লক্ষণ এই যে, কবি কায়সারের বিকাশলগ্ন অর্থাৎ নব্বই দশকে বিরচিত কবিতার আসর নিজের উপ্রে পড়তে দেননি। আবেগকে যে-মাত্রায় সেলাই করলে তারে শব্দের জাগলিং মনে করার পরিবর্তে আন্তর-সংবেদী বইলা পাঠক মনে নিতে থাকেন,- শিয়র ও শিরোস্ত্রাণে সমবেত কবিতাপুঞ্জে প্রবাহটি কবি ধরে রাখতে কামিয়াব ছিলেন। আমার তাই মত। অন্যরা সহমত অথবা দ্বিমত যাইতে পারেন সেখানে।

এখন আসি ব্যক্তিকবির মনোজগৎ হইতে নির্গত এসব কবিতা কি নৈর্ব্যক্তিক? ব্যক্তি-আবেগকে কতখানি নৈর্ব্যক্তিক করতে পারছেন আমাদের কবিবর? কবিতাগুলা কি সহনীয় মাত্রায় নৈর্ব্যক্তিক? নাকি এতটাই অতিরিক্ত যে পাঠকের পক্ষে কবিকে মনে হবে নিরাবেগ কোনো পাষাণ অথবা ঈশ্বর? আমার কাছে সেরকম মনে হয়নি। শিয়র ও শিরোস্ত্রাণে জিম্মি কবিতাগুলা পাঠ যাওয়ার সময় কবির মনোসংবেদের ভাগীদার হইতে কোনো অসুবিধা ঘটে নাই। আবেগের পুরোটাই সেখানে কবির একান্ত ব্যক্তি-জাগতিক অনুভূতির বিস্ফার, কিন্তু বিস্ফারটা পাঠককে স্পর্শ করতেছে সেখানে। একেই তো চশমাধারী কবিতা-সমালোচক সংক্রাম বইলা ডাকেন? কায়সারের কবিতাভাষায় জিনিসখান বিদ্যমান। উদাহরণ দিতে গেলে অনেকগুলা দিতে হবে। একটি আস্ত ও আরো কিছু কবিতার পঙক্তিচরণ আপাতত নিচে পেশ যাইতেছি। আমার মনে হয় সংক্রামটা পাঠক টের পাওয়ার কথা। কবি কায়সার কহিতেছেন…

টানা দশ ঘণ্টা আতশবাজি শেষে নতুন বছর শুরু হলো 
মাত্র কিছুদিন আগে
তারপর এই যে আবারও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি
রাজস্থানের মরুভূমিতে এক প্রকাণ্ড উটের পিঠে চড়ে
টপ্পা গাইতে গাইতে
এই যে একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি
একে অন্যের দৃষ্টিসীমা থেকেও দূরে—
একটা মানুষ এবং একটা উট থেকে ক্রমে শুধুই
একখানা বড় পীপিলিকা এবং একখানা কালো বিন্দু হয়ে
যে যার মর্মন্তুদ অশ্রু ও হাহাকারে এই যে নিরুদ্দিষ্ট হচ্ছি ধীরে
এর নাম মৃত্যু নাকি মডার্নিটি—
জিজ্ঞেস করে রাখছি ভাষাতত্ত্বের সব দার্শনিকের কাছে!
[মৃত্যু অথবা মডার্নিটি] 
. . . 

বরং একটা একাকী গাছের গলা জড়িয়ে ধরে, ভাবি, 
গলা ছেড়ে কেঁদে উঠি; আর লোকেরা ভাবুক
হয়তো একটা বিপন্ন ট্রাম রাস্তাচ্যুত হয়ে কোথাও থুবড়ে পড়েছে
এই যে প্রেম ও মৈথুন সব বৃথা বৃথা বৃথা মনে হয়...

এখন রাত তিনটে বাহান্ন মিনিটে জানতে ইচ্ছে করছে একজন ভাষাবিজ্ঞানী, 
একজন মনোবিজ্ঞানী 
একজন পাঁড়-মূর্খ এবং একজন জ্ঞানী 
একজন সফল এবং একজন বিফল প্রেমিক 
এই বিষয়গুলো কীভাবে ব্যাখ্যা করেন! 
[রাত তিনটে চল্লিশ মিনিট] 
. . . 

এই নদীতীরেই আমাদের শুরু 
কোনো না কোনো নদীতীরেই তো আমরা আসলে শুরু করি 
তীরের কোনো বাঁকে দাঁড়িয়েই প্রথম আকাশ দেখে আমরা আঁতকে উঠেছিলাম 
নদীকূলেই তো আমরা সঞ্চয় করেছি জীবন, বিত্ত আর বিবিধ বৈভব 
তীরবর্তী বিস্তীর্ণ মাঠে মেষ চরাতে চরাতে আমরা কেউ ত্রাতা হয়েছি, কেউ প্রেমিক 
আবার কেউ বা প্রবঞ্চক 
আমাদের প্রণয়, চুম্বন আর ধ্যানোন্মাদ সংগমের ভেতরও 
একটা নাতিশীতোষ্ণ নদীই বয়ে যায়; তীরে রাইখেত, আদিগন্ত ইলামের মাঠ! 
[ক্রান্তিকাল] 
. . . 

ডিসেম্বর আসুক 
শীত আরও ঘন হয়ে পড়তে শুরু করলে 
আমিও ধীরে ধীরে গোপন সিন্ধুক থেকে বের করব 
আমাদের ধ্বংসোন্মুখ, প্রলয়োন্মুখ, প্রজননোন্মুখ গূঢ় চুম্বনের স্মৃতি! 
[স্মৃতি] 
. . . 

শুঁড়িখানার সঙ্গী, সুরা, পানপাত্র সব ফেলে এসেছি 
এখন খুব তুষারপাত হোক 
মাঝে মাঝে তুমুল বজ্রপাতও; কে না কে মারা গেল—তাতে আমার কী 
[গোঁ] 
. . . 

কী আশ্চর্য গো এই আপেলফল! 
বাকলে কেঁপে কেঁপে উঠছে ক্ষণে ঈশান আবার ক্ষণে বিষাণমুখো আগুনের ফ্লেম; 
উপরন্তু ঘুম-সরোবরের ছায়া 
[আপেল] 

এরকম আরো চয়ন করা যাইতে পারে। কায়সার যতগুলা কবিতা বইয়ে সন্নিবেশ করছেন, তার সবগুলায় উদ্ধৃত অনুভূতির প্রবাহ কমবেশি আমরা পাইতে থাকব। ব্যক্তিএককের উচ্চারণকে তারা প্রকাশ যাইতেছে। ব্যক্তিএকক হইলেও সেখানে এলিয়টের নৈর্ব্যক্তিক আভাসের রেশ বহমান থাকায় কবির ইমোশনকে নিজের করতে পাঠকের বেগ পাইতে হয় না। এইটুকুন একাত্মতা যদি না থাকত তাহলে কবিতাগুলা পাঠের প্রয়োজন ফুরাইত। চার ফর্মায় সাজানো কবিতাপসরা আদতে কী জানাইতে চায় পাঠককে, তার মামলায় এবে আসা যাক। বইয়ে সংকলিত কবিতাসমষ্টির মধ্য থেকে প্রিয়তর কবিতাটিকে এখানে নিতে চাই। আস্ত উধ্দৃতি যাই বরং :

বারুতখানা রোডের ধারে হাঁটছি যখন 
স্ল্যাবের চিপায় পা ঢুকিল হঠাৎ কখন
গোসাঁই, আমার হাত ধরো নয় ভেসে যাব চেনার স্রোতে
নিচে কালো পুরীষস্তূপ আর চেনা তো নয়; পুঁজ-প্রবাহ
সইতে নারি সইতে নারি আহা মরি!
গোসাঁই আমার হাত ধরো গো!
[হাত ধরো]
Plato’s Cave : Symbolic Artwork; Source – philosophyterms.com

ওই-যে স্ল্যাবের চিপায় পা হড়কাচ্ছেন কবিবর, গোঁসাইকে বলতেছেন হাতটা ধরে তারে পুরীষস্তূপে পতিত হওয়ার হাত থেকে পরিত্রাণ করতে, কায়সারের কবিসত্তার এইটা হইতেছে মূল সুর। এবং আমাদের সকলের ক্ষেত্রে সুরটা প্রযোজ্য। আমরা তো আদতে টাবুলা রাসা ছিলাম বাহে। প্লেটোর গুহায় বন্দি ছিলাম। গুহার মধ্যে যা দেখছি সেইটা ছিল চেনা। তার বাইরে যা ছিল তার সবটা অচেনা। আমাদের মধ্যে প্রথম যে-পামর ঘটনাচক্রে গুহা থেকে বাহির হয় ও পরম বিস্ময়ে দেখতে পায় গুহার বাইরে আশ্চর্য এক জগৎ বহমান, সেইটা ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে বড়ো বিস্ময়! দাসত্বের শিকল কেটে মুক্ত হওয়ার প্রথম আলোসুর। অবিষ্কারটা পরে একইসঙ্গে সম্ভাবনা ও বিপর্যয় নিয়া আসে আমাদের জীবনে।

আরণ্যিক সভ্যতা থেকে মানববিরচিত সভ্যতায় আমাদের যাত্রা প্লেটোর গুহাস্বরূপ সরলরৈখিক জগৎ থেকে অবিশ্বাস্য জটিল ও সংক্ষুব্ধ সড়ক ধরে যাত্রার সমতুল। তারপর থেকে কিছুই ঠিকঠাক নাই আর! আমরা কতরকম গুহা যে তৈরি করছি, তার এক-একটা খোপে বসে কতভাবে নিজেকে দেখতেছি, তার কোনো লেখাজোঁকা নাই! কোনো দেখাটাই পরিতুুষ্টি ও নিশ্চয়তা বিধানের সক্ষমতা রাখে না। সুতরাং মানবজীবনের সবটাই অনিশ্চিত ও সংক্ষুব্ধ হাহাকার আর পুরীষে সয়লাব নর্দমায় পতিত হওয়ার শঙ্কায় কাতরায়। কোন গোঁসাইয়ের হাত ধরবে এখন কবি কায়সার? ঈশ্বর? শয়তান অথবা শয়তানের মতো দেখতে ঈশ্বর সমতুল কোনো মানব? উত্তর অধরা। মডার্নিটি অত্র এসে অভিশাপে পরিণত। মানুষকে স্বস্তি দিতে সে নাচার। এইটা হইতেছে আন্তর অনুভূতি। সকলের মধ্যে কমবেশি প্রবাহিত এবং কায়সারের শিয়র ও শিরোস্ত্রাণগাঁথায় যা পুনরায় ঘোষিত হইতেছে।

এখানে এসে ব্যক্তি কায়সার ও কবি কায়সারকে পৃথক দুটি সত্তা ভাবতে পাঠক অনেকটা বাধ্য। তারা এক নয়। এক হইতে পারবে না কখনো! ব্যক্তি কায়সারকে যেহেতু নিবিড়ভাবে জানি, আমার পক্ষে কবি কায়সারের সঙ্গে ব্যক্তি কায়সারকে একীভূত করা কঠিন মনে হইতেছে। ব্যক্তি কায়সার আড্ডাবাজ। রসিক ও মজলিশি। সে গানটান করে। সুযোগ পাইলে দোস্তদের পিঠকে তবলা বানিয়ে গানচর্চায় ত্রুটি করে না। গীতিনাট্যে মঞ্চ মাতায়। মঞ্চে লাগাতার তাকে হাজির দেখি আমরা পরিচিতজন।

Bandana – Rohim Badsha Rupban – T M Ahmed Kaysher; Source – RadhaRaman Folk Festival YTC

মঞ্চমাতানো কায়সার আর সেখানে সদা গরহাজির কবি কায়সার আমার কাছে যে-কারণে পৃথক মানুষ। কবি কায়সার হইতেছে মঞ্চ কায়সারের বিবেক। তার আয়না। সময়রেখায় ভগ্ন, আতুর, স্মৃতিকাতর এক মানুষকে যে-আয়নায় দেখতে পায় মঞ্চমাতানো সামাজিক কায়সার। কোনোকিছুই সে-কবি কায়সারকে তৃপ্তি দিতে অক্ষম। নিজেকে সে শৃঙ্খলিত বইলা ঘোষণা করে। ফুকোর মানব হওয়ার হতাশায় আবেগাতুর হয়। তার জন্য পরিত্রাণের জায়গা অবশিষ্ট নাই বইলা জানায়। কবিতায় এখন মঞ্চমাতানো কায়সার আদতে নিজের বিপন্নতাকে প্রকাশ যায়। যেমন যুগ-যুগ ধরে কবিগণ এভাবে প্রকাশ যাইতেছেন নিজেদেরকে। শিয়র ও শিরোস্ত্রাণে গচ্ছিত কবিতাগুচ্ছে কাজেই আশাবাদ ক্ষীণ। জৈববাসনার লেলিহান হাহাকারটাই বড়ো হয়ে কানে লাগে।

এখন আসা যাক প্রভাবিত হওয়া বা না হওয়ার মামলায়। কায়সারের কবিতা দলবিচ্ছিন্ন উচ্চারণ নয়। কাজেই সেখানে রবি ঠাকুর আছেন, আল মাহমুদ বিরাজ করতেছেন, আরো অনেকে সংগোপন উঁকি দিতেছেন বৈকি। তাতে কিছু যায় আসে না। প্রভাবহীন কোনো কবি পৃথিবীতে নাই। কবির কাজ হইতেছে অন্যের দ্বারা নিজেকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করা, যেখানে প্রভাবকে তার নিজ-অনুকূল ভাষায় যদি সে আত্মস্থ করতে পারে তাহলে ঐতিহ্য ও ব্যক্তিপ্রতিভায় এলিয়ট যে-ইশারা রেখে গেছেন, তার সঙ্গে বড়ো একটা গোল বাধে না।

কবি কায়সারের কবিতাগুলা আরেক দিক হইতে আমার কাছে ব্যতিক্রম মনে হইছে। নিজের দশক নয়ে তাঁর কবিতারচনার সূত্রপাত বইলা আমরা জানি। নয়ের কবিকুলদের চোরাগুপ্তা সব কেরদানি, এগুলার সাফল্য ও সমধিক ব্যর্থতার কোনোটাই কবিকে বিশেষ একটা নাগালে পায় নাই। লোকঅনুষঙ্গ ব্যবহার করে বিরচিত গদ্যছাদের কবিতাগুলায় নব্বইয়ের উত্তর-আধুনিক কবিতার ঢং খানিক পাওয়া যাইতেছে, আছে মিথের অনুরণন, এবং আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় এগুলা বইয়ে স্থান না দিলে বড়ো কোনো ক্ষতি মনে হয় না ঘটত।

Saudha Arts activities 

কবির আবেগ এসব লোক-অনুষঙ্গের সঙ্গে খুব যাইতেছে বইলা মনে হয় নাই। শহুরে ভাবালুতার অনুপ্রবেশটাই বরং চোখে লাগে অধিক। লোকসুরের সঙ্গে যেটি বৈপরীত্য তৈরি করতেছে এখানে। আল মাহমুদ যে-জায়গা হইতে নাগরিক যন্ত্রণারে সঙ্গে আবহমান লোকবাংলাকে একীভূত করে জাতীয় ইতিহাসের দিকে যাইতে থাকেন, ক্ষেত্রবিশেষ ভাঙন ও বিচ্ছেদ ঘটান ইত্যাদি… উনার জার্নি সেখানে এলিয়ট বর্ণিত ছকমাফিক ঘটতে থাকায় আমরা ঐতিহ্যকে নতুন আঙ্গিকে পাঠ ও অনুভবের শিহরন টের পাই। কায়সারের এই ধাঁচের কবিতাগুলার মধ্যে ব্যাপ্তিটা নিখোঁজ। এখানে সে নয়ের দশককে মনে হয় খানিক ফলো করছে অজান্তে, এবং না করলে ভালো ছিল মনে হইতেছে। তার স্থিতি আশির দশকের কবিকুল পর্যন্ত যারা ছিলেন তাদের সঙ্গে অধিক গাঢ়। সেরকম সহজ ও জীবনসংবেদী উচ্চারণে নিজেকে প্রকাশ করতে ভালোবাসেন এই কবিবর। একাধিক কবিতাকে এক অর্থে আঙ্গিকের দিক থেকে না হইলেও ভাবার্থ বিবচেনায় ম্যাক্সিম ভাবা যাইতে পারে।

পরিশেষে আসি নামকরণের মামলায়। রাফসডি শব্দটা আমার বুঝে আসে নাই। আমাদের এখানকার উচ্চারণ মোতাবেক ওইটা হইতেছে রাপসোডি। য-ফলা সংযুক্ত করে সচরাচর লেখা হয়, যদিও বাংলা ইউনিকোড ফন্টের সমস্যার কারণে র-এর সঙ্গে য-ফলাটা ভেঙে যায়। আমি যেমন এখানে য-ফলা বাদ দিয়া রাপসোডি লিখতে বাধ্য হইতেছি। যাই হোক, কুইন ব্যান্ডের ফারুখ বুলসারা ওরফে ফ্রেডি মার্কারির বোহেমিয়ান রাপসোডি গান ও তাঁর উপ্রে নির্মিত বায়োপিকের সুবাদে বহুদিন ধরে শব্দখানা মগজে অকাট্য। কায়সারের রাফসডি কি ওই শব্দের অনুবর্তী? নাকি ভিন্ন কোনো উৎস বা উচ্চারণবিধি হইতে শব্দখানা বাছাই করলেন কবি? আমার অজ্ঞতা হইতে পারে, তবে শিয়র ও শিরোস্ত্রাণের সঙ্গে শব্দটি কেন জানি বেখাপ্পা লাগে কানে! কোন উদ্দেশ্য থেকে কবি শিরোনামে জুড়ছেন সেইটা আন্দাজ করতে পারলেও আবশ্যক মনে হয় নাই। শিয়র ও শিরোস্ত্রাণ কিংবা শিয়রে শিরোস্ত্রাণ এরকম হইলেও চলত বোধ করি।
. . .

শিয়র ও শিরোস্ত্রাণ নিয়ে একগুচ্ছ রাফসডি – উৎসর্গ – টি এম আহমেদ কায়সার

. . .

পিডিএফ সংস্করণ : শিয়র ও শিরোস্ত্রাণ নিয়ে একগুচ্ছ রাফসডি 
টি এম কায়সার

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 3

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *