
. . .

ভয় : কাহলিল জিবরান
ভাষান্তর : বাপ্পা দত্ত
লোকে বলে সাগরে প্রবেশের মুখে
ভয়ে কেঁপে ওঠে নদী।
ফিরে দেখে গতিধারা,
পর্বত শৃঙ্গ হতে,
জঙ্গল গ্রাম পেরিয়ে আঁকাবাঁকা পথ।
আর সামনে দেখে,
সমুদ্র এতই বিস্তৃত,
যে প্রবেশ করার
একমাত্ৰ পরিণতি
চিরতরে হারিয়ে যাওয়া।
কিন্তু অন্য উপায় যে নেই।
নদী তো আর ফিরে যেতে পারেনা।
কেউই ফিরে যেতে পারেনা।
জীবনের পথে ফেরা সম্ভব নয়।
সাগরে প্রবেশের
ঝুঁকিটা নিতেই হবে তাকে
কারণ ভয় ভাঙার এটাই একমাত্র পথ,
আর তখনই নদীর উপলব্ধি হবে
সাগরে হারিয়ে যাওয়া নয়,
এ আসলে সাগর হয়ে ওঠা।
. . .
কাহলিল জিবরানের কবিতা-ভুবন, সৃষ্টি ও নির্মাণ নিয়ে মন্তব্য/ বিশ্লেষণ জানতে আগ্রহী। কেউ কি যোগ করবেন কিছু…
. . .

আজব লাগবে শুনে,—কাহলিল জিবরানক ভালোভাবে কখনো পড়া হয়ে ওঠেনি। তাঁর নাম শুনে-শুনে বড়ো হয়েছি। দ্য প্রফেট ভুবনবিখ্যাত। অনেকগুলো ভাষায় অনূদিত ও পঠিত হয়ে চলেছে এখনো! বাংলায় যার একাধিক ভাষান্তর হয়েছে এ-পর্যন্ত। চোখের সামনে বইটি দেখেছি। কিনেছিও। হারিয়ে ফেলায় আবার কিনেছি। অদ্ভুত মানতে হচ্ছে,—উলটে-পালটে রেখে দিয়েছি বইয়ের তাকে! পাঠ করা আজো হয়ে ওঠেনি!
একই সময়রেখায় মনিরউদ্দীন ইউসুফের তর্জমায় মাওলানা রুমির মসনবী পড়েছি সাগ্রহে। দিওয়ান-ই-শামস্ তাবরিজ পড়েছি মুগ্ধতায়। কোলম্যান বার্কসের রুমিকে নিয়ে লেখা বই ও কথালাপে কান পেতেছি আগ্রহ নিয়ে। আর, শাহজাদ গারিবপুরের সম্মোহক পাপেট ড্রামা মাওলভী অনলাইনের বদৌলতে উপভোগের সৌভাগ্য লভেছি জীবনে!
আল্লামা ইকবালও এভাবে ইংরেজি আর বাংলা ভাষান্তর মিলিয়ে পাঠ ও শ্রবণ-অভিজ্ঞতার অংশ হয়েছেন। কাহলিল জিবরানের বেলায় ঘটনাটি কেন ঘটল না,—এর উত্তর নিজের কাছেই অজানা! বহু-উচ্চারিত নাম হওয়ার কারণে হয়তো তাঁকে পাঠের আগ্রহ স্তিমিত হয়ে এসেছিল। কাজটি ঠিক হয়নি; তবে মাঝেমধ্যে এরকম ঘটে যায়! হারুকি মুরাকামির একটি বইও যেমন আজো পড়া হয়ে ওঠেনি! তাঁর গল্প-উপন্যাস থেকে বানানো ছবি অবশ্য দেখেছি একাধিক।
আরবি কবিতায় অ্যাডোনিস আমার পছন্দের। আরব মনীষা ত্বহা হুসাইনের ব্যাপারে টের পাই কৌতূহল। মোল্লাদের চাপে জন্মভূমি মিশর থেকে নির্বাসিত হওয়ার কারণে জীবনের বড়ো অংশ ফ্রান্সে কেটেছিল এই গুণীর। মনীষায় গভীর ত্বহা হুসেইনের বইপত্র এমনকি ইংরেজিতে অতটা সুলভ দেখিনি। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যেটুকু পাওয়া গেছে,—তাঁর পাণ্ডিত্য ও কবিত্বশক্তির দ্যুতি তাতে আঁচ করতে অসুবিধে হয়নি। অন্যদিকে, অ্যাডোনিসের কবিতা ও বিচ্ছিন্ন কিছু গদ্য বাংলা-ইংরেজি মিলে পাঠের সুযোগ হয়েছে। আরবি ও বিশ্বকবিতায় এই কবির প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত। প্রাক-ইসলাম ও পাশ্চাত্য কবিতাশৈলীর রসায়নে আরবি কবিতায় অ্যাডোনিস ভিন্ন ও নতুন। পড়তে বসে সেরকম লেগেছে বটে।
কাহলিল জিবরানের প্রভাব কি সেখানে পাচ্ছি? যেটুকু পড়েছি, তাতে কিছু নজরে আসেনি। থাকাটা অবশ্য অবান্তর নয়। মরমিরসে চোবোনো প্রাচ্যে অ্যাডোনিস পৌত্তলিক আরব কবিদের সঙ্গে অধিক ঘনিষ্ঠ। ইমরুল কায়েস বা আল-মুতানাব্বির মতো তাঁর মনের বনেদে বস্তুমুখীন ইহজাগতিক অনুরুক্তির ছাপ বেশ প্রবল! রোমান্টিক সংবেদে ইন্দ্রিয়ানুভব গুরুতর হতে দেখছি বলে মনে হয়েছে। আল-মুতানাব্বির মতো তিনিও অনেকখানি দ্রোহি;—এবং সে-কারণে সিরিয়া থেকে নির্বাসিত থাকতে হচ্ছে হয়ে গেল অনেকদিন।
তো, সেই অ্যাডোনিসের সুবাদে জানতে পারি,—সিরিয়া ও লেবাননে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধশতক মিলে একটি শিক্ষিতসমাজ গড়ে উঠেছিল। আমাদের এখানে যেমন,—অনেকখানি সেরকম ঘটনা ছিল তা। কাহলিল জিবরান সেই পরিধিসীমায় সাবালক হলেও থেকেছেন আমেরিকায়। সায়েবদের দেশে বসে আরবি ও ইংরেজিতে নিয়মিত লিখেছেন জিবরান। দ্য প্রফেট ইংরেজিতেই লেখা। ইংরেজিতে লেখার সময় মূলত গদ্যছন্দে লিখতেন। শুনেছি,—আরবি কবিতা লেখার সময় এর ভাষিক জলবায়ুতে পাশ্চাত্য শৈলী সূক্ষ্মভাবে মিশিয়ে দিতেন তিনি।
সব মিলিয়ে আরবি ও বিশ্বকবিতায় অগ্রগণ্য এক কবিতাকার। মরমি ও মানবিক। স্থানিকতার ব্যাপারে সচেতন, কিন্তু সেখানে সীমাবদ্ধ বা নিবিড় নন। জাতিগত সংকীর্ণতা ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সীমানা পেরিয়ে বৃহৎ পরিসরে বিস্তার ঘটিয়েছেন নিজের। সবটাই তাঁর পাঠক ও গুণগ্রাহীজনের আলাপ থেকে শোনা। সেইসব গুণগ্রাহী,—নিবিড় পাঠ করতে যেয়ে যাঁরা তাঁকে ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছেন।
কাহলিল জিবরানের কবিতার ব্যাপারে সুতরাং আমার মতো আনপড়ের কথা বলা সাজে না। তাঁর কবিতায় নিশ্চয় এমন কোনো দ্রবগুণ রয়েছে, যে-কারণে বিশ্বের শতাধিক ভাষায় দ্য প্রফেট অনূদিত ও পঠিত হয়ে চলেছে! পাশ্চাত্যে মাওলানা রুমির পরে তিনি সম্ভবত সর্বাধিক পঠিত কবি। রুমির চেয়ে বেশিও হতে পারেন। এতো মানুষ যাঁর কবিতা পড়ছেন, সে তো এমনি-এমনি নয়;—নিগূঢ় ব্যঞ্জনা ও বোধির সাক্ষাৎ মিলছে দেখে পাঠ করছেন তাঁকে। এমন কোনো সান্ত্বনা হয়তো কাহলিল জিবরান মানুষকে দিতে পেরেছেন, যেটি প্রেমের দিকে, মানবিক বিভূতির দিকে, চিরন্তন মানবিক আভার দিকে মানুষকে ফেরত আসতে বলে।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় এই দ্রবগুণ পাই সচরাচর। নিঃসঙ্গতা ও অসীম অপার্থিবে সমর্পণের আকুলতা সেখানে যদিও স্বস্তি বহায় না মনে। সান্ত্বনা খোঁজার চাপ বরং সকল ছাপিয়ে মনে প্রবল হয়ে দাঁড়ায়। রবি ঠাকুরের নিজেকে সুস্থির রাখার প্রাণান্ত চেষ্টায় নীলকণ্ঠ অনুভব মনে তরঙ্গ দিয়ে যায়। কাহলিল জিবরানের কল্পিত চরিত্র আল-মুস্তাফা কি সেরকম কিছু? বাইবেলের যিশুর মতো তার প্রফেটিক উচ্চারণে মানুষ মনে হয় স্বস্তি ও নিরাময় খুঁজে পায়;—সকল ক্ষত ও গুরভারকে যেটি লঘু ভাবতে তাকে সাহায্যও করে। এর সবটাই আমার অনুমান ও মাঝেমধ্যে দ্য প্রফেট-র দু-চারটি কবিতায় আনমনা চোখ বোলানো ও শ্রবণ থেকে পাওয়া। একে সুতরাং গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো।
ফ্রেডরিখ নিটশের দাজ স্পোক জরাথুস্ট্রও প্রফেটিক স্পিচের আদলে বিরচিত। হাতে নিলে রাখতে মন চায় না। নিটশের উচ্চারণমালা প্রশান্তিদায়ী নয়। অশান্ত গোলযোগ ও খুনি আত্মার চিৎকারে তা আবিল। আবার ধরুন,—বাইবেল কিন্তু পড়তে দারুণ। চার সাহাবির বিবরণে উঠে আসা যিশুর আলাপে দীপ্তি রয়েছে; এবং তাঁর ওই বলিদান,—গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় তখন! যেমন দাঁড়ায়, দস্তয়েভস্কি পাঠের সময়! ঈশ্বরের মতো গরিয়ান এই লোক!
কাহলিল জিবরান হয়তো এসব অভিজ্ঞানকে ধ্যানির মতো আত্মস্থ করে প্রশান্ত হওয়ার উপায় বাতলে গেছেন! যে-কেনো কারণে হোক, তাঁর এই আধ্যাত্মিক সান্ত্বনাগুণে গাঢ় প্রফেটিক স্পিচ আমাকে দখলে নিতে পারেনি। এটি তাঁর নয়, বরং আমি-পাঠকের ভয়ানক সীমাবদ্ধতা মনে করি। তাহলে রুমি বা ইকবাল পড়ছি কেন? রুমির মসনবীকে সাদা সায়েব-মেমরা গোলযোগপূর্ণ জীবনের ছকে শান্তি ও প্রেম-লাভের আশায় ছোট-ছোট প্রবচনে কেটেছেটে নিয়েছেন। মসনবী তা নয়। রুমির প্রেমবচনে স্নিগ্ধ মসনবী হলো একগুচ্ছ গল্পরসে পরিপূর্ণ কবিতার সমষ্টি। যেখানে, মানুষের জন্ম, বিকাশ ও পরিণতির নকশা আঁকতে বসে তিনি কেবল সারসংক্ষেপ টানছেন না, বরং মানুষের রক্তমাংসের জৈবজীবনকে প্রখর অনুভবে ধারণ করছেন। এই অর্থে মসনবী ভীষণ মাত্রায় জৈব ও প্রাণবন্ত কিতাব।
মনিরউদ্দিন ইউসুফের অনুবাদেও যার রস কমে না। যে-কারণে সুফি দর্শন ও শামস তাবরিজের প্রতি তার এশকে প্রচুর নাটকীয় উপাদান ও জীবনজিজ্ঞাসার লহরি উঠতে দেখি। মসনবীকে যা ভিন্নমাত্রায় মোড় নিতে মজবুর রাখে। ইকবাল আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেন খুদি তত্ত্বের পলিটিক্যাল ডিকশনের কারণে। শিকওয়া ও জওয়াব-ই-শিকওয়ার মধ্যে জোশ মারাত্মক। যদিও ব্যক্তিজীবনে ইকবালের মধ্যে খুদির সারবত্তা গভীর নয়।
জাভেদ হুসেন তাঁকে যতভাবে গ্লোরিফাই করুন না কেন, এই ইকবাল অত্যন্ত হাস্যকরভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পারতেন না! তাঁকে বাদ দিয়ে ওই ব্যাটা নোবেল কেমনে পায়,—এই বিস্ময় ছিল মনে! লাহোরে একবার রবীন্দ্রনাথকে সেখানকার সাহিত্যমহল অতিথি করেছিলেন। ঠাকুর কেবল ইকবালের দেখা পাওয়ার আশায় যেচে তাঁর বাড়ি অবধি গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আসছেন শুনে ইকবাল সেদিন শহর ছেড়ে চলে গেলেন! লাহোরের নামকরা লেখকরা লজ্জিত আর বিব্রত হয়েছিলেন তাঁর এই আচরণে। ঘটনাটি নিয়ে উর্দুভাষী লেখকদের অনেকে পরে লিখেছেনও।
উর্দুকে রেখে বাংলা ভাষায় এক কবি নোবেল পেয়েছে;—ইকবালের তা সয়নি! বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাপারে তাঁর ধারণা ছিল তাচ্ছিল্যপূর্ণ ও অতিশয় নিম্নরুচির। একটি জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক গভীরতাকে গভীরভাবে না জেনে রায় দিয়ে বসেছিলেন ইকবাল। অশোভন বটে! ভারতবর্ষে তখন বেঙ্গল ডোমিনেন্স চলছিল রীতিমতো! আমাদের কাছে বাংলার জাগরণ অসম্পূর্ণ বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু সেকালে এর মাহাত্ম্যে ভূবর্ষ মুগ্ধ বোধ করেছে। যৌক্তিক কারণে মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল তখন। একসঙ্গে পরপর সকল দিকে এতো বিচিত্র মাত্রার গুণীর আবির্ভাব বিস্ময়কর ঘটনা!
পাকিস্তান তত্ত্বের পালে হাওয়া ইকবাল দিয়ে গেছেন মারাত্মক! জিন্নার বরোটাও বাজালেন সেইসাথে। সবমিলিয়ে দার্শনিকতায় গভীর খুদির প্রায়োগিক ভাবনায় নিহিত সারবীজ স্বস্তিকর নয় কোনোভাবে। তথাপি, তাঁকে পাঠ অনিবার্য, এবং সেটি সুখপ্রদ।
কাহলিল জিবরানকে সেভাবে না পড়েই বলছি,—তাঁর সঙ্গে হয়তো রবার্ট ফ্রস্টের সাদৃশ্য ও নৈকট্য খোঁজ করলে মিলবে। ফ্রস্ট অবশ্য তাঁর কবিতায় নিখাদ ভাবুক;—প্রশ্নশীল ও দার্শনিক মীমাংসায় নিবিড়। যেখানে, ছোট-ছোট ইমেজে তৈরি করেন রহসময় গভীরতা।
যাকগে, কাহলিল জিবরানের দ্য প্রফেট ও অন্যান্য রচনা হয়তো দেখা যাবে পড়তে শুরু করেছি কোনো একদিন। মানুষ কখন কোনদিকে মোড় ফিরবে তা বলা কঠিন। কে কখন অমোঘ হতে থাকবেন, এই নির্ণয় নয় সহজ! তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এ-কারণে যে,—অস্থির এক শতাব্দীর সন্তান হয়েও মানবসত্তাকে প্রেরণাদায়ক শুভবোধে সুস্থির হওয়ার বার্তা দিয়ে গেছেন। কবিতার এটিও বিশেষ দিক; এবং কবিতা যেহেতু অনেকরকম,—কাহলিল জিবরান আগামীতে পঠিত হতে থাকবেন;—অমলিন থাকবেন অনেকের হৃদয়পটে।
. . .
. . .



